কবি by সৈয়দ শামসুল হক

কবি আবদুর রব মুনশী ১৩৭০ সনের ২রা বৈশাখ তাঁর জন্মগ্রাম তামাই, পাবনায়, পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র আটচলি্লশ বৎসর।
আজ সাহিত্যের দরবারে তাঁর কাব্য সংগ্রহ পেশ করবার মুহূর্তে কয়েকটি কথা বলতে আগ্রহ বোধ করছি।


আমি পেশাদার সমালোচক নই, সম্পাদক নই, সাহিত্যের কারিগরি নিয়ে গুছিয়ে দু'কথা বলি এমন অনুশীলন আমার নেই; আমি মুনশী সাহেবের জীবনের কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করব মাত্র। সম্পাদক-শোভন ভূমিকা হয়তো এটি হবে না, কিন্তু তাতে বিরত বোধ করছি না; কারণ আমার বিশ্বাস তাঁর রচনার চেয়ে তাঁর জীবন সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্টতর, নিকটতর। সাগর সৈকত যে বালক বালির দুর্গ নির্মাণ করে, সে দুর্গের নির্মাণ কৌশলের চেয়ে বালকের আনন্দ-বিকাশ আমার কাছে অধিক মূল্যবান।
সে আজ থেকে বছর দশেক আগের কথা। আমার প্রথম গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে। তার নামোল্লেখ না করেই বলি, বইটি ছিল নিতান্তই প্রথম প্রয়াস। আজ পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, সে বইটিকে নিয়ে বালিশের নিচে নিয়ে কত বিনিদ্র রাতই না যাপন করেছি, কত সুরসিক, প্রাজ্ঞ সুরুচিবান পরিচিত শ্রদ্ধেয়কেই না আশংকিত হৃদয়ে, অকল্পিত হাতে উপহার দিয়েছি সে বই।
তখন আমি কোথাও বেরুলে সে বইয়ের কয়েকটি কপি আমার সঙ্গে থাকত। যিনিই আন্তরিকতা নিয়ে দু'দণ্ড কথা বলতেন, তাঁকেই এক কপি বই উপহার হিসেবে লিখে দিতাম।
তখন কবি আবদুর রব মুনশীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। দীর্ঘকাল পরে আমি সেবার ফুফুজানের বাড়িতে গেছি। ফুফুকে দেখার চেয়ে গ্রাম দেখার ইচ্ছেটাই ছিল প্রবল।
গ্রামটি সত্যিই গ্রাম। শহর থেকে প্রায় সতের মাইল দূরে, এক টেরে পড়ে আছে। সেখানে যাবার কোনো সরকারি বা নিয়মিত সড়ক নেই। বর্ষায় এক রকম পথ, গ্রীষ্মে আরেক রকম। ফুফা সাহেব সাইকেলসহ লোক পাঠিয়ে দিয়েছিলেন শহরের রেল স্টেশানে। গ্রামে পেঁৗছুলাম যখন, তখন রাত এগারটা। হিসেবমতো সন্ধে নাগাদ পেঁৗছে যাবার কথা। কিন্তু পথে সাইকেল বিকল হয়ে যাওয়ায় বাকি পথ হাঁটতে হয়েছে এবং সে হাঁটাটা খুব গতিময় হয়নি; একে আমি গেঁয়ো পথ চলতে অনভ্যস্ত তার ওপর বিকল সাইকেলের ভার।
একটা খালের ওপারে আমার ফুফুজানের বাড়ি। খালটা ডিঙ্গি করে পেরুতে হবে। খালের এপার থেকেই দেখতে পেলাম ওপারে ছায়ামূর্তির মতো কয়েকজন উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পেঁৗছে দেখি ফুফা সাহেব উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আর তার পেছনে ফুফুজান অশ্রুসজল। পথের দুর্ঘটনা তৎক্ষণাৎ বিবৃত করলাম।
সেই রাতেই আবদুর রব মুনশীর নাম প্রথম শুনলাম। ফুফা সাহেব বললেন যে, মুনশী সাহেব সন্ধ্যে থেকেই অপেক্ষা করেছিলেন কখন আমি এসে পেঁৗছুব। তিনি শুনেছেন, আমি লিখে থাকি, আমাকে দেখতে চান। এবং সেই খাওয়ার আসনেই জানতে পেলাম মুনশী সাহেব কবিতা লেখেন, গান বাঁধেন। ফুফা সাহেব বললেন, কাল একবার আসবে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে।
আমি খুব রোমাঞ্চিত বোধ করেছিলাম, মনে আছে। সেটা সম্ভবত এইজন্যে যে, আমি লিখি শুধুমাত্র এই কারণে একজন আমার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। আমার যতদূর মনে হয়, আবদুর রব মুনশীই প্রথম মানুষ যিনি লেখক হিসেবে আলাপ করতে এগিয়ে এসেছিলেন আমার কাছে।
কিন্তু পরদিন তিনি এলেন না। তারপর এক সপ্তাহ চলে গেল, তাঁর সাক্ষাৎ পেলাম না। আমি মাঝে মাঝেই ফুফু সাহেবকে তাঁর কথা জিগ্যেস করতাম, তিনি বিরক্ত বোধ করতেন। বলতেন, মুনশীর কথার ঠিক নাই। দ্যাখোগা কোথায় আসর জমাইয়া বসেছে। তোমরা কবিরা হইলা গা পাগল ছাগল মানুষ।
আমি স্মিতহাস্যে উপহাসটুকু ঢাকবার চেষ্টা করতাম। গ্রামের সামাজিকতা আমার জানা ছিল না। শুনলাম, মুনশী সাহেবের বাড়িতে আমি নিজে গেলে তা ফুফা সাহেবের সম্মানহানির কারণ হবে। ফুফা অবস্থাপন্ন মানুষ, মুনশী সাহেব মাত্র কয়েক বিঘে জমির ওপর নির্ভর করে চলেন, এক্ষেত্রে কোনোমতেই তাঁর বাড়িতে আমার যাওয়া সাজে না।
মনের মধ্যে মুনশী সাহেবের জন্যে আকর্ষণ প্রবলতর হয়ে উঠল।
একদিন এক অভাবিত সুযোগ মিলে গেল। ফুফা সাহেবের এক চাচাতো ভাই ছিল আমারই সমবয়সী। তাকে আমি চাচা বলে ডাকতাম। অবস্থা ছিল গরিব, অতিকষ্টে শহরে কম্পাউন্ডারি পড়ছিল সে। তার সঙ্গে ডিঙ্গি করে সেদিন খাল বেয়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। লগি ঠেলছিল চাচা। যাবার কথা ছিল বউমারী বিল পর্যন্ত, সেখানে গিয়ে এই খাল মিলিত হয়েছে।
আমার সঙ্গে লেখার ব্যাগ। তাতে কাগজ, কলম আর আমার দু'কপি বই রয়েছে। গ্রামে এসে একটা কাজ করছিলাম, আর তা হচ্ছে চারদিকে দেখা গাছপালা লতা পাতা পাখির নাম আর বর্ণনা লিখে রাখা। লেখার ব্যাগটি তাই সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। উনিশ বছর বয়সে সাহিত্যের জন্যে তখন সবকিছুই জরুরি মনে হতো, মনে হতো সব কিছু ধরে রাখা কর্তব্য আগামী রচনার জন্যে।
এগিয়ে চলেছি বউমারীর দিকে। হঠাৎ চাচা বলল, দূরে একটা বাড়ি দেখিয়ে, ওটাই আবদুর রব মুনশীর বাড়ি। আগ্রহে চোখ তুলে তাকালাম। দূর থেকে জামগাছ সুপারিগাছ ঢাকা একটা টিনের চালা চোখে পড়ল। বার বাড়ির উঠোন খাড়া নেমে এসেছে খালের পানিতে। আমার চোখের সমুখে চলমান ডিঙ্গির প্রেক্ষিতে বাড়িটা একখণ্ড ছবির মতো চক্রাকারে সরে আসছে কাছে। চলো না, মুনশী সাহেবের বাড়ি যাই।
চাচা যেন অস্পষ্ট একটা ভঙ্গি করল নিষেধের। কিন্তু সেটা আমার চোখে ভুল হবে হয়তো।
বলল, যাইবা?
হ্যাঁ, চলুন না।
বাড়িতে আছে কি নাই।
চাচা সন্দেহের প্রকাশ করলেন। আমি যথাসম্ভব কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখবার চেষ্টা করে বললাম, তবু চলুন, দেখতে ক্ষতি কি!
ততক্ষণে খাল থেকে একটা উপখালে আমাদের ডিঙ্গি এসে ঢুকেছে। তার পাড়ে মুনশী সাহেবের বাড়ি।
বাড়ির ঘাটে ডিঙ্গি বাঁধল চাচা। আমরা খাড়া পাড় বেয়ে উঠে গেলাম ওপরে। পরিষ্কার করে ঝাড়ু দেওয়া বার-বাড়ি। দুটো বড় বড় জামগাছ বাইরের ঘরের রোয়াক ঘেঁষে উঠেছে। একটার নিচে বাঁশ দিয়ে বসবার মাচা বাঁধা হয়েছে। আরেকটা গাছের নিচে এক গাদা খড়ের স্তূপ। দুটো গাই অলসভাবে সেই খড় চিবোচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, খালের পানিতে মাটি ভাঙ্গার ঘুপ ঘুপ শব্দ। আর কিছু না। সমস্ত বাড়িটা নির্জন।
চাচা বেড়ার দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে গলা তুলে ডাকতে লাগল, অ কবিচা, বাড়িতে আছো না? অ কবিচা।
একটা শব্দ শোনা গেল। মানুষের গলা। কে একজন আধা প্রৌঢ় লোক বেরুল, তার খালি গা। পরনে একটা লুঙ্গি। আর কিছু না। কনুই পর্যন্ত দু'হাতে মাটি আর তুষের মাখামাখি। মাত্র একটি মুহূর্ত লোকটির চোখ পড়ল আমার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সে টেনে নিল, লুকিয়ে ফেলল, দ্রুত পায়ে চলে গেল ভেতরে। চাচা উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, অ কবিচা, গেলা ক্যান? দ্যাহো কেডা আইছে।
কিন্তু উত্তর আর এলো না।
কিছুক্ষণ পরে একটা ছোট্ট মেয়ে, ডুরে পরা, হাতে গুড়ের দলা, এসে চাচাকে বলে গেল, বসতে কইছে বাজান।
প্রায় আধ ঘণ্টা পরে বেরিয়ে এলেন কবি আবদুর রব মুনশী। পরিষ্কার করে ধোয়া একটি লুঙ্গি পরেছেন, গায়ে ছেঁড়া কিন্তু ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, তার উপরে গেরুয়া রঙের উড়ুনি জড়ানো, পায়ে কাঠের উঁচু খড়ম, মাথায় কিশতি টুপি। আমি তাঁকে হাত তুলে আদাব জানালে তিনি ভারি বিব্রত বোধ করলেন এবং আমার দিকে চোখ ফিরিয়ে চাচার ওপরে চোখ রাখলেন, নিঃশব্দে হাসলেন একটু, যেন আমি সেখানেই উপস্থিত নই। বললেন, বসেন, বসেন, ডাক্তার সাব।
কম্পাউন্ডারি পাস করার আগেই চাচা ডাক্তার হয়ে উঠেছে জেনে খুব আমোদ বোধ করলাম।
আমি মুনশী সাহেবকে দেখতে লাগলাম।
তিনি চাচার সাথে আলাপ তুললেন, তার ডাক্তারি কতদূর শেষ হলো, প্রসঙ্গ আনলেন স্থানীয় ইস্কুলের নতুন বাংলা মাস্টারের, অদূরেই গাই দুটো দেখিয়ে বললেন, আজকাল ছ'সের সাড়ে ছ'সের দুধ হচ্ছে।
আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অনুভব করছিলাম, আমার একটা কিছু বলা দরকার। বললাম, শুনলাম, আপনি কবিতা লেখেন।
না, কই?
আবদুর রব মুনশী সচকিত কণ্ঠে বললেন। তারপর হেসে ফেললেন যেন ধরা পড়ে গেছেন।
সংসারের কাজে সময় পাই না।
তারপর হয়তো ভাবলেন, এটাও যথেষ্ট বলা হলো না, লজ্জিত হয়ে যোগ করলেন, আমাদের রচনা আপনাদের ভাল লাইগবে? লেখাপড়া শিখি নাই, গাঁয়ে জামাল হোসেন বয়াতি আছিল আর আমার বাল্যকালে এক হেড মাস্টার খুব ভাল গদ্য রচনা কইরতো, তাঁদের দেইখা দেইখা নিজের হাউসে নিজেও রচনা করছি। মাইনষে অনর্থক আমারে কবি-সাব কয়। আমি কিছু না।
কথাগুলো একটানা পড়ে যাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর সেই কথনভঙ্গি আমি জীবন্ত করে তুলব কি করে? থেমে থেমে, হাতের নানা রকম ভঙ্গি করে, আমার দিকে না তাকিয়ে খালের অপর পাড়ে কয়েকটা চলমান মানুষের দিকে চোখ রেখে, তিনি কথাগুলো বলে গেলেন।
প্রতিবাদ করল আমার চাচা। বলে উঠল, দুরো। কবি সাবের রচনা তুমি দ্যাখো নাই। এমুন সুন্দর রচনা দশ বিশ গাঁয়ে কেউ কইরতে পারে না। এই অঞ্চলে কবিচার গান মাইনষে মুখে মুখে গায়্যা থাকে। তার পইদ্য ইস্কুলের সভায় আবৃত্তি করে গাঁয়ের ছাত্রেরা।
আমি বললাম, আপনার জন্যে আমার একখানা বই এনেছি। উপহার দিতে চাই।
এতকাল, আগেই বলেছি, বহুজনকে সামান্য আলাপের সূত্রে আমার বই দিয়েছি। আজ যেন বই দিতে গিয়ে মনের মধ্যে একটা অনির্বচনীয় আনন্দ বোধ জাগরিত হলো।
কম্পিত হাতে তিনি বইটা নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখ অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমার নিজ হাতে লেখা তাঁর নামটা অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন, তারপর পাতা ওল্টালেন, কয়েকটা পাতা ওল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চোখ যেন চিন্তামগ্ন হয়ে উঠল। হঠাৎ বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন এবং কিছু না বলেই বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।
চাচা বলল, চলো যাইগ্যা। সইন্ধ্যা হয়।
মুনশী সাহেব ফিরে এলেন। হাতে একটা পকেট সাইজের বই, সবুজ কাগজের মলাট। বললেন, একখানা বই ছাপিয়েছিলাম আমার।
বইটার নাম 'মনিহার'। নিচে এক তোড়া গোলাপের ছবি, মফম্বলের প্রেসে যে ছবিটা বিয়ের উপহারে সাধারণত ছেপে থাকে। তারও নিচে লেখা আবদুর রব মুনশী প্রণীত ও প্রকাশিত। ফুলস্কেপের আট ভাঁজ ছাপা বই, ভাঙ্গা টাইপের অযত্নে ছাপা। আশি পৃষ্ঠা। দাম দশ আনা। মুনশী সাহেবের প্রথম বই।
চাচা বলল, ক্যান, তোমার না আরাকখানা বই আছে?
বললাম, তাই নাকি? সেটা দিলেন না?
মুনশী সাহেব লজ্জিত স্বরে উত্তর করলেন, সেখান ঘরে নাই। কয়েকখানা গান দিয়া বইটি ছাপছি। আমার বড় ছেলে তা বিক্রি কইরতে গেছে সাতবেড়ের হাটে।
বিস্মিত হয়ে শুনলাম, প্রতি হাটে তাঁর গানের বই নিয়ে তাঁর বড় ছেলে বসে। তার কণ্ঠ খুব সুরেলা। সে গান গেয়ে বই বিক্রি করে যে কটি পয়সা পায় তা দিয়ে সওদা কিনে বাড়ি ফেরে। হাট ভাঙ্গবে রাত এগারটায়। মুনশী সাহেব বললেন, কাল সকালে তিনি সে বই আমাকে দিয়ে আসবেন। বাড়ির ভেতর থেকে মুড়ি মাখানো আর বেলের শরবত এলো।
সেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ আবদুর রব মুনশীর সঙ্গে।
রাতে এসেই কবিতার বইটা পড়ে ফেললাম। প্রায় সবগুলো কবিতা প্রকৃতি বিষয়ক, ঋতুকেন্দ্রিক। কিছু রচনা আছে যা ঈশ্বরের মহিমা বিবৃত করেছে। কিছুই রচনা কোনো এক রহসময়ী চিরসুদূরবর্তিনী রমণীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
পরদিন মুনশী সাহেবের কিশোর বয়সী বড় ছেলে এসে তাঁর গানের চটি বইটি আমাকে দিয়ে গেল। তাতে জীবনের অনিত্যতার সুর ধ্বনিত। প্রতিটি গানের ওপর তার রাগ রাগিনীও তালের নির্দেশ লেখা। আমি তাঁর ছেলেকে অনুরোধ করলাম যে-কোনো একটি গান শোনাবার জন্যে। সে বলল, সঙ্গে যন্ত্র নেই, পরে শোনাবে। আবার অনুরোধ করলাম। সে তখন গাইতে শুরু করল। আশ্চর্য দরাজ কণ্ঠ তার। প্রায় অপ্রত্যাশিত। সুরের অবলম্বনে কথাগুলো যেন ধুলোর ধরণী ছেড়ে মুহূর্তে অমর লোকের দিকে যাত্রা করল। খালে দুরন্ত পানির কুলুকুলু ধ্বনি সে সুরের সহযাত্রী হলো। আমার চেতনার মধ্যে সঞ্জারিত হয়ে গেল আকাশ-বাতাস-নদী জীবনের নেশা।
সেদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি ডিঙ্গি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মুনশী সাহেবের বাড়ির দিকে। এতদিনে আমি লগি চালানোর কৌশল অনেকখানি আয়ত্ত করে ফেলেছি চাচার কাছ থেকে। জানি, ফুফা সাহেব টের পেলে আমাকে বেরুতে দেবেন না, অপটু হাতে ডিঙ্গি বেয়ে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। কাউকে না বলেই বেরুলাম।
সেই সন্ধের কথাও ভুলতে পারব না। গোধূলির রক্তিম নীল আলোয় অত্যন্ত উদাস হয়ে এসেছে চারদিক। পেঁৗছে দেখি, যেন আমারই অপেক্ষায় কবি আবদুর রব মুনশী জামগাছের নিচে বাঁধা মাচার উপর বসে খালের দিকে তাকিয়ে আছেন। বড় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন দেখে, বললেন, একাকী এভাবে আমার ডিঙ্গি চালান মোটেই নিরাপদ নয়।
সেই প্রথম, খুব স্পষ্ট করে, আমি হঠাৎ একাত্মবোধ করলাম তার সঙ্গে। তাঁর কাছে আসাটা যে ফুফা সাহেব মোটেই পছন্দ করেন না তা মনে করে তীব্র এক দংশন বেদনার অনুভূতি সঞ্চারিত হয়ে গেল আমার ভেতরে। সমস্ত গ্রামে মুনশী সাহেব ছাড়া আর সব কিছুই আমার কাছে অসত্য অচেনা বলে মনে হতে লাগল।
আমরা দুজন চুপচাপ বসে রইলাম সেই জামগাছের নিচে। আস্তে আস্তে সমস্ত পৃথিবী অন্ধকার হয়ে এলো। দূরে অন্ধকার বিন্দু বিন্দু তিনটে চারটে আলো দেখা দিল। যেন তারা জানান দিয়ে গেল ওখানে মানুষ আছে, তার ঘর আছে। দুধেল গাই দুটো ডেকে উঠল একবার। চমক ভেঙ্গে মুনশী সাহেব উচ্চকণ্ঠে ছেলেকে ডাকলেন, 'গোয়ালে বাতিটা ধররে'।
তাঁর শঙ্কাকুল কণ্ঠ শুনে বিস্মিত হলে তিনি স্বাভাবিক সুরে বললেন, কখনো কখনো গোয়ালে সাপ আসে বাঁট থেকে দুধ চুষে খেতে। আমি শিহরিত হয়ে উঠলাম।
সেই সন্ধ্যায় বাস্তবের প্রতিটি শব্দ, ঘটনা, উপস্থিতি আমার কাছে জীবনের গভীর সত্যের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করতে লাগল।
তিনি আমাকে ফুফা সাহেবের ঘাট পর্যন্ত পেঁৗছে দিয়ে গেলেন নিজের লগি ঠেলে।
কয়েকদিন পর তিনি নিজে এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। ফুফা সাহেব এক অদ্ভুত মানুষ। মুনশীর বাড়িতে যেতে নারাজ, কিন্তু তিনি যখন এলেন, তাঁকে অভ্যর্থনা করলেন সহাস্য কণ্ঠে। বসবার জন্যে চেয়ার আনতে বললেন। তারপর আলবোলায় দীর্ঘ টান দিয়ে প্রশ্ন করলেন, কও কবি কেমন আছো। আমাদের কবির সাথে তোমার আলাপ হইছে?
অপ্রিয় সত্য বেরিয়ে পড়ার ভয়ে আমি বলে উঠলাম, হ্যাঁ, চাচার সঙ্গে হাটে গিয়ে দেখা হয়েছে।
ফুফা সাহেবের কাছে দরবারের জন্যে গ্রামের লোক এসে ঘিরে বসল। আমি আর মুনশী সাহেব তখন সেখান থেকে উঠে এলাম। এসে খালপাড়ে অন্ধকারে হাঁটতে লাগলাম নিঃশব্দে। আমার সেই চাচা এসে যোগ দিল। তখন দীর্ঘ নীরবতা ভাঙ্গল। চাচা জিগ্যেস করল মুনশী সাহেবকে, অর গল্পের বইটা পড়লেন?
সময় পাই নাই। পড়মু তো নিশ্চয়।
কিন্তু কেমন যেন আমার মনে হলো, তিনি আমার বইটা পড়েছেন কিন্তু এগুতে পারেননি। আমি যেন স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমি যে জগতের কথা, যে ভাষা লিখি, সে জগৎ সে ভাষা তার অজানা। মনে হলো, এই পরিবেশে আমার বইয়ের কথা একেবারেই বেসুরো। তাড়াতাড়ি বললাম, ও কথা থাক। বললাম, আপনার কবিতাগুলো আমার খুব ভাল লেগেছে। সেদিন আপনার ছেলে মুখে একটা গান শুনলাম।
হ্যাঁ, আমারে কইছে ও। একদিন বাড়িতে আসর কইরা আপনারে শোনাতি ইচ্ছে করে।
বেশ তো খুব ভাল হয়। আমি আসব। আপনার যে সব গান বইতে নেই সেগুলো শোনাবেন, নতুন কবিতা শোনাবেন।
মুনশী সাহেব নিঃশব্দে হাসলেন। নিজের লেখা সম্পর্কে তার সেই মধুর সংকোচ আমি আজও ভুলতে পারিনি। কেন যেন, সেই মুহূর্তে সেই সংকোচটাকে দূর করে দিতে ইচ্ছে হলো আমার। প্রসঙ্গ তুললাম, আচ্ছা, আপনার কবিতায় প্রকৃতির ছবি বারবার কেন আঁকেন? কারণটা কী? এ রকম প্রশ্ন শুনতে তিনি অভ্যস্ত নন। লোকে ভাল বলে, মন্দ বলে, কিন্তু এ আবার কী? অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলাম না। শেষে উত্তর করলেন, আমার প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিতে, কি জানি, আমার য্যান সমনে হয়, এই চাইর দিকে যা দেখি তা আমার পর না। আমি একটা কষ্ট পাইলে লতাডাও যেন কথা কইয়া উঠে। আমার একটা শুশি হইলে চারদিকে তার ছবি দ্যাখা যায়। আমি ভাবি, আমার বাপদাদাও এইসব দেইখ্যা গ্যাছে, এই লতাপাতা, ম্যাঘ-বাদল, চান-সূর্য, সব তারা দেখছে। তারা বইলা গ্যাছে। আমরা আসছি, আমরাও দেখতাছি। যারা চইলা গ্যাছে তারা মনডারে এই সবের মইধ্যে ছড়াইয়া দিয়া গ্যাছে। আমি যা রচনা করি সেই মেঘ-বাদল, চান-সূর্য, লতাপাতার কাছ থিকা শোনা কথা নিয়াই রচনা করি। তার নিজের ভাবটাকে মিশাইয়া দিবার চাই। আপনে আমার কথা শুইনা হাসতাছেন, যে পাগলে কি কয়? আঁ?
আমি তাঁকে দ্রুতকণ্ঠে আশ্বাস দিলাম, না, না, আপনি বলুন।
কিন্তু হঠাৎ যেন কোথায় বাধা পড়েছে। কিম্বা তার মনে হয়েছে আমি শহুরে শিক্ষিত মানুষ_আর তিনি গেঁয়ো, অশিক্ষিত। তিনি চুপ করে গেলেন। সে রাতে তাঁকে আর কিছুতেই মুখর করে তোলা গেল না। কেউ একটা ডিঙ্গি যাচ্ছিল বেয়ে। তিনি ডেকে শুধালেন, কে যায়? অন্ধকার খাল থেকে শোনা গেল, কেউ উৎফুল্ল কণ্ঠে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল, কবি সাব না? বাড়ি যাইবেন? তিনি বিদায় নিলেন।
এর দু'দিন পর ঢাকায় ফিরে আসি আমি। বর্তমান অতীত হয়ে যায়। অতীত হয় স্মৃতি। স্মৃতি থাকে নিদ্রিত। প্রসঙ্গের স্পর্শ না পেলে তার নিদ্রাহরণ হয় না। কবি আবদুর রব মুনশীর কথা তার মনের মধ্যে জাগ্রত থাকে না একদিন।
প্রায় বছর চারেক পরে আমার সেই চাচা এলেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য সরকারি চাকরির একটা ইন্টারভিউ দেয়া। আমার বাসাতেই উঠলেন, তিনিই একদিন কথায় জিগ্যোস করলেন, ভাল কথা। আবদুর রব মুনশীর কথা তোমার মনে আছে না? সেই কবি! এক মুহূর্ত স্মৃতির জগতে আলোড়ন তুলে উঠে এলেন কবি। প্রথম দিনের সাক্ষাৎ আমাকে দেখে বেশভূষা বদলানোর জন্যে তাঁর চলে যাওয়া, জামগাছের নিচে বসে থাকা, খালপাড়ের সেই রহস্যময় আলাপ একই সঙ্গে মনে পড়ল আমার। মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। কেমন আছেন তিনি? আর কবিতার বই বেরোয়নি তাঁর?
চাচা প্রথম প্রশ্নটাই বেছে নিলেন। একটু বিষণ্ন সুর ফুটে উঠল তার কণ্ঠে, না বিষণ্ন নয়, কেমন যেন অপরাধ বোধের ছোঁয়া তাঁর স্বরে; বললেন, ভালই আছে।
আমার মনটা অজানা আশঙ্কায় স্তব্ধহীন হয়ে উঠল। আস্তে আস্তে সব শুনলাম।
শুনলাম, গেল বছর ইলেকশানে দাঁড়িয়েছিলেন ঐ অঞ্চলের আলতাফ তালুকদার। চাচা জিগ্যেস করলেন, তালুকদার সাহেবের নাম আমি শুনেছি কি-না। বললাম, না। বললেন কেন আমি কি তাকে একদিন ফুফা সাহেবের বাড়িতে দেখিনি, তিনি এসেছিলেন? অধৈর্য হয়ে বললাম, সে কথা থাক, মুনশী সাহেবের কি হয়েছে তাই বলুন। তখন আবার তিনি বলতে শুরু করলেন। বললেন, তালুকদার সাহেব ইলেকশানে দাঁড়িয়েছিলেন। ফুফা সাহেব ছিলেন তার সমর্থক। তা ভোটের সময় কতো রঙেরই না প্রচার হয়, তুমি জান। পালা হয়, ভোজ হয়, সং বেরোয়, রং-বেরঙের নৌকা বেরোয়, গান বাঁধা হয়, সে গান হাটে হাটে গাওয়া হয়। ফুফা সাহেব কি কাজে খবর পাঠালেন দেখা করবার জন্যে। তিনি সেদিন আসতে পারলেন না। (ঘটনাটি সম্পূর্ণ শোনবার পর আমার মনে হয়েছে, আগে থেকেই মুনশী সাহেব আঁচ করতে পেরেছিলেন আর তাই আসেননি।)
পরদিন আবার লোক গেল তাঁর কাছে। তারা মুনশী সাহেবকে ডিঙ্গি করে নিয়ে এলো। ফুফা সাহেব বললেন, মুনশী, গান রচনা করা লাইগবে। শুইনছাও তো, তালুকদার সাহেব ইলেকশানে খাড়াইছেন। তারে পাস না করালি দ্যাশের আর মঙ্গল নাই। বুঝছ? দ্যাশের কাম বইলা তোমারে সম্মান করমু না তা না। তালুকদার সাব গুণীর মান রাইখতে জানে। আর আমার উপর কথা কি! কি_চুপ কইরা আছো যে! কোমর বাইন্ধা গান রচনা করো দেখি একখান।
আমার সময় নাই।
বজ্রপাতের মত শোনায় কবি আবদুর রহমান মুনশীর কণ্ঠস্বর। ফুফা সাহেব গর্জন করে ওঠেন, কী, কী কইলা?
কী আর কমু? সময় নাই সেই কথা কই।
মাথামুথা ঠিক আছে তোমার? এতবড় একটা কামে তোমার সময় নাই, সেই কথা আমার সামনে খাড়াইয়া কও?
চুপ করে থাকেন কবি।
তোমার মনের কথাডা কি কওছেন শুনি।
আমি গান রচনা কইরতে পারমু না।
ক্যান?
ফুফা সাহেবের দুচোখ ক্রোধে বিস্ময়ে ছোট হয়ে আসে। তাঁর কণ্ঠস্বর পাতলা ছুরির মত শোনায়।
মুনশী সাহেব উত্তর করেন, যে মানুষ না তার নামে গান রচনা কইরতে কন?
জবান সামলাইয়া কথা কইও, মুনশী। বনের মধ্যে বাঘের সামাল দিয়া পথ চলা লাগে। চোখমুখে বড় কথা কইও না। মানীরে মান দিয়া চইলো। যাও, কাইল সকালে তোমার গান আমি শোনবো। একখান থুইয়া দশখান শোনেন, আমি না করি না। কার জন্যে গান বান্ধি? আপনেরা দশজন আছেন, আপনেরা শোনেন বইলাই রচনা করি। এই অনুরোধ আমারে কইরেন না, খাঁন সাব। তালুকদার সাবেরে নিয়া গান রচনা আমারে দিয়া হবি না।
তুমি তাহলে রাজি না?
না।
তুমি ছাড়া দ্যাশে কবি নাই?
আছে।
কামডা ভাল কইরলা না, মুনশী। ভাইবা দ্যাখো, যা কইছো। এখনো মাফের ওক্ত আছে। কও কী কইরবা?
আমার কথা আমি কইয়া দিছি। যে ব্যাডা মানুষ না, যার হাত দিয়া গরিবের একডা কাম হয় নাই, যার প্যাডে এক মুখে আরেক কথা_আমি গান রচনা করমু তারে নিয়া? আপনে কন কি, খাঁ সাব!
শেষ কথাটি উচ্চারণের সময় মুনশী সাহেবের ঠোঁটে বোধ হয় বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠেছিল। আমার ফুফা সাহেব স্তব্ধ হয়ে ভাবলেন খানিক। তারপর চোখ তুলে বললেন, আইচ্ছা যাও।
সেলামালেকুম।
মুনশী সাহেব বেরিয়ে গেলেন। সালামের প্রত্যুত্তরটা পর্যন্ত পেলেন না। ফুফা সাহেব উপস্থিত সবাইকে শুনিয়ে বললেন, তোমারে আর গান রচনা করা লাগবি না, মুনশী। তোমার ওষুধ আমার জানা আছে।
ঘটনাটা শোনাতে শোনাতে চাচা বললেন, যাই কও মিয়া। ভাইসাব কামডা ভাল করেন নাই। না হয় নাই রাজি হছিল, তাই বইলা তার উপর অত্যাচার কইরবা তোমরা?
অত্যাচার বটে! পরদিন ভোরে দেখা গেল মুনশী সাহেবের ক্ষেতের ধানের বাড়ন্ত গাছগুলো কে নির্মূল করে কেটে নিয়ে গেছে। তার গাই দুটো একদিন মাঠ থেকে আর ফিরল না। তার ছেলে হাটে গানের বই বিক্রি করতে গেছে, তার সমস্ত বই কেড়ে খালের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। মুনশী সাহেবকে শাসিয়ে দেয়া হয়েছে, সে যদি গান বা কবিতা ভবিষ্যতে আর কোনদিন লেখে, আর তা শোনা যায়, তাহলে গ্রাম থেকে উচ্ছেদ করা হবে তাঁকে।
আমি বললাম চাচা, তোমরা গাঁয়ের জোয়ান ছেলেরা তার প্রতিবাদ করল না?
চাচা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বলল, গাঁয়ে তো থাকো না, হাল হকিকতও জানো না। আমরা কেউ মানুষ না।
শুনলাম আবদুর রব মুনশী আজ আর লেখেন না।
ব্যথিত হয়ে আবারো প্রশ্ন করলাম, যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, সত্যি তিনি লেখা ছেড়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ, এতো ভাল কবি আছিল। সব ছাইড়া দিছে। মাইনষের সাথে কথা পর্যন্ত কয় না আর। বোধ হয় মানুষকে কোনো না কোনোখানে নত হতেই হয়। কবি আবদুর রব মুনশী আর কবিতা লেখেন না, এর চেয়ে বড় পরাজয় আমি আর ভাবতে পারিনি সেদিন। তাঁকে একবার দেখার জন্য বড় ব্যাকুল হয়ে উঠল আমার মন। মনে হলো ফুফা সাহেবের অপরাধে আমি যেন অংশীদার। যেন আমিও তাঁর থেকে দূরে সরে গেছি।
চাচার সাথেই গ্রামে গেলাম। ফুফা সাহেব দেখে অবাক হলেন। পরিহাস করলেন, কি মিয়া, তোমারে কইছি না, গায়ের সিনারি তোমার দেখার কাম বেশি কইরা। এ যাত্রা থাইকা যাও কিছুদিন। এত ভাব গাঁয়ে আছে যে রচনা কইরা কুল পাইবা না।
পরদিন ভোর বেলায় চাচাকে নিয়ে চুপিচুপি মুনশী সাহেবের বাড়িতে গেলাম। সেই শ্রীমণ্ডিত ছোট্ট বাড়িটার চেহারা দেখে বিষম ধাক্কা খেলাম। শূন্য গোয়াল ঘরটা ভেঙ্গে পড়েছে। বার-বাড়িতে ঝাড়ু দেয়া হয়নি কতদিন। জামগাছের নিচে বাঁধা বাঁশের মাচায় বহুকাল কেউ বসে না। কাকপক্ষীর নোংরায় ভয়ে গেছে। শুনলাম, মুনশী সাহেব মাঠে গেছেন।
চাচা বলল, তাহলে ফিরে যাই। আমার যেন জেদ চেপে গিয়েছে। বললাম, না, দেখা করেই যাব। চলুন মাঠেই যাওয়া যাক।
মাঠের সন্ধান নিয়ে চাচা চলতে শুরু করল। আমি পেছনে পেছনে। মাথার ওপরে চড়চড় করে সূর্য উঠতে লাগল। পায়ের তলায় ব্যথা করতে লাগল। চোখে ধাঁধান রোদ্দুর ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না চারদিকে। পেঁৗছুলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ মেলে দূরে দেখিয়ে চাচা বলল, ঐ যে কবি চাচা লাঙ্গল দিতাছে।
তাকালাম। সে দৃশ্য না দেখাও ভাল ছিল। পরনে একটা গামছা। আর কিছু না। শরীরের বাকি অংশ নগ্ন, লাঙ্গল ঠেলছেন কবি আবদুর রব মুনশী।
ঐটুকু দূরত্ব পেরুতে যেন এক যুগ লাগল আমার। কাছে গিয়ে দেখলাম সেই সৌম্য আত্মস্থ সলজ্জ সুন্দর চেহারার একি ভয়াবহ পরিবর্তন! গায়ের রং পুড়ে কালো হয়ে গেছে। শীর্ণ হয়েছে স্বাস্থ্য। ফুটে উঠেছে চোয়াল। চোখে এক ভীষণ উন্মত্ত দৃষ্টি জ্বলজ্বল করছে কোটরের গভীর থেকে। সারা গা বেয়ে ঘাম ঝরছে দরদর করে। লাঙ্গলের ওপর শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দিয়ে মাটিকে চিরে চিরে এগিয়ে যাচ্ছেন কবি।
আমাকে দেখে ক্ষণিকের জন্যে তিনি তাকালেন। তার পরমুহূর্তে আমাকে নিষ্করুণভাবে উপেক্ষা করে গরু দুটোকে নির্মমভাবে নড়ি দিয়ে পেটাতে লাগলেন। একটা হিংস্র গড়গড় আওয়াজ তুলে দ্রুত লাঙ্গল ঠেলে এগিয়ে গেলেন।
আমার মনের মধ্যে কেমন একটা অনুভূতি হলো_যা ভয় নয়, বেদনা নয়, এক সঙ্গে দুটোই এবং কোনোটাই নয়। যন্ত্রচালিতের মত হাত উঠল আমার সালামের ভঙ্গিতে। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণও করলাম। কোনো জবাব এলো না।
চাচা কানে কানে বলল, চলো যাই। তোমারে বোধ হয় চিনবার পারে নাই।
তখন আমার মনে হলো হয়তো সত্যি। সত্যি হোক মিথ্যা হোক সেখানে আর দাঁড়াতে পারলাম না আমি। উল্টো মুখে হাঁটতে শুরু করলাম। কলাই ক্ষেতের ঢালু বেয়ে নামতে নামতে একবার কি মনে হলো, পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, দূরে ঢালুর মাথায় আকাশের পটভূমিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কবি আবদুর রব মুনশী। আমাকে দেখছেন।
ফুফা সাহেবের শত অনুরোধ সত্ত্বেও একদিনের বেশি এখানে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। ফুফুজান অশ্রু মোচন করলেন। তাকে বললাম, সিরাজগঞ্জ হয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনাকে দেখেই যাই, তাই আসা। আমি সময় পেলেই আসব এবং অনেকদিন থাকব। আমার মরহুম আব্বার একমাত্র জীবিতা বোন তিনি। মাথায় দিব্যি দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন, আমি যেন শিগগিরই আসি।
আমি এতদূর করেছি কবির সঙ্গে দেখা করতে, আর এই রকম একটা ঘটনা ঘটল_ব্যাপারটা আমার চাচাকে বিব্রত করেছিল খুব। সে আরেকবার গিয়েছিল সে রাতে কবির বাড়িতে আমার সংবাদ নিয়ে। আমার কথা তুলতেই তিনি নাকি বলেছেন, না, না, আমি আর রচনা করি না। তার সাথে দেখা করার কোনো কাম নাই আমার। কইয়া দিও, সে য্যান আর না আসে।
চাচার কাছেই শুনলাম, মুনশী সাহেব আর তো লেখেনই না, তাঁর পুরনো গান কেউ গাইলে পর্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ইস্কুলের সভায় তাঁর কবিতার আবৃতি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তালুকদার সাহেব ইলেকশানে জেতার পর কোথা থেকে দুই ছোকরা গায়েন এনে আবদুর রব মুনশীর বার-বাড়িতে লেঠেল দাঁড় করিয়ে গান করিয়েছেন সারারাত। সে গানের বিষয় ছিল মুনশী সাহেবের ঊর্ধ্বতন আর অধস্তন চৌদ্দপুরুষের আদ্যন্ত শ্রদ্ধা। অশ্লীল খেউর এর সঙ্গে তুমুল রবে সারারাত বেজেছে ঢোল কাঁসর। কোমর লুকিয়ে চেনে চিৎকার করে তারা সারারাত গান করে গেছে।
আমার মনে হলো তিনি তো ইচ্ছে করলেই স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। ভীষণ আক্রোশ হলো এই ভেবে যে, কেন তিনি গেলেন না? না হয় ভিক্ষা করে খেতেন, দিন মজুর খাটতেন, অনাহারে মারা যেতেন, এ পরাজয় কেন মাথা পেতে নিলেন তিনি? কেন তার কাব্য রচনার ইতি স্বীকার করে নিলেন?
বিক্ষুব্ধ চিত্তে বিদায় নিলাম গ্রাম থেকে। প্রশ্নগুলোর জবাব আমি বছর দুয়েক পরে পেলাম এবং আমার সৌভাগ্য, স্বয়ং কবি আবদুর রব মুনশীর কাছ থেকেই।
বছর দুয়েক করে আরেকবার আমি গ্রামে আসি ফুফুজানের সঙ্গে প্রতিশ্রুত দেখা করতে, কিছুদিন বিশ্রাম নিতে। ঢাকায় তখন অত্যধিক কাজের চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ডাক্তারের পরামর্শে বিশ্রাম গ্রহণের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়লাম একদিন।
গ্রামে এসেই মনে পড়ল মুনশী সাহেবের কথা। চাচা সরকারি চাকরি না পেয়ে গ্রামেই ডাক্তারি শুরু করে দিয়েছিলেন। পশার হচ্ছিল মন্দ না। সে ভোরে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। সারা গ্রামে এ-ই আমার একমাত্র বন্ধু যার কাছে নির্ভয়ে সব বলতে পারি, খোঁজ নিতে পারি। তার কাছেই শুনলাম, মুনশী সাহেব ভীষণভাবে অসুস্থ। শুলব্যাধিতে শয্যাশায়ী, উৎকট বেদনায় দিনরাত চিৎকার করেন। মৃত্যুর বোধ হয় আর বড় বেশি দেরি নেই।
বড় অসহায় মনে হলো নিজেকে। তাঁর আর্ত চীৎকার যেন আমার কানের কাছে এসে ধাক্কা মারতে লাগল। চাচাকে বললাম, আমি তাঁকে দেখতে যেতে চাই।
চাচা উত্তর করল, আজ থাক। আজ সে দেখতে যাবে কবিকে। আমার কথা বলবে। চুপি চুপি সে-ই চিকিৎসা করছে তাঁর।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে চাচা এলো আমার সঙ্গে গল্প করতে। সেই খালপাড়ে গিয়ে বসলাম আমরা দুজন। আজ বড় শূন্য মনে হতে লাগল সব কিছু। চাচা বলল, তোমার কথা কবি চাচারে বলছি।


কী বললেন তিনি?
শুইনা খুশি হইল। আমার হাত ধইরা কইলো, তারে নিয়া আসতি পারো?
মনটা তখুনি তাঁর কাছে যাবার জন্যে উন্মুখ হয়ে উঠল আমার। সারারাত তাঁর কথা মনে পড়তে লাগল কেবলি।
পরদিন সকালে চাচার সঙ্গে গেলাম মুনশী সাহেবের বাড়িতে। এ কবছরে বাড়িটার ভগ্নদশা আরো বেড়েছে। গোরস্থানের মতো পতিত, পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে। আগাছায় বার-বাড়িটা ঢেকে গেছে।
খবর পেয়ে মুনশীর বড় ছেলে ভেতরে নিয়ে গেল আমাদের। ছেলেটা মাথায় বড় হয়েছে বেশ, গোঁফ উঠেছে, মুখের সেই শ্যামল ভাবটা মরে গিয়ে একটা ক্ষুধার্ত রূপ ফুটে উঠেছে সেখানে।
ঘরে ছেঁড়া চাটাইয়ের ওপর শুয়ে আছেন কবি। আজ জীবন্ত মানুষ বলে তাকে ধারণা করতে কষ্ট হয়। মনে হয়, একটা কংকাল সজীব হয়ে উঠবার চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। আমি সেই উদগ্রীব শীর্ণ হাতটা মুঠোর মধ্যে নিয়ে তাঁর পাশে বসে পড়লাম। তিনি ব্যগ্র চোখ মেলে আমাকে দেখতে লাগলেন। কিছু বলবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হতে লাগল তাঁর, বলতে পারলেন না।
আমি বললাম,
আবার আপনি ভাল হয়ে উঠবেন। চাচা আমাকে বলেছে এ রোগ কিছু না।
আমার সে কথা যেন তাঁর কানে গেল না। তিনি আপন মনে বললেন, প্রায় ফিসফিস করে, আপনে আসছেন। কত কথা কইবার আছে। কী খুশি হইলাম ডাক্তারের কাছে শুইনা। ভাল আছেন আপনে? বই লেখেন নাই আর?
বলতে বলতে তিনি আমার মুঠো থেকে তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমার শরীরকে ব্যাকুল দু'হাতে স্পর্শ করতে লাগলেন। আমার চোখ সজল হয়ে উঠল।
চাচা উঠে দাঁড়াল।
আমি কাছেই একটা রুগী দেখে আসি। তুমি কথা কও। কবি চা তুমি কাইন্দোনা কইলাম কানবার কিছুই নাই। ভাল হইয়া উঠবা। আমি আসতাছি।
চাচা চলে গেলে মুনশী সাহেব বললেন, মিয়াসাব ডাক্তার হইলেন কি হয়, জ্ঞান হয় নাই। আমার মৃত্যু আইসতাছে। তারে ঠেকাবে কেডা? ডাক্তার? আমার মওতো আমি চিনি না? সেই সনে আসলেন, আপনারে সাথে খারাপ ব্যবহার করছি, কথা কই নাই ভাই, আমাকে মাফ কইরা দিও।
আমি তাড়াতাড়ি সে প্রসঙ্গ চাপা দেবার জন্যে বললাম, আমি কিছু মনে করিনি। আমি সব শুনেছি। আপনি আমাকে পেছন থেকে দেখেছিলেন, তাও দেখেছি। আপনি অনেক বড়, একদিন ও গ্রাম আপনার জন্যে গৌরব বোধ করবে। তারা বলবে, এই গাঁয়ে কবি আবদুর রব মুনশী বাস করতেন। তারা বলবে, তিনি ঐ জামগাছটার নিচে বসে গান রচনা করতেন, কবিতা লিখতেন।
আমাকে যেন নেশার মতো পেয়ে বসেছিল, তাঁর চোখের সমুখে ভবিষ্যতের ছবিগুলো তুলে ধরেছিলাম। বলতে বলতে আমার গলা ধরে আসছিল। তবু আমি বলে চলেছি। আমার কথা শুনতে শুনতে তিনি শয্যায় উঠে বসলেন স্বপ্নগ্রস্তের মতো, চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর, আনন্দে মুখের রেখাগুলো থর থর করে কাঁপতে লাগল। আমি তাঁর হাত ধরে বললাম, এ সবই সত্যি হবে দেখবেন। আপনার দুঃখ করবার কিছু নেই। একদিন সবাই আপনাকে বুঝতে পারবে, তারা তাদের ভুলের জন্যে লজ্জিত হবে।
যে রূপকথা শোনাচ্ছি তাঁকে তাঁর চোখ মুখ থেকে শিশুর উজ্জ্বল আগ্রহ ঝরে পড়ছে। আমাকে ভবিষ্যতের দূত মনে করছেন তিনি। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই আবার আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন।
তাঁর বড় ছেলে এক গেলাশ গুড়ের শরবত এনে আমার সমুখে রাখলেন। উঠোনে দেখলাম কবির স্ত্রী মাথায় কাপড় নিয়ে একখণ্ড বেদনার মতো মুখটাকে দরোজার আড়ালে রেখে আমাকে দেখছেন।
মুনশী সাহেব বললেন, শরবত খান।
বলে নিজেই গেলাশটা তুলে দিলেন আমার হাতে। যতক্ষণ আমি পান করলাম নিঃশব্দে দেখলেন। তারপর শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বললেন, আপনারে ডাকছি, ডাক্তারের কাছে সেবার মিছা কথা কইয়া পাঠাইছিলাম। দিন শেষ হয়ে আসছে আমার। তালুকদার সাবে আমার ক্ষতি করতে পারে নাই। এখন কইতে আর ভয় নাই আমার, আমি রচনা থামাই নাই। কথা না কইয়া মানুষ বাঁচিতে পারে? আমি কতো কবিতা গান রচনা করছি তারপরে। সব ল্যাখা আছে। লেইখা তোরঙ্গে বন্ধ কইরা থুইছি। আইজ না হউক কাইল তা লোকে জানাত পাইরবে। আপনেরে আমি ডাকছি, আমার কবিতাগুলো একখানা বই কইরা ছাপাইয়া দিয়েন। আপনে পারবেন। দিবেন?
একটা আশ্চর্য শিহরণ বোধ করলাম, সমস্ত অন্তরের মধ্যে অপূর্ব একটা আনন্দ হলো। কবি আবদুর রব মুনশী মরে যায়নি। সেই খররৌদ্রে সারাদিন লাঙ্গল চষে বাড়ি ফিরে রাতের অন্ধকারে গোপনে গোপনে তিনি রচনা করে গেছেন।
তাঁর বড় ছেলেকে বললেন, তোরঙ্গ খুলে কবিতাগুলো দিতে। সে পুরনো একখণ্ড কাপড়ে যত্ন করে বাঁধা লেখা পুঁটুুলী এনে দিল। মুনশী সাহেব ইশারা করলেন আমাকে পুঁটুলীটা তুলে দিতে। এক মুহূর্তে ভারি নিরাসক্ত নির্লিপ্ত মনে হলো তাঁকে। এতো যে আগ্রহ, এতো যে মমতা, লেখাগুলো স্পর্শ পর্যন্ত করলেন না তিনি, তাকিয়ে দেখলেন না আর। চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল শুধু। মুখ ফিরিয়ে বিকৃত কণ্ঠে বললেন, কতদিন ভাবছি, এক দ্যাশ ছাইড়া যে দিক দুই চোখ যায় চইলা যামু। আবার ভাবছি, কোথায় যামু এই মাটি ফালাইয়া। এই চান সূর্য, গাছ-গাছালি, ম্যাঘ বাদল, আর কোনো দ্যাশে আছে? আমি চইলা গেলে অন্যায় তো আর আমার সাথে সাথে যাবি না। এই দেশেই রয়্যা যাবি। তো আমার চইলা যাওয়ার লাভ? তাই মাটি ধইরা পইড়া ছিলাম। মাটির সাথে কতো কথা কইছি। কইছি, মাটিরে তুমই আমার মা, কত দুঃখে তুই কালাবরণ হইছাস রে তা আমি জানি না? তুইি তো আমারে পর করস নাই, আমি তরে ছাইড়া যামু কোন দুঃখে। তুই আছস, আমার সব আছে।
বলতে বলতে তার ফেরান মুখটি তিনি নামিয়ে নিলেন আরো; মেঝের ওপর মুখ রেখে ক্রন্দন কম্পিত শব্দগুলোকে বুকের ভেতর থেকে বের করে চলেছেন, তাঁর দুঃখ দিনের নিঃসঙ্গ সাধনার পুষ্পগুলো আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। মাথার কাছে লোকটা বসে আছে অবোধ চোখে, কবি আবদুর রব মুনশীর সঙ্গে সেই আমার শেষ সাক্ষাৎ।
আমার একমাত্র শোক এই জন্যে যে, তাঁর এ কাব্যে সংগ্রহ তিনি দেখে যেতে পারলেন না।

No comments

Powered by Blogger.