সরেজমিন- ওবামার এই স্বপ্ন পূরণ হোক by মিজানুর রহমান খান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে এমন জয় পাওয়ার কথা ছিল না। নির্বাচনী প্রচার অভিযান যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। বিভিন্ন জরিপ ও সমীক্ষায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ধারণা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ৫০ অঙ্গরাজ্যের মধ্যে সুইং বা দোদুল্যমান হিসেবে চিহ্নিত ৮ থেকে ১০টি রাজ্যের অধিকাংশেই ওবামা এগিয়ে যান।
সে কারণেই ওবামার পুনর্নির্বাচিত হওয়া নিউইয়র্ক টাইমস-এর কথায়, ‘নাটকীয়’ এবং এপির বর্ণনায় ‘তাঁর আবারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা ছিল না।’
উপরন্তু আরও একটি আশঙ্কা ছিল, ওবামা যদি জিতেও যান তা হলেও সিনেটে তাঁর দলের শক্তি-ভারসাম্য টিকে থাকবে কি থাকবে না। কংগ্রেস হলো নিম্নকক্ষ। আর সিনেট উচ্চকক্ষ। কংগ্রেস আগে থেকেই রিপাবলিকানদের কবজায়। সিনেটেও তাদের কবজায় গেলে ওবামাকে অনেক বেশি কাষ্ঠ হাসি হাসতে হতো। কারণ, রিপাবলিকানরা তাঁকে পদে পদে হেনস্তা করার সুযোগ পেত। এখন সেটা ঘটবে না। প্রথম মেয়াদের মতোই বিভক্ত কংগ্রেস ও সিনেটে তাঁর দলের জোর নিয়ে তিনি চলতে পারবেন। সরকার চালানোর জন্য কংগ্রেসের চেয়ে সিনেট অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা বণ্টনে এমনই এক ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা থেকে কোনো ব্যক্তি, তা তিনি প্রেসিডেন্ট কিংবা যে পদেই থাকুন না কেন, তাঁর পক্ষে সমষ্টিকে অগ্রাহ্য বা প্রতিষ্ঠানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে চলা সম্ভব নয়। একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগসর্বস্ব বাংলাদেশি স্টাইলের শাসন, যা আসলেই এ দেশে ভোগ করা সম্ভব নয়।
ব্যক্তিকে যদি সমষ্টির মতামতকে পাত্তা না দিতে হয়, পার্লামেন্টকে যদি বছরের পর বছর ব্যক্তির বশংবদ রাখা হয়, তা হলে একটি অপ্রতিরোধ্য মোসাহেব গোষ্ঠী সৃষ্টি হতে পারে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রে কল্পনাও করা যায় না। পদ্ধতি সেটা কাউকে করতে দেবে না।
বারাক ওবামা নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম ভাষণ যেটি দিয়েছেন, তাতে তিনি বিরোধী দল ও তাঁর সবাইকে নিয়ে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের যে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তা বাংলাদেশে আমরা দেখি না। অথচ গণতান্ত্রিক শাসন চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই।
এটা দেখার বিষয়, অল্প সময়ের ব্যবধানে ওবামা কী করে তাঁর দলের প্রেসিডেন্টের গণ্ডি ছাড়িয়ে রিপাবলিকানদেরও, সবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে উন্নীত করেন।
শিকাগোতে ডেমোক্র্যাট সদর দপ্তরে ওবামা তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে যে জাতি প্রথম তার নিয়তি স্থির করার অধিকার পেয়েছিল, ৬ নভেম্বরে তারা এই জাতির ঐক্য আরও যথার্থ করার কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা একটি আমেরিকান পরিবার। আমাদের জেগে ওঠা কিংবা তলিয়ে যাওয়া হবে একটি জাতি ও জনগণ হিসেবেই।’
বাংলাদেশি নেতারা এ ধরনের উক্তি করতে এমনকি চিন্তা করতেও ভুলে গেছেন। তাঁরা বিভেদ, সংঘাত ও ঘৃণা ছড়ানোর কথাই বলেন। অপতৎপরতায় তাঁরা অবশ্য ঐক্যবদ্ধ। যেমন তাঁরা এখন আবদার করছেন যে সংসদে প্রস্তাবিত আচরণ নিয়ন্ত্রণ বিল পাস হতে দেবেন না। স্থানীয় সরকার যাতে তাঁরা বগলে রেখে বিশেষ নেতা-নেত্রীর মনোরঞ্জন করতে পারেন, এটা যাতে কখনোই যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো ক্ষমতাশালী না হতে পারে, সেটা তাঁরা আগলে রাখবেন। অগণতান্ত্রিক, অস্বচ্ছ ও কলুষিত প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন বেচাকেনার ধারা বজায় রেখে তথাকথিত দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে তুঘলকি রাজনীতিটাও চালিয়ে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্রকে হয়তো বুঝতে হবে, জঙ্গিবাদটা এ ধরনের রাজনীতিতে বেড়ে ওঠে। তাই আন্তসীমান্ত ও জঙ্গিবাদ দমাতে হলে এসব শাসনকে গণতন্ত্রমুখী করতে হবে। এতে বিশ্ব নিরাপদ থাকবে, যুক্তরাষ্ট্রও নিরাপদ থাকবে। আর এটা ওবামা ও তাঁর দলের মতো মেধাবী নেতৃত্বের মাথায় রাখতে হবে।
ওবামা বিরোধী দলের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সব সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করেছেন। তিনি তাই রমনির প্ল্যাকার্ড বহনকারী রাজনৈতিক কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এমনকি তিনি যখন বাক্যটি এ মর্মে শুরু করেছিলেন যে ‘আমি কিছুক্ষণ আগে গভর্নর রমনিকে অভিনন্দন জানিয়েছি’ তখন তা শুনে কিঞ্চিৎ উতলা হয়েছিলাম, আহা এই বাক্যটি এখন কীভাবে শেষ হতে পারে। কিন্তু ওবামা বলেন, ‘রমনিকে এই অভিনন্দন, তাঁর সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার জন্য।’ এমনকি রমনি ও তাঁর পরিবার জাতির জন্য যে সেবা দিচ্ছেন, সে জন্যও তিনি তাঁদের প্রশংসা করেন। রমনির পূর্বপুরুষকেও শ্রদ্ধা জানাতে ওবামা প্রগল্ভ ছিলেন। ‘এই দেশকে কীভাবে একত্রে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে জন্য আমি রমনির সঙ্গে বসার জন্য তাকিয়ে আছি।’ কিংবা ‘আমি আপনাদের কাছ থেকে শিখেছি। আপনারা আমাকে একজন উত্তম প্রেসিডেন্ট বানিয়েছেন।’ কৌতুক করেও এমন উক্তি বাংলাদেশসহ বহু জায়গা আছে, যেখানে উচ্চারিত হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রকে তোয়াজ করতে খাজাঞ্চিখানা উজাড় করে দরিদ্র মানুষের অর্থকড়ি খরচ করা হবে, আমাদের মন্ত্রী-নেতারা ওয়াশিংটনে এসে বাজার-সওদা করবেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেস্ক অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ঘুরঘুর করবেন, আরও বড় মন্ত্রীরা, প্রাতরাশে চা খেয়ে, একটু করমর্দন করে, লজ্জার মাথা খেয়ে সেসবকেই ‘শীর্ষ বৈঠক’ এবং তেমন ধরনের ছবি ছাপিয়ে নিজেকে ও জাতিকে ছোট করবেন, কিন্তু ওই রকম একটি উক্তি তাঁরা জিবে আনবেন না।
ওবামার গতকালের ভাষণটি অসাধারণ। প্রতিটি অক্ষরের জন্য তাঁকে অভিবাদন। কারণ, তাতে তিনি রাজনীতি, বিরোধী দল ও সরকারি দলের ভূমিকার বিষয়ে একটি রূপকল্প দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে।’ ওবামা বলেছেন, ‘৩০০ মিলিয়ন মানুষের গণতন্ত্র গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ হতে পারে। নির্বাচনের আগে আমরা যা নিয়ে বিতর্ক করেছি, তা নির্বাচনের পরও শেষ হবে না। এবং তা যেন শেষ নয়। সেটা উচিত হবে না। আমরা যে এ কথা বলছি সেটা প্রমাণ করে যে আমরা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’
এরপর ওবামা যে উক্তি করেন, সেটা আমাকে ভীষণ আন্দোলিত করে। তিনি যেন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে লক্ষ্য করে এ কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই যে আমরা যে বাক্স্বাধীনতা ভোগ করছি, আমরা যেভাবে ভোটাভুটির অনুষ্ঠান করছি, সেভাবে দূরবর্তী বহু জাতি তাদের জীবনের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, সেসব বিষয়ে মত প্রকাশ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রশ্নে নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তারাও আমাদের মতোই ভোট করে ক্ষমতার বদল দেখতে চায়।’
আমি যদি তাঁর এই বক্তব্য ঠিক অর্থে শ্রবণ করে থাকি, তা হলে আমি বলব, ওবামা যেন তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর বর্ণিত ওই ‘ডিসট্যান্ট নেশনস’-এর জনগণের জীবন থেকে দুঃখ ও যন্ত্রণার বোঝা লাঘবে বাস্তব পদক্ষেপ নেন। এ ধরনের ‘দূরবর্তী দেশ ও তার জনগণ’, যারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নির্বাচনের স্বপ্ন দেখে, তাদের জন্য ওবামার করণীয় আছে। এসব দেশের দুর্নীতি বন্ধে কংগ্রেসের পাস করা মিলিনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টের উদ্দেশ্য বিফলে গেছে। ওই সব দেশের শাসকেরা জনগণের টাকা মেরে, রাষ্ট্রের অর্থ লুট করার পরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বন্ধে মার্কিন সরকারের ‘ক্লিপটোক্রেসি’বিরোধী প্রকল্পও মনে হয় ভেস্তে গেছে। বিদেশি সামরিক কিংবা নির্বাচিত স্বৈরশাসকদের রক্ষা ও তাদের লালন-পালনে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রণযোগ্য ও বিতর্কিত ইতিহাস রয়েছে, এখনো তার ধারা চলছে, তাই তাঁকে ঘিরে যে সন্দেহ-সংশয়, তা আমলে নিতেই হবে। ওই উক্তির মধ্যে ওবামা যে দরদ দেখিয়েছেন তার আলোকে যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন, তা হলেই তা অর্থপূর্ণ হতে পারে। না হলে তা বাগড়ম্বরই থেকে যাবে।
প্রস্তাবিত ড্রিম অ্যাক্ট পাস হলে অভিবাসীরা খুশি হবে। গণভোটে দেওয়া এই প্রশ্নটি এবার উতরে যাবে বলেই মনে হয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে অভিবাসীদের প্রশ্নে ওবামা যা বলেছেন, তা হূদয়ছোঁয়া। এটা তাঁর ও আমেরিকাবাসীর পূর্বপুরুষের প্রতি রক্তের ঋণ বটে।
নিউইয়র্কের স্টাচু অব লিবার্টি দ্বীপে দেখেছিলাম একটি প্রাচীন ট্রেনের মূর্তি। ২০০ বছর আগের আমেরিকায় কালিঝুলি মাখা ক্রীতদাসরা আসছেন। পথে পথে বাধা। লন্ডনের মাদাম তুসোর জাদুঘরের মতো সেই দৃশ্য জীবন্ত ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে স্বাধীনতার দ্বীপে।
ওবামার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তিনি যেন সেই ট্রেনটাকে চলতে দিতে চান। বা তাঁর কথা যেন স্টেশন মাস্টারের ঘণ্টাধ্বনি। ‘আমরা এক সহূদয়, করুণাময়, সহিষ্ণু আমেরিকা চাই। যেখানে অভিবাসীদের ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখবে তারা এ দেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উদ্যোক্তা, এমনকি প্রেসিডেন্ট হবে।’ এ কথার পরই সবচেয়ে বেশি করতালি পড়ে। ‘এখানেই আমাদের ভবিষ্যৎ, এটাই আমাদের গন্তব্য, এটাই আমাদের আশা-ভরসা।’ ওবামা একই কথা স্তোত্র পাঠের গাম্ভীর্যে বারবার উচ্চারণ করছিলেন। করতালি আর থামছিল না।
ওবামার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলি, অবশ্যই সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নয়, আমেরিকার জ্ঞানের টানেই আমরা তাদের উপকূলে যাব। আমেরিকার নিরাপত্তার চাবিকাঠি অবশিষ্ট বিশ্বের অধিকতর নিরাপত্তার মধ্যেও নিহিত। আর এই নিরাপত্তার মারাত্মক হুমকি জঙ্গিরা নয়, গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী, ওরাই ওদের সত্যিকারের পৃষ্ঠপোষক।
রমনির মন্তব্য দিয়ে শেষ করি। তিনিও দারুণ ঔদার্য দেখিয়েছেন। প্রচার শেষে যেভাবে অভিযোগ করা শুরু হয়েছিল, তাতে এমন নির্বিঘ্নে শেষ অধ্যায়টি মঞ্চস্থ হবে, তা নিয়ে কারও মনে যে খটকা ছিলই না, তা কিন্তু নয়। নির্বাচনী পরাজয় মেনে রমনি বলেন, ‘আমি যদি নির্বাচিত হতাম তা হলে দেশকে ভালোভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আপনাদের আশা পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু জাতি অন্য একজনকে নেতা বেছে নিয়েছে। তাই আমি ও আমার স্ত্রী অ্যান প্রেসিডেন্ট ওবামা ও এই মহান জাতির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করছি।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
উপরন্তু আরও একটি আশঙ্কা ছিল, ওবামা যদি জিতেও যান তা হলেও সিনেটে তাঁর দলের শক্তি-ভারসাম্য টিকে থাকবে কি থাকবে না। কংগ্রেস হলো নিম্নকক্ষ। আর সিনেট উচ্চকক্ষ। কংগ্রেস আগে থেকেই রিপাবলিকানদের কবজায়। সিনেটেও তাদের কবজায় গেলে ওবামাকে অনেক বেশি কাষ্ঠ হাসি হাসতে হতো। কারণ, রিপাবলিকানরা তাঁকে পদে পদে হেনস্তা করার সুযোগ পেত। এখন সেটা ঘটবে না। প্রথম মেয়াদের মতোই বিভক্ত কংগ্রেস ও সিনেটে তাঁর দলের জোর নিয়ে তিনি চলতে পারবেন। সরকার চালানোর জন্য কংগ্রেসের চেয়ে সিনেট অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা বণ্টনে এমনই এক ভারসাম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা থেকে কোনো ব্যক্তি, তা তিনি প্রেসিডেন্ট কিংবা যে পদেই থাকুন না কেন, তাঁর পক্ষে সমষ্টিকে অগ্রাহ্য বা প্রতিষ্ঠানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে চলা সম্ভব নয়। একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগসর্বস্ব বাংলাদেশি স্টাইলের শাসন, যা আসলেই এ দেশে ভোগ করা সম্ভব নয়।
ব্যক্তিকে যদি সমষ্টির মতামতকে পাত্তা না দিতে হয়, পার্লামেন্টকে যদি বছরের পর বছর ব্যক্তির বশংবদ রাখা হয়, তা হলে একটি অপ্রতিরোধ্য মোসাহেব গোষ্ঠী সৃষ্টি হতে পারে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রে কল্পনাও করা যায় না। পদ্ধতি সেটা কাউকে করতে দেবে না।
বারাক ওবামা নির্বাচন-পরবর্তী প্রথম ভাষণ যেটি দিয়েছেন, তাতে তিনি বিরোধী দল ও তাঁর সবাইকে নিয়ে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের যে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন, তা বাংলাদেশে আমরা দেখি না। অথচ গণতান্ত্রিক শাসন চাইলে এর কোনো বিকল্প নেই।
এটা দেখার বিষয়, অল্প সময়ের ব্যবধানে ওবামা কী করে তাঁর দলের প্রেসিডেন্টের গণ্ডি ছাড়িয়ে রিপাবলিকানদেরও, সবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে উন্নীত করেন।
শিকাগোতে ডেমোক্র্যাট সদর দপ্তরে ওবামা তাঁর ভাষণের শুরুতেই বলেন, ‘২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে যে জাতি প্রথম তার নিয়তি স্থির করার অধিকার পেয়েছিল, ৬ নভেম্বরে তারা এই জাতির ঐক্য আরও যথার্থ করার কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা একটি আমেরিকান পরিবার। আমাদের জেগে ওঠা কিংবা তলিয়ে যাওয়া হবে একটি জাতি ও জনগণ হিসেবেই।’
বাংলাদেশি নেতারা এ ধরনের উক্তি করতে এমনকি চিন্তা করতেও ভুলে গেছেন। তাঁরা বিভেদ, সংঘাত ও ঘৃণা ছড়ানোর কথাই বলেন। অপতৎপরতায় তাঁরা অবশ্য ঐক্যবদ্ধ। যেমন তাঁরা এখন আবদার করছেন যে সংসদে প্রস্তাবিত আচরণ নিয়ন্ত্রণ বিল পাস হতে দেবেন না। স্থানীয় সরকার যাতে তাঁরা বগলে রেখে বিশেষ নেতা-নেত্রীর মনোরঞ্জন করতে পারেন, এটা যাতে কখনোই যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো ক্ষমতাশালী না হতে পারে, সেটা তাঁরা আগলে রাখবেন। অগণতান্ত্রিক, অস্বচ্ছ ও কলুষিত প্রক্রিয়ায় মনোনয়ন বেচাকেনার ধারা বজায় রেখে তথাকথিত দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে তুঘলকি রাজনীতিটাও চালিয়ে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্রকে হয়তো বুঝতে হবে, জঙ্গিবাদটা এ ধরনের রাজনীতিতে বেড়ে ওঠে। তাই আন্তসীমান্ত ও জঙ্গিবাদ দমাতে হলে এসব শাসনকে গণতন্ত্রমুখী করতে হবে। এতে বিশ্ব নিরাপদ থাকবে, যুক্তরাষ্ট্রও নিরাপদ থাকবে। আর এটা ওবামা ও তাঁর দলের মতো মেধাবী নেতৃত্বের মাথায় রাখতে হবে।
ওবামা বিরোধী দলের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সব সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করেছেন। তিনি তাই রমনির প্ল্যাকার্ড বহনকারী রাজনৈতিক কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এমনকি তিনি যখন বাক্যটি এ মর্মে শুরু করেছিলেন যে ‘আমি কিছুক্ষণ আগে গভর্নর রমনিকে অভিনন্দন জানিয়েছি’ তখন তা শুনে কিঞ্চিৎ উতলা হয়েছিলাম, আহা এই বাক্যটি এখন কীভাবে শেষ হতে পারে। কিন্তু ওবামা বলেন, ‘রমনিকে এই অভিনন্দন, তাঁর সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার জন্য।’ এমনকি রমনি ও তাঁর পরিবার জাতির জন্য যে সেবা দিচ্ছেন, সে জন্যও তিনি তাঁদের প্রশংসা করেন। রমনির পূর্বপুরুষকেও শ্রদ্ধা জানাতে ওবামা প্রগল্ভ ছিলেন। ‘এই দেশকে কীভাবে একত্রে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সে জন্য আমি রমনির সঙ্গে বসার জন্য তাকিয়ে আছি।’ কিংবা ‘আমি আপনাদের কাছ থেকে শিখেছি। আপনারা আমাকে একজন উত্তম প্রেসিডেন্ট বানিয়েছেন।’ কৌতুক করেও এমন উক্তি বাংলাদেশসহ বহু জায়গা আছে, যেখানে উচ্চারিত হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রকে তোয়াজ করতে খাজাঞ্চিখানা উজাড় করে দরিদ্র মানুষের অর্থকড়ি খরচ করা হবে, আমাদের মন্ত্রী-নেতারা ওয়াশিংটনে এসে বাজার-সওদা করবেন, স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডেস্ক অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ঘুরঘুর করবেন, আরও বড় মন্ত্রীরা, প্রাতরাশে চা খেয়ে, একটু করমর্দন করে, লজ্জার মাথা খেয়ে সেসবকেই ‘শীর্ষ বৈঠক’ এবং তেমন ধরনের ছবি ছাপিয়ে নিজেকে ও জাতিকে ছোট করবেন, কিন্তু ওই রকম একটি উক্তি তাঁরা জিবে আনবেন না।
ওবামার গতকালের ভাষণটি অসাধারণ। প্রতিটি অক্ষরের জন্য তাঁকে অভিবাদন। কারণ, তাতে তিনি রাজনীতি, বিরোধী দল ও সরকারি দলের ভূমিকার বিষয়ে একটি রূপকল্প দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে।’ ওবামা বলেছেন, ‘৩০০ মিলিয়ন মানুষের গণতন্ত্র গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ হতে পারে। নির্বাচনের আগে আমরা যা নিয়ে বিতর্ক করেছি, তা নির্বাচনের পরও শেষ হবে না। এবং তা যেন শেষ নয়। সেটা উচিত হবে না। আমরা যে এ কথা বলছি সেটা প্রমাণ করে যে আমরা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’
এরপর ওবামা যে উক্তি করেন, সেটা আমাকে ভীষণ আন্দোলিত করে। তিনি যেন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে লক্ষ্য করে এ কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই যে আমরা যে বাক্স্বাধীনতা ভোগ করছি, আমরা যেভাবে ভোটাভুটির অনুষ্ঠান করছি, সেভাবে দূরবর্তী বহু জাতি তাদের জীবনের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, সেসব বিষয়ে মত প্রকাশ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রশ্নে নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। তারাও আমাদের মতোই ভোট করে ক্ষমতার বদল দেখতে চায়।’
আমি যদি তাঁর এই বক্তব্য ঠিক অর্থে শ্রবণ করে থাকি, তা হলে আমি বলব, ওবামা যেন তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর বর্ণিত ওই ‘ডিসট্যান্ট নেশনস’-এর জনগণের জীবন থেকে দুঃখ ও যন্ত্রণার বোঝা লাঘবে বাস্তব পদক্ষেপ নেন। এ ধরনের ‘দূরবর্তী দেশ ও তার জনগণ’, যারা যুক্তরাষ্ট্রের মতো নির্বাচনের স্বপ্ন দেখে, তাদের জন্য ওবামার করণীয় আছে। এসব দেশের দুর্নীতি বন্ধে কংগ্রেসের পাস করা মিলিনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টের উদ্দেশ্য বিফলে গেছে। ওই সব দেশের শাসকেরা জনগণের টাকা মেরে, রাষ্ট্রের অর্থ লুট করার পরে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া বন্ধে মার্কিন সরকারের ‘ক্লিপটোক্রেসি’বিরোধী প্রকল্পও মনে হয় ভেস্তে গেছে। বিদেশি সামরিক কিংবা নির্বাচিত স্বৈরশাসকদের রক্ষা ও তাদের লালন-পালনে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রণযোগ্য ও বিতর্কিত ইতিহাস রয়েছে, এখনো তার ধারা চলছে, তাই তাঁকে ঘিরে যে সন্দেহ-সংশয়, তা আমলে নিতেই হবে। ওই উক্তির মধ্যে ওবামা যে দরদ দেখিয়েছেন তার আলোকে যদি উপযুক্ত ব্যবস্থা নেন, তা হলেই তা অর্থপূর্ণ হতে পারে। না হলে তা বাগড়ম্বরই থেকে যাবে।
প্রস্তাবিত ড্রিম অ্যাক্ট পাস হলে অভিবাসীরা খুশি হবে। গণভোটে দেওয়া এই প্রশ্নটি এবার উতরে যাবে বলেই মনে হয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে অভিবাসীদের প্রশ্নে ওবামা যা বলেছেন, তা হূদয়ছোঁয়া। এটা তাঁর ও আমেরিকাবাসীর পূর্বপুরুষের প্রতি রক্তের ঋণ বটে।
নিউইয়র্কের স্টাচু অব লিবার্টি দ্বীপে দেখেছিলাম একটি প্রাচীন ট্রেনের মূর্তি। ২০০ বছর আগের আমেরিকায় কালিঝুলি মাখা ক্রীতদাসরা আসছেন। পথে পথে বাধা। লন্ডনের মাদাম তুসোর জাদুঘরের মতো সেই দৃশ্য জীবন্ত ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে স্বাধীনতার দ্বীপে।
ওবামার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তিনি যেন সেই ট্রেনটাকে চলতে দিতে চান। বা তাঁর কথা যেন স্টেশন মাস্টারের ঘণ্টাধ্বনি। ‘আমরা এক সহূদয়, করুণাময়, সহিষ্ণু আমেরিকা চাই। যেখানে অভিবাসীদের ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখবে তারা এ দেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উদ্যোক্তা, এমনকি প্রেসিডেন্ট হবে।’ এ কথার পরই সবচেয়ে বেশি করতালি পড়ে। ‘এখানেই আমাদের ভবিষ্যৎ, এটাই আমাদের গন্তব্য, এটাই আমাদের আশা-ভরসা।’ ওবামা একই কথা স্তোত্র পাঠের গাম্ভীর্যে বারবার উচ্চারণ করছিলেন। করতালি আর থামছিল না।
ওবামার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলি, অবশ্যই সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব নয়, আমেরিকার জ্ঞানের টানেই আমরা তাদের উপকূলে যাব। আমেরিকার নিরাপত্তার চাবিকাঠি অবশিষ্ট বিশ্বের অধিকতর নিরাপত্তার মধ্যেও নিহিত। আর এই নিরাপত্তার মারাত্মক হুমকি জঙ্গিরা নয়, গণবিরোধী শাসকগোষ্ঠী, ওরাই ওদের সত্যিকারের পৃষ্ঠপোষক।
রমনির মন্তব্য দিয়ে শেষ করি। তিনিও দারুণ ঔদার্য দেখিয়েছেন। প্রচার শেষে যেভাবে অভিযোগ করা শুরু হয়েছিল, তাতে এমন নির্বিঘ্নে শেষ অধ্যায়টি মঞ্চস্থ হবে, তা নিয়ে কারও মনে যে খটকা ছিলই না, তা কিন্তু নয়। নির্বাচনী পরাজয় মেনে রমনি বলেন, ‘আমি যদি নির্বাচিত হতাম তা হলে দেশকে ভালোভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আপনাদের আশা পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু জাতি অন্য একজনকে নেতা বেছে নিয়েছে। তাই আমি ও আমার স্ত্রী অ্যান প্রেসিডেন্ট ওবামা ও এই মহান জাতির মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করছি।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments