বিশ্ব অভিবাসী দিবসঃ মর্যাদা মেলেনি প্রবাসী শ্রমিকদের by জেসমিন পাঁপড়ি
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, ২০১১ সালে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২১৭ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১২ সালে এর পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়াবে বলে আশা করছে মন্ত্রণালয়।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে সোমবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে ৮০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিক কর্মরত থেকে দেশের রেমিট্যান্স বাড়াতে সাহায্য করছেন। অথচ যারা অর্থনীতিকে বিপদমুক্ত রাখতে সাহায্য করছেন, তারাই প্রতিনিয়ত শিকার হচ্ছেন নানা অবহেলার। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের রেকর্ড গড়তে যাদের অবদান বেশি, সেসব প্রবাসীরা আজও সত্যিকারের মূল্যায়ন পাননি। তাদের প্রতি সম্মান শুধু সভা সেমিনারের বক্তৃতা বৈ কিছু নয়। অভিবাসী এই শ্রমিকেরা দেশে-বিদেশে শিকার হচ্ছেন উন্মুক্ত প্রতারণার।
আর এ অবস্থায় সারা বিশ্বের মতো মঙ্গলবার বাংলাদেশেও পালিত হবে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আইন মেনে যাব বিদেশ, অর্থ এনে গড়ব স্বদেশ’।
কিন্তু এই আইন মানা শুধু শ্রমিকের কাজ নয়। তাকে আইন মানতে শেখানোর দায়িত্ব যাদের, তাদেরকে অধিকাংশ সময়ই দায় এড়িয়ে চলতে দেখা যায়। সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে তাই দোষীরা ছাড় পেয়ে যায় সব সময়। ভোগান্তি হয় খেটে খাওয়া মানুষদের।
বিদেশ ফেরত ও বিদেশে যাওয়ার আশা নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে ছুটে বেড়ানো কয়েকজন জানান, বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনার শুরু থেকেই হয়রানির শিকার হওয়া শুরু হয়। এরপর পাসপোর্ট তৈরি থেকে রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে মিথ্যা তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্রসহ সব ক্ষেত্রে সীমাহীন ভোগান্তি তো আছেই। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত কি! অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার পথে অনেককে যাত্রাপথেই নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়।
এসব বিষয়ে সচেতনতার জন্যই এবারের অভিবাসী দিবসে নিয়ম মেনে বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে।
বিদেশে অবস্থানরত কর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে সাধারণত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর দ্বারস্থ হন। কিন্তু সেখানে তাদের ভাগ্যে মেলে শুধুই বঞ্চনা। দূতাবাসের কাছে তাদের পরিচয় কেবলই শ্রমিক। সেবার বদলে অবহেলা এসব শ্রমিকের মানসিক শক্তিও নষ্ট করে দেয়।
বাহরাইনে অবস্থাননরত শ্রমিক রেজাউল করিম টেলিফোনে বাংলানিউজকে বলেন, “এখানকার দূতাবাসে গেলে সাহায্য দূরে থাক, তারা আমাদের সাথে ভালোভাবে কথাই বলে না। তারা অনেক শিক্ষিত আর আমরা সামান্য শ্রমিক। একারণে তারা সব সময় আমাদের মত শ্রমিকদের অবজ্ঞা করে এড়িয়ে চলে।”
রেজাউল আরও বলেন, “ভারত বা ফিলিপাইনের দূতাবাস ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকলেও বাংলাদেশের দূতাবাস ছয় সাত ঘণ্টার বেশি খোলা থাকে না। তা-ও সেখানে গেলে অধিকাংশ সময় কর্মকর্তাদের দেখা মেলে না।”
একই দেশে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করা আরেক শ্রমিক মোতালেব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, “এদেশের কোনো মালিক বাংলাদেশি শ্রমিককে কাজে নিতে চান না। কারণ, এসব মালিকের অভিযোগ, আমাদের দেশের দূতাবাসে তারা শ্রমিক চাইতে বা অন্য কোনো কাজে গেলে তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার তো করেই না, বরং অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে ভারত বা ফিলিপাইনের দূতাবাস শ্রমিক বা স্থানীয় মালিকদের অতিথির মতো সেবা দিয়ে থাকে। এজন্য আমরাও একেবারে বাধ্য না হলে দূতাবাসে যাই না।”
শুধু বিদেশে নয়, ছুটিতে দেশে আসা শ্রমিকরাও তাদের যোগ্য সম্মান পান না। সভা সেমিনারে তাদেরকে দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক বলা হলেও বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতি শুরু হয় স্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরূপ আচরণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের লাঞ্ছিত হতে হয় বিমানবন্দরেই।
সৌদি আরব থেকে ছুটিতে দেশে ফেরা শ্রমিক আব্দুস সবুর বলেন, “দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দেশের বিমানবন্দর কর্মকর্তাদের আচরণ দেখলে মনে হয়, আমরা চুরি করে ফিরছি। কেন তারা এমন আচরণ করে? কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? এর জবাব কে দেবে?”
বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার পথেও শ্রমিকদের পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। কখনো ছিনতাইকারীর হাতে খোয়াতে হয় সঞ্চিত উপার্জন দিয়ে প্রিয়জনের জন্য কেনা উপহার বা অর্থ। নিজের সঞ্চয়টুকু প্রিয়জনের কাছ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নিরাপত্তাও পান তারা।
সম্প্রতি বিদেশে কর্মী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা আর কিছু বাংলাদেশির নেতিবাচক কাজের কারণে বাংলাদেশিরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। প্রায় প্রতিমাসেই কিছু না কিছু শ্রমিক দেশে ফিরে আসছেন।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, “আমাদের সরকার প্রবাসীদের যে কোনো সেবা দিতে সবসময়ই আন্তরিক। দেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু করে বিদেশেও প্রবাসীদেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে সবসময় প্রস্তুত। তবে লোকবল সংকটের কারণে অনেক জায়গায় সমস্যার অভিযোগ আসে। সেসব আমরা অতি দ্রুত কাটিয়ে উঠব আশা করি।”
যে কোনো সরকারের তুলনায় প্রবাসীরা এখন বেশি সুবিধা পাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি।
জনশক্তি, কর্মসংসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটির) মহাপরিচালক বেগম শামসুন্নাহার বলেন, “অভিবাসীদের মর্যাদা, সুরক্ষা ও সার্বিক কল্যাণের জন্য অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের কল্যাণের জন্য বিএমইটিসহ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিরন্তরভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা এর মধ্যে একটি অন্যতম পদক্ষেপ। এছাড়া এ খাতের অন্যান্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত তা দ্রুত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।”
২০১১ সালে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬২ জন এবং ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮২৭ জন শ্রমিক বিদেশে গিয়েছে। এদের মধ্যে আছেন পাঁচ ভাগেরও বেশি নারী শ্রমিক, যারা পুরুষদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশর জন্য রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সেসব নারী শ্রমিকদের জন্যও বিশেষ নিরাপত্তার ব্যস্থা নেই। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে এদের অনেকেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন কোনো বিচার ছাড়াই।
এসব নারী শ্রমিকরা কর্মস্থলে মোবাইল ফোন রাখতে না পারায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন না। ফলে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। গৃহকর্তা কর্তৃক নির্যাতিত নারী শ্রমিকরা পালিয়ে আসলে বা বিভিন্ন সমস্যায় পড়লে তাদের জন্য সেসব দেশে কোন আশ্রয় কেন্দ্র নেই। ফলে মানবেতর জীবন থেকে পালিয়ে এসেও তারা অকূল পাথারে পড়েন। আবার যেসব নারী শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসেন বা বেড়াতে আসেন তারা নিজ গ্রাম বা এলাকায় নানা ধরনের অপমানের স্বীকার হন।
এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে বলেন, “বিপদ মাথায় নিয়ে যারা দেশের জন্য রোজগার করছে, তাদের দেশে আসা থেকে শুরু করে এলাকায় থাকাকালীন সব ধরনের সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রসাশনকে নির্দেশ দিতে হবে। এ বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করব।”
এদিকে মন্দাসহ নানা কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে আকস্মিকভাবে আউট পাস দিয়ে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘুরতে হয় দীর্ঘদিন। ফিরে আসা শ্রমিকদের অনেকে অর্থাভাবে আর বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন না।
আবার বিদেশে মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকদের মরদেহ দেশে আনতে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেকে বছরের পর বছর চলে গেলেও প্রিয়জনের লাশের দেখা পাননা। আবার অনেক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, বিমানবন্দরে লাশ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। আর ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে পেতে আরও অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় হয়ে যায়।
কিছু অসঙ্গতির কথা স্বীকার করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় দেশে এখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেশি। পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশে রেমিট্যান্স কমেনি। জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়।”
তিনি বলেন, “শ্রমিকদের যাতে বিদেশ যেতে লাখ লাখ টাকা খরচ না হয় সেজন্য বর্তমান সরকার মালয়েশিয়ার সঙ্গে আন্তঃসরকার চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে কর্মী পাঠানো হবে। এজন্য খরচ হবে মাত্র ৪০ হাজার টাকা। মালয়েশিয়ার এই বাজার চালু করতে পারলে সব জায়গাতেই খরচ কমে আসবে। এর ফলে দালালদের দৌরাত্ম্য কমবে।”
মন্ত্রী বলেন, “যারা এত কষ্ট করে বিদেশ যাচ্ছে, তাদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া যেন মর্যাদার সঙ্গে করা যায়, সব ধরনের প্রতারণা যেন বন্ধ হয়, সেজন্য সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।”
এছাড়া অভিবাসীদের সুবিধা বাড়াতে অভিবাসী অর্ডিন্যান্স আইনের ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “১৯৮২ সালের অভিবাসী শ্রমিক অর্ডিন্যান্সটির চূড়ান্ত খসড়া আমাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে মতামত নিয়ে আইন তৈরির চেষ্টা করছে সরকার। অতি দ্রুত তা মন্ত্রিসভায় তোলা হবে।”
আর এ অবস্থায় সারা বিশ্বের মতো মঙ্গলবার বাংলাদেশেও পালিত হবে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আইন মেনে যাব বিদেশ, অর্থ এনে গড়ব স্বদেশ’।
কিন্তু এই আইন মানা শুধু শ্রমিকের কাজ নয়। তাকে আইন মানতে শেখানোর দায়িত্ব যাদের, তাদেরকে অধিকাংশ সময়ই দায় এড়িয়ে চলতে দেখা যায়। সঠিক তত্ত্বাবধানের অভাবে তাই দোষীরা ছাড় পেয়ে যায় সব সময়। ভোগান্তি হয় খেটে খাওয়া মানুষদের।
বিদেশ ফেরত ও বিদেশে যাওয়ার আশা নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরে ছুটে বেড়ানো কয়েকজন জানান, বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনার শুরু থেকেই হয়রানির শিকার হওয়া শুরু হয়। এরপর পাসপোর্ট তৈরি থেকে রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে মিথ্যা তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসা কেনাবেচা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্রসহ সব ক্ষেত্রে সীমাহীন ভোগান্তি তো আছেই। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত কি! অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার পথে অনেককে যাত্রাপথেই নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়।
এসব বিষয়ে সচেতনতার জন্যই এবারের অভিবাসী দিবসে নিয়ম মেনে বিদেশ যাওয়ার বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে।
বিদেশে অবস্থানরত কর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে সাধারণত বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর দ্বারস্থ হন। কিন্তু সেখানে তাদের ভাগ্যে মেলে শুধুই বঞ্চনা। দূতাবাসের কাছে তাদের পরিচয় কেবলই শ্রমিক। সেবার বদলে অবহেলা এসব শ্রমিকের মানসিক শক্তিও নষ্ট করে দেয়।
বাহরাইনে অবস্থাননরত শ্রমিক রেজাউল করিম টেলিফোনে বাংলানিউজকে বলেন, “এখানকার দূতাবাসে গেলে সাহায্য দূরে থাক, তারা আমাদের সাথে ভালোভাবে কথাই বলে না। তারা অনেক শিক্ষিত আর আমরা সামান্য শ্রমিক। একারণে তারা সব সময় আমাদের মত শ্রমিকদের অবজ্ঞা করে এড়িয়ে চলে।”
রেজাউল আরও বলেন, “ভারত বা ফিলিপাইনের দূতাবাস ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকলেও বাংলাদেশের দূতাবাস ছয় সাত ঘণ্টার বেশি খোলা থাকে না। তা-ও সেখানে গেলে অধিকাংশ সময় কর্মকর্তাদের দেখা মেলে না।”
একই দেশে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করা আরেক শ্রমিক মোতালেব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, “এদেশের কোনো মালিক বাংলাদেশি শ্রমিককে কাজে নিতে চান না। কারণ, এসব মালিকের অভিযোগ, আমাদের দেশের দূতাবাসে তারা শ্রমিক চাইতে বা অন্য কোনো কাজে গেলে তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার তো করেই না, বরং অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেক্ষেত্রে ভারত বা ফিলিপাইনের দূতাবাস শ্রমিক বা স্থানীয় মালিকদের অতিথির মতো সেবা দিয়ে থাকে। এজন্য আমরাও একেবারে বাধ্য না হলে দূতাবাসে যাই না।”
শুধু বিদেশে নয়, ছুটিতে দেশে আসা শ্রমিকরাও তাদের যোগ্য সম্মান পান না। সভা সেমিনারে তাদেরকে দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক বলা হলেও বিমানবন্দরে নামার সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রতি শুরু হয় স্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরূপ আচরণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের লাঞ্ছিত হতে হয় বিমানবন্দরেই।
সৌদি আরব থেকে ছুটিতে দেশে ফেরা শ্রমিক আব্দুস সবুর বলেন, “দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দেশের বিমানবন্দর কর্মকর্তাদের আচরণ দেখলে মনে হয়, আমরা চুরি করে ফিরছি। কেন তারা এমন আচরণ করে? কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? এর জবাব কে দেবে?”
বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফেরার পথেও শ্রমিকদের পড়তে হয় নানা বিড়ম্বনায়। কখনো ছিনতাইকারীর হাতে খোয়াতে হয় সঞ্চিত উপার্জন দিয়ে প্রিয়জনের জন্য কেনা উপহার বা অর্থ। নিজের সঞ্চয়টুকু প্রিয়জনের কাছ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার নিরাপত্তাও পান তারা।
সম্প্রতি বিদেশে কর্মী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক মন্দা আর কিছু বাংলাদেশির নেতিবাচক কাজের কারণে বাংলাদেশিরা চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। প্রায় প্রতিমাসেই কিছু না কিছু শ্রমিক দেশে ফিরে আসছেন।
বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. জাফর আহমেদ খান বলেন, “আমাদের সরকার প্রবাসীদের যে কোনো সেবা দিতে সবসময়ই আন্তরিক। দেশের বিমানবন্দর থেকে শুরু করে বিদেশেও প্রবাসীদেকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে সবসময় প্রস্তুত। তবে লোকবল সংকটের কারণে অনেক জায়গায় সমস্যার অভিযোগ আসে। সেসব আমরা অতি দ্রুত কাটিয়ে উঠব আশা করি।”
যে কোনো সরকারের তুলনায় প্রবাসীরা এখন বেশি সুবিধা পাচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি।
জনশক্তি, কর্মসংসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটির) মহাপরিচালক বেগম শামসুন্নাহার বলেন, “অভিবাসীদের মর্যাদা, সুরক্ষা ও সার্বিক কল্যাণের জন্য অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাদের কল্যাণের জন্য বিএমইটিসহ প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিরন্তরভাবে কাজ করে যাচ্ছে। অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনা এর মধ্যে একটি অন্যতম পদক্ষেপ। এছাড়া এ খাতের অন্যান্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত তা দ্রুত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।”
২০১১ সালে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ৬২ জন এবং ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৮২৭ জন শ্রমিক বিদেশে গিয়েছে। এদের মধ্যে আছেন পাঁচ ভাগেরও বেশি নারী শ্রমিক, যারা পুরুষদের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশর জন্য রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সেসব নারী শ্রমিকদের জন্যও বিশেষ নিরাপত্তার ব্যস্থা নেই। যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে এদের অনেকেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন কোনো বিচার ছাড়াই।
এসব নারী শ্রমিকরা কর্মস্থলে মোবাইল ফোন রাখতে না পারায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন না। ফলে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। গৃহকর্তা কর্তৃক নির্যাতিত নারী শ্রমিকরা পালিয়ে আসলে বা বিভিন্ন সমস্যায় পড়লে তাদের জন্য সেসব দেশে কোন আশ্রয় কেন্দ্র নেই। ফলে মানবেতর জীবন থেকে পালিয়ে এসেও তারা অকূল পাথারে পড়েন। আবার যেসব নারী শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসেন বা বেড়াতে আসেন তারা নিজ গ্রাম বা এলাকায় নানা ধরনের অপমানের স্বীকার হন।
এ বিষয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশনের এক অনুষ্ঠানে বলেন, “বিপদ মাথায় নিয়ে যারা দেশের জন্য রোজগার করছে, তাদের দেশে আসা থেকে শুরু করে এলাকায় থাকাকালীন সব ধরনের সহযোগিতা ও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রসাশনকে নির্দেশ দিতে হবে। এ বিষয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করব।”
এদিকে মন্দাসহ নানা কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে আকস্মিকভাবে আউট পাস দিয়ে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু তাদের ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে ঘুরতে হয় দীর্ঘদিন। ফিরে আসা শ্রমিকদের অনেকে অর্থাভাবে আর বিদেশ যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন না।
আবার বিদেশে মৃত্যুবরণ করা শ্রমিকদের মরদেহ দেশে আনতে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। অনেকে বছরের পর বছর চলে গেলেও প্রিয়জনের লাশের দেখা পাননা। আবার অনেক ভুক্তভোগীর অভিযোগ, বিমানবন্দরে লাশ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। আর ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে পেতে আরও অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় হয়ে যায়।
কিছু অসঙ্গতির কথা স্বীকার করে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় দেশে এখন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেশি। পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বাংলাদেশে রেমিট্যান্স কমেনি। জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়।”
তিনি বলেন, “শ্রমিকদের যাতে বিদেশ যেতে লাখ লাখ টাকা খরচ না হয় সেজন্য বর্তমান সরকার মালয়েশিয়ার সঙ্গে আন্তঃসরকার চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।”
মন্ত্রী আরও বলেন, “মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে কর্মী পাঠানো হবে। এজন্য খরচ হবে মাত্র ৪০ হাজার টাকা। মালয়েশিয়ার এই বাজার চালু করতে পারলে সব জায়গাতেই খরচ কমে আসবে। এর ফলে দালালদের দৌরাত্ম্য কমবে।”
মন্ত্রী বলেন, “যারা এত কষ্ট করে বিদেশ যাচ্ছে, তাদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া যেন মর্যাদার সঙ্গে করা যায়, সব ধরনের প্রতারণা যেন বন্ধ হয়, সেজন্য সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে।”
এছাড়া অভিবাসীদের সুবিধা বাড়াতে অভিবাসী অর্ডিন্যান্স আইনের ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, “১৯৮২ সালের অভিবাসী শ্রমিক অর্ডিন্যান্সটির চূড়ান্ত খসড়া আমাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে মতামত নিয়ে আইন তৈরির চেষ্টা করছে সরকার। অতি দ্রুত তা মন্ত্রিসভায় তোলা হবে।”
No comments