বিশ্বজিৎ হত্যা মামলাঃ ফাঁসানো হচ্ছে চারজনকে! by কামরুল হাসান ও কাজী আনিছ
বিশ্বজিৎ দাস হত্যার ঘটনা শুরুতেই ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। জড়িত নয়, এমন আটজনকে গ্রেপ্তার করে মামলার আসামি করতে চেয়েছিলেন পুলিশের এক উপকমিশনার (ডিসি)। কিন্তু গণমাধ্যমে ছবিসহ সবার পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
পুলিশ চাপের মুখে ছাত্রলীগের ছয় কর্মীকে গ্রেপ্তারে বাধ্য হলেও ‘নিরীহ’ চার ব্যক্তি এখনো এ মামলায় গ্রেপ্তার আছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর প্রথমে ওই ডিসির মুখ থেকে শুনেই ‘বিশ্বজিৎ দাস হত্যায় আটজন গ্রেপ্তার হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।পুলিশের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মন্তব্য নিয়ে পুলিশ প্রশাসনকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। আটজন গ্রেপ্তারের কথা বলার পর তিনি আবার ১১ জনের কথা বলেছিলেন; সেই হিসাব এখনো মেলেনি।
সেই আটজন কারা, কীভাবে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তা নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালানো হয়। এতে দেখা যায়, এ ঘটনায় প্রথমে যে আটজনকে গ্রেপ্তার করার কথা বলা হয়েছিল, তাদের কোনো নাম-ছবি গণমাধ্যমে আসেনি। এদের কেউ ছাত্রও নয়। বরং প্রথমে পুলিশ তাদের ‘সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। দুদিন পর এদের চারজনকে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আসামি করা হয়। মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় অন্য চারজনকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, বিশ্বজিৎ হত্যার দুদিন পর ১১ ডিসেম্বর ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়—এমন আটজনকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। প্রথমে তাদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানো হয়, এরা বিশ্বজিৎ দাস হত্যার আসামি। ওই কর্মকর্তার কথা শুনেই মন্ত্রী গণমাধ্যমের কাছে আটজনকে গ্রেপ্তারের কথা বলেন। কিন্তু ওই দিন মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই উপকমিশনার কোতোয়ালি থানায় আটক আটজনকে পরে সূত্রাপুর থানায় পাঠিয়ে তাদের বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারের জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) বলেন। কিন্তু এতে ওয়ারি বিভাগের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। শেষ পর্যন্ত চাপের মুখে চারজনকে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এই চারজনসহ বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় এখন গ্রেপ্তার আছেন ১০ জন।
ফাঁসানো হলো যাঁদের: গ্রেপ্তার দেখানো চারজন হলেন মামুন অর রশীদ (২৪), ফারুক হোসেন (২৩), মোসলেহ উদ্দিন ওরফে মোসলেম (৪০) ও কাজী নাহিদুজ্জামান ওরফে তুহিন (৩২)। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এঁদের পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা হয়। তাঁদের অভিযোগ, বিশ্বজিৎ হত্যায় গ্রেপ্তার নিয়ে বিভ্রান্তির সামাল দিতে নিরপরাধ এ মানুষগুলোকে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১১ ডিসেম্বর কোর্ট এলাকা থেকে মামুন, ফারুক, মোসলেহ, নাহিদুজ্জামানসহ বেশ কয়েকজনকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানার পুলিশ। ১২ ডিসেম্বর তাঁদের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আদালতে দেওয়া কাগজপত্র অনুযায়ী, আসামিরা আদালত এলাকায় সরকারবিরোধী স্লোগানসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যে সন্দেহমূলক ঘোরাফেরা করছিলেন। এ কারণে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর ১৩ ডিসেম্বর সূত্রাপুর থানার পুলিশ বিশ্বজিৎ হত্যায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখায়।
গতকাল সোমবার মামুন, ফারুক ও মোসলেহ উদ্দিনের বাসায় গেলে তাঁদের পরিবারও অভিযোগ করেন, বিশ্বজিৎকে কারা মেরেছে তা স্পষ্ট। অথচ নিরপরাধ মানুষদের ধরে এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
এদিকে নাহিদুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা পাওয়া না যাওয়ায় তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে নাহিদুজ্জামানের কয়েকজন বন্ধুও একই অভিযোগ করেন।
মামুন ও ফারুকের বাসা দক্ষিণখান থানা এলাকায়। পরিবারের সঙ্গে মধুবাগের ২৯ নম্বর বাসার দোতলায় থাকেন মামুন। আর ফারুক থাকেন বিমানবন্দরের কাছে। দুজনকেই একসঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সরেজমিন: মামুনের বাসায় গেলে মা ঝিনু আক্তার বলেন, ‘উত্তরায় মামুনের কাপড়ের দোকান আছে। আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তার বন্ধু ফারুক ওই দোকান দেখাশোনা করে। ১১ ডিসেম্বর সকালে তারা দুজন এক আত্মীয়ের জামিন হবে বলে আদালত এলাকায় যায়। দুপুরের পর তাদের দুজনের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিন ১২ ডিসেম্বর রাতে জানা গেল ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর টিভিতে দেখি, তাদের বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
মামুনের বাবা হারুনুর রশিদ কাঁদতে কাঁদতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি ও খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত নয়। আমার নিরপরাধ ছেলেসহ কয়েকজনরে বিনা কারণে হত্যা মামলায় ঢুকাইয়া দিল। এর জবাব কার কাছে চাইব।’
ঢাকা মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের আইনজীবী নাছির উদ্দিন বলেন, ‘এক আত্মীয়ের মামলায় জামিনের ব্যাপারে আমার কাছে এসেছিলেন মামুন ও ফারুক। পরে তাঁরা সই দিয়ে নিচে নামেন। কিছুক্ষণ পর শুনলাম, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
বিমানবন্দর সড়ক ধরে দক্ষিণখানের দিকে যেতেই বাঁ পাশে ফারুকের বাসা। মা-ভাই-বোনের সঙ্গে সেখানেই থাকেন তিনি। বাবা মৃত ওয়াকিল উদ্দিন। বাসার সামনে গেলে এলাকাবাসী ও তাঁর পরিবার ছুটে এসে এ প্রতিবেদকের কাছে ফারুকের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান।
ফারুকের মা লাইলি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ফারুক রাজনীতি ও খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত নয়। অথচ তারে হত্যা মামলার আসামি করল। কী করমু, কারে বলমু—কিছুই বুঝতে পারতেছি না।’
মধ্য বাড্ডার জ/৯০ বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন মোসলেহ উদ্দিন। সেখানে গেলে তাঁর স্ত্রী পারভীন আক্তার জানান, মধ্য বাড্ডার লিংক রোডে মোসলেহের বৈদ্যুতিক সামগ্রীর দোকান আছে। ১১ ডিসেম্বর নবাবপুর থেকে বৈদ্যুতিক সামগ্রী কিনতে গিয়েছিলেন তিনি। বেলা দুইটার পর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ ছিল। পরদিন রাতে তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার খবর জানতে পারেন তিনি। মোসলেহ উদ্দিন কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলেও দাবি করেন তিনি।
নাহিদুজ্জামানের কয়েকজন বন্ধু দাবি করেন, নাহিদুজ্জামান একজনের জামিনের ব্যাপারে আইনজীবীর সঙ্গে আলাপ করতে আদালতে গিয়েছিলেন। আদালত থেকে বের হওয়ার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি কাপড়ের দোকানে চাকরি করেন।
জানতে চাইলে মামলার সাবেক তদন্তকারী কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার এসআই মাহবুবুল আলম আকন্দ জানান, বিশ্বজিৎ হত্যার সময় ওই চারজন ঘটনাস্থলে ছিলেন, এমন তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
কিন্তু তাঁদের তো ১১ তারিখ সন্দেহজনক ঘোরাঘুরির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ কথা বললে মাহবুবুল আলম ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
ছয় আসামি রিমান্ডে: ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোটের রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া অন্য ছয়জন হলেন: রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, এইচ এম কিবরিয়া, জি এম রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন, সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিয়া। এঁরা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগের কর্মী। কাইয়ুম ছাড়া পাঁচজনের ছবি-পরিচয় গণমাধ্যমে এসেছে। তাঁরা প্রত্যেকেই আট দিন করে রিমান্ডে আছেন। বর্তমানে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করছে।
No comments