মুক্তিযোদ্ধা সম্মিলন-বাম প্রগতিশীল ঐক্যের তাগিদ by পঙ্কজ ভট্টাচার্য
গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের এই বিপদ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো জরুরি জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলকে দৃঢ়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুসরণ করতে হবে, দলীয় ঐক্য, অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতার পথে এ দলকে অগ্রসর হতে হবে
মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনক বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ছয় দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে জাতি তখন ঐক্যবদ্ধ বঙ্গবল্পুব্দর অনুপস্থিতিতে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের অধীনে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলে ঐতিহাসিক অবদান রাখে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে। অন্যতম ইতিহাস নির্মাতা সেসব সহযোদ্ধাকে আমরা ভুলি কেমন করে? ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থান সত্ত্বেও যারা প্রগতির ধারাটি বহন করে চলেছেন, তাদের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন ও অভিবাদন জানাতে ঢাকায় আয়োজিত হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা সম্মিলন। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যৌথ গেরিলা পরিবারের প্রীতি সম্মেলন যেসব কারণে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে তা হলো_
১. এ দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উপাদানগুলো ধারণ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত জনযুদ্ধের চেহারা অর্জন করেছিল, যার অন্যতম শরিক ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী। এ ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্যটি ইতিহাস রচনার জন্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি ইতিহাস বিকৃতি রোধে এ সত্যটি তুলে ধরা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
২. বাংলাদেশের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ভূমিকা ও অবদান বিলম্বে হলেও স্বীকৃতি আদায়, গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মরণোত্তর এবং জীবিতাবস্থায় সম্মান ও মর্যাদা অর্জনের স্বার্থে, মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার ন্যায্য দাবিতে এ সমাবেশ জরুরি হয়ে উঠেছে।
বিরাজমান আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক যে প্রেক্ষিতে এই মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা অনেক চ্যালেঞ্জ হাজির করেছে। যার মধ্যে রয়েছে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতিসহ জনদুর্ভোগ, শেয়ারবাজারের মহালুণ্ঠনের ঘটনা এবং দুর্নীতি_ এসব ক্ষেত্রে দেশবাসী যত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তার চেয়ে কম উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ নয় মৌলবাদী, উগ্রসাম্প্রদায়িক, জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রযন্ত্র দখলের নগ্ন আগ্রাসন-হুমকি ও হুঙ্কারে। এই বিপদের বীজ রোপিত হয় '৭৫-এর দুঃখজনক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে; স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রদ্রোহীরা রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অশুভ শক্তি পাকিস্তানি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠাকল্পে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিমুহূর্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারছে_ এরা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, শিক্ষার গণমুখী সংস্কার, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রভৃতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে। তারা সংবিধান-বিরুদ্ধ ক্ষমতা দখলের একটি নগ্ন মহড়া দিয়েছে গত ৪ এপ্রিল। জাতির জন্য এ ঘটনা নবতর অশনি সংকেত। যেখানে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র তথা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি হুমকিদাতা এ অশুভ শক্তির প্রতি প্রশাসনের নমনীয় নীতি অনুসরণ, সরকারের দ্বিধাগ্রস্ততা, '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের ক্ষেত্রে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্নে সরকারি দলের মধ্যকার মতভিন্নতা প্রভৃতি যুদ্ধাপরাধী বিচারের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া গণদুর্ভোগ মোচনে দুর্নীতি দমনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ় পদক্ষেপের অভাবের কারণে জনমনে সৃষ্ট অসন্তোষের সুযোগ নিতে সদাব্যস্ত এই যুদ্ধাপরাধী চক্রের পরিবারটি।
গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের এই বিপদ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো জরুরি জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলকে দৃঢ়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুসরণ করতে হবে, দলীয় ঐক্য, অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতার পথে এ দলকে অগ্রসর হতে হবে, অন্যথায় যুদ্ধাপরাধীর নেতৃত্বে পূর্বতন চারদলীয় জোট আগামীতে ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ সহজেই পেতে পারে।
জাতীয় জীবনের এই সন্ধিক্ষণ মুহূর্তে বাম প্রগতিশীল শক্তি যারা স্বাধীনতা-পূর্বকালে গণতন্ত্র অর্জনে ও মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, সেই উল্লেখযোগ্য শক্তিটি আজ বহুধাবিভক্ত ও শক্তিহীন। অতীতের মতো গৌরবজনক ও নীতিনিষ্ঠ ভূমিকা পালনে এই পরিবারের অনুসারীদের আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। তারা বর্তমান নাজুক জাতীয় পরিস্থিতিতে উপরোক্ত শক্তির ঘনিষ্ঠ মেরুকরণ ও ঐক্য দেখতে আগ্রহী।
ওই যৌথ গেরিলা বাহিনীর অনুসারী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলাই হবে আজকের জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সঠিক কর্মপন্থা। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে নীতিনিষ্ঠ দেশপ্রেমের চেতনায় জাগ্রত ও উত্থিত করার কঠিন কর্তব্য পালন করতে হবে।
ওই মেরুকরণ বা ঐক্য ফ্রন্টের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত; যুদ্ধাপরাধীনির্ভর জামায়াত-আশ্রিত বিএনপি তথা যুদ্ধাপরাধী সমর্থিত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার বিপদ থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করা। এই যুদ্ধাপরাধীদের মদদদাতারা মুক্তিযুদ্ধের দেশে বিরোধী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করুক তা-ও কারও কাম্য হতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হলে যুদ্ধাপরাধী আশ্রিত সরকার ক্ষমতাসীন হোক, কোনো মুক্তিযোদ্ধা তা মেনে নিতে পারেন না। এ জন্য বিএনপি নেতৃত্বকে বিরাজমান ঝুঁকিপূর্ণ গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এবং মুক্তিযুদ্ধকে নিরাপদ করতে আহ্বান জানাই, যুদ্ধাপরাধী-সংশ্লিষ্ট জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করুন; জামায়াতবান্ধব না হয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রবান্ধব হোন।
অতীতের গৌরবজনক ভূমিকার অধিকারী ওই যৌথ গেরিলা পরিবারের বাম গণতান্ত্রিক শক্তির পুনরায় ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্টে পরিণত করে সম্পাদন করতে হবে নিম্নোক্ত জাতীয় কর্তব্য :
১. গণসচেতনতা ও গণজাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচার; ২. দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান কশাঘাত থেকে দরিদ্রসহ জনসাধারণের রক্ষার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যায্যমূল্যের দোকান চালুর মাধ্যমে সরকারি গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু করা; ৩. মেহনতি ক্ষেতমজুর, শ্রমিকসহ গরিব মানুষের জন্য রেশনিং চালু, গার্মেন্ট শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও অধিকার, ক্ষেতমজুরের ন্যায্য মজুরি, কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি এবং কৃষি উপকরণ সুলভ মূল্যে পাওয়ার নিশ্চয়তা; ৪. জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি কার্যকর করা এবং শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জাতীয় গণউদ্যোগ সৃষ্টি জরুরি প্রয়োজন। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধী অনুগামী শক্তিদের বিরোধিতা এবং সরকার ও প্রশাসনের দ্বিধা ও কালক্ষেপণ দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া; ৫.'৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ, পানি-বিদ্যুৎ-যোগাযোগ-পরিবেশ বিষয়ে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বহুমুখী পরস্পরের স্বার্থ রক্ষাকারী আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক উদ্যোগ গ্রহণ। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন, মাদক ও অস্ত্র পাচার বন্ধ, পরিবেশ দূষণ রক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুরূপ উদ্যোগ এবং বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র দৃঢ়তার সঙ্গে রুখবে, পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌমত্ব হরণকারী ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব নির্দেশ-পরামর্শ-বিরোধিতা প্রভৃতি।
মোটাদাগে উপরোক্ত ধরনের নীতিনিষ্ঠ জাতীয় ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে অতীতের মতো কার্যকর মেরুকরণ ও জাগরণ সৃষ্টির স্বার্থে ন্যাপ-গণতন্ত্রী-সিপিবি-গণফোরামকে একটি ঐক্য ফ্রন্টে পরিণত করা, অর্থাৎ সাবেক যৌথ গেরিলা পরিবারটিকে ঐক্য ফ্রন্টে সংগঠিত করা এবং অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ ধারায় যুক্ত করা তথা অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার কাজে নিরন্তর প্রয়াস চালাবে।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী
১. এ দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের উপাদানগুলো ধারণ করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত জনযুদ্ধের চেহারা অর্জন করেছিল, যার অন্যতম শরিক ছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী। এ ঐতিহাসিক তথ্য ও সত্যটি ইতিহাস রচনার জন্য যেমন অপরিহার্য, তেমনি ইতিহাস বিকৃতি রোধে এ সত্যটি তুলে ধরা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
২. বাংলাদেশের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ভূমিকা ও অবদান বিলম্বে হলেও স্বীকৃতি আদায়, গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মরণোত্তর এবং জীবিতাবস্থায় সম্মান ও মর্যাদা অর্জনের স্বার্থে, মুক্তিযোদ্ধা সনদ পাওয়ার ন্যায্য দাবিতে এ সমাবেশ জরুরি হয়ে উঠেছে।
বিরাজমান আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক যে প্রেক্ষিতে এই মুক্তিযোদ্ধা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তা অনেক চ্যালেঞ্জ হাজির করেছে। যার মধ্যে রয়েছে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, আইন-শৃঙ্খলার অবনতিসহ জনদুর্ভোগ, শেয়ারবাজারের মহালুণ্ঠনের ঘটনা এবং দুর্নীতি_ এসব ক্ষেত্রে দেশবাসী যত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভ প্রকাশ করছে, তার চেয়ে কম উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ নয় মৌলবাদী, উগ্রসাম্প্রদায়িক, জঙ্গি, যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রযন্ত্র দখলের নগ্ন আগ্রাসন-হুমকি ও হুঙ্কারে। এই বিপদের বীজ রোপিত হয় '৭৫-এর দুঃখজনক পটপরিবর্তনের মাধ্যমে; স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী রাষ্ট্রদ্রোহীরা রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অশুভ শক্তি পাকিস্তানি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠাকল্পে বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রতিমুহূর্ত চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মারছে_ এরা জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, শিক্ষার গণমুখী সংস্কার, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন প্রভৃতির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে। তারা সংবিধান-বিরুদ্ধ ক্ষমতা দখলের একটি নগ্ন মহড়া দিয়েছে গত ৪ এপ্রিল। জাতির জন্য এ ঘটনা নবতর অশনি সংকেত। যেখানে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্র তথা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি হুমকিদাতা এ অশুভ শক্তির প্রতি প্রশাসনের নমনীয় নীতি অনুসরণ, সরকারের দ্বিধাগ্রস্ততা, '৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রবর্তনের ক্ষেত্রে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের প্রশ্নে সরকারি দলের মধ্যকার মতভিন্নতা প্রভৃতি যুদ্ধাপরাধী বিচারের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে। এ ছাড়া গণদুর্ভোগ মোচনে দুর্নীতি দমনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দৃঢ় পদক্ষেপের অভাবের কারণে জনমনে সৃষ্ট অসন্তোষের সুযোগ নিতে সদাব্যস্ত এই যুদ্ধাপরাধী চক্রের পরিবারটি।
গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের এই বিপদ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো জরুরি জাতীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলকে দৃঢ়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুসরণ করতে হবে, দলীয় ঐক্য, অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক শক্তির বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতার পথে এ দলকে অগ্রসর হতে হবে, অন্যথায় যুদ্ধাপরাধীর নেতৃত্বে পূর্বতন চারদলীয় জোট আগামীতে ক্ষমতাসীন হওয়ার সুযোগ সহজেই পেতে পারে।
জাতীয় জীবনের এই সন্ধিক্ষণ মুহূর্তে বাম প্রগতিশীল শক্তি যারা স্বাধীনতা-পূর্বকালে গণতন্ত্র অর্জনে ও মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন, সেই উল্লেখযোগ্য শক্তিটি আজ বহুধাবিভক্ত ও শক্তিহীন। অতীতের মতো গৌরবজনক ও নীতিনিষ্ঠ ভূমিকা পালনে এই পরিবারের অনুসারীদের আকাঙ্ক্ষাও রয়েছে। তারা বর্তমান নাজুক জাতীয় পরিস্থিতিতে উপরোক্ত শক্তির ঘনিষ্ঠ মেরুকরণ ও ঐক্য দেখতে আগ্রহী।
ওই যৌথ গেরিলা বাহিনীর অনুসারী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিভিত্তিক ঐক্যফ্রন্ট গড়ে তোলাই হবে আজকের জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সঠিক কর্মপন্থা। একই সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে নীতিনিষ্ঠ দেশপ্রেমের চেতনায় জাগ্রত ও উত্থিত করার কঠিন কর্তব্য পালন করতে হবে।
ওই মেরুকরণ বা ঐক্য ফ্রন্টের মুখ্য লক্ষ্য হওয়া উচিত; যুদ্ধাপরাধীনির্ভর জামায়াত-আশ্রিত বিএনপি তথা যুদ্ধাপরাধী সমর্থিত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার বিপদ থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করা। এই যুদ্ধাপরাধীদের মদদদাতারা মুক্তিযুদ্ধের দেশে বিরোধী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করুক তা-ও কারও কাম্য হতে পারে না। আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হলে যুদ্ধাপরাধী আশ্রিত সরকার ক্ষমতাসীন হোক, কোনো মুক্তিযোদ্ধা তা মেনে নিতে পারেন না। এ জন্য বিএনপি নেতৃত্বকে বিরাজমান ঝুঁকিপূর্ণ গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এবং মুক্তিযুদ্ধকে নিরাপদ করতে আহ্বান জানাই, যুদ্ধাপরাধী-সংশ্লিষ্ট জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করুন; জামায়াতবান্ধব না হয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রবান্ধব হোন।
অতীতের গৌরবজনক ভূমিকার অধিকারী ওই যৌথ গেরিলা পরিবারের বাম গণতান্ত্রিক শক্তির পুনরায় ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্টে পরিণত করে সম্পাদন করতে হবে নিম্নোক্ত জাতীয় কর্তব্য :
১. গণসচেতনতা ও গণজাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের মানবতাবিরোধী অপরাধের দ্রুত ও কার্যকর বিচার; ২. দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান কশাঘাত থেকে দরিদ্রসহ জনসাধারণের রক্ষার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যায্যমূল্যের দোকান চালুর মাধ্যমে সরকারি গণবণ্টন ব্যবস্থা চালু করা; ৩. মেহনতি ক্ষেতমজুর, শ্রমিকসহ গরিব মানুষের জন্য রেশনিং চালু, গার্মেন্ট শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি ও অধিকার, ক্ষেতমজুরের ন্যায্য মজুরি, কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি এবং কৃষি উপকরণ সুলভ মূল্যে পাওয়ার নিশ্চয়তা; ৪. জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি কার্যকর করা এবং শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জাতীয় গণউদ্যোগ সৃষ্টি জরুরি প্রয়োজন। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধী অনুগামী শক্তিদের বিরোধিতা এবং সরকার ও প্রশাসনের দ্বিধা ও কালক্ষেপণ দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া; ৫.'৭২ সালের সংবিধান অনুযায়ী সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রাখা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ, পানি-বিদ্যুৎ-যোগাযোগ-পরিবেশ বিষয়ে ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বহুমুখী পরস্পরের স্বার্থ রক্ষাকারী আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক উদ্যোগ গ্রহণ। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমন, মাদক ও অস্ত্র পাচার বন্ধ, পরিবেশ দূষণ রক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুরূপ উদ্যোগ এবং বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র দৃঢ়তার সঙ্গে রুখবে, পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সার্বভৌমত্ব হরণকারী ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব নির্দেশ-পরামর্শ-বিরোধিতা প্রভৃতি।
মোটাদাগে উপরোক্ত ধরনের নীতিনিষ্ঠ জাতীয় ভূমিকা পালনের লক্ষ্যে অতীতের মতো কার্যকর মেরুকরণ ও জাগরণ সৃষ্টির স্বার্থে ন্যাপ-গণতন্ত্রী-সিপিবি-গণফোরামকে একটি ঐক্য ফ্রন্টে পরিণত করা, অর্থাৎ সাবেক যৌথ গেরিলা পরিবারটিকে ঐক্য ফ্রন্টে সংগঠিত করা এবং অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ ধারায় যুক্ত করা তথা অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার কাজে নিরন্তর প্রয়াস চালাবে।
পঙ্কজ ভট্টাচার্য : রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী
No comments