ওয়াশিংটনে ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ফ্যামিলির পিঠা উৎসব- হারুণ চৌধুরী, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে
প্রবাদ আছে মাঘের শীত বাঘের গায়ে। শীত এলেই বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন আর পবার্ণের উৎসব লাগে। গোলা ভরা ধান দেখে কৃষকের মনে একবুক ভরা আনন্দ জাগে।
এক সময় ছিল মামাবাড়িতে শিশু-কিশোরদের যাওয়ার ও শীতের পিঠা খাবার নিমন্ত্রণের ধুম। বর্তমানে সেই যুগ কি আছে? সবাই এখন ব্যস্ত নিজেদের নিয়ে। তারপরও গ্রামে-গঞ্জে পিঠার গন্ধ পাওয়া যায়। সেই মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে গেলে ভোরবেলা খেজুরের রস মাটির ঠিলস্নায় (গ্রাম্য ভাষায়) গাছি পাড়ায় পাড়ায় রস বিক্রি করে। সেই রস দিয়ে পিঠা তৈরি হয়। হাতে বানানো সেমাই, কলুই পিঠা, বিবি খানা পিঠা তাছাড়া রয়েছে ভাঁফা পিঠা, ফুল পিঠা, মেড়া পিঠা, বনফুল, মালাই পিঠা, গন্ধরাজ, পাটিশাপটা, দুধকারি, খিড় আরও কত বাহারের নাম। শীতে নতুন জামাইকে বিভিন্ন ধরনের পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।এসব শীতের পিঠা থেকে প্রবাসী বাঙালীরাও বাদ যায় না। শুধু আমাদের নুতন প্রজন্মকে এসব শীতের পিঠার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য এই প্রবাসে কিছুসংখ্যক সাংস্কৃতিকপ্রেমী প্রতিবছরই অতি ব্যসত্মতার মাঝেও শীতের পিঠা উৎসবের আয়োজন করে থাকে।
সম্প্রতি এই ওয়াশিংটন ডিসির বুকেই হয়ে গেল ফ্রেন্সস এন্ড ফ্যামিলির উদ্যোগে ভার্জিনিয়ার আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত এভাজ এলিমেন্টরি স্কুলের অডিটরিয়ামে রমরমা পিঠা উৎসব। অডিটরিয়ামে স্থান সংকুলানের অভাবে কানায় কানায় হলভর্তি দর্শকের উপস্থিতি দেখে সিকিউরিটির লোকেরা রাত ৮টার মধ্যে গেট বন্ধ করে দেয়। দূর-দূরানত্ম থেকে আসা প্রায় তিন শ' দর্শককে এই কন কনে শীতের রাতে ঠাঁয় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। উদ্যোক্তাদের কিছুই করার ছিল না। তারাও অসহায়ত্ব বোধ করে। এ দেশে আইন মেনে চলতে হয় নচেত ফায়ার মার্শাল চলে এলে আরও বিপদ হবে। নিরাপত্তাজনিত কারণে ওরা কোন কিছুর পরোয়ানা করে অনেক সময় অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। জানা যায়, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া থেকে ৭৫ মাইল গাড়ি ড্রাইভ করে এসেও অনেকে পিঠা উৎসবে প্রবেশ করতে পারেনি। পিঠা উৎসবের প্রধান উদ্যোক্তা আবু মোঃ রম্নমী দুঃখ প্রকাশ করে জানান, যারা পিঠা উৎসব দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের ৰমা-সুন্দর চোখে দেখবেন বলে অনুরোধ করেন।
নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মাননীয় রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের পিঠা উৎসবের উদ্বোধন করেন। প্রায় ৩৫টি স্টল পিঠার বাহারি নিয়ে বসেছিল। বিভিন্ন ধরনের পিঠার আয়োজন ছিল। গৃহিণীরা রাত জেগে পিঠা তৈরি করেছেন। বিক্রিও হয়েছে ভাল। আবার পিঠা খাবার ধুম লেগেছিল সেই রাতে। অনেক স্টলে সারাৰণ ভিড় গেলেই ছিল। যারা কষ্ট করে পিঠা তৈরি করে এনে ছিলেন ভাল বিক্রি হওয়াতে গৃহিণীদের ও কিশোরীদের চোখে মুখে ছিল আনন্দের ছাপ। নোয়াখালীর পিঠা ঘর প্রথম স্থান অধিকার করে সোনার চেইন জিতে নেয়। চা আর ঝালমুড়ি দেদার বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ত্রীরাও পিঠা উৎসবে অংশ গ্রহণ করে। তাদের স্টলটাও ছিল গ্রামবাংলার কারম্নশিল্পে ভরা। বিক্রিও ছিল ভাল।
মাননীয় রাষ্ট্রদূত প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, শীতকাল। শীতের পিঠা খাবার লোভ সামলাতে পারিনি। এটা আমাদের ঐতিহ্য। সংস্কৃতির অঙ্গ। নুতন প্রজন্ম দেশের শেকড়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে এসব কর্মকা- দেখে। একদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে অন্যদিকে পিঠার স্টলে মানুষের ভিড় জমে। অনুষ্ঠান ঘোষণায় ছিলেন বাংলাদেশের টিভি ব্যক্তিত্ব, অভিনেত্রী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিৰক রাশেদা রওনক খান। তার প্রাণবনত্ম উপস্থাপনা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। কচি শিশুরা নৃত্য পরিবেশন করে। চতুরঙ্গ অনুষ্ঠানে দর্শকদের কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এক ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। চতুরঙ্গ অনুষ্ঠানটি পরিচালনায় ছিলেন প্রতিবেদক নিজে। তাকে সহযোগিতা করে উপস্থাপিকা রওনক। গান পরিবেশন করে স্থানীয় শিল্পীরা। বাল্টিমোরে বাসরত সাহিন ও রম্নবীর গান পরিবেশন ছিল চমৎকার। বেবী নাজনীনের বোন নিউজার্সি থেকে আসা লিপি সাবরিনা গান গেয়ে স্টেজে দর্শকদের মাতিয়ে তোলে। রাত তখন ১০টা বাজে। তখনও হলভর্তি দর্শক কোজআপ ওয়ানের রম্নমীর নাম শোনার জন্য দর্শকরা বসে আছেন। সামনের সারিতে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা গান গাইতে গাইতে রম্নমী এল স্টেজে। তার পরিচিত গান গাইলেন। দর্শক মাতালেন। র্যাফেল ড্র'তে ছিল নামিদামি পুরস্কার। আক্তার হোসেন ও ইনাম হক উদ্যোক্তাদের মধ্যে রাফেল ড্র সহযোগিতা করে সঙ্গে ছিলেন রওনক, শিশির, তবলায় আশীষ বড়ুয়া ও প্রানত্মিক। সবাই ভাল বাজিয়েছেন। এরপর দূতাবাস থেকে বানানো পিঠা, মাছ, জাতীয় পতাকা, নোয়াখালীর পিঠা, ঘরের তৈরি পিঠা, বাংলাদেশের মানচিত্র, ইলিশ মাছ নিলামে এক শ' ডলার করে দর্শকদের অংশ গ্রহণের মধ্যে দিয়ে বিক্রি করা হয় চড়া দামে। এই পিঠা উৎসবের মিডিয়া পার্টনার ছিল চ্যানেল আই। রম্নমী ভাই, আফরাফুল হক খোকনসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
শীতের রাতে সবাই বাংলার পিঠার স্বাদ নিয়ে ঘরে ফিরে গেলেন। আগামীতে আবার পিঠা উৎসব হবে এই প্রত্যাশায়।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments