সরেজমিন- স্কুল চলছে, ভোটও চলছে by মিজানুর রহমান খান

মার্কিন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পরতে পরতে রয়েছে বিস্ময় ও রহস্য। শীর্ষ নেতা নির্বাচনই কেবল নয়, একই সঙ্গে শাসনব্যবস্থায় সরাসরি অংশ নিয়ে নেতা নিয়ন্ত্রণ, অঙ্গরাজ্যগুলোর স্বায়ত্তশাসন কার্যকর বা জনগণকে শাসনমুখী করা নিশ্চিত করতে পারছে মার্কিন নির্বাচন। এই নির্বাচন-প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্যের যেন কোনো সীমা নেই।


৬ নভেম্বর রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি, ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের কয়েকটি কেন্দ্র পরিদর্শন করে এমনটাই মনে হয়েছে।
হোয়াইট হাউসের কাছে একটি ভোটকেন্দ্রের বাইরে নিরুত্তাপ দীর্ঘ সারি দেখলাম। সেটি ছিল একটি স্কুলে। ভোটের জন্য স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়নি বলেই হয়তো বাইরে লাইন দেখা গেছে। ভোটের জন্য কোনো সরকারি ছুটি ছিল না। কোথাও কোনো অস্বাভাবিক বা বিশেষ জীবনযাত্রা চোখে পড়েনি। নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো কিংবা টান টান উত্তেজনা অথবা উৎসাহের কিছুই ছিল না। ভোটকেন্দ্রের ত্রিসীমানায় পুলিশ বা তাদের টহল গাড়ি দেখা যায়নি। প্রধান দুই দলের কর্মীরা নীরবে সক্রিয় ছিলেন। কেউ গাড়িতে করে ভোটার এনেছেন। কেউ প্ল্যাকার্ড বিলিয়েছেন। কিন্তু ক্ষণকালের জন্যও কোথাও হুড়োহুড়ি নেই।
প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান ছাড়াও নীরবে শত শত নীতি ও শাসনসংক্রান্ত মতবিরোধ ভোটাভুটিতে সুরাহা করে নিল অঙ্গরাজ্যগুলো। একটি রাজ্যের নিজস্ব বিষয়ের সঙ্গে অন্য রাজ্যের নিজস্ব বিষয়ের কোনো মিল নেই। বিচিত্র রকম বিষয়ে গণভোট হলো। কোথাও বিচারক, পুলিশ-প্রধান, কোথাও স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যও নির্বাচিত হলেন। এক রাজ্যের খবর আরেক রাজ্যের কাছে নেই। সবকিছু পৃথক।
যে ব্যালটে ওবামা জয়ের মুকুট পরলেন, সেই একই ব্যালট বহু ক্ষেত্রে তাঁর ও তাঁর দলের শাসনক্ষমতা সীমিত বা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। অথচ এ নিয়ে তাঁদের কোনো আক্ষেপ নেই। ৫০ অঙ্গরাজ্যের ৫০ রকম সংবিধান। ৫০ রকম সংসদে ৫০ রকমের আইন পাস হয়। তাই তাঁদের বৈচিত্র্যেরও শেষ নেই।
নির্বাচনী নিয়মকানুন, যা এক রাজ্যে হালাল কিন্তু পাশের রাজ্যেই তা হারাম। ভার্জিনিয়ার পেন্টাগন শহরের আর্লিংটনে প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা হাসিমুখে সাক্ষাৎকার দিলেন। এমনকি ভোট কক্ষে ভিডিও করতে দিলেন। কিন্তু পাশের রাজ্য মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর সিটির একই পদমর্যাদার কর্মকর্তা ঘোরতর আপত্তি করলেন। ছবি তোলা দূরে থাক, নিজের নামটি বলতেও মানা—সাফ জানিয়ে দিলেন।
মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশ ককাসের সদস্য ও প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের আরও অগ্রগতি ও উন্নয়নে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন।
৬ নভেম্বর রাত আটটায় ভোট গ্রহণ বন্ধের দুই ঘণ্টার মধ্যে মেরিল্যান্ডের মন্টিগোমারি কাউন্টির হোটেল হিলটনে মুহুর্মুহু করতালি আর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছিলেন ডেমোক্র্যাট-দলীয় নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যেই ক্রিস্টোফার হোলেন এলেন। প্রথম আলোকে জানালেন বাংলাদেশ সফরের আগ্রহের কথা। বললেন, তাঁর বাবা ছিলেন কূটনীতিক। ১৯৫৯ সালে করাচিতে তাঁর জন্ম।
বাংলাদেশ থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে এসেছি জেনে মেরিল্যান্ড ডেমোক্র্যাট দলের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান ড্যান এডকক পাল্টা প্রশ্ন করলেন। কেমন দেখলেন? বললাম, ‘সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন।’ তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্য: ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ।’ জানতে চাইলাম, শক্ত আইন থাকার চেয়েও ঐতিহ্য মূল্যবান? বর্ষীয়ান এই নেতা বলেন, উত্তম আইন ঐতিহ্যকে দৃঢ়তর করে।
ওয়াশিংটন ডিসি: দুপুর ১২টা। হোয়াইট হাউস থেকে দুই মাইল দূরের ভোটকেন্দ্রে দীর্ঘ সারি। এটা ১৭৫৫ নিউটন স্ট্রিটের ব্যাংকক্রফট প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভেতরে ক্লাস চলছে। তাই বাইরে ভোটারদের সারি। নজরে পড়ল একটি ক্ষুদ্র প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা, ‘প্রচারকাজের শেষ সীমা।’ মানে হলো, এই দাগের পরে গিয়ে নির্বাচনী আলোচনা নিষেধ। তবে নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ হয় না। ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা চলে ভোটের দিনেও।
ম্যাটসিটিলি একজন আইটি বিশ্লেষক। ওহাইওতে তিনি আগাম ভোট দিয়েছেন। তিনি নিবন্ধিত ডেমোক্র্যাট নন। কিন্তু ওহাইওতে গত ৫ অক্টোবর ভোট দিয়েছেন ওবামাকেই। কারণ, তিনি মধ্যবিত্ত ও ছাত্রদের বন্ধু। এখানে ভোটার তালিকা তৈরির সময় ভোটাররা নিজের দলীয় পরিচয় ঘোষণা করেন। যাঁরা কোনো দলের নন, তাঁরা হলেন স্বাধীন। কোনো জোরাজুরি নেই। এর সুবিধা হলো, কোথাও ভোট গ্রহণকালেই তাৎক্ষণিকভাবে দলীয় অবস্থাটা বোঝা যায়।
সোনালি চুলো মিজ মিশেল হফম্যান ভোট দিয়ে এসেছেন। তিনি বুশ-গোরের মতো লড়াইয়ের শঙ্কা ব্যক্ত করেন। আঙুলে কালির ছাপ থাকার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, না। তবে এই যে দেখুন, একটি ছোট স্টিকার লাগানো। এতে লেখা, ‘আই ভোটেড।’
ভার্জিনিয়া: বেলা আড়াইটা। পেন্টাগন সিটিতে অবস্থিত দক্ষিণ আর্লিংটনের অরোরা হিলস কমিউনিটি সেন্টার। ম্যাট হান্টার পেশায় সম্পত্তি ব্যবস্থাপক। তিনি ডেট্রয়েটে থাকেন। ভোটের জন্য বিরতি নিয়েছেন। এখানে দেখা পেলাম ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দলের দুই কর্মীর। তাঁদের হাতে দলীয় প্রচারপত্র। ডেমোক্র্যাট দলের মিজ সুজি। এখানকার ব্যালট পেপারে রাজ্যের সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত দুটি প্রশ্ন। এটাই গণভোট। প্রথমত, ব্যক্তির সম্পত্তি অধিগ্রহণের বিনিময়ে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রথা চালু, নাকি রাষ্ট্রের দরকার ছাড়া অধিগ্রহণ একেবারে নিষিদ্ধ করা? দ্বিতীয়ত, কোনো বিল পাসে গভর্নরের ভেটো দান-সংক্রান্ত প্রস্তাব সমর্থন করেন কি?
মিজ সুজির অকপট উত্তর: প্রথমটায় তিনি ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন, কিন্তু দ্বিতীয়টিতে ভোট দেননি। কারণ, এটি তিনি বুঝতে পারেননি। রিপাবলিকান দলীয় জিম উইনগার্ট নৌবাহিনীর জাহাজ প্রকৌশলী। এক দিন ছুটি নিয়ে প্রচারণায় নেমেছেন। প্রথমটিতে ‘হ্যাঁ’ এবং দ্বিতীয়টিতে ‘না’ ভোট দিয়েছেন।
এখানে পরিচয় হলো বার্নি অল্টারের সঙ্গে। অন্যতম নির্বাচনী কর্মকর্তা। কূটনীতিক ছিলেন। পাঁচ বছর আগে অবসর নিয়েছেন। নিজেই বললেন, ১৯৮০ থেকে ৮২ পর্যন্ত মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে বাংলাদেশ ডেস্কে ছিলেন। এক জেনারেলের (জিয়া) হত্যাকাণ্ড এবং আরেক জেনারেলের (এরশাদ) ক্ষমতা গ্রহণ—দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা স্মরণ করেন তিনি। ওই সময় ছয় সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন। অবসর জীবনেও নাগরিক দায়িত্ব পালন করছেন।
বাল্টিমোর সিটি: সন্ধ্যা ছয়টা। মেরিল্যান্ডের বাল্টিমোর সিটির নর্থ ওয়েস্টার্ন হাইস্কুল কেন্দ্র। এর নারী চিফ ইলেকশন জাজ পরিচয় জানা মাত্রই বেঁকে বসলেন। বারণ করলেন ছবি তুলতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুলশিক্ষিকা জানালেন, তিনি ক্যাসিনো চালুর পক্ষে এবং গে ম্যারেজের বিপক্ষে ভোট দিলেন। জুয়ার পক্ষে যুক্তি কী? বললেন, ‘অবৈধ তৎপরতার চেয়ে বৈধ উত্তম।’
৭২ বছরের জেরোমি ব্রুকস। হুইলচেয়ারে ভোট দিলেন। তাঁর দুই চোখই অন্ধ। দুটো পা হাঁটু থেকে কাটা। মেরিল্যান্ডের অন্ধ শিল্প সংস্থার পরিচালক (পার্সোনেল) ছিলেন। ওবামা, ক্যাসিনো ও গে ম্যারেজের পক্ষে ভোট দেন। পাশেই একটি প্ল্যাকার্ড। গে ম্যারেজকে না বলুন। বিয়ে মানে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। প্রশ্নের জবাবে তাঁর যুক্তি: কারও মত নিয়ে জবরদস্তি চলে না।

No comments

Powered by Blogger.