যাদের ত্যাগে স্বাধীনতাঃ একাত্তরে সব হারিয়ে এখন বইয়ের ফেরিওয়ালা by রমেন দাশগুপ্ত
মধ্যাহ্নের কাঠফাটা রোদ, তীব্র, ভ্যাপসা গরম। চট্টগ্রাম শহরের যে কোন রাস্তায় পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ করে চোখে পড়ে যেতে পারে কাঁধে বইয়ের ঝোলা নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধা।
আগুনের মত তপ্ত পিচ ঢালা রাজপথে তার খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া দেখে থমকে যেতে হয় পথিককে। তিনি রমা চৌধুরী, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের ঝাপটায় ঘরবাড়ি, নিজের সৃষ্টি সর্বোপরি দু’সন্তান হারানো বিপর্যস্ত জীবনসংগ্রামী।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অগণিত মা, বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন, রমা চৌধুরী তাদেরই একজন। শুধু সম্ভ্রমই হারাননি তিনি, এরপর থেকে সামাজিক গঞ্জনা সয়ে আর কখনোই মাথা তুলেও দাঁড়াতে পারেননি।
সেদিন যেসব মানুষ শহীদ হয়েছিল, তাদের তালিকায় হয়ত তার দু’সন্তানের নাম যুক্ত হয়নি, কিন্তু রমা চৌধুরীর কাছে তারা মুক্তিযুদ্ধের বলি। রমা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, `বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ফলে অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় হারা হয়ে ওষুধ-পথ্য ও সুচিকিৎসার অভাবে শুধু একটি নয়, পর পর দু`টি শিশু সন্তানকে আমি চির বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছি বাংলার বিজয় দিবসের পরে। হানাদার বাহিনীর গুলি হয়ত তাদের বুকে বিদ্ধ হয়নি, সত্য, কিন্তু বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সেই দিনগুলোই তাদের ওপর মরণ কামড় বসিয়ে যায়। তাই আমার মতে আমার সন্তান দুটিও শহীদ।`
রমা চৌধুরীর মত অসংখ্য মায়ের এমন আত্মত্যাগেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে দেশ। বিজয়ের ৪১ বছর পূর্তি উপলক্ষে আত্মত্যাগের ইতিহাস জানতে বাংলানিউজর পক্ষ থেকে রমা চৌধুরীর মুখোমুখি হলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। বলেন, “আমি কিছু বলতে পারব না, এটা আমার জন্য বিজয়ের মাস নয়, আমার জন্য শোকের মাস। আমি সহ্য করতে পারিনা।”
মুখে সেসব দুঃখগাঁথার আধো আধো স্মৃতিচারণের পাশাপাশি হাতে ধরিয়ে দেন নিজের লেখা কয়েকটি বই। বলেন, “বইগুলো পড়লে অনেক কিছুই জানবে। যেটুকু বাকি আছে, মৃত্যুর আগে আমি সবকিছু লিখে রেখে যাব।”
প্রাণে মরেননি, ঘটেছে আত্মার অপমৃত্যু
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করা রমা চৌধুরী পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকতাকে। বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়ায়।
মুক্তিযুদ্ধের চলাকালে একাত্তরের ১৩ মে তিন শিশু সন্তান নিয়ে পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন রমা চৌধুরী। স্বামী ছিলেন ভারতে। ওইদিন এলাকার পাকিস্তানিদের দালালদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর লোকজন তাদের ঘরে হানা দেয়। নিজের মা আর পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী টগরের সামনেই তার ওপর হামলে পড়ে এক হানাদার।
একাত্তরের জননী গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় নিজের সম্ভ্রম হারানোর সেই কাহিনীর পাশাপাশি রমা চৌধুরী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতার বর্ণণা দিয়ে লিখেন, “সেদিন আমাদের পাড়ায় কতো মেয়েকে যে ধর্ষণ করেছে পিশাচগুলো তার কোন ইয়ত্তা নেই। যুবতী মেয়ে ও বৌ কাউকেই ছাড়েনি। গর্ভবতী বৌ এমনকি আসন্ন-প্রসবারাও বাদ যায়নি। এসব কথা জানতে পেরে আমি অন্তরের গ্লানি ভুলে নিজেকে কোনমতে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেও মা কিন্তু আমার গর্ভে হানাদারের সন্তান আসতে পারে ভেবে আতংকে ও উদ্বেগে ছটফট করতে থাকেন।”
ধর্ষণেই ক্ষান্ত হয়নি, বাড়িও পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা
হানাদারদের হাত থেকে কোনমতে মুক্ত হয়ে রমা চৌধুরী পুকুরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন পুনঃধর্ষণের ভয়ে। তার বর্ণনায়, তিনি দেখতে পান, চারদিক থেকে দলে দলে হানাদাররা দেশীয় দালালদের সহযেগিতায় প্রবেশ করতে লাগল তাদের বাড়িতে। হানাদাররা গান পাউডার দিয়ে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। চোখের সামনে ঘরের ভেতর রাখা মূল্যবান মালামাল, নিজের লেখা সাহিত্যকর্ম পুড়ে যেতে থাকল। কিন্তু হানাদারের ভয়ে কেউ আগুন নেভাতে এগিয়ে এলনা। এক পর্যায়ে রমা চৌধুরী নিজেই ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে আসেন। চেষ্টা করেন, ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ছিঁটেফোটা রক্ষা করার, কিন্তু ব্যর্থ হন।
শুরু হল সমাজের লাঞ্চনা, অপবাদ
পাকিস্তানি হানাদারের হাতে সম্ভ্রম হারানোর পর কেউ কেউ হয়ত সহযোগিতার হাত নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু নিকটজন সহ সমাজের লোকদের কাছে শুরু হয়েছিল তার দ্বিতীয় দফা লাঞ্ছিত হবার পালা।
একাত্তরের জননী গ্রন্থের ৬৪ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, “আমাদেরকে দেখতে বা সহানুভূতি জানাতে যারাই এসেছেন তাদের কাছে আমার নির্যাতিত হবার ঘটনাটা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে অশ্রাব্য ভাষায়। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে খোন্দকারের বাড়ি। সে বাড়ির দু`তিনজন শিক্ষিত ছেলে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে এলে আমার আপন মেজকাকা এমন সব বিশ্রী কথা বলেন যে তারা কানে আঙ্গুল দিতে বাধ্য হই। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিনা, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার জন্য।”
হারালেন দু`সন্তানও
হানাদারদের কাছে নির্যাতিত হয়ে সমাজের লাঞ্ছনায় এবং ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন রমা চৌধুরী। পোড়া দরজা-জানালাবিহীন ঘরে শীতের রাতে থাকতে হয় মাটিতে। গরম বিছানাপত্রও সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দিনান্তে ভাত জুটছেনা। অনাহারে, অর্ধহারে ঠাণ্ডায় দু`সন্তান সাগর আর টগরের অসুখ বেঁধে গেল।
বিজয়ের আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সাগরের। ছেলেকে সুস্থ করতে পাগলপ্রায় অবস্থা রমা চৌধুরীর। গ্রাম্য চিকিৎসক দু`একজন অবশেষে আসলেন। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা গেল সাগর।
একাত্তরের জননী গ্রন্থের ২১১ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, “ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কাঁদতে থাকেন, `আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)।”
রমা চৌধুরী জানান, প্রথম সন্তানকে হারিয়ে তিনি প্রায় পাগল হয়ে যান। একই অসুখে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তানও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর।
পরের ইতিহাস আরও বিপর্যয়ের, হারালেন আরও এক সন্তান
মুক্তিযুদ্ধে নিজের সতীত্ব, দু`সন্তান হারানো, সমাজের লাঞ্চনা, গঞ্জনা, অভাব, জীবন সংগ্রাম- সব মিলিয়ে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি রমা চৌধুরী। প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
জুতা পরেন না রমা চৌধুরী
হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করেন না রমা চৌধুরী। তাই তিন সন্তানকেই দেওয়া হয়েছে মাটিচাপা। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পরেননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পরা শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেওয়া। এরপর গত ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলছেন রমা চৌধুরী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রমা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, `আমার তিন ছেলে মাটির নীচে। তাদের শরীরের উপর দিয়ে জুতা পায়ে আমি হাঁটি কী করে ? আমার সন্তানদের কষ্ট হবে না ?`
সব হারিয়ে তিনি এখন বইয়ের ফেরিওয়ালা
রমা চৌধুরী এখন নিজের লেখা বই ফেরি করেন নিজেই। তাকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন এমন কিছু বাঁধা গ্রাহক আছেন। তারাই রমা চৌধুরীর বই প্রথমে কিনে নেন। এ পর্যন্ত ১৮টি বই প্রকাশ করেছেন রমা চৌধুরী।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, `আমি বই বিক্রি করি। যেদিন বিক্রি করতে পারি সেদিন খাই, যেদিন পারিনা সেদিন উপোস থাকি।`
কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, `মুক্তিযুদ্ধ আমার কাঁধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব মুক্তিযুদ্ধেরই অবদান। আমার ভিতর অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে বলতে না পারি, কালি দিয়ে লিখে যাব। আমি নিজেই একাত্তরের জননী।`
আরডিজি, সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর, মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ
[ রমা চৌধুরীর ওপর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে। এরপর লেখাটি পড়ে বাংলানিউজের অনেক পাঠক তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকেই চেয়েছেন সাহায্যের হাত বাড়াতে। মহান মুক্তিযুদ্ধে এমন একজন নারী যোদ্ধার প্রতি যারা আগ্রহ দেখিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। অনেকেই চেয়েছেন প্রতিবেদনটি আবারও পড়তে। তাদের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতিবেদনটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো। আর যারা রমা চৌধুরীকে সহযোগিতা করতে চান তাদের যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে এই ঠিকানায়: eic@banglanews24.com]
সেদিন যেসব মানুষ শহীদ হয়েছিল, তাদের তালিকায় হয়ত তার দু’সন্তানের নাম যুক্ত হয়নি, কিন্তু রমা চৌধুরীর কাছে তারা মুক্তিযুদ্ধের বলি। রমা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, `বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ফলে অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় হারা হয়ে ওষুধ-পথ্য ও সুচিকিৎসার অভাবে শুধু একটি নয়, পর পর দু`টি শিশু সন্তানকে আমি চির বিদায় দিতে বাধ্য হয়েছি বাংলার বিজয় দিবসের পরে। হানাদার বাহিনীর গুলি হয়ত তাদের বুকে বিদ্ধ হয়নি, সত্য, কিন্তু বাংলার মুক্তি সংগ্রামের সেই দিনগুলোই তাদের ওপর মরণ কামড় বসিয়ে যায়। তাই আমার মতে আমার সন্তান দুটিও শহীদ।`
রমা চৌধুরীর মত অসংখ্য মায়ের এমন আত্মত্যাগেই একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে দেশ। বিজয়ের ৪১ বছর পূর্তি উপলক্ষে আত্মত্যাগের ইতিহাস জানতে বাংলানিউজর পক্ষ থেকে রমা চৌধুরীর মুখোমুখি হলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। বলেন, “আমি কিছু বলতে পারব না, এটা আমার জন্য বিজয়ের মাস নয়, আমার জন্য শোকের মাস। আমি সহ্য করতে পারিনা।”
মুখে সেসব দুঃখগাঁথার আধো আধো স্মৃতিচারণের পাশাপাশি হাতে ধরিয়ে দেন নিজের লেখা কয়েকটি বই। বলেন, “বইগুলো পড়লে অনেক কিছুই জানবে। যেটুকু বাকি আছে, মৃত্যুর আগে আমি সবকিছু লিখে রেখে যাব।”
প্রাণে মরেননি, ঘটেছে আত্মার অপমৃত্যু
১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করা রমা চৌধুরী পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকতাকে। বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়ায়।
মুক্তিযুদ্ধের চলাকালে একাত্তরের ১৩ মে তিন শিশু সন্তান নিয়ে পোপাদিয়ায় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন রমা চৌধুরী। স্বামী ছিলেন ভারতে। ওইদিন এলাকার পাকিস্তানিদের দালালদের সহযোগিতায় হানাদার বাহিনীর লোকজন তাদের ঘরে হানা দেয়। নিজের মা আর পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী টগরের সামনেই তার ওপর হামলে পড়ে এক হানাদার।
একাত্তরের জননী গ্রন্থের ৫২ পৃষ্ঠায় নিজের সম্ভ্রম হারানোর সেই কাহিনীর পাশাপাশি রমা চৌধুরী পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর পৈশাচিকতার বর্ণণা দিয়ে লিখেন, “সেদিন আমাদের পাড়ায় কতো মেয়েকে যে ধর্ষণ করেছে পিশাচগুলো তার কোন ইয়ত্তা নেই। যুবতী মেয়ে ও বৌ কাউকেই ছাড়েনি। গর্ভবতী বৌ এমনকি আসন্ন-প্রসবারাও বাদ যায়নি। এসব কথা জানতে পেরে আমি অন্তরের গ্লানি ভুলে নিজেকে কোনমতে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেও মা কিন্তু আমার গর্ভে হানাদারের সন্তান আসতে পারে ভেবে আতংকে ও উদ্বেগে ছটফট করতে থাকেন।”
ধর্ষণেই ক্ষান্ত হয়নি, বাড়িও পুড়িয়ে দেয় হানাদাররা
হানাদারদের হাত থেকে কোনমতে মুক্ত হয়ে রমা চৌধুরী পুকুরে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন পুনঃধর্ষণের ভয়ে। তার বর্ণনায়, তিনি দেখতে পান, চারদিক থেকে দলে দলে হানাদাররা দেশীয় দালালদের সহযেগিতায় প্রবেশ করতে লাগল তাদের বাড়িতে। হানাদাররা গান পাউডার দিয়ে তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। চোখের সামনে ঘরের ভেতর রাখা মূল্যবান মালামাল, নিজের লেখা সাহিত্যকর্ম পুড়ে যেতে থাকল। কিন্তু হানাদারের ভয়ে কেউ আগুন নেভাতে এগিয়ে এলনা। এক পর্যায়ে রমা চৌধুরী নিজেই ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে আসেন। চেষ্টা করেন, ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ছিঁটেফোটা রক্ষা করার, কিন্তু ব্যর্থ হন।
শুরু হল সমাজের লাঞ্চনা, অপবাদ
পাকিস্তানি হানাদারের হাতে সম্ভ্রম হারানোর পর কেউ কেউ হয়ত সহযোগিতার হাত নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু নিকটজন সহ সমাজের লোকদের কাছে শুরু হয়েছিল তার দ্বিতীয় দফা লাঞ্ছিত হবার পালা।
একাত্তরের জননী গ্রন্থের ৬৪ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, “আমাদেরকে দেখতে বা সহানুভূতি জানাতে যারাই এসেছেন তাদের কাছে আমার নির্যাতিত হবার ঘটনাটা ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে অশ্রাব্য ভাষায়। আমাদের বাড়ির উত্তর দিকে খোন্দকারের বাড়ি। সে বাড়ির দু`তিনজন শিক্ষিত ছেলে আমাদের তখনকার অবস্থা সম্পর্কে জানতে এলে আমার আপন মেজকাকা এমন সব বিশ্রী কথা বলেন যে তারা কানে আঙ্গুল দিতে বাধ্য হই। আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিনা, দোকানে গিয়ে কিছু খাবারও সংগ্রহ করতে পারলাম না মা ও ছেলেদের মুখে দেবার জন্য।”
হারালেন দু`সন্তানও
হানাদারদের কাছে নির্যাতিত হয়ে সমাজের লাঞ্ছনায় এবং ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়লেন রমা চৌধুরী। পোড়া দরজা-জানালাবিহীন ঘরে শীতের রাতে থাকতে হয় মাটিতে। গরম বিছানাপত্রও সব পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। দিনান্তে ভাত জুটছেনা। অনাহারে, অর্ধহারে ঠাণ্ডায় দু`সন্তান সাগর আর টগরের অসুখ বেঁধে গেল।
বিজয়ের আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় সাগরের। ছেলেকে সুস্থ করতে পাগলপ্রায় অবস্থা রমা চৌধুরীর। গ্রাম্য চিকিৎসক দু`একজন অবশেষে আসলেন। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা গেল সাগর।
একাত্তরের জননী গ্রন্থের ২১১ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, “ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কাঁদতে থাকেন, `আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)।”
রমা চৌধুরী জানান, প্রথম সন্তানকে হারিয়ে তিনি প্রায় পাগল হয়ে যান। একই অসুখে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তানও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর।
পরের ইতিহাস আরও বিপর্যয়ের, হারালেন আরও এক সন্তান
মুক্তিযুদ্ধে নিজের সতীত্ব, দু`সন্তান হারানো, সমাজের লাঞ্চনা, গঞ্জনা, অভাব, জীবন সংগ্রাম- সব মিলিয়ে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি রমা চৌধুরী। প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
জুতা পরেন না রমা চৌধুরী
হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী শবদেহ পোড়ানোতে বিশ্বাস করেন না রমা চৌধুরী। তাই তিন সন্তানকেই দেওয়া হয়েছে মাটিচাপা। মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পরেননি রমা চৌধুরী। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পরা শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেওয়া। এরপর গত ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই পথ চলছেন রমা চৌধুরী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে রমা চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, `আমার তিন ছেলে মাটির নীচে। তাদের শরীরের উপর দিয়ে জুতা পায়ে আমি হাঁটি কী করে ? আমার সন্তানদের কষ্ট হবে না ?`
সব হারিয়ে তিনি এখন বইয়ের ফেরিওয়ালা
রমা চৌধুরী এখন নিজের লেখা বই ফেরি করেন নিজেই। তাকে ভালবাসেন, শ্রদ্ধা করেন এমন কিছু বাঁধা গ্রাহক আছেন। তারাই রমা চৌধুরীর বই প্রথমে কিনে নেন। এ পর্যন্ত ১৮টি বই প্রকাশ করেছেন রমা চৌধুরী।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, `আমি বই বিক্রি করি। যেদিন বিক্রি করতে পারি সেদিন খাই, যেদিন পারিনা সেদিন উপোস থাকি।`
কথা বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, `মুক্তিযুদ্ধ আমার কাঁধে ঝোলা দিয়েছে। আমার খালি পা, দুঃসহ একাকীত্ব মুক্তিযুদ্ধেরই অবদান। আমার ভিতর অনেক জ্বালা, অনেক দুঃখ। আমি মুখে বলতে না পারি, কালি দিয়ে লিখে যাব। আমি নিজেই একাত্তরের জননী।`
আরডিজি, সম্পাদনা: তপন চক্রবর্তী, ব্যুরো এডিটর, মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ
[ রমা চৌধুরীর ওপর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে। এরপর লেখাটি পড়ে বাংলানিউজের অনেক পাঠক তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকেই চেয়েছেন সাহায্যের হাত বাড়াতে। মহান মুক্তিযুদ্ধে এমন একজন নারী যোদ্ধার প্রতি যারা আগ্রহ দেখিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। অনেকেই চেয়েছেন প্রতিবেদনটি আবারও পড়তে। তাদের প্রত্যাশার প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতিবেদনটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো। আর যারা রমা চৌধুরীকে সহযোগিতা করতে চান তাদের যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে এই ঠিকানায়: eic@banglanews24.com]
No comments