বিদেশীরা মিলেছিল নগ্ন পায়ে প্রভাতফেরিতে
"সত্যিই অবিশ্বাস্য! ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আজকের মানুষের ঢল দেখে বুঝতে পারছি; এ জাতির ভাষা কেড়ে নেয়ার ৰমতা কারও ছিল না। সময়ের বিবর্তনে এ ভালবাসা একটুও বিবর্ণ হয়নি।
ভাষার জন্য বাঙালীর প্রাণদান বিশ্বকে ঋণী করেছে। আজ এটি কেবল কোন দিবস নয়। এটি বিশ্বময় বিভিন্ন জাতির সেতুবন্ধনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।" এটি কোন বাঙালী বা এ দেশের নাগরিকের প্রতিক্রিয়া নয়। অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রবিবার লাখো বাঙালীর নগ্ন পায়ে নামা প্রভাফেরিতে শামিল হওয়া অনেক ভিনদেশীর প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে এসেছে এমন বক্তব্য। একুশের প্রথম প্রহর থেকে রাত জেগে কিংবা ভোর থেকে রাতঅবধি ফুল হাতে খালি পায়ে এ দেশের মানুষের সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাতে হাজারও মিছিলের স্রোতে শামিল হয়েছিলেন তাঁরা। শ্রদ্ধা জানাতে লাখো বাঙালীর এমন মিছিলের স্রোত বিস্ফারিত চোখে অবলোকন করেছেন এসব ভীনদেশী। সময়ের বিবর্তনে ভাষা শহীদদের প্রতি এখনও বাঙালীর এমন হৃদয়নিংড়ানো ভালবাসার বহিপর্্রকাশ দেখে সত্যিই হতবাক হয়ে যান ভাষার টানে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা এসব ভিনদেশী।শুধু কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নগ্ন পায়ে ফুল দিয়ে একুশের ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন নয়, একুশের প্রথম প্রহর থেকে রবিবার রাত অবধি কেউবা দলবেঁধে, আবার কেউ বাঙালী গাইডকে সঙ্গে নিয়ে প্রাণভরে ছুটে বেড়িয়েছেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরম্ন করে টিএসসি পর্যনত্ম। ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি সন্ধানী আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচীতেও অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা দু'যুবক নিজ দেহ থেকে এক ব্যাগ করে রক্তদান করে বাঙালী জাতিকে রক্তঋণে আবদ্ধ করে যান।
বার বার নাম জিজ্ঞাসা করলেও পরিচয় দিতে রাজি হননি ওই দুই যুবক। শুধু নিজ দেশের নাম উচ্চারিত করে ওই দুই যুবকের একটাই প্রতিক্রিয়া, এ দেশের মানুষ একুশের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মহৎ কিছু করতে পারে। আমি দেহ থেক্ এে;ক ব্যাগ রক্ত দিয়েছি গর্বিত এ জাতির জন্য, মাতৃভূমি ও ভাষার জন্য অকাতরে প্রাণপাত করা শহীদদের প্রতি ঋণ পরিশোধের একটি ৰুদ্র প্রচেষ্টা থেকে। নাম-পরিচয় জানালে সেই উদ্দেশ্যে ছেদ পড়বে। আর কিছু দান করে নাম প্রকাশ করাও ঠিক নয়। সুঠাম দেহের ওই দুই ভিনদেশীর এমন সাহসী উচ্চারণে মুগ্ধ হয়ে যান সবাই। রক্ত সংগ্রহকারী চিকিৎসক-শিৰাথর্ীসহ বেশ ক'বাঙালী যুবক-যুবতী হাত মিলিয়ে তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাতে এতটুকু কসুর করেননি।
সকালে শহীদ মিনারে এসে একুশের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন যুক্তরাজ্যের ইসথার লেইক। কিন্তু মানুষের বাঁধভাঙ্গা স্রোত দেখে ভিরমি খাওয়ার দশা হয় তাঁর। টিএসসি থেকে পলাশীর মোড় হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যনত্ম হাজারও মানুষের সারিবেঁধে আসার দৃশ্য, নগ্ন পায়ে হাজার হাজার মানুষের মিছিল-সেস্নাগান, দৃপ্ত পথচলা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকেন দীর্ঘৰণ। সঙ্গে থাকা আরেক স্বদেশীকে নিয়ে তাঁর ঘন ঘন ক্যামেরায় এই অবিশ্বাস্য শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের স্রোতের ছবি তুলতে থাকেন। কানত্মিহীনভাবে ঘুরতে থাকেন পুরো এলাকা। ভাষার জন্য প্রাণপাত করা বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের এমন স্রোত তিনি জীবনেও দেখেননি। এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে শুধু এটুকু মনত্মব্য করেন, "এ চিত্র ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।"
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন পার্শ্ববতর্ী দেশ ভারত থেকে অশীতিপর বৃদ্ধ কিশোর সান্যাল, রাধা সান্যালসহ বেশ ক'জন। এত বয়সেও সামান্য নু্যব্জ হননি কিশোর সান্যাল। বরং শ্রদ্ধা জানাতে নামা মানুষের এমন বাঁধভাঙ্গা স্রোতের সঙ্গে শামিল হতে পেরেই তিনি যেন গর্বিত, পুলকিত। প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া মাত্রই কিশোর সান্যাল ভাষা শহীদদের প্রতি তাঁর গভীর কৃতজ্ঞতার কথা জানাতে ভোলেননি এতটুকু। বলেন, "প্রতিবছর ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে আমরা দলবেঁধে কলকাতার শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি। আজ বাংলাদেশে এসে মূল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পেরে সত্যিই আমি আনন্দিত। যেন আজন্ম লালিত একটি স্বপ্ন আমার পূরণ হলো। এমন বাঁধাভাঙ্গা জোয়ারে প্রমাণিত হলো- বাঙালীর মুখের ভাষা বাংলাকে পৃথিবীতে আর কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। আমরাও বাঙালী, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মতো এমন গৌরব আমাদের নেই।
এশিয়ান ডিজাস্টার সেন্টারে চাকরিসূত্রে বাংলাদেশে থাকেন ব্রিটিশ নাগরিক লেইক। বিডিনিউজকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, "লন্ডনে যখন দেখতাম বাঙালীরা সকালে এ দিবসটি উদযাপন করতে যাচ্ছে, তখন কেমন অস্বাভাবিক মনে হতো। এখন তাদের সেই সাংস্কৃতিক শক্তির উৎস বুঝতে পারছি। এ শক্তির কারণেই একদিন বাংলা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার মর্যাদা পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।"
যুক্তরাষ্ট্রের কালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা বেট্টি বারি চাকরি করেন ঢাকার আইসিডিডিআরবিতে। স্বামীসহ থাকেন এদেশে। নগ্ন পায়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসেন তিনি। ওই সংস্থার কাছে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, "ভাষার জন্য বাঙালীর প্রাণদান বিশ্বকে ঋণী করেছে। আজ এটি কেবল কোন দিবস নয়। এটি বিশ্বময় বিভিন্ন জাতির সেতুবন্ধনের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। "অস্ট্রেলিয়ার লিয়া বিডিনিউজকে বলেন, গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভাষা আন্দোলনের এ ঘটনা ঘটেছে। অথচ সেটি আজও মানুষকে এত প্রেরণা দিতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। সময়ের বিবর্তনে এ ভালবাসা একটুও বিবর্ণ হয়নি।"
No comments