৫০০ বিঘা জমির জাল দলিল by রোজিনা ইসলাম ও মাসুদ রানা
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে শতাধিক ব্যক্তির ৫০০ বিঘা (সাড়ে ১৬ হাজার শতাংশ) জমি জাল দলিলের মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান। এ অভিযোগে ‘রাজ হাউজিং লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। গত রোববার থেকে বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকাবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। গতকাল ভূমি অফিস ও থানার সামনে গিয়ে তারা বিক্ষোভ করে।
গতকাল দুপুর পর্যন্ত কালিয়াকৈর থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। পুলিশ জালিয়াত চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, মৃত ব্যক্তিকে দাতা দেখিয়ে ভুয়া দলিল বানিয়ে একের পর এক জমি লিখে নেওয়া হচ্ছে। ২১ বছর আগে মারা গেছেন কালিয়াকৈর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আওলাদ হোসেন। গত ১৬ জানুয়ারি তাঁকে দাতা সাজিয়ে আমমোক্তার নিযুক্ত হয়েছেন মো. ওয়াহিদুর রহমান। এরপর তিনি নিজের নামে জাল দলিল করে নেন।
স্থানীয় সাংসদ ও ভূমি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আওলাদ হোসেন আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমি তাঁর জানাজায় অংশ নিয়েছি। অথচ দাতা হিসেবে তাঁর নাম ও ভুয়া ছবি ব্যবহার করে কালিয়াকৈরের বিষাইদ মৌজায় একটি দলিলে ৪৭০ শতাংশ জমি আত্মসাৎ করা হয়েছে।’
কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাত্রা এলাকায় আওলাদ হোসেনের স্ত্রী মাজেদা খানমের সঙ্গে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ১৯৪৮ সাল থেকে ৪৭০ শতাংশ জমির মালিক হয়ে ভোগদখল করে আসছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি মারা যান। সম্প্রতি জানতে পারি, আমার স্বামীকে জীবিত দেখিয়ে প্রতারক ওয়াহিদুর রহমান গত ১৬ জানুয়ারি আমমোক্তার সেজেছেন।’
এভাবে ভুয়া দাতা সাজিয়ে স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দলিল লেখকদের সহায়তায় প্রভাবশালী জালিয়াত চক্র ওই এলাকার ৯০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি নিজেদের নামে লিখে নিয়েছে।
স্থানীয় সাংসদ গত মঙ্গলবার ভূমি মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানান। গতকাল তিনি এ বিষয়ে ভূমি, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানান। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর এলাকায় শতাধিক ভুয়া দলিল হয়েছে। ৪ নভেম্বর কালিয়াকৈর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হয়ে তিনি আটটি ভুয়া দলিলের সন্ধান পান। প্রতিটি দলিল পরীক্ষা করে তিনি জানতে পারেন, এগুলোর তিনজন গ্রহীতা হলেন মো. ওয়াহিদুর রহমান, টিপু সুলতান ও মো. বরকত উল্লাহ খান।
এই তিন ব্যক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান: সাংসদের চিঠির ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ওয়াহিদুর রহমানের ঠিকানা ২৩/ক, নিউ ইস্কাটন রোড। গতকাল সন্ধ্যায় ওই ভবনে গেলে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী জানান, ফিয়াজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদুর রহমান পঞ্চম তলায় বসেন। তিনি অফিসে আছেন। ওই নিরাপত্তাকর্মী এই প্রতিনিধির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ওপরে যাওয়ার অনুমতি দেন। পঞ্চম তলায় ফিয়াজ গ্রুপের অভ্যর্থনাকক্ষের দুই কর্মী তাঁর আসার কারণ জানতে চান। এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার আগে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক তাজুল ইসলাম সাক্ষাতের কারণ জানতে চান। বিষয়টি বলার পর ওই কর্মকর্তা জানান, এমডি সাহেব দপ্তরে নেই। তিনি প্রতিষ্ঠানের ভূমি বিষয়ে দেখভাল করা প্রধান কর্মকর্তা খান টিপু সুলতানের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর মুঠোফোনের নম্বর দেন। কিন্তু ওই নম্বরে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই টিপু সুলতানের নামেও বেশ কয়েকটি দলিল সম্পন্ন হয়েছে। তিনি রাজ হাউজিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই পরিচয়ে তিনি বড়ইছুটি মৌজায় একটি দলিলে ৯৮০ শতাংশ জমির আমমোক্তার নিযুক্ত হয়েছেন। এই সূত্রে প্রমাণ মিলেছে, টিপু সুলতান ও ওয়াহিদুর রহমান এই অপকর্মে জড়িত।
দলিলে উল্লেখ করা ঠিকানা অনুযায়ী, গতকাল বিকেলে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের মাদ্রাসা কমপ্লেক্স মার্কেটের দোতলায় গিয়ে রাজ হাউজিংয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। কার্যালয়টি ভেতর থেকে আটকানো ছিল। কড়া নাড়তেই নিরাপত্তারক্ষী জুলহাস বেরিয়ে আসেন। রাজ হাউজিংয়ের মালিকের নাম জানতে চাইলে তিনি জানান, কয়েক দিন আগে যোগদান করেছেন, মালিককে এখনো দেখেননি। তবে তাঁর মালিকের নাম খান টিপু সুলতান। তিনি কোথায় জানতে চাইলে ওই নিরাপত্তাকর্মীসহ আশপাশের কয়েকজন জানান, তিনি হজে গেছেন।
ভুয়া দলিল গ্রহীতাদের আরেকজন হলেন বরকত উল্লাহ খান। তিনি ডিগ ফুটওয়্যার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ওয়াহিদুর রহমান ও টিপু সুলতানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকার কথা জানা গেছে।
সাংসদ আ ক ম মোজাম্মেল প্রথম আলোকে বলেন, কালিয়াকৈর শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা হওয়ায় জমির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই সুযোগে একশ্রেণীর দালাল, ভূমিদস্যু, দুর্নীতিবাজ, হাউজিং কোম্পানি ও দলিল লেখক মিলে একটি চক্র গড়ে তুলেছে। চক্রটি ভুয়া মালিক সেজে প্রতারণার মাধ্যমে জাল দলিল সৃষ্টি করে কৃষিজমি ও বসতবাড়ি দখলের চেষ্টা করছে।
কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান জানান, ‘সাতটি মৌজার প্রায় ৫০০ বিঘা জমি জাল দলিল করা হয়েছে বলে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এই জালিয়াত চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।’
ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাংসদের চিঠি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। জালিয়াতি চক্রকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
সরেজমিন রেজিস্ট্রি অফিস: উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস জানায়, গত এক বছরে প্রায় ১৪ হাজার দলিল হয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে ১০০ ব্যক্তির জমি জাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত দুই দিনে তল্লাশি করে ১২টি জাল দলিলের খোঁজ পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিদের জীবিত দেখিয়ে এবং ভুয়া মালিক সাজিয়ে দলিল করা হয়েছে। ১২টি দলিলে কালিয়াকৈর উপজেলার পাঁচটি মৌজায় চার হাজার ১৫৩ শতাংশ জমি লিখে নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। বর্তমানে ওই এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ৩০ হাজার টাকা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ: কালিয়াকৈর উপজেলার ভাতারিয়া গ্রামের মকবুল হোসেন বলেন, ‘তিন-চার দিন আগে কালিয়াকৈর মাছের বাজারে লোকমুখে জানতে পারি, ভাতারিয়া গ্রামের অনেকের জমি জাল দলিল করে নিয়ে যাচ্ছে এলাকার কিছু ভূমিদস্যু। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, টিপু সুলতান ও ওয়াহিদুর রহমান নামের দুই লোক কয়েকটি গ্রামের শতাধিক বাসিন্দার জমি লিখে নিয়েছেন।’
উপজেলার চাতৈলভিটি এলাকার আবুল হোসেন জানান, তাঁর বাবা মোগর আলী মারা গেছেন ১৯৯৮ সালের ১৪ জুন। অথচ বাবাকে জীবিত দেখিয়ে তাঁর ৩৪৯ শতাংশ জমি প্রতারক চক্রের সদস্য মো. ইয়াছিন ও রবিউল ইসলাম বিক্রি করে দিয়েছেন টিপু সুলতান ও ওয়াহিদুর রহমানের কাছে।
বড়ইছুটি এলাকার সেলিম উদ্দিন জানান, ‘বড়ইছুটি মৌজার ৫১৭ শতাংশ জমি আমরা দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ভোগদখল করে আসছি। প্রতারক চক্রের ১৪-১৫ জন পরিকল্পিতভাবে দলিল লেখক ও সাব-রেজিস্ট্রারের যোগসাজশে ওয়াহিদুর রহমানের কাছে বিক্রি করে দেয়।’
কালিয়াকৈর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলিল রেজিস্ট্রি করার সময় সব নিয়ম-কানুন মেনে উপস্থিত সাক্ষীদের সামনেই দলিল করা হয়েছে। কিন্তু তিন-চার দিন আগে অনেকগুলো দলিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে এগুলো জাল দলিল। এখনো আমরা এসব বিষয় খোঁজাখুঁজির মধ্যে আছি। প্রায় ১৪ হাজার দলিল। দুই দিনে ১২টি জাল দলিলের খোঁজ পাওয়া গেছে। এগুলোর বেশির ভাগই মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে রেজিষ্ট্রি করা হয়েছে।’
এলাকাবাসীর দাবি: আগামী এক মাসের মধ্যে দলিলদাতা ও গ্রহীতাকে স্বপ্রণোদিত হয়ে জাল দলিল বাতিল করার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। এ ছাড়া এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাজ হাউজিংয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব তহশিলদার ওই সব জমির নামজারি জমাভাগ (খারিজ) দিয়েছেন, তাঁদের শাস্তি দিতে হবে। জাল দলিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত দলিল লেখকদের সনদ বাতিল করতে হবে। ব্যাংকে যেসব জমি বন্ধক দেওয়া হয়েছে, তা অবমুক্ত করতে হবে। জাল দলিলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে হবে। ভুক্তভোগীদের কোনোভাবেই হয়রানি করা যাবে না।
তিন মামলা: কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক জানান, জাল দলিল করার অভিযোগে গত মঙ্গলবার ও গতকাল কালিয়াকৈর থানায় তিনটি প্রতারণা মামলা করা হয়েছে। মামলা তিনটি করেন কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাত্রা এলাকার প্রয়াত দেওয়ান আওলাদ হোসেনের স্ত্রী মাজেদা খানম, বড়ইছুটি এলাকার প্রয়াত আমিন উদ্দিনের ছেলে মো. সেলিম উদ্দিন ও চাতৈলভিটি এলাকার প্রয়াত মোগর আলীর ছেলে আবুল হোসেন।
মামলার পর পুলিশ কালিয়াকৈরের দলিল লেখক তমছের আলী ও বড়ইছুটি এলাকার আ. রহমান মাস্টারকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল দুপুরে তাঁদের গাজীপুর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
থানার সামনে গ্রামবাসী: গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাত্রা, বড়ইছুটি, জালশুকা, খোলাপাড়া, ভাতারিয়াসহ কয়েকটি গ্রামের শতাধিক লোকের জমি জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়া ভুমিদস্যুদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল দুপুরে শত শত লোক কালিয়াকৈর থানার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে। এ সময় থানার ওসি জাল দলিল বাতিল ও ভূমিদস্যুদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলে গ্রামবাসী থানা এলাকা ত্যাগ করে।
এদিকে আটাবহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম এ আলীম জানান, জালিয়াত চক্রকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সরেজমিনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, মৃত ব্যক্তিকে দাতা দেখিয়ে ভুয়া দলিল বানিয়ে একের পর এক জমি লিখে নেওয়া হচ্ছে। ২১ বছর আগে মারা গেছেন কালিয়াকৈর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আওলাদ হোসেন। গত ১৬ জানুয়ারি তাঁকে দাতা সাজিয়ে আমমোক্তার নিযুক্ত হয়েছেন মো. ওয়াহিদুর রহমান। এরপর তিনি নিজের নামে জাল দলিল করে নেন।
স্থানীয় সাংসদ ও ভূমি মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আওলাদ হোসেন আমার ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমি তাঁর জানাজায় অংশ নিয়েছি। অথচ দাতা হিসেবে তাঁর নাম ও ভুয়া ছবি ব্যবহার করে কালিয়াকৈরের বিষাইদ মৌজায় একটি দলিলে ৪৭০ শতাংশ জমি আত্মসাৎ করা হয়েছে।’
কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাত্রা এলাকায় আওলাদ হোসেনের স্ত্রী মাজেদা খানমের সঙ্গে কথা হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ১৯৪৮ সাল থেকে ৪৭০ শতাংশ জমির মালিক হয়ে ভোগদখল করে আসছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি মারা যান। সম্প্রতি জানতে পারি, আমার স্বামীকে জীবিত দেখিয়ে প্রতারক ওয়াহিদুর রহমান গত ১৬ জানুয়ারি আমমোক্তার সেজেছেন।’
এভাবে ভুয়া দাতা সাজিয়ে স্থানীয় ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দলিল লেখকদের সহায়তায় প্রভাবশালী জালিয়াত চক্র ওই এলাকার ৯০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি নিজেদের নামে লিখে নিয়েছে।
স্থানীয় সাংসদ গত মঙ্গলবার ভূমি মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানান। গতকাল তিনি এ বিষয়ে ভূমি, স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানান। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর এলাকায় শতাধিক ভুয়া দলিল হয়েছে। ৪ নভেম্বর কালিয়াকৈর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে উপস্থিত হয়ে তিনি আটটি ভুয়া দলিলের সন্ধান পান। প্রতিটি দলিল পরীক্ষা করে তিনি জানতে পারেন, এগুলোর তিনজন গ্রহীতা হলেন মো. ওয়াহিদুর রহমান, টিপু সুলতান ও মো. বরকত উল্লাহ খান।
এই তিন ব্যক্তি সম্পর্কে অনুসন্ধান: সাংসদের চিঠির ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ওয়াহিদুর রহমানের ঠিকানা ২৩/ক, নিউ ইস্কাটন রোড। গতকাল সন্ধ্যায় ওই ভবনে গেলে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী জানান, ফিয়াজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াহিদুর রহমান পঞ্চম তলায় বসেন। তিনি অফিসে আছেন। ওই নিরাপত্তাকর্মী এই প্রতিনিধির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর ওপরে যাওয়ার অনুমতি দেন। পঞ্চম তলায় ফিয়াজ গ্রুপের অভ্যর্থনাকক্ষের দুই কর্মী তাঁর আসার কারণ জানতে চান। এরপর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলার আগে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক তাজুল ইসলাম সাক্ষাতের কারণ জানতে চান। বিষয়টি বলার পর ওই কর্মকর্তা জানান, এমডি সাহেব দপ্তরে নেই। তিনি প্রতিষ্ঠানের ভূমি বিষয়ে দেখভাল করা প্রধান কর্মকর্তা খান টিপু সুলতানের সঙ্গে কথা বলার জন্য তাঁর মুঠোফোনের নম্বর দেন। কিন্তু ওই নম্বরে তাঁকে পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই টিপু সুলতানের নামেও বেশ কয়েকটি দলিল সম্পন্ন হয়েছে। তিনি রাজ হাউজিং লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই পরিচয়ে তিনি বড়ইছুটি মৌজায় একটি দলিলে ৯৮০ শতাংশ জমির আমমোক্তার নিযুক্ত হয়েছেন। এই সূত্রে প্রমাণ মিলেছে, টিপু সুলতান ও ওয়াহিদুর রহমান এই অপকর্মে জড়িত।
দলিলে উল্লেখ করা ঠিকানা অনুযায়ী, গতকাল বিকেলে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের মাদ্রাসা কমপ্লেক্স মার্কেটের দোতলায় গিয়ে রাজ হাউজিংয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। কার্যালয়টি ভেতর থেকে আটকানো ছিল। কড়া নাড়তেই নিরাপত্তারক্ষী জুলহাস বেরিয়ে আসেন। রাজ হাউজিংয়ের মালিকের নাম জানতে চাইলে তিনি জানান, কয়েক দিন আগে যোগদান করেছেন, মালিককে এখনো দেখেননি। তবে তাঁর মালিকের নাম খান টিপু সুলতান। তিনি কোথায় জানতে চাইলে ওই নিরাপত্তাকর্মীসহ আশপাশের কয়েকজন জানান, তিনি হজে গেছেন।
ভুয়া দলিল গ্রহীতাদের আরেকজন হলেন বরকত উল্লাহ খান। তিনি ডিগ ফুটওয়্যার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ওয়াহিদুর রহমান ও টিপু সুলতানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক থাকার কথা জানা গেছে।
সাংসদ আ ক ম মোজাম্মেল প্রথম আলোকে বলেন, কালিয়াকৈর শিল্পসমৃদ্ধ এলাকা হওয়ায় জমির দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই সুযোগে একশ্রেণীর দালাল, ভূমিদস্যু, দুর্নীতিবাজ, হাউজিং কোম্পানি ও দলিল লেখক মিলে একটি চক্র গড়ে তুলেছে। চক্রটি ভুয়া মালিক সেজে প্রতারণার মাধ্যমে জাল দলিল সৃষ্টি করে কৃষিজমি ও বসতবাড়ি দখলের চেষ্টা করছে।
কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান জানান, ‘সাতটি মৌজার প্রায় ৫০০ বিঘা জমি জাল দলিল করা হয়েছে বলে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এই জালিয়াত চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি জানাই।’
ভূমি প্রতিমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাংসদের চিঠি পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। জালিয়াতি চক্রকে চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান।
সরেজমিন রেজিস্ট্রি অফিস: উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস জানায়, গত এক বছরে প্রায় ১৪ হাজার দলিল হয়েছে। এর মধ্যে গত এক বছরে ১০০ ব্যক্তির জমি জাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গত দুই দিনে তল্লাশি করে ১২টি জাল দলিলের খোঁজ পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিদের জীবিত দেখিয়ে এবং ভুয়া মালিক সাজিয়ে দলিল করা হয়েছে। ১২টি দলিলে কালিয়াকৈর উপজেলার পাঁচটি মৌজায় চার হাজার ১৫৩ শতাংশ জমি লিখে নেওয়ার তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। বর্তমানে ওই এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির মূল্য ৩০ হাজার টাকা।
এলাকাবাসীর অভিযোগ: কালিয়াকৈর উপজেলার ভাতারিয়া গ্রামের মকবুল হোসেন বলেন, ‘তিন-চার দিন আগে কালিয়াকৈর মাছের বাজারে লোকমুখে জানতে পারি, ভাতারিয়া গ্রামের অনেকের জমি জাল দলিল করে নিয়ে যাচ্ছে এলাকার কিছু ভূমিদস্যু। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, টিপু সুলতান ও ওয়াহিদুর রহমান নামের দুই লোক কয়েকটি গ্রামের শতাধিক বাসিন্দার জমি লিখে নিয়েছেন।’
উপজেলার চাতৈলভিটি এলাকার আবুল হোসেন জানান, তাঁর বাবা মোগর আলী মারা গেছেন ১৯৯৮ সালের ১৪ জুন। অথচ বাবাকে জীবিত দেখিয়ে তাঁর ৩৪৯ শতাংশ জমি প্রতারক চক্রের সদস্য মো. ইয়াছিন ও রবিউল ইসলাম বিক্রি করে দিয়েছেন টিপু সুলতান ও ওয়াহিদুর রহমানের কাছে।
বড়ইছুটি এলাকার সেলিম উদ্দিন জানান, ‘বড়ইছুটি মৌজার ৫১৭ শতাংশ জমি আমরা দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ভোগদখল করে আসছি। প্রতারক চক্রের ১৪-১৫ জন পরিকল্পিতভাবে দলিল লেখক ও সাব-রেজিস্ট্রারের যোগসাজশে ওয়াহিদুর রহমানের কাছে বিক্রি করে দেয়।’
কালিয়াকৈর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দলিল রেজিস্ট্রি করার সময় সব নিয়ম-কানুন মেনে উপস্থিত সাক্ষীদের সামনেই দলিল করা হয়েছে। কিন্তু তিন-চার দিন আগে অনেকগুলো দলিলের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে যে এগুলো জাল দলিল। এখনো আমরা এসব বিষয় খোঁজাখুঁজির মধ্যে আছি। প্রায় ১৪ হাজার দলিল। দুই দিনে ১২টি জাল দলিলের খোঁজ পাওয়া গেছে। এগুলোর বেশির ভাগই মৃত ব্যক্তিকে জীবিত দেখিয়ে রেজিষ্ট্রি করা হয়েছে।’
এলাকাবাসীর দাবি: আগামী এক মাসের মধ্যে দলিলদাতা ও গ্রহীতাকে স্বপ্রণোদিত হয়ে জাল দলিল বাতিল করার দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী। এ ছাড়া এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাজ হাউজিংয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব তহশিলদার ওই সব জমির নামজারি জমাভাগ (খারিজ) দিয়েছেন, তাঁদের শাস্তি দিতে হবে। জাল দলিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত দলিল লেখকদের সনদ বাতিল করতে হবে। ব্যাংকে যেসব জমি বন্ধক দেওয়া হয়েছে, তা অবমুক্ত করতে হবে। জাল দলিলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে হবে। ভুক্তভোগীদের কোনোভাবেই হয়রানি করা যাবে না।
তিন মামলা: কালিয়াকৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক জানান, জাল দলিল করার অভিযোগে গত মঙ্গলবার ও গতকাল কালিয়াকৈর থানায় তিনটি প্রতারণা মামলা করা হয়েছে। মামলা তিনটি করেন কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাত্রা এলাকার প্রয়াত দেওয়ান আওলাদ হোসেনের স্ত্রী মাজেদা খানম, বড়ইছুটি এলাকার প্রয়াত আমিন উদ্দিনের ছেলে মো. সেলিম উদ্দিন ও চাতৈলভিটি এলাকার প্রয়াত মোগর আলীর ছেলে আবুল হোসেন।
মামলার পর পুলিশ কালিয়াকৈরের দলিল লেখক তমছের আলী ও বড়ইছুটি এলাকার আ. রহমান মাস্টারকে গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল দুপুরে তাঁদের গাজীপুর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
থানার সামনে গ্রামবাসী: গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাত্রা, বড়ইছুটি, জালশুকা, খোলাপাড়া, ভাতারিয়াসহ কয়েকটি গ্রামের শতাধিক লোকের জমি জালিয়াতি করে হাতিয়ে নেওয়া ভুমিদস্যুদের গ্রেপ্তারের দাবিতে গতকাল দুপুরে শত শত লোক কালিয়াকৈর থানার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে। এ সময় থানার ওসি জাল দলিল বাতিল ও ভূমিদস্যুদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলে গ্রামবাসী থানা এলাকা ত্যাগ করে।
এদিকে আটাবহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম এ আলীম জানান, জালিয়াত চক্রকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার সকালে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়েছে।
No comments