বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৫৬২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম বিক্রমী এক প্রতিরোধযোদ্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ১৯৭১ সালে প্রেষণে ইপিআরে কর্মরত ছিলেন রাজশাহী ইপিআর সেক্টরের ৭ নম্বর উইংয়ে।
এর অবস্থান নওগাঁয়। তাঁর পদবি ছিল ক্যাপ্টেন এবং তিনি উইংয়ের সহকারী অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বিদ্রোহ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
গিয়াসউদ্দিন ২৮ মার্চ নওগাঁ থেকে একদল ইপিআর সেনা নিয়ে বগুড়ায় যান। রংপুর থেকে বগুড়ায় আগত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলকে তাঁর নেতৃত্বাধীন দলের একাংশ ৩০ মার্চ অ্যাম্বুশ করে। এ অ্যাম্বুশে পড়ে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর তিনি সহযোদ্ধাদের একাংশকে বগুড়ায় রেখে বাকিদের নিয়ে নওগাঁয় ফিরে যান।
গিয়াসউদ্দিন পরে গোদাগাড়ীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইপিআর সেনাদের সঙ্গে মিলিত হন। তাঁদের নিয়ে রাজশাহীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। ইপিআর সেনা ও স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে ৬ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে আক্রমণ চালান। তাঁর সার্বিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেন। কয়েক দিন ধরে সেখানে যুদ্ধ হয়। তাঁদের আক্রমণে রাজশাহীতে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১২ এপ্রিল গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী একদল (কোম্পানি) সহযোদ্ধা নিয়ে পাবনার দিকে অগ্রসর হন। কিছুদূর (১০ মাইল) যাওয়ার পর তিনি ঢাকা থেকে আগত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দলের মুখোমুখি হন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে কিছুটা পিছু হটে রাজশাহী ও সারদার মোড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
সেখানে আগে থেকেই গিয়াসউদ্দিনের অধীন মিশ্র বাহিনীর আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন। তাঁরা সবাই মিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। তখন সেখানে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
গিয়াসউদ্দিন ছত্রভঙ্গ মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশকে সংগঠিত করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি পুনরায় গোদাগাড়িতে অবস্থান নেন। রাজশাহী দখলের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোদাগাড়ি আক্রমণ করে। সেখানেও যুদ্ধ হয়। গোদাগাড়ির পতন হলে ২২ এপ্রিল তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতে যান।
ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় গেরিলাযুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওই এলাকায় অনেক গেরিলা অপারেশন করেন। এ সময় তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। এরপর তাঁকে প্রায় ১০ সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়।
এর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। গিয়াসউদ্দিনের যুদ্ধ এলাকা ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায় পড়ে। তখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। চিকিৎসকসহ সহযোদ্ধাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে তার পরও তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। এরপর তিনি লালগোলা সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাবসেক্টরের বিভিন্ন স্থানে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচালনায় অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অগ্রভাগেও ছিলেন।
১৪ নভেম্বর শেষ রাত থেকে পরদিন সকাল নয়টা পর্যন্ত সোনা মসজিদ এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সার্বিক নেতৃত্ব দেন। সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা। এর সামনে সীমান্তরেখা বরাবর ছিল কয়েক মাইল লম্বা বেশ চওড়া খাল। পাকিস্তানিদের বাংকার ও পরিখা ছিল খালের পাড়ে।
সে দিন শেষ রাতে ওই এলাকা ছিল অত্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন। সকাল নয়টার পরও কুয়াশা কাটেনি। তাঁর সহযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কিন্তু কুয়াশার কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করতে পারেননি। তবে তাঁরা পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হন।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০৫।
গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। অবসর নেওয়ার আগে প্রেষণে রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার পায়েলগাছা গ্রামে। তবে স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকায় (ঠিকানা ১০৯ পার্ক রোড, ব্লক এ, মহাখালী ডিওএইচএস)। তাঁর বাবার নাম শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। মা আফসারের নেছা। স্ত্রী মাহমুদা চৌধুরী। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম ও দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
গিয়াসউদ্দিন ২৮ মার্চ নওগাঁ থেকে একদল ইপিআর সেনা নিয়ে বগুড়ায় যান। রংপুর থেকে বগুড়ায় আগত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দলকে তাঁর নেতৃত্বাধীন দলের একাংশ ৩০ মার্চ অ্যাম্বুশ করে। এ অ্যাম্বুশে পড়ে পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর তিনি সহযোদ্ধাদের একাংশকে বগুড়ায় রেখে বাকিদের নিয়ে নওগাঁয় ফিরে যান।
গিয়াসউদ্দিন পরে গোদাগাড়ীতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ইপিআর সেনাদের সঙ্গে মিলিত হন। তাঁদের নিয়ে রাজশাহীতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। ইপিআর সেনা ও স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে ৬ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে আক্রমণ চালান। তাঁর সার্বিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেন। কয়েক দিন ধরে সেখানে যুদ্ধ হয়। তাঁদের আক্রমণে রাজশাহীতে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়।
১২ এপ্রিল গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী একদল (কোম্পানি) সহযোদ্ধা নিয়ে পাবনার দিকে অগ্রসর হন। কিছুদূর (১০ মাইল) যাওয়ার পর তিনি ঢাকা থেকে আগত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি বড় দলের মুখোমুখি হন। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে কিছুটা পিছু হটে রাজশাহী ও সারদার মোড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন।
সেখানে আগে থেকেই গিয়াসউদ্দিনের অধীন মিশ্র বাহিনীর আরেক দল মুক্তিযোদ্ধা প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন। তাঁরা সবাই মিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। তখন সেখানে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তাঁদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
গিয়াসউদ্দিন ছত্রভঙ্গ মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশকে সংগঠিত করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি পুনরায় গোদাগাড়িতে অবস্থান নেন। রাজশাহী দখলের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোদাগাড়ি আক্রমণ করে। সেখানেও যুদ্ধ হয়। গোদাগাড়ির পতন হলে ২২ এপ্রিল তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতে যান।
ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর গিয়াসউদ্দিন সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় গেরিলাযুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওই এলাকায় অনেক গেরিলা অপারেশন করেন। এ সময় তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। এরপর তাঁকে প্রায় ১০ সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হয়।
এর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আনুষ্ঠানিক রূপ পায়। গিয়াসউদ্দিনের যুদ্ধ এলাকা ৭ নম্বর সেক্টরের আওতায় পড়ে। তখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। চিকিৎসকসহ সহযোদ্ধাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে তার পরও তিনি যুদ্ধে যোগ দেন। এরপর তিনি লালগোলা সাবসেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাবসেক্টরের বিভিন্ন স্থানে তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচালনায় অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কয়েকটি যুদ্ধে তিনি অগ্রভাগেও ছিলেন।
১৪ নভেম্বর শেষ রাত থেকে পরদিন সকাল নয়টা পর্যন্ত সোনা মসজিদ এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর এক ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সার্বিক নেতৃত্ব দেন। সেখানে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা। এর সামনে সীমান্তরেখা বরাবর ছিল কয়েক মাইল লম্বা বেশ চওড়া খাল। পাকিস্তানিদের বাংকার ও পরিখা ছিল খালের পাড়ে।
সে দিন শেষ রাতে ওই এলাকা ছিল অত্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন। সকাল নয়টার পরও কুয়াশা কাটেনি। তাঁর সহযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন। কিন্তু কুয়াশার কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উচ্ছেদ করতে পারেননি। তবে তাঁরা পাকিস্তানিদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম হন।
মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস ও বীরত্বের জন্য গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ০৫।
গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। অবসর নেওয়ার আগে প্রেষণে রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লা জেলার বরুড়া উপজেলার পায়েলগাছা গ্রামে। তবে স্থায়ীভাবে বাস করেন ঢাকায় (ঠিকানা ১০৯ পার্ক রোড, ব্লক এ, মহাখালী ডিওএইচএস)। তাঁর বাবার নাম শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। মা আফসারের নেছা। স্ত্রী মাহমুদা চৌধুরী। তাঁদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র, নবম ও দশম খণ্ড।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info
No comments