প্রতারণার দায়ে ফার্মা জায়ান্টকে জরিমানা by ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ
প্রতারণার দায়ে আগে কোনো ওষুধ কম্পানিকে এত বড় অঙ্কের জরিমানা করার নজির ইতিহাসে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ যুক্তরাজ্যের ফার্মা জায়ান্ট গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনকে ওষুধের বেআইনি ও অনৈতিক প্রচারের জন্য ২৪ হাজার কোটি টাকা জরিমানা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ম হলো, খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) কোনো ওষুধের লাইসেন্স দিলে শুধু চিকিৎসকরা তাঁদের যুক্তিসংগত বিচার-বিবেচনায় ওষুধের লেবেলে বর্ণিত তথ্য, নির্দেশ বা প্রয়োগবিধি-বহির্ভূতভাবে অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রেও একই ওষুধ প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু ওষুধ কম্পানি যে নির্দিষ্ট রোগে ব্যবহারের জন্য ওষুধের লাইসেন্স পেয়ে থাকে, এর বাইরে অন্য কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য ওই ওষুধ উৎপাদন, বাজারজাত ও প্রচার করতে পারে না। একই ধরনের প্রতারণার জন্য ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওষুধ কম্পানি ফাইজারকে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ চারটি ওষুধের বেআইনি ও অনৈতিক প্রচারের জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকা (২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার) জরিমানা করেছিল। ব্যথানিবারক বেকস্ট্রা (জেনেরিক : ভালডেকক্সিব), মানসিক রোগের ওষুধ জিওডন (জেনেরিক : জিপ্রাসিডন), অ্যান্টিবায়োটিক জাইভক্স (জেনেরিক : লিনেজোলিড) এবং মৃগীরোগের ওষুধ লিরিকার (জেনেরিক : প্রেগাবেলিন) বেআইনি প্রচারের জন্য ফাইজারকে এই জরিমানা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ বলেছে, গ্ল্যাক্সো তাদের ওষুধ প্যাক্সিল, ওয়েলবুট্রিন, অ্যাজমার ওষুধ অ্যাডভেইর এবং অন্য দুটি অখ্যাত ওষুধের বেআইনি প্রমোশনের কথা স্বীকার করেছে এবং এ অপরাধের জন্য আদালত কর্তৃক নির্ধারিত জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয়েছে। ২০০৭ সালে ডায়বেটিসের ওষুধ অ্যাভেন্ডিয়ার (জেনেরিক : রসিগ্লিটাজোন) কনজেস্টিভ হার্ট ফেইলিওর ও স্ট্রোকের ঝুঁকি মারাত্মক বাড়ায় বলে প্রমাণিত হওয়ায় যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রে এর ব্যবহার সীমাবদ্ধ করা হয়।
গ্ল্যাক্সো সাত বছর ধরে সরকারকে ওষুধটির নিরাপত্তাজনিত তথ্যাবলি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ার দোষও স্বীকার করে নিয়েছে। অন্যদিকে সরকার কর্তৃক পরিচালিত ওষুধ সাহায্য কার্যক্রমে ওষুধের দাম বেশি রাখার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয় গ্ল্যাক্সো। এ ছাড়া অ্যাজমার ওষুধ ফ্লোভেট এবং যৌন সংসর্গের দ্বারা সংক্রমিত ভাইরাসঘটিত রোগের ওষুধ ভালট্রেক্স ব্যবস্থাপত্রে লেখার সম্মানী বাবদ চিকিৎসকদের গ্ল্যাক্সোর অর্থ দেওয়ার কথা প্রমাণিত হয়।
বিশ্বের ফার্মা জায়ান্টদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। অতীতে অনেক কম্পানি প্রতারণা ও দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত হয়ে কোটি কোটি টাকা জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। মার্ক যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম ওষুধ কম্পানি। ১৯৯৯ সালে মার্ক কম্পানি ব্যথা-বেদনা, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও প্রদাহের ওষুধ ভায়োক্স (জেনেরিক : রফেকক্সিব) বাজারজাত করে। বাজারজাত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চিকিৎসকরা দেখতে পান, ভায়োক্স গ্রহণের ফলে অসংখ্য রোগী হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। মার্ককে ব্যাপারটি বারবার অবহিত করার পরও রোগী ও চিকিৎসকের কোনো অভিযোগই আমলে নেয়নি কম্পানিটি; বরং মার্ক বারবার বলে আসছিল তাদের ওষুধ ভায়োক্স সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। চার বছর পর ভায়োক্সের কারণে সারা বিশ্বে হাজার হাজার মানুষ হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ ও মৃত্যুবরণ করার কারণে ২০০৪ সালে মার্ক ওষুধটি বাজার থেকে তুলে নেয়। ইতিমধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মার্ক কম্পানির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী রোগী ও মৃত আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে ২৭ হাজার মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মার্ক ভুক্তভোগীদের ৩৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মাধ্যমে আপসরফা করে। বাজারজাত করা থেকে শুরু করে প্রত্যাহার করে নেওয়া পর্যন্ত আট কোটি লোক ওষুধটি সেবন করেছিল। এর মধ্যে কত লোক মৃত্যুবরণ করেছে, আর কত লোক রোগাক্রান্ত হয়েছে, তার পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওষুধ কম্পানিগুলোর অপকর্ম সম্পর্কে অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে উঠেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে অনেক কম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। গ্ল্যাক্সো কম্পানিকে জরিমানা করেই ক্ষান্ত হয়নি সরকার, আগামী পাঁচ বছর সরকার কম্পানিকে সূক্ষ্ম নজরদারিতে রাখবে, যাতে তারা আইন ও নিয়ম-বহির্ভূর্ত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না পারে।
২০০৩ সালে গ্ল্যাক্সোর বিক্রয় প্রতিনিধি গ্রেগ থর্প ও ব্লেয়ার হ্যামরিক মামলাটি প্রথমে আদালতে নিয়ে যান। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই মামলায় জড়িত হয়। মামলার প্রসিকিউটর বলেন, ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত গ্ল্যাক্সো শিশুদের বিষাদগ্রস্ততার (Depression) ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য বেআইনিভাবে প্যাক্সিল প্রমোট করে আসছিল। যদিও এফডিএ ১৮ বছরের কম বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এ ওষুধ ব্যবহারের কোনো অনুমতি দেয়নি। এ ছাড়া গ্ল্যাক্সো ওজন কমানোর জন্য, যৌন অক্ষমতার ক্ষেত্রে, মাদকাসক্তি ও অমনোযোগী অতিক্রিয়াশীলতার সমস্যায় ব্যবহার করার জন্য ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ওয়েলবুট্রিন প্রমোট করেছিল, যার জন্য কম্পানিটির কোনো অনুমতি ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ওষুধ কম্পানিগুলোর ওপর কত বেশি ক্ষিপ্ত ও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ মেলে আরেকটি মামলা থেকে। মামলাটি হয়েছিল অ্যাবোট কম্পানির বিরুদ্ধে। এ মামলার কারণে অ্যাবোটকে জরিমানা হিসেবে সরকারকে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দিতে হয়েছিল। অপরাধটি ফাইজার ও গ্ল্যাক্সোর মতো একই ধরনের। ডেপাকোট বাইপোলার ডিস-অর্ডার ও মৃগীরোগের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত একটি ওষুধ। কিন্তু অ্যাবোট ওষুধটি ডিমেনশিয়া (স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া) ও অটিজমের (এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিজেদের গুটিয়ে রাখে এবং অস্বাভাবিক আচরণ করে) ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য বেআইনিভাবে প্রমোট করে। জরিমানা ছাড়াও অ্যাবোটকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ঠুকে দেওয়া মামলায় আপসরফার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করতে হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা।
বিশ্বের সর্বত্র ছোটবড় সব ওষুধ কম্পানিই তাদের উৎপাদিত ওষুধের অনৈতিক প্রচারে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। এর মধ্যে কিছু শীর্ষস্থানীয় কম্পানি তাদের ওষুধ প্রচারে অত্যন্ত আগ্রাসী নীতি অবলম্বন করে থাকে। এ ধরনের আগ্রাসী তৎপরতা চালানোর তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে ফাইজার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওষুধ কম্পানি হওয়া সত্ত্বেও তাদের দুর্নীতি ও অপকর্মের শেষ নেই। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালে ১৩টি ওষুধের 'অফ লেবেল' প্রচারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই কম্পানিকে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল। ১৩টি ওষুধের মধ্যে রয়েছে দুটি স্বনামধন্য ও ব্লকব্লাস্টার ওষুধ। এ দুটি ওষুধ হলো ভায়াগ্রা (যৌন অক্ষমতা দূর করার ওষুধ) ও লিপিটর (কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ)। বিক্রির দিক থেকে লিপিটর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ। বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১২ থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার। ফাইজারের এ দুটি ওষুধের বিশাল বিক্রির পরিমাণ শুধু তাদের কার্যকারিতার জন্য নয়, এর পেছনে অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডও জড়িত। লিপিটর ও ভায়াগ্রা বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চিকিৎসকদের এ দুটি ওষুধ বেশি করে প্রেসক্রাইব করার জন্য উদ্বুদ্ধ করার দোষে অভিযুক্ত হয়েছিল ফাইজার। ওষুধ দুটি প্রেসক্রাইব করার জন্য ফাইজার অনৈতিকভাবে চিকিৎসকদের ফ্রি গলফ, অঙ্গ-মালিশ, আনন্দফুর্তি, বনভোজন ও বিলাসবহুল বিনোদনকেন্দ্রে রাত্রিযাপনের সুযোগ দিয়েছিল।
আমি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে সাধুবাদ জানাই। বিচার বিভাগ ও এফডিএর কঠোর ভূমিকার কারণে অসাধু কম্পানিগুলোর মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে। আমরাও জানতে পারছি, এসব বহুজাতিক ফার্মা জায়ান্ট দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে কিভাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে ঠকিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুটে নিচ্ছে। এই দুনিয়ায় এখনো বহু সাহসী ও ভালো মানুষ রয়েছেন। ফাইজারের ক্যাপচিনস্কি, গ্ল্যাক্সোর গ্রেগ থর্প ও ব্লেয়ার হ্যামরিক- এ ধরনের কয়েকজন সাহসী ও ভালো মানুষ। তাঁরা পেশায় নিষ্ঠাবান, অনমনীয়, বলিষ্ঠ ও অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁদের সততা ও সাহসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ফাইজার, অ্যাবোট ও গ্ল্যাক্সোর মতো ফার্মা জায়ান্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারল। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ফেডারেল তদন্ত কমিটির মতে, কম্পানিগুলো ওষুধের লেবেলে নির্দেশিত বিধিবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে ওষুধ বাজারজাত ও প্রমোশন করে নরহত্যার শামিল অপরাধ করে যাচ্ছে। ওষুধ কম্পানিগুলো রোগীর স্বার্থ আমলে নেয় না। তাদের টার্গেট জীবনের বিনিময়ে হলেও মুনাফা অর্জন। এই রক্তচোষা মুনাফা অর্জনের জন্য ওষুধ কম্পানিগুলোর সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ ও অসংখ্য চিকিৎসক। মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ ও চিকিৎসকরা একটুও ভাবেন না, তাঁদের দুর্নীতি ও প্রতারণার কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার শিকার হচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি, মার্ক কম্পানির একগুঁয়েমির কারণে, জীবনের আগে মুনাফাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে রফেকক্সিব সেবন করে সারা বিশ্বে কিভাবে লাখ লাখ মানুষ স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে। ফাইজার একটিমাত্র ওষুধ (লিপিটর) বিক্রি করে বছরে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে, বাংলাদেশের সব ওষুধ কম্পানির মোট ওষুধ বিক্রির পরিমাণ তার সমান নয়। প্রিয় পাঠক, ফাইজারের উৎপাদিত সব ওষুধের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণটা একটু হিসাব করতে চেষ্টা করুন। অঙ্কটা আমার জানা নেই। তবে এটুকু বুঝি, তা শুধু বিশাল নয়, অতি বিশাল, যা আমাদের ধারণাতীত। এর পরও এসব কম্পানি দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে অসুস্থ ও মৃতপ্রায় রোগীদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে আমি এর মনস্তাত্ত্বিক কারণ বুঝে উঠতে পারি না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এর কারণ হয়তো আর কেউই কোনো সময় বুঝে উঠতে পারবে না।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপ-উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
গ্ল্যাক্সো সাত বছর ধরে সরকারকে ওষুধটির নিরাপত্তাজনিত তথ্যাবলি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ার দোষও স্বীকার করে নিয়েছে। অন্যদিকে সরকার কর্তৃক পরিচালিত ওষুধ সাহায্য কার্যক্রমে ওষুধের দাম বেশি রাখার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হয় গ্ল্যাক্সো। এ ছাড়া অ্যাজমার ওষুধ ফ্লোভেট এবং যৌন সংসর্গের দ্বারা সংক্রমিত ভাইরাসঘটিত রোগের ওষুধ ভালট্রেক্স ব্যবস্থাপত্রে লেখার সম্মানী বাবদ চিকিৎসকদের গ্ল্যাক্সোর অর্থ দেওয়ার কথা প্রমাণিত হয়।
বিশ্বের ফার্মা জায়ান্টদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। অতীতে অনেক কম্পানি প্রতারণা ও দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত হয়ে কোটি কোটি টাকা জরিমানা ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। মার্ক যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম ওষুধ কম্পানি। ১৯৯৯ সালে মার্ক কম্পানি ব্যথা-বেদনা, অস্টিওআর্থ্রাইটিস ও প্রদাহের ওষুধ ভায়োক্স (জেনেরিক : রফেকক্সিব) বাজারজাত করে। বাজারজাত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই চিকিৎসকরা দেখতে পান, ভায়োক্স গ্রহণের ফলে অসংখ্য রোগী হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। মার্ককে ব্যাপারটি বারবার অবহিত করার পরও রোগী ও চিকিৎসকের কোনো অভিযোগই আমলে নেয়নি কম্পানিটি; বরং মার্ক বারবার বলে আসছিল তাদের ওষুধ ভায়োক্স সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে। চার বছর পর ভায়োক্সের কারণে সারা বিশ্বে হাজার হাজার মানুষ হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ ও মৃত্যুবরণ করার কারণে ২০০৪ সালে মার্ক ওষুধটি বাজার থেকে তুলে নেয়। ইতিমধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মার্ক কম্পানির বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী রোগী ও মৃত আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে ২৭ হাজার মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত মার্ক ভুক্তভোগীদের ৩৫ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার মাধ্যমে আপসরফা করে। বাজারজাত করা থেকে শুরু করে প্রত্যাহার করে নেওয়া পর্যন্ত আট কোটি লোক ওষুধটি সেবন করেছিল। এর মধ্যে কত লোক মৃত্যুবরণ করেছে, আর কত লোক রোগাক্রান্ত হয়েছে, তার পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওষুধ কম্পানিগুলোর অপকর্ম সম্পর্কে অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে উঠেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে অনেক কম্পানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। গ্ল্যাক্সো কম্পানিকে জরিমানা করেই ক্ষান্ত হয়নি সরকার, আগামী পাঁচ বছর সরকার কম্পানিকে সূক্ষ্ম নজরদারিতে রাখবে, যাতে তারা আইন ও নিয়ম-বহির্ভূর্ত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না পারে।
২০০৩ সালে গ্ল্যাক্সোর বিক্রয় প্রতিনিধি গ্রেগ থর্প ও ব্লেয়ার হ্যামরিক মামলাটি প্রথমে আদালতে নিয়ে যান। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ওই মামলায় জড়িত হয়। মামলার প্রসিকিউটর বলেন, ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত গ্ল্যাক্সো শিশুদের বিষাদগ্রস্ততার (Depression) ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য বেআইনিভাবে প্যাক্সিল প্রমোট করে আসছিল। যদিও এফডিএ ১৮ বছরের কম বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে এ ওষুধ ব্যবহারের কোনো অনুমতি দেয়নি। এ ছাড়া গ্ল্যাক্সো ওজন কমানোর জন্য, যৌন অক্ষমতার ক্ষেত্রে, মাদকাসক্তি ও অমনোযোগী অতিক্রিয়াশীলতার সমস্যায় ব্যবহার করার জন্য ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ওয়েলবুট্রিন প্রমোট করেছিল, যার জন্য কম্পানিটির কোনো অনুমতি ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ওষুধ কম্পানিগুলোর ওপর কত বেশি ক্ষিপ্ত ও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে, তার প্রমাণ মেলে আরেকটি মামলা থেকে। মামলাটি হয়েছিল অ্যাবোট কম্পানির বিরুদ্ধে। এ মামলার কারণে অ্যাবোটকে জরিমানা হিসেবে সরকারকে পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দিতে হয়েছিল। অপরাধটি ফাইজার ও গ্ল্যাক্সোর মতো একই ধরনের। ডেপাকোট বাইপোলার ডিস-অর্ডার ও মৃগীরোগের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত একটি ওষুধ। কিন্তু অ্যাবোট ওষুধটি ডিমেনশিয়া (স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া) ও অটিজমের (এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা অস্বাভাবিকভাবে নিজেদের গুটিয়ে রাখে এবং অস্বাভাবিক আচরণ করে) ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য বেআইনিভাবে প্রমোট করে। জরিমানা ছাড়াও অ্যাবোটকে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ঠুকে দেওয়া মামলায় আপসরফার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করতে হয়েছে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা।
বিশ্বের সর্বত্র ছোটবড় সব ওষুধ কম্পানিই তাদের উৎপাদিত ওষুধের অনৈতিক প্রচারে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে। এর মধ্যে কিছু শীর্ষস্থানীয় কম্পানি তাদের ওষুধ প্রচারে অত্যন্ত আগ্রাসী নীতি অবলম্বন করে থাকে। এ ধরনের আগ্রাসী তৎপরতা চালানোর তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে ফাইজার। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওষুধ কম্পানি হওয়া সত্ত্বেও তাদের দুর্নীতি ও অপকর্মের শেষ নেই। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালে ১৩টি ওষুধের 'অফ লেবেল' প্রচারের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওই কম্পানিকে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল। ১৩টি ওষুধের মধ্যে রয়েছে দুটি স্বনামধন্য ও ব্লকব্লাস্টার ওষুধ। এ দুটি ওষুধ হলো ভায়াগ্রা (যৌন অক্ষমতা দূর করার ওষুধ) ও লিপিটর (কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ)। বিক্রির দিক থেকে লিপিটর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ। বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১২ থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার। ফাইজারের এ দুটি ওষুধের বিশাল বিক্রির পরিমাণ শুধু তাদের কার্যকারিতার জন্য নয়, এর পেছনে অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডও জড়িত। লিপিটর ও ভায়াগ্রা বিক্রি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চিকিৎসকদের এ দুটি ওষুধ বেশি করে প্রেসক্রাইব করার জন্য উদ্বুদ্ধ করার দোষে অভিযুক্ত হয়েছিল ফাইজার। ওষুধ দুটি প্রেসক্রাইব করার জন্য ফাইজার অনৈতিকভাবে চিকিৎসকদের ফ্রি গলফ, অঙ্গ-মালিশ, আনন্দফুর্তি, বনভোজন ও বিলাসবহুল বিনোদনকেন্দ্রে রাত্রিযাপনের সুযোগ দিয়েছিল।
আমি যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগকে সাধুবাদ জানাই। বিচার বিভাগ ও এফডিএর কঠোর ভূমিকার কারণে অসাধু কম্পানিগুলোর মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে। আমরাও জানতে পারছি, এসব বহুজাতিক ফার্মা জায়ান্ট দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে কিভাবে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে ঠকিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লুটে নিচ্ছে। এই দুনিয়ায় এখনো বহু সাহসী ও ভালো মানুষ রয়েছেন। ফাইজারের ক্যাপচিনস্কি, গ্ল্যাক্সোর গ্রেগ থর্প ও ব্লেয়ার হ্যামরিক- এ ধরনের কয়েকজন সাহসী ও ভালো মানুষ। তাঁরা পেশায় নিষ্ঠাবান, অনমনীয়, বলিষ্ঠ ও অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁদের সততা ও সাহসের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ ফাইজার, অ্যাবোট ও গ্ল্যাক্সোর মতো ফার্মা জায়ান্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারল। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ফেডারেল তদন্ত কমিটির মতে, কম্পানিগুলো ওষুধের লেবেলে নির্দেশিত বিধিবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে ওষুধ বাজারজাত ও প্রমোশন করে নরহত্যার শামিল অপরাধ করে যাচ্ছে। ওষুধ কম্পানিগুলো রোগীর স্বার্থ আমলে নেয় না। তাদের টার্গেট জীবনের বিনিময়ে হলেও মুনাফা অর্জন। এই রক্তচোষা মুনাফা অর্জনের জন্য ওষুধ কম্পানিগুলোর সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করে মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ ও অসংখ্য চিকিৎসক। মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ ও চিকিৎসকরা একটুও ভাবেন না, তাঁদের দুর্নীতি ও প্রতারণার কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার শিকার হচ্ছে। আগেই উল্লেখ করেছি, মার্ক কম্পানির একগুঁয়েমির কারণে, জীবনের আগে মুনাফাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে রফেকক্সিব সেবন করে সারা বিশ্বে কিভাবে লাখ লাখ মানুষ স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়েছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে। ফাইজার একটিমাত্র ওষুধ (লিপিটর) বিক্রি করে বছরে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে, বাংলাদেশের সব ওষুধ কম্পানির মোট ওষুধ বিক্রির পরিমাণ তার সমান নয়। প্রিয় পাঠক, ফাইজারের উৎপাদিত সব ওষুধের বার্ষিক বিক্রির পরিমাণটা একটু হিসাব করতে চেষ্টা করুন। অঙ্কটা আমার জানা নেই। তবে এটুকু বুঝি, তা শুধু বিশাল নয়, অতি বিশাল, যা আমাদের ধারণাতীত। এর পরও এসব কম্পানি দুর্নীতি ও প্রতারণার মাধ্যমে অসুস্থ ও মৃতপ্রায় রোগীদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে আমি এর মনস্তাত্ত্বিক কারণ বুঝে উঠতে পারি না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এর কারণ হয়তো আর কেউই কোনো সময় বুঝে উঠতে পারবে না।
লেখক : অধ্যাপক, ফার্মাসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপ-উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
No comments