জীবন-সার্থকতা মৃত্যুর সৌন্দর্যে by রণজিৎ বিশ্বাস
মৃত্যু সম্পর্কে ধারণা খুব সিম্পল থাকাই ভালো। এটি এমন এক ঠিকানা অথবা গন্তব্য কিংবা স্টেশন, যেখানে প্রাণের সব গাড়ি এক সময় পেঁৗছবে ও থেমে পড়বে। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে। কিছুতেই তা আর চালু করা যাবে না। প্রাণের সব গাড়ি বলতে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে_ যাদের দেহ আছে ও দেহের ভেতর প্রাণ আছে, তাদের সবার জীবনগাড়ি।
শুধু মানুষের নয়, একটি এককোষী প্রাণী থেকে শুরু করে জটিলাতিজটিল মানুষের জীবনগাড়ি পর্যন্ত সবার প্রাণবাহন। দেহ একদিন খাঁচা হয়ে যাবে আর ভেতরের পাখি অবধারিতভাবে হাওয়া হয়ে যাবে।
মানুষ অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছে; কিন্তু তার জীবনে যতি নামানো এই মহাপ্রক্রিয়াকে থামানো কিংবা রোধ করা অথবা রদ করে ফেলা কিংবা বিলম্বিত করার মতো কোনো কৌশল এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। এটিই হতে পারে সবচেয়ে বড় প্রমাণক যে, মানুষের শক্তি অসীম নয়, মানুষ সীমাবদ্ধ প্রাণী। মানুষের জীবনে প্রারম্ভিক সমতা দেয় জন্ম, মৃত্যু তাকে দেয় প্রান্তিক সমতা। জন্মের সময় মানুষের জন্ম বা বিশ্বভুবনে তার অবতরণ হয় মানব সন্তান হিসেবে। আরও সহজভাবে বললে মনুষ্যশাবক হিসেবে। বাঘের বাচ্চা যেমন ব্যাঘ্রশাবক, সিংহের বাচ্চা যেমন সিংহশাবক, বিড়ালের বাচ্চা যেমন মার্জার শাবক, মানুষের বাচ্চা যেমন মনুষ্যশাবক অর্থাৎ মানুষের সন্তান, মানবসন্তান।
এই সমতা জন্মের পর থেকেই ঘুচতে শুরু করা হয়। পৃথিবীতে নামমাত্র তার ক্রন্দনের ভাষা এক হলেও তার আবাহন হয় একেকভাবে, একে প্রক্রিয়ায়, একেক মন্ত্রে, একেক শব্দে, একেক বাদ্য কিংবা ধ্বনিতে। বিশ্বাসভিত্তিক একেক আচরণে। বিভক্তি ও পার্থক্যের শুরুটা সেই বিন্দুতে হয় এবং হয়ে একটি মাত্র বৃক্ষের শাখা ও প্রশাখা ধরে ধরে এগোতে থাকে। মৃত্যু দেখতে দেখতেও, নিকটজনের বিয়োগব্যথা পেতে পেতেও মৃত্যুর কথা তার তেমন মনে থাকে না। বরং সে ভাবে অমুক গেছেতো গেছে, তমুক গেছেতো গেছে, বাবা গেছেতো গেছে, মা গেছেতো গেছে, বন্ধু গেছেতো গেছে, আমিতো আছি! ওরা যে গেছে, তাতে আমার কোনো দায় নেই; আমি যে বেঁচে আছি, তাতেও তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সবই প্রকৃতির খেলা, কেউ বলে নিয়তির খেলা, কেউ বলে ঊর্ধ্বলোকের খেলা, প্রভুর খেলা, মহাপ্রভুর খেলা; কেউ কেউ তার পরম উপাস্যের নাম ধরে বলে_ এ হলো গিয়ে তার খেলা। তিনি যেদিন চাইবেন, সেদিন নিয়ে যাবেন; যতদিন চাইবেন ততদিন রাখবেন। সময় না এলে মাথা কুটলেও আমি যেতে পারব না, সময় এলে মাথা কুটলেও আমি থাকতে পারব না। মানুষ এসব বলে তার বিশ্বাস, আধোবিশ্বাস, সংশয়, সাহস, ভয়, আনুগত্য এবং নির্ভরতা ও আত্মসমর্পণের লিপি-স্বরলিপি মেনে মেনে।
তবে এই মানামানির ব্যাপারটি সবাইকে মানতে হয়। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সংশয়বাদী নাস্তিক অথবা পেশার কিংবা নেশার যে পরিচয়েই বা স্তরেই মানুষ থাকুক না কেন, মানুষ জানে তার জীবন চিরদিনের জন্য নয়। তার নড়নসরণত্বরণ, তার উচ্ছ্বাস ও উল্লম্ফন একদিন থেমে যাবে। সে বিজ্ঞানী হোক কিংবা কলাবিশারদ, সন্ত্রাসশিল্পী কিংবা চৌর্যশিল্পী, মৌলবাদী কিংবা মানবতাবিরোধী, মুক্তিযোদ্ধা কিংবা যুদ্ধাপরাধী একদিন তার সবকিছুই জিরোতে এসে নামবে।
জন্ম ও মৃত্যু মধ্যবর্তী সময়টা নিয়ে মানবসাম্যের ব্যাপারে যত ভ্রান্তবিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ এক স্বশিক্ষিত মানুষের উচ্চারণে_
'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ছুন্নৎ দিলে হয় মুসলমান/নারীর বেলায় কী হয় বিধান/ব্রাহ্মণ চিনি পৈতে প্রমাণ/বামনী চিনি কী প্রকারে!/সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে!'
ভাবনার এই ডাল আমাদের মনোযোগ খুব কাড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের চারপাশের সমাজ সে সাক্ষ্য ভালোমতো জোগাতে পারছে না। তবে মৃত্যু ভাবনাকে যদি আমরা বিষয় মানি, অনেক চিন্তার মাঝে দুটো চিন্তা মাথা উঁচোয়। মৃত্যুর প্রয়োজন ও প্রস্তুতি। মৃত্যুর প্রয়োজন ছিল এবং মৃত্যুর প্রয়োজন আছে বলেই, যত প্রাণ এখন দেহ নিয়ে মাটির ওপরে নড়েচড়ে, তার শত সহস্র গুণ দেহ মাটিতে মিশে না গেলে এতদিনের এই পৃথিবীতে কারও দাঁড়ানোর জায়গা থাকত না, কারও জন্য খাওয়ার কোনো কণা জুটত না।
জরুরি এ মৃত্যুর প্রস্তুতি মানুষের এসে যায়। এক সময় মানুষ আবিষ্কার করে, তার চার পাশে ফাঁকা ভাবটাই বেশি। তার প্রিয় ও ভালোবাসার অনেক মানুষ জায়গা খালি করে চলে গেছে। তখন, আগ্রহে সে খুব উদ্বাহু না হলেও ভাবে_ যেখানে প্রিয়জন বেশি, আত্মীয় বেশি, বান্ধব বেশি, সেখানে যদি যে কোনো সময় চলে যেতে হয়ই, যাব! এতে এমন আর আফসোস কী! এমন আর মন খারাপ করে বসে থাকার কী!
চলে যাওয়ার এই যে কোনো দিনের জন্য প্রস্তুতিটা সবার সমান থাকে না। কারও কারও একেবারেই থাকে না। তাই অনেকেরই বোঝা হয় না জীবনের সার্থকতা জন্মের আভিজাত্যে কিংবা জমকেগমকে নয়, জীবনের সার্থকতা মৃত্যুর সৌন্দর্যে।
রণজিৎ বিশ্বাস :কথাসাহিত্যিক
মানুষ অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছে; কিন্তু তার জীবনে যতি নামানো এই মহাপ্রক্রিয়াকে থামানো কিংবা রোধ করা অথবা রদ করে ফেলা কিংবা বিলম্বিত করার মতো কোনো কৌশল এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। এটিই হতে পারে সবচেয়ে বড় প্রমাণক যে, মানুষের শক্তি অসীম নয়, মানুষ সীমাবদ্ধ প্রাণী। মানুষের জীবনে প্রারম্ভিক সমতা দেয় জন্ম, মৃত্যু তাকে দেয় প্রান্তিক সমতা। জন্মের সময় মানুষের জন্ম বা বিশ্বভুবনে তার অবতরণ হয় মানব সন্তান হিসেবে। আরও সহজভাবে বললে মনুষ্যশাবক হিসেবে। বাঘের বাচ্চা যেমন ব্যাঘ্রশাবক, সিংহের বাচ্চা যেমন সিংহশাবক, বিড়ালের বাচ্চা যেমন মার্জার শাবক, মানুষের বাচ্চা যেমন মনুষ্যশাবক অর্থাৎ মানুষের সন্তান, মানবসন্তান।
এই সমতা জন্মের পর থেকেই ঘুচতে শুরু করা হয়। পৃথিবীতে নামমাত্র তার ক্রন্দনের ভাষা এক হলেও তার আবাহন হয় একেকভাবে, একে প্রক্রিয়ায়, একেক মন্ত্রে, একেক শব্দে, একেক বাদ্য কিংবা ধ্বনিতে। বিশ্বাসভিত্তিক একেক আচরণে। বিভক্তি ও পার্থক্যের শুরুটা সেই বিন্দুতে হয় এবং হয়ে একটি মাত্র বৃক্ষের শাখা ও প্রশাখা ধরে ধরে এগোতে থাকে। মৃত্যু দেখতে দেখতেও, নিকটজনের বিয়োগব্যথা পেতে পেতেও মৃত্যুর কথা তার তেমন মনে থাকে না। বরং সে ভাবে অমুক গেছেতো গেছে, তমুক গেছেতো গেছে, বাবা গেছেতো গেছে, মা গেছেতো গেছে, বন্ধু গেছেতো গেছে, আমিতো আছি! ওরা যে গেছে, তাতে আমার কোনো দায় নেই; আমি যে বেঁচে আছি, তাতেও তাদের কোনো ভূমিকা নেই। সবই প্রকৃতির খেলা, কেউ বলে নিয়তির খেলা, কেউ বলে ঊর্ধ্বলোকের খেলা, প্রভুর খেলা, মহাপ্রভুর খেলা; কেউ কেউ তার পরম উপাস্যের নাম ধরে বলে_ এ হলো গিয়ে তার খেলা। তিনি যেদিন চাইবেন, সেদিন নিয়ে যাবেন; যতদিন চাইবেন ততদিন রাখবেন। সময় না এলে মাথা কুটলেও আমি যেতে পারব না, সময় এলে মাথা কুটলেও আমি থাকতে পারব না। মানুষ এসব বলে তার বিশ্বাস, আধোবিশ্বাস, সংশয়, সাহস, ভয়, আনুগত্য এবং নির্ভরতা ও আত্মসমর্পণের লিপি-স্বরলিপি মেনে মেনে।
তবে এই মানামানির ব্যাপারটি সবাইকে মানতে হয়। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সংশয়বাদী নাস্তিক অথবা পেশার কিংবা নেশার যে পরিচয়েই বা স্তরেই মানুষ থাকুক না কেন, মানুষ জানে তার জীবন চিরদিনের জন্য নয়। তার নড়নসরণত্বরণ, তার উচ্ছ্বাস ও উল্লম্ফন একদিন থেমে যাবে। সে বিজ্ঞানী হোক কিংবা কলাবিশারদ, সন্ত্রাসশিল্পী কিংবা চৌর্যশিল্পী, মৌলবাদী কিংবা মানবতাবিরোধী, মুক্তিযোদ্ধা কিংবা যুদ্ধাপরাধী একদিন তার সবকিছুই জিরোতে এসে নামবে।
জন্ম ও মৃত্যু মধ্যবর্তী সময়টা নিয়ে মানবসাম্যের ব্যাপারে যত ভ্রান্তবিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ এক স্বশিক্ষিত মানুষের উচ্চারণে_
'সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে/ছুন্নৎ দিলে হয় মুসলমান/নারীর বেলায় কী হয় বিধান/ব্রাহ্মণ চিনি পৈতে প্রমাণ/বামনী চিনি কী প্রকারে!/সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে!'
ভাবনার এই ডাল আমাদের মনোযোগ খুব কাড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের চারপাশের সমাজ সে সাক্ষ্য ভালোমতো জোগাতে পারছে না। তবে মৃত্যু ভাবনাকে যদি আমরা বিষয় মানি, অনেক চিন্তার মাঝে দুটো চিন্তা মাথা উঁচোয়। মৃত্যুর প্রয়োজন ও প্রস্তুতি। মৃত্যুর প্রয়োজন ছিল এবং মৃত্যুর প্রয়োজন আছে বলেই, যত প্রাণ এখন দেহ নিয়ে মাটির ওপরে নড়েচড়ে, তার শত সহস্র গুণ দেহ মাটিতে মিশে না গেলে এতদিনের এই পৃথিবীতে কারও দাঁড়ানোর জায়গা থাকত না, কারও জন্য খাওয়ার কোনো কণা জুটত না।
জরুরি এ মৃত্যুর প্রস্তুতি মানুষের এসে যায়। এক সময় মানুষ আবিষ্কার করে, তার চার পাশে ফাঁকা ভাবটাই বেশি। তার প্রিয় ও ভালোবাসার অনেক মানুষ জায়গা খালি করে চলে গেছে। তখন, আগ্রহে সে খুব উদ্বাহু না হলেও ভাবে_ যেখানে প্রিয়জন বেশি, আত্মীয় বেশি, বান্ধব বেশি, সেখানে যদি যে কোনো সময় চলে যেতে হয়ই, যাব! এতে এমন আর আফসোস কী! এমন আর মন খারাপ করে বসে থাকার কী!
চলে যাওয়ার এই যে কোনো দিনের জন্য প্রস্তুতিটা সবার সমান থাকে না। কারও কারও একেবারেই থাকে না। তাই অনেকেরই বোঝা হয় না জীবনের সার্থকতা জন্মের আভিজাত্যে কিংবা জমকেগমকে নয়, জীবনের সার্থকতা মৃত্যুর সৌন্দর্যে।
রণজিৎ বিশ্বাস :কথাসাহিত্যিক
No comments