চুড়ি by রাহাত খান
সবই বুঝি। আসল কথা বউটার ভরা গা-গতরের দিকে নজর দিয়েছে ছোকরা। কুয়োতলার পাশেই দোকান তো, নিত্যি দু-বেলা দেখছে। দেখে দেখে চোখে নেশা ধরেছে, বুদ্ধির গোড়ায় ঘোর লেগেছে হারামির। তা নেশাই লাগুক আর ঘোরই লাগুক, একটা কিরা কাটা আর গিল্লা গাওয়া ধেড়ে বজ্জাতের বানানো কথা অমন ঝটপটতি বিশ্বাস করতে আর যে হোক কালু মিয়া রাজি না।
সুলতান বলে : লিজের চউক্ষে দেখচি, ফির ক্যা?
: যা বে শালা, ভাগ।
: অবিশ্বাস করলা? আল্লার কিরা মাইরি।
: ফির?
ইচ্ছে হয় ক'টা ওজনদার গোত্তা দিয়ে বজ্জাতের তিরপল পিঠটা লোকসান করে দিই। মহল্লার পোলাপান না ভাবে তাহেরি, তাই ক্ষেমা দিলাম। তবে সুলতান বুঝল ঝুটমুট টাইম খারাপ করাটা ভালো হয়নি। কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়ল।
কুয়োতলায় রগড় করছিল বাতাসী আর মজিদী। ছেমরা বয়সের লোকমান পানের দোকানে বসে গান লাগিয়েছে আর লাল-চকচক পিরানের জেল্লা দেখাচ্ছে। পথের একধারে বনমালী পাঁড়ের তুলসীগাছ। দুটো মুরগি তুলসীগাছতলায় ঘুরছে আর কটকট শব্দ করছে। তারও পেছনে, বোধ হয় ভিড়ের ভয়ে কলসি হাতে জবুথবু দাঁড়িয়ে আছে বউটা_বৈদরের বউ জৈগুন।
বায়োস্কোপের বাহাদুর হয়ে লোকমান এগিয়ে আসে। বলে : কী হইচে, পানি লিবার আইচ?
বউটা কোনোমতে মাথা নাড়ে। বোধ হয় ডর লাগল।
: এই বাতাসী চাচি...
লোকমান চেঁচিয়ে বলে : হালায় পাইচ কী? দেখতাচ না মানুষ খাড়া। জলদি জলদি করো না...
: লে, লে ছেমরা...
বাতাসী খেপে গিয়ে দুই হাতে উল্টি কাটে। বলে : তেরিবিরি করবি তো দিব এক চটকনা।
: আবে কয় কী? কইলাম ভালার লাইগ্যা।
লোকমান কুৎসিত গালি দিয়ে ওঠে। চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে মজা লুটার জন্য দোকানের হীরু, সুলতান উঁকি মারে। ঝগড়াটা তুমুল হয়ে ওঠে। একসময় নজর করে দেখি আসল মানুষ নাই। বউটা পালিয়েছে।
পালাবে জানতাম। আমারই ঘরের তিন হাত দূরে ওরা আছে দেড় বছরের ওপর। পিয়ন বৈদর আলীর বউ। এই পর্যন্ত যা দেখেছি তাতে আমার হিসাব গলতি হওয়ার না। এইসব মেয়েমানুষ কেবল সুখের ইস্তিরিই না, আপদ-বিপদের বউও। বাতাসী, মজিদী, অগুনীর মা, এদের কারোর সাথে মিল নাই। এক মিল ছিল কালু মিঞার এক নম্বরের বউ ময়নার সাথে। হ্যাঁ, ময়নার সাথেই মিল। ছুরতে না হোক, খাসলতে। সুলতান, হীরু, এমনকি লোকমান ছেমরা পর্যন্ত বউটার ভরা গা-গতর দেখে লোভে চুকচুক করে। কিন্তু ওরা যদি জানত এই ধরনের মেয়েমানুষের ঘোমটায় ফাঁকি নাই। জানলে সুলতান ওমন গিল্লা গাইত না ভালোমানুষ বউটার নামে।
ময়নাকে বোধ হয় বেমালুম ভুলে যাচ্ছিলাম। ঐদিন দুপুরে জৈগুনকে দেখে ময়নার ছবিটাই মনে পড়ে গিয়েছিল। ময়নার মতো এও দেখি কপাল তক ঘোমটা দেয়। হাঁটে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে। মাগির খাসলত ভালো, কথা বলে কম। একচলি্লশ বছরের বুকটায় তিয়াস লেগেছিল। না, ওই পাড়ার ফুলীদের গা-গতর থেকে সুখ-সুড়সুড়ির যে তিয়াস মিটাই, এই তিয়াস না। এর রকম আলাদা। স্বাদ আলাদা। চৈত মাসের তেজি খরায় গাঙের তলায় ডুব দিতে যেমন মন চায়, আশ্বিন মাসের মাঝরাত্তিরে কড়ই গাছের নিচে ভরা-ঘুমের চোখ নিয়ে শুতে যেমন ইচ্ছা করে, এই তিয়াস সেই তিয়াস। সুলতান হারামজাদা এ বুঝবে না। বুঝলে আমি অমন শক্ত ইট, আমার কাছে কাঁচা গুলের বলটু ভাঙতে আসে!
সুলতান বলে : ওস্তাদ, ধবধবে ছিল্কের ছাড় আর বেলাউজ পরছে... আর হাটে কেম্তে.. কোমর লাড়িয়ে লাড়িয়ে,... দেখ,... এম্তে...
এটা পয়লা দিনের বাৎচিত। আড় ইশারায় মানা করেছি। খবিশটা জবর বজ্জাত, বুঝেও বুঝল না। ঘরে তাস পিটছিল মালু মিঞা, চুনীলাল বাবু, সব ওর ঢঙ দেখে হেসে উঠল। আমি কী করি, বেরিয়ে এলাম।
বেইজ্জতি আমার না। তবু মনে লাগে। ময়না তো আর কারোর বউ ছিল না। ওরে বললে লাগত না আমার? ময়নার মতোই একটা বউ মহল্লার ভেতর পাখ গুঁজেছে। একেবারে আমার ঘরের তিন হাতের ভিতর। লাগালাগি চাল। সিলিংয়ের ফোকরে চোখ রাখলে এই ঘর ওই ঘর দুই-ই ঝকমক ফর্সা। দেখছি তো দেড় বছর নাগাদ। এখন তখন, সকাল বিকাল_সব সময়। কই, ও রকম কিছু দেখলাম না তো। তুই শালা সুলতান, তোর ডেরা আর দোকান ও মোড়া, এসব তোর নজর পড়ল কোন্ সময়? বল্, বল্, খাঁটি কথা বল্। কিরা কাটো, আর মানুষের ছিদ্দত গাও, তুমি শালা বেতমিজ, তোমার কথা বিশ্বাস করি আমি?
না, বিশ্বাস করি না। আরে, আমিই তো একদিন বাসের তেলের বোতল নিয়ে ঢুকেছিলাম বৈদরের ঘরে। বৈদর তখন ছিল না। দুই পাইটে ডুবে গিয়ে দিল একদম জাঁহাবাজ লুচ্চা। বউটাকে বোতল দিতে গেলাম। এ্যাহ শালা,_দেখি পায়ের উপরে কদমবুজি মারে। কয় ভাইছাব। বাইরে এসে বোতল দিলাম ফুলীকে। হাসতে হাসতে বাঁচি না। আমাগো এই মহল্লায় বৈদরের মেয়ে মানুষটার সাথে আর কারো মিল নাই। ঘোমটা-পরা একদম বৌমানুষ। নিজের চৌকির ওপর শুয়ে শুয়ে ওদের দিল-রৌশন বাৎচিত শুনি আর হাসি।
বৈদর বলে : রাখ্ না,... খাড়া। সামনের মাসটা আইলেই তরে গলার পাডা বানায়া দিয়াম।
: এ্যাহ্... খালি ত কথা। জৈগুন হাসে।
বৈদর কিরা কাটে : দয়াল্লা। দিয়াম বানায়া কইলাম ত, বিশ্বাস করস না কেরে?
: অইছে...
জৈগুন হাসে,_অইছে, গপ্প থুইয়া এহন খায়া লও। কুপিত তেল পুড়তাছে।
: পুড়ুক।
: কী কইলা?
: কইতাছি তেল পুড়ুক। পয়সা যায় যাইব আমার। তর কী।
এইসব মিল-মহব্বত যখন থাকে তখনকার আলাপ। এ ছাড়া মাঝে মাঝে জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজও শুনি। বৈদর রেগে গেলে পাতিল ভাঙে, বাসন ভাঙে, বউয়ের চুল ধরে পিটায়। বউটা গলা চেপে কাঁদে। জোরে কাঁদে না, যদি মহল্লার মানুষের মজার খোরাক হয়। বৈদর বলে : কতবার কই, হুনস না কেরে? জৈগুন বলে : এইতান মাইনসের লগে আমি কথা কইতে পারতাম না।
: আরে বজ্জাত।
বৈদর গাল দেয় : এইতান মানুষ কই দেখলি? আবু ভাই, মাস্টার চাচা, এরা তর এইতান মানুষ অইল? আচ্ছা কও দেহি, এরা কী মনে করবো।
বুঝি সবই। বৈদরের আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে জৈগুন ওদের সামনে শরমে বেরোয় না। কথা কয় না। বৈদরের তাইতো রাগ। কিরা খেয়ে বলে : রাখ্, তরে বাড়িতে পাডায়া লই...
জৈগুনের চাপা কান্নাটা এই কথার পরে বেড়ে যায়। বাড়ি যেতে জৈগুনের যে অনিচ্ছা, এটা বুঝতে কষ্ট হয় না। ওষুধে কাম দিয়েছে টের পেয়ে বৈদর বারবার কথাটা জোর দিয়ে বলে। জৈগুন বাদ-প্রতিবাদ করে না। চাপা কান্নাটা একটু একটু জোরদার হয়ে পরে আস্তে কমে যায়। তলানিটুকু থমথম করে জৈগুনের ঠোঁটে, পানি-ধোয়া লাল-চোখে আর ঝিম-মারা শরীরে। রাত বাড়ে একটু একটু। বৈদর বলে : খোদায় আর শান্তি দিল না।
বলে বোধ হয় জবাব আশা করে। কিন্তু জৈগুন একদম চুপ। বৈদর উশখুশ করে। অতটা রেগে গিয়ে যা কাণ্ড করল, সেটা মানাবার মতো আর কায়দা পাচ্ছে না। বিছানার এপাশে-ওপাশে শুয়ে... কিংবা ঝটকা মেরে উঠে বসে দুই হাতে মশা মেরে, ঊরশ মেরেও যখন দেখে এসবে ফল নাই, আর এক পক্ষ এই গর্মির অর্থ বুঝছে না, তখন বৈদর ভাঙা-গলায় বলে, আচ্ছারে জৈগুন, তার আসল নাম না কী?
: জানি না।
: জানস, জানস...
বৈদর একগাল হাসে, বলে, ক'না হুনি। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বলে : বাত্তিডা নিবায়া দেই?
: না, আমারে বাড়িত পাডায়া দাও।
বৈদর হি হি হাসে। বলে : আরে ধুর। এইডা তুইন বিশ্বাস করছস_তরে বাড়িত পাডায়াম আমি।
টের পাই পীরিতের হাত গিয়ে মিলেছে আদরের শরীরে। ক্বলব আর লহুর ভিতর পাইট কি পাইট নেশার দঙ্গল। জৈগুনের বেচান স্বরটা বারবার ফিসফিস করে বলে : না আমাদের বাড়িত পাডায়া দেও, হেইডাই তো চাও তুমি! দেও, পাডায়া দেও...
: দয়াল্লারে জৈগুন। এইডা একটা মিছা কথা। আইচ্ছা যা, এইরহম কথা আর কইতাম না।
বৈদর প্রাণপণে বুঝাতে চায়। জৈগুন তার পরও কিছু বলে। বৈদর জবাব দেয়। কথাবার্তা ছাপিয়ে শোনা যায় চোরা নিশ্বাসের ওঠানামা। বাতি অনেক আগেই বুজানো। কথাবার্তা আর কিছু শুনি না। বদলে টুংটাং করে আর একরকমের মিঠা আওয়াজ। যে যে রাতে ওদের টাইমের সাথে আমার টাইমটা মিলে যায়, সে সে রাতেই আওয়াজটা শুনি। কখনো কমতি, কখনো বাড়তি। হাতের ক'টা চুড়ির বাজনা জৈগুনের দিলভরা রোশনীর জানান দেয়। বুকভরা পীরিতির মধুর গীত বাজায়। ময়নার মতো জৈগুনও যে সব দেয় আওয়াজটা তারই নিশানা। আমার মতো আর কেউ হলেও বুঝত মহব্বত ছাড়া আন্ধার বিছানায় আর যা-ই হৌক মেয়েমানুষের হাতের চুড়ি বাজে না। কক্ষনো না।
আমি জানি সবই। পিয়ন বৈদরের বৌ জৈগুনের গা-গতর বৈশাখ মাসের চানি্নর পশর কি না, সুলতান, হীরু, চুনীলাল ওদের দিল বেকারার। আমি তিন হাত তফাতের পড়শী, তাই আমার কাছে আসে বাও নিতে। বউটার উপর নজর দিলে কী হবে, যতক্ষণ ঘোড়েল কালুর কবুল না আসে ততক্ষণ তো সব মিছা। কোনো বুলবুলির ক্ষেমতা নাই ধান খায়।
আমি ফুলির ঘরে গিয়ে কাবলিসি করি। দিল্লাগি করি। পাইটের পর পাইট মেরে লুচ্চা বনি। কিন্তু যা-ই করি আমার এক নম্বরের বউ ময়নার কথা ভুলি কীভাবে? ওদের টাইমের সাথে টাইম মিলে গেলে নিজের চৌকিতে শুয়ে জৈগুন আর বৈদরের বাৎচিত শুনি। ওদের রগড় দেখি, মিটিমিটি কাইজা-ফ্যাসাদের খবর পাই। মিঠা বুলি শুনি জৈগুনের হাতভরা রেশমি চুড়ির। তারপর সব বিলকুল সাফ। আমি হাসি। নিজের মনে হাসি। যা ব্যাটা দ্যাখ্। ও হল বৌ মানুষ। ফুলি না, আতরজান না।
এসব ভাবতে ভাবতে রাতে বোধ হয় মেজাজের তাল কেটে গিয়েছিল। দেরিতে ঘুমিয়েছি। উঠেছি পরদিন ন'টায়। মাথাটা ভার-ভার। কেওয়ারের ফাঁক দিয়ে নজর ঘুরিয়ে দেখি, পাহাড়ি স্নোর বিজ্ঞাপনের ছুড়িটা ঠোঁটে বেদাগ হাসির সওদা নিয়ে হাসছে। উঁচু পোস্টার থেকে আসমানটা ঢালু হয়ে নেমেছে গাছগাছালি, বাড়িঘরের ছাদে, ওখান থেকে রহমতের মসজিদের গম্বুজে।
দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি আর এক তাণ্ডব। মসজিদের বাঁহাতি গলির পূর্বদিকে সুলতানের দোকান, দেখি_দোকানের বারান্দায় গোল হয়ে বসে সুলতান, চুনীলাল, শব্দর আড্ডায় গুলজার। আমাকে দেখেই ভেতরে সরে পড়ল। উল্টোদিকে নজর ঘুরিয়ে ব্যাপার ধরতে কষ্ট হয় না। জৈগুন নিচু হয়ে নিজের ঘরের বারান্দা সুড়ছে।
ইচ্ছে করছিল, জোর বকুনি লাগিয়ে কমবক্ত ক'টা খলিফাকে রাবিশ করে দিয়ে আসি। পরে থামলাম। বেহুঁশ টেক্কা হয়ে লাভ নাই। এক গোয়ালের জানোয়ার তো কালু মিঞাও। এখন সদ্দারীর কবজির জোর দেখাই, পরে সন্ধ্যার পরে যখন রঙের তাস নিয়ে দাপাদাপি করব, ইয়ারি করব, তখন? ইয়ার-দোস্ত দুশমনি করলে, মুখ ব্যাজার করে রাখলে দিল্লাগি হবে, টাইম চলবে?
গুলি মারো জোরসে। ওসব তাহেরীর ধার ধারি না। একচলি্লশ বছর দুনিয়া দেখে দেখে কালু মিঞা একদম ইরানী ছুরির ঝকঝক ফলা। দিলে মরছে কবুল করব সেই দিন, যেদিন গা-গতরে লহুর বদল পিঁচুটির পানি পচবে। এখন রঙের মৌজ উড়াও, খালি দেখো বেইমানি না হয়। হ্যাঁ, সাফ মাথায় বেইমানি, অধর্ম যে করে করুক, কালু করবে না। ওটা বাদ দিয়ে, ওটা সমঝে-সুমঝে যত খুশি ডু ফুর্তি, মানা নাই।
ফুর্তি করার একটা টাইমেই বোধ হয় রোনাজারিটা শোনা গিয়েছিল। কালু মিঞা তখন গলায়-ঢালা মালের মেজাজে নিজেই গরম শিককাবাব। চেতন আসার পর রোনাজারিকে মনে হয়েছিল জারে পাওয়া বাচ্চা কুত্তার কেঁও কেঁও। তারপর গলাটা চেনা গেল। কাঁদছে জৈগুন। বৈদরও চুপকে নেই। চেল্লাচ্ছে : চুপ, চুপ।
কাঁদতে কাঁদতে জৈগুন বলে : তুমার দুইডা পাও পড়ি গো! আমারে বাড়িতে পাডায়া দাও। আমি আর পারতাম না।
: এ্যাহ্, বাড়িতে পাডায়া দেও...। কন্টলের চাউলের ভাত বুঝি পছন্দ অয় না? পডের বিবি অইছস...
: হায় গো আল্লা, আমি কী করি... আমার মরণ নাই!
জৈগুন কাঁদতে থাকে।
ঝিলিক লাগে। এই কী কাণ্ড! রাতদুপুরে মেয়েটা কান্দে কেন? বাড়িতে তো জৈগুন কোনোদিন যেতে চায় না।
থাকতে না পেরে পরদিন বৈদরকে পুছ করে বসলাম : রাইতে বউ কানছিল ক্যা? বেমার-টেমার অইছে নাকি!
বৈদর বিড়ি টানতে টানতে বলল : কপাল গো কালু ভাই, সব গরিব মাইনসের কপাল।
হ্যাঁ, বৈদর গরিব। বেতন পায় তেষট্টি। বাড়িভাড়া গিয়ে থাকে ছাপ্পান্ন, এই ছাপ্পান্ন টাকায় চাইল, ডাইল, তেল, নুন, মরিচ কেনার পরও আছে কাপড় কেনা, ওষুধ, রঙ-ফুর্তির বিড়ি খাওয়া, হ্যাঁ, চলে না। তা বাবা, এই মহল্লায় চলে কার? সবারই তো চাল ফুটো, নকল রঙের মিঞা সব। চলে না তো চলে না। এর জন্য রোনাজারি আর চেল্লাচিলি্ল কেন?
কান্নাটা আরও ক'দিন শুনলাম। জৈগুনের এককথা, বাড়ি যাবে। বৈদর গালিগালাজ করে। কখনো রেগে গিয়ে ধরে পিটোয় বৌকে। জৈগুন হামেলা মেয়েমানুষের মতো গলা গুঁজে কাঁদে। শুনতে শুনতে কান পচে যাবার জোগাড়। ঘরে থাকলে সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা বরবাদ। বুঝি আর সইছে না। এদিকে আমিও কামাই-শোধ মানুষ, বুঝি, বৈদর কী করবে।
এই মহল্লায় কার কী করার আছে, বরাতের ভাগীদার সব শালার অবস্থা সমান। সব ভাতের কষ্টে বেইজ্জত। পিয়ন বৈদরের তবু তো তেষট্টি টাকার একটা উপায় আছে, অনেকের তাও নাই। রাত পুইলে খোদার ফজলে দিন চলে।
কত ফিকির করি, আমারই একলা একটা কিসমতের রুজি হতে চায় না। একদিন অবাক হয়ে দেখি, বৈদরের গায়ে দামি পিরহান। আর একদিন দেখি, রিকশা থেকে নামল। ঝুপড়িতে রকমারি বাজার। ব্যাপারটা কী!
সুলতানও একদিন বলতে চেয়েছিল। ওস্তাদ, বৈদর মিঞার বউয়েরে দেখলাম বায়োস্কোপে যাইতেছে। আবে পরছে কী জানো? ছিল্কের ছাড়ি... বেলাউজ বি ছিল্কের...
ধমক দিয়েছিলাম আড় ইশারায়। সুলতান মানা শোনেনি। সিল্কের শাড়ি পিন্দনে জৈগুন কীভাবে হাঁটে দেখিয়েছিল। মালু মিঞা বলেছিল, কও কী মেঞা, পিয়নের বউ, হে বি ছিল্কের শাড়ি পিন্দে?
: বুঝলা না...
সুলতান রস লাগিয়েছিল : চান্দিত্ চুল নাই, বগলে আউসের বাবড়ি।
চুনীলাল, মালু, শব্দর হো হো করে হেসে উঠেছিল।
আজব দুনিয়া। পাইটের মেজাজে দিলখোশ কালুর কলবের বেইমানির মতো বেইমান দেখি সবাই। এই ক'দিন আগে বৌ বৌ মেয়েটার ইজ্জতের সওয়ালে সুলতানকে ধমক দিয়েছিলাম, এখন দেখি ওই ধমকটা কালু মিঞার বেওকুফ জিন্দিগির কামাই। আমার আর বুঝতে কিছু বাকি নেই। ময়নার সাথে মিল আছে বলে ভেবেছি যে মেয়েটাকে, অভাবের তাণ্ডবে সেও বেতমিজ ঘোড়া। তার বাড়ি যেতে চাওয়ার কারণটা বিলকুল সাফ। জৈগুন এখন উড়াল দিতে চায়। মুঠো ধরলেই জোয়ান মানুষের ধনী নজর... বৈদর এখন তার কাছে হবেই তো ফুটো পয়সার শামিল।
ক'দিনই দেখলাম আবু মিঞা আর মাস্টার চাচা বারান্দার জলচৌকিতে বসে ঠ্যাং নাড়ে, আর একটু বাদে বাদে জৈগুনের মিঠা হাতের পান আসে।
মাস্টার চাচা বলে : তে উডি বৈদর। বাইর অইবা?
কী বাইর আইয়াম চাচা। মিজাজ বড় খারাপ।
কী হইছে গো ভাইস্তা? ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে মাস্টার চাচা পুছ করে।
বৈদর তখন জানায় ঘরে বাজার নাই। জৈগুনের ভারি শখ ছিটকাপড়ের শাড়ি পিনব। তার হাত একদম খালি। শখ থাকলেই কী?
মাস্টার চাচা কন্ট্রাক্টরি করে। এই কথা শুনে তার ভাসা ভুঁড়ি হাসির তরজলায় দুলতে থাকে। পকেট থেকে তিনটা নোট বের করে দিয়ে বলে : আইজই কিইন্যা আনো। ট্যাহা নাই, একটা কথা অইল? নিজের মানুষ আমরা আছি কী কারণের লাইগ্যা?
ময়নার চরিত্রের হিসাবটা গলতি হয়ে যায়। অভাগী গুণ্ডা কালুকে ভালো পথে আনার চেষ্টা করেছিল, না পেরে দুঃখে-শোকে, হাহাকারে শুকিয়ে কাঠি হয়ে মরেছিল। জৈগুনের মতো ঘোমটা দিত। কথা বলত কম। বুকভরা মমতা ছিল। কিন্তু জৈগুনের মতো বলছি কেন? জৈগুন কি এই রকম?
সন্ধ্যার পরে পরেই দেখলাম আবু মিঞা, মাস্টার কন্ট্রাক্টার আর একজন নয়া লোক বারান্দায় বসে চা পিতে পিতে রঙ্গরসিকতা করছে। এশার নামাজের আজানের পরে আবু মিঞা, নয়া মানুষটা আর বৈদর উঠল। ওরা কথা বলতে বলতে বনমালী পাঁড়ের ডেরার বাঁ-হাতি গলি দিয়ে নজরের বাইরে চলে গেল। বুঝলাম ঘরের ভিতরে যে মানুষটা কাঁপা হাতে সিগারেট ফুঁকছে আর ফিসফিস হাসছে, এই মাস্টার কন্ট্রাক্টরই জৈগুনের মানুষ, সে-ই আজ ঘরের বাতি নিভাবে।
বেওকুফ কালুর খুনের ভিতর ময়না বৌ তড়পাচ্ছিল। আমার ঘরের সাড়ে তিন হাতের ওধারে যারা আছে তারা অস্থির। দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনলাম। বাতি নিভল। আমি বেহুঁশ টেক্কার মতো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। শুনছিলাম। চৌকির ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ শুনলাম, ভারী একটা দমের হাঁসফাঁস শুনলাম। তারপর সব থামল। কিন্তু আরে আরে, আরে... জৈগুনের তো হাত-ভরা রেশমি চুড়ি, চুড়ির আওয়াজ শুনলাম না তো।
: যা বে শালা, ভাগ।
: অবিশ্বাস করলা? আল্লার কিরা মাইরি।
: ফির?
ইচ্ছে হয় ক'টা ওজনদার গোত্তা দিয়ে বজ্জাতের তিরপল পিঠটা লোকসান করে দিই। মহল্লার পোলাপান না ভাবে তাহেরি, তাই ক্ষেমা দিলাম। তবে সুলতান বুঝল ঝুটমুট টাইম খারাপ করাটা ভালো হয়নি। কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়ল।
কুয়োতলায় রগড় করছিল বাতাসী আর মজিদী। ছেমরা বয়সের লোকমান পানের দোকানে বসে গান লাগিয়েছে আর লাল-চকচক পিরানের জেল্লা দেখাচ্ছে। পথের একধারে বনমালী পাঁড়ের তুলসীগাছ। দুটো মুরগি তুলসীগাছতলায় ঘুরছে আর কটকট শব্দ করছে। তারও পেছনে, বোধ হয় ভিড়ের ভয়ে কলসি হাতে জবুথবু দাঁড়িয়ে আছে বউটা_বৈদরের বউ জৈগুন।
বায়োস্কোপের বাহাদুর হয়ে লোকমান এগিয়ে আসে। বলে : কী হইচে, পানি লিবার আইচ?
বউটা কোনোমতে মাথা নাড়ে। বোধ হয় ডর লাগল।
: এই বাতাসী চাচি...
লোকমান চেঁচিয়ে বলে : হালায় পাইচ কী? দেখতাচ না মানুষ খাড়া। জলদি জলদি করো না...
: লে, লে ছেমরা...
বাতাসী খেপে গিয়ে দুই হাতে উল্টি কাটে। বলে : তেরিবিরি করবি তো দিব এক চটকনা।
: আবে কয় কী? কইলাম ভালার লাইগ্যা।
লোকমান কুৎসিত গালি দিয়ে ওঠে। চেঁচামেচির আওয়াজ পেয়ে মজা লুটার জন্য দোকানের হীরু, সুলতান উঁকি মারে। ঝগড়াটা তুমুল হয়ে ওঠে। একসময় নজর করে দেখি আসল মানুষ নাই। বউটা পালিয়েছে।
পালাবে জানতাম। আমারই ঘরের তিন হাত দূরে ওরা আছে দেড় বছরের ওপর। পিয়ন বৈদর আলীর বউ। এই পর্যন্ত যা দেখেছি তাতে আমার হিসাব গলতি হওয়ার না। এইসব মেয়েমানুষ কেবল সুখের ইস্তিরিই না, আপদ-বিপদের বউও। বাতাসী, মজিদী, অগুনীর মা, এদের কারোর সাথে মিল নাই। এক মিল ছিল কালু মিঞার এক নম্বরের বউ ময়নার সাথে। হ্যাঁ, ময়নার সাথেই মিল। ছুরতে না হোক, খাসলতে। সুলতান, হীরু, এমনকি লোকমান ছেমরা পর্যন্ত বউটার ভরা গা-গতর দেখে লোভে চুকচুক করে। কিন্তু ওরা যদি জানত এই ধরনের মেয়েমানুষের ঘোমটায় ফাঁকি নাই। জানলে সুলতান ওমন গিল্লা গাইত না ভালোমানুষ বউটার নামে।
ময়নাকে বোধ হয় বেমালুম ভুলে যাচ্ছিলাম। ঐদিন দুপুরে জৈগুনকে দেখে ময়নার ছবিটাই মনে পড়ে গিয়েছিল। ময়নার মতো এও দেখি কপাল তক ঘোমটা দেয়। হাঁটে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে। মাগির খাসলত ভালো, কথা বলে কম। একচলি্লশ বছরের বুকটায় তিয়াস লেগেছিল। না, ওই পাড়ার ফুলীদের গা-গতর থেকে সুখ-সুড়সুড়ির যে তিয়াস মিটাই, এই তিয়াস না। এর রকম আলাদা। স্বাদ আলাদা। চৈত মাসের তেজি খরায় গাঙের তলায় ডুব দিতে যেমন মন চায়, আশ্বিন মাসের মাঝরাত্তিরে কড়ই গাছের নিচে ভরা-ঘুমের চোখ নিয়ে শুতে যেমন ইচ্ছা করে, এই তিয়াস সেই তিয়াস। সুলতান হারামজাদা এ বুঝবে না। বুঝলে আমি অমন শক্ত ইট, আমার কাছে কাঁচা গুলের বলটু ভাঙতে আসে!
সুলতান বলে : ওস্তাদ, ধবধবে ছিল্কের ছাড় আর বেলাউজ পরছে... আর হাটে কেম্তে.. কোমর লাড়িয়ে লাড়িয়ে,... দেখ,... এম্তে...
এটা পয়লা দিনের বাৎচিত। আড় ইশারায় মানা করেছি। খবিশটা জবর বজ্জাত, বুঝেও বুঝল না। ঘরে তাস পিটছিল মালু মিঞা, চুনীলাল বাবু, সব ওর ঢঙ দেখে হেসে উঠল। আমি কী করি, বেরিয়ে এলাম।
বেইজ্জতি আমার না। তবু মনে লাগে। ময়না তো আর কারোর বউ ছিল না। ওরে বললে লাগত না আমার? ময়নার মতোই একটা বউ মহল্লার ভেতর পাখ গুঁজেছে। একেবারে আমার ঘরের তিন হাতের ভিতর। লাগালাগি চাল। সিলিংয়ের ফোকরে চোখ রাখলে এই ঘর ওই ঘর দুই-ই ঝকমক ফর্সা। দেখছি তো দেড় বছর নাগাদ। এখন তখন, সকাল বিকাল_সব সময়। কই, ও রকম কিছু দেখলাম না তো। তুই শালা সুলতান, তোর ডেরা আর দোকান ও মোড়া, এসব তোর নজর পড়ল কোন্ সময়? বল্, বল্, খাঁটি কথা বল্। কিরা কাটো, আর মানুষের ছিদ্দত গাও, তুমি শালা বেতমিজ, তোমার কথা বিশ্বাস করি আমি?
না, বিশ্বাস করি না। আরে, আমিই তো একদিন বাসের তেলের বোতল নিয়ে ঢুকেছিলাম বৈদরের ঘরে। বৈদর তখন ছিল না। দুই পাইটে ডুবে গিয়ে দিল একদম জাঁহাবাজ লুচ্চা। বউটাকে বোতল দিতে গেলাম। এ্যাহ শালা,_দেখি পায়ের উপরে কদমবুজি মারে। কয় ভাইছাব। বাইরে এসে বোতল দিলাম ফুলীকে। হাসতে হাসতে বাঁচি না। আমাগো এই মহল্লায় বৈদরের মেয়ে মানুষটার সাথে আর কারো মিল নাই। ঘোমটা-পরা একদম বৌমানুষ। নিজের চৌকির ওপর শুয়ে শুয়ে ওদের দিল-রৌশন বাৎচিত শুনি আর হাসি।
বৈদর বলে : রাখ্ না,... খাড়া। সামনের মাসটা আইলেই তরে গলার পাডা বানায়া দিয়াম।
: এ্যাহ্... খালি ত কথা। জৈগুন হাসে।
বৈদর কিরা কাটে : দয়াল্লা। দিয়াম বানায়া কইলাম ত, বিশ্বাস করস না কেরে?
: অইছে...
জৈগুন হাসে,_অইছে, গপ্প থুইয়া এহন খায়া লও। কুপিত তেল পুড়তাছে।
: পুড়ুক।
: কী কইলা?
: কইতাছি তেল পুড়ুক। পয়সা যায় যাইব আমার। তর কী।
এইসব মিল-মহব্বত যখন থাকে তখনকার আলাপ। এ ছাড়া মাঝে মাঝে জিনিসপত্র ভাঙার আওয়াজও শুনি। বৈদর রেগে গেলে পাতিল ভাঙে, বাসন ভাঙে, বউয়ের চুল ধরে পিটায়। বউটা গলা চেপে কাঁদে। জোরে কাঁদে না, যদি মহল্লার মানুষের মজার খোরাক হয়। বৈদর বলে : কতবার কই, হুনস না কেরে? জৈগুন বলে : এইতান মাইনসের লগে আমি কথা কইতে পারতাম না।
: আরে বজ্জাত।
বৈদর গাল দেয় : এইতান মানুষ কই দেখলি? আবু ভাই, মাস্টার চাচা, এরা তর এইতান মানুষ অইল? আচ্ছা কও দেহি, এরা কী মনে করবো।
বুঝি সবই। বৈদরের আত্মীয়স্বজন বেড়াতে এলে জৈগুন ওদের সামনে শরমে বেরোয় না। কথা কয় না। বৈদরের তাইতো রাগ। কিরা খেয়ে বলে : রাখ্, তরে বাড়িতে পাডায়া লই...
জৈগুনের চাপা কান্নাটা এই কথার পরে বেড়ে যায়। বাড়ি যেতে জৈগুনের যে অনিচ্ছা, এটা বুঝতে কষ্ট হয় না। ওষুধে কাম দিয়েছে টের পেয়ে বৈদর বারবার কথাটা জোর দিয়ে বলে। জৈগুন বাদ-প্রতিবাদ করে না। চাপা কান্নাটা একটু একটু জোরদার হয়ে পরে আস্তে কমে যায়। তলানিটুকু থমথম করে জৈগুনের ঠোঁটে, পানি-ধোয়া লাল-চোখে আর ঝিম-মারা শরীরে। রাত বাড়ে একটু একটু। বৈদর বলে : খোদায় আর শান্তি দিল না।
বলে বোধ হয় জবাব আশা করে। কিন্তু জৈগুন একদম চুপ। বৈদর উশখুশ করে। অতটা রেগে গিয়ে যা কাণ্ড করল, সেটা মানাবার মতো আর কায়দা পাচ্ছে না। বিছানার এপাশে-ওপাশে শুয়ে... কিংবা ঝটকা মেরে উঠে বসে দুই হাতে মশা মেরে, ঊরশ মেরেও যখন দেখে এসবে ফল নাই, আর এক পক্ষ এই গর্মির অর্থ বুঝছে না, তখন বৈদর ভাঙা-গলায় বলে, আচ্ছারে জৈগুন, তার আসল নাম না কী?
: জানি না।
: জানস, জানস...
বৈদর একগাল হাসে, বলে, ক'না হুনি। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বলে : বাত্তিডা নিবায়া দেই?
: না, আমারে বাড়িত পাডায়া দাও।
বৈদর হি হি হাসে। বলে : আরে ধুর। এইডা তুইন বিশ্বাস করছস_তরে বাড়িত পাডায়াম আমি।
টের পাই পীরিতের হাত গিয়ে মিলেছে আদরের শরীরে। ক্বলব আর লহুর ভিতর পাইট কি পাইট নেশার দঙ্গল। জৈগুনের বেচান স্বরটা বারবার ফিসফিস করে বলে : না আমাদের বাড়িত পাডায়া দেও, হেইডাই তো চাও তুমি! দেও, পাডায়া দেও...
: দয়াল্লারে জৈগুন। এইডা একটা মিছা কথা। আইচ্ছা যা, এইরহম কথা আর কইতাম না।
বৈদর প্রাণপণে বুঝাতে চায়। জৈগুন তার পরও কিছু বলে। বৈদর জবাব দেয়। কথাবার্তা ছাপিয়ে শোনা যায় চোরা নিশ্বাসের ওঠানামা। বাতি অনেক আগেই বুজানো। কথাবার্তা আর কিছু শুনি না। বদলে টুংটাং করে আর একরকমের মিঠা আওয়াজ। যে যে রাতে ওদের টাইমের সাথে আমার টাইমটা মিলে যায়, সে সে রাতেই আওয়াজটা শুনি। কখনো কমতি, কখনো বাড়তি। হাতের ক'টা চুড়ির বাজনা জৈগুনের দিলভরা রোশনীর জানান দেয়। বুকভরা পীরিতির মধুর গীত বাজায়। ময়নার মতো জৈগুনও যে সব দেয় আওয়াজটা তারই নিশানা। আমার মতো আর কেউ হলেও বুঝত মহব্বত ছাড়া আন্ধার বিছানায় আর যা-ই হৌক মেয়েমানুষের হাতের চুড়ি বাজে না। কক্ষনো না।
আমি জানি সবই। পিয়ন বৈদরের বৌ জৈগুনের গা-গতর বৈশাখ মাসের চানি্নর পশর কি না, সুলতান, হীরু, চুনীলাল ওদের দিল বেকারার। আমি তিন হাত তফাতের পড়শী, তাই আমার কাছে আসে বাও নিতে। বউটার উপর নজর দিলে কী হবে, যতক্ষণ ঘোড়েল কালুর কবুল না আসে ততক্ষণ তো সব মিছা। কোনো বুলবুলির ক্ষেমতা নাই ধান খায়।
আমি ফুলির ঘরে গিয়ে কাবলিসি করি। দিল্লাগি করি। পাইটের পর পাইট মেরে লুচ্চা বনি। কিন্তু যা-ই করি আমার এক নম্বরের বউ ময়নার কথা ভুলি কীভাবে? ওদের টাইমের সাথে টাইম মিলে গেলে নিজের চৌকিতে শুয়ে জৈগুন আর বৈদরের বাৎচিত শুনি। ওদের রগড় দেখি, মিটিমিটি কাইজা-ফ্যাসাদের খবর পাই। মিঠা বুলি শুনি জৈগুনের হাতভরা রেশমি চুড়ির। তারপর সব বিলকুল সাফ। আমি হাসি। নিজের মনে হাসি। যা ব্যাটা দ্যাখ্। ও হল বৌ মানুষ। ফুলি না, আতরজান না।
এসব ভাবতে ভাবতে রাতে বোধ হয় মেজাজের তাল কেটে গিয়েছিল। দেরিতে ঘুমিয়েছি। উঠেছি পরদিন ন'টায়। মাথাটা ভার-ভার। কেওয়ারের ফাঁক দিয়ে নজর ঘুরিয়ে দেখি, পাহাড়ি স্নোর বিজ্ঞাপনের ছুড়িটা ঠোঁটে বেদাগ হাসির সওদা নিয়ে হাসছে। উঁচু পোস্টার থেকে আসমানটা ঢালু হয়ে নেমেছে গাছগাছালি, বাড়িঘরের ছাদে, ওখান থেকে রহমতের মসজিদের গম্বুজে।
দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি আর এক তাণ্ডব। মসজিদের বাঁহাতি গলির পূর্বদিকে সুলতানের দোকান, দেখি_দোকানের বারান্দায় গোল হয়ে বসে সুলতান, চুনীলাল, শব্দর আড্ডায় গুলজার। আমাকে দেখেই ভেতরে সরে পড়ল। উল্টোদিকে নজর ঘুরিয়ে ব্যাপার ধরতে কষ্ট হয় না। জৈগুন নিচু হয়ে নিজের ঘরের বারান্দা সুড়ছে।
ইচ্ছে করছিল, জোর বকুনি লাগিয়ে কমবক্ত ক'টা খলিফাকে রাবিশ করে দিয়ে আসি। পরে থামলাম। বেহুঁশ টেক্কা হয়ে লাভ নাই। এক গোয়ালের জানোয়ার তো কালু মিঞাও। এখন সদ্দারীর কবজির জোর দেখাই, পরে সন্ধ্যার পরে যখন রঙের তাস নিয়ে দাপাদাপি করব, ইয়ারি করব, তখন? ইয়ার-দোস্ত দুশমনি করলে, মুখ ব্যাজার করে রাখলে দিল্লাগি হবে, টাইম চলবে?
গুলি মারো জোরসে। ওসব তাহেরীর ধার ধারি না। একচলি্লশ বছর দুনিয়া দেখে দেখে কালু মিঞা একদম ইরানী ছুরির ঝকঝক ফলা। দিলে মরছে কবুল করব সেই দিন, যেদিন গা-গতরে লহুর বদল পিঁচুটির পানি পচবে। এখন রঙের মৌজ উড়াও, খালি দেখো বেইমানি না হয়। হ্যাঁ, সাফ মাথায় বেইমানি, অধর্ম যে করে করুক, কালু করবে না। ওটা বাদ দিয়ে, ওটা সমঝে-সুমঝে যত খুশি ডু ফুর্তি, মানা নাই।
ফুর্তি করার একটা টাইমেই বোধ হয় রোনাজারিটা শোনা গিয়েছিল। কালু মিঞা তখন গলায়-ঢালা মালের মেজাজে নিজেই গরম শিককাবাব। চেতন আসার পর রোনাজারিকে মনে হয়েছিল জারে পাওয়া বাচ্চা কুত্তার কেঁও কেঁও। তারপর গলাটা চেনা গেল। কাঁদছে জৈগুন। বৈদরও চুপকে নেই। চেল্লাচ্ছে : চুপ, চুপ।
কাঁদতে কাঁদতে জৈগুন বলে : তুমার দুইডা পাও পড়ি গো! আমারে বাড়িতে পাডায়া দাও। আমি আর পারতাম না।
: এ্যাহ্, বাড়িতে পাডায়া দেও...। কন্টলের চাউলের ভাত বুঝি পছন্দ অয় না? পডের বিবি অইছস...
: হায় গো আল্লা, আমি কী করি... আমার মরণ নাই!
জৈগুন কাঁদতে থাকে।
ঝিলিক লাগে। এই কী কাণ্ড! রাতদুপুরে মেয়েটা কান্দে কেন? বাড়িতে তো জৈগুন কোনোদিন যেতে চায় না।
থাকতে না পেরে পরদিন বৈদরকে পুছ করে বসলাম : রাইতে বউ কানছিল ক্যা? বেমার-টেমার অইছে নাকি!
বৈদর বিড়ি টানতে টানতে বলল : কপাল গো কালু ভাই, সব গরিব মাইনসের কপাল।
হ্যাঁ, বৈদর গরিব। বেতন পায় তেষট্টি। বাড়িভাড়া গিয়ে থাকে ছাপ্পান্ন, এই ছাপ্পান্ন টাকায় চাইল, ডাইল, তেল, নুন, মরিচ কেনার পরও আছে কাপড় কেনা, ওষুধ, রঙ-ফুর্তির বিড়ি খাওয়া, হ্যাঁ, চলে না। তা বাবা, এই মহল্লায় চলে কার? সবারই তো চাল ফুটো, নকল রঙের মিঞা সব। চলে না তো চলে না। এর জন্য রোনাজারি আর চেল্লাচিলি্ল কেন?
কান্নাটা আরও ক'দিন শুনলাম। জৈগুনের এককথা, বাড়ি যাবে। বৈদর গালিগালাজ করে। কখনো রেগে গিয়ে ধরে পিটোয় বৌকে। জৈগুন হামেলা মেয়েমানুষের মতো গলা গুঁজে কাঁদে। শুনতে শুনতে কান পচে যাবার জোগাড়। ঘরে থাকলে সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা বরবাদ। বুঝি আর সইছে না। এদিকে আমিও কামাই-শোধ মানুষ, বুঝি, বৈদর কী করবে।
এই মহল্লায় কার কী করার আছে, বরাতের ভাগীদার সব শালার অবস্থা সমান। সব ভাতের কষ্টে বেইজ্জত। পিয়ন বৈদরের তবু তো তেষট্টি টাকার একটা উপায় আছে, অনেকের তাও নাই। রাত পুইলে খোদার ফজলে দিন চলে।
কত ফিকির করি, আমারই একলা একটা কিসমতের রুজি হতে চায় না। একদিন অবাক হয়ে দেখি, বৈদরের গায়ে দামি পিরহান। আর একদিন দেখি, রিকশা থেকে নামল। ঝুপড়িতে রকমারি বাজার। ব্যাপারটা কী!
সুলতানও একদিন বলতে চেয়েছিল। ওস্তাদ, বৈদর মিঞার বউয়েরে দেখলাম বায়োস্কোপে যাইতেছে। আবে পরছে কী জানো? ছিল্কের ছাড়ি... বেলাউজ বি ছিল্কের...
ধমক দিয়েছিলাম আড় ইশারায়। সুলতান মানা শোনেনি। সিল্কের শাড়ি পিন্দনে জৈগুন কীভাবে হাঁটে দেখিয়েছিল। মালু মিঞা বলেছিল, কও কী মেঞা, পিয়নের বউ, হে বি ছিল্কের শাড়ি পিন্দে?
: বুঝলা না...
সুলতান রস লাগিয়েছিল : চান্দিত্ চুল নাই, বগলে আউসের বাবড়ি।
চুনীলাল, মালু, শব্দর হো হো করে হেসে উঠেছিল।
আজব দুনিয়া। পাইটের মেজাজে দিলখোশ কালুর কলবের বেইমানির মতো বেইমান দেখি সবাই। এই ক'দিন আগে বৌ বৌ মেয়েটার ইজ্জতের সওয়ালে সুলতানকে ধমক দিয়েছিলাম, এখন দেখি ওই ধমকটা কালু মিঞার বেওকুফ জিন্দিগির কামাই। আমার আর বুঝতে কিছু বাকি নেই। ময়নার সাথে মিল আছে বলে ভেবেছি যে মেয়েটাকে, অভাবের তাণ্ডবে সেও বেতমিজ ঘোড়া। তার বাড়ি যেতে চাওয়ার কারণটা বিলকুল সাফ। জৈগুন এখন উড়াল দিতে চায়। মুঠো ধরলেই জোয়ান মানুষের ধনী নজর... বৈদর এখন তার কাছে হবেই তো ফুটো পয়সার শামিল।
ক'দিনই দেখলাম আবু মিঞা আর মাস্টার চাচা বারান্দার জলচৌকিতে বসে ঠ্যাং নাড়ে, আর একটু বাদে বাদে জৈগুনের মিঠা হাতের পান আসে।
মাস্টার চাচা বলে : তে উডি বৈদর। বাইর অইবা?
কী বাইর আইয়াম চাচা। মিজাজ বড় খারাপ।
কী হইছে গো ভাইস্তা? ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে মাস্টার চাচা পুছ করে।
বৈদর তখন জানায় ঘরে বাজার নাই। জৈগুনের ভারি শখ ছিটকাপড়ের শাড়ি পিনব। তার হাত একদম খালি। শখ থাকলেই কী?
মাস্টার চাচা কন্ট্রাক্টরি করে। এই কথা শুনে তার ভাসা ভুঁড়ি হাসির তরজলায় দুলতে থাকে। পকেট থেকে তিনটা নোট বের করে দিয়ে বলে : আইজই কিইন্যা আনো। ট্যাহা নাই, একটা কথা অইল? নিজের মানুষ আমরা আছি কী কারণের লাইগ্যা?
ময়নার চরিত্রের হিসাবটা গলতি হয়ে যায়। অভাগী গুণ্ডা কালুকে ভালো পথে আনার চেষ্টা করেছিল, না পেরে দুঃখে-শোকে, হাহাকারে শুকিয়ে কাঠি হয়ে মরেছিল। জৈগুনের মতো ঘোমটা দিত। কথা বলত কম। বুকভরা মমতা ছিল। কিন্তু জৈগুনের মতো বলছি কেন? জৈগুন কি এই রকম?
সন্ধ্যার পরে পরেই দেখলাম আবু মিঞা, মাস্টার কন্ট্রাক্টার আর একজন নয়া লোক বারান্দায় বসে চা পিতে পিতে রঙ্গরসিকতা করছে। এশার নামাজের আজানের পরে আবু মিঞা, নয়া মানুষটা আর বৈদর উঠল। ওরা কথা বলতে বলতে বনমালী পাঁড়ের ডেরার বাঁ-হাতি গলি দিয়ে নজরের বাইরে চলে গেল। বুঝলাম ঘরের ভিতরে যে মানুষটা কাঁপা হাতে সিগারেট ফুঁকছে আর ফিসফিস হাসছে, এই মাস্টার কন্ট্রাক্টরই জৈগুনের মানুষ, সে-ই আজ ঘরের বাতি নিভাবে।
বেওকুফ কালুর খুনের ভিতর ময়না বৌ তড়পাচ্ছিল। আমার ঘরের সাড়ে তিন হাতের ওধারে যারা আছে তারা অস্থির। দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনলাম। বাতি নিভল। আমি বেহুঁশ টেক্কার মতো অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। শুনছিলাম। চৌকির ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ শুনলাম, ভারী একটা দমের হাঁসফাঁস শুনলাম। তারপর সব থামল। কিন্তু আরে আরে, আরে... জৈগুনের তো হাত-ভরা রেশমি চুড়ি, চুড়ির আওয়াজ শুনলাম না তো।
No comments