কৃষি- সোনালি ফসলের পাশে কৃষকের মুখ by তুহিন ওয়াদুদ
বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই, হেমন্তের রোদে গ্রামে সবুজের পাশের বিস্তীর্ণ মাঠ এখন পাকা ধানে সোনালি হয়ে উঠেছে। কিন্তু কৃষকের মনে সেই সোনারং নেই; বিবর্ণ কৃষক, ফসলভরা মাঠের পাশে দাঁড়িয়েও তাঁরা হাসেন না! কয়েক মৌসুম ধরে কৃষক ধান উৎপাদনে যে টাকা ব্যয় করছেন, বিক্রয়মূল্য কখনো তার সমান আবার কখনো কখনো তার চেয়ে কম।
বর্তমানে ধানের মূল্য কম হওয়ার কারণে দিনমজুর কিংবা হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ যাঁরা চাল কিনে থাকেন, তাঁরা সবাই উপকৃত হচ্ছেন। দেশের প্রথম মৌলিক চাহিদা কম মূল্যে পাওয়া যায়, সেটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কিন্তু যাঁরা উৎপাদন করে থাকেন তাঁদের ক্ষতি করে এই সুবিধা খুব বেশি দিন পাওয়া যাবে না। কারণ, কৃষকেরা উৎপাদনমুখী না হলে আবার পরিস্থিতি আগের অবস্থায়ই ফিরবে। কমপক্ষে যতখানি লাভে কৃষকেরা নিরুৎসাহিত না হন, সরকারকে সেই পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। বিশ্বব্যাপী কৃষি খাতে নামমাত্র ভর্তুকিও কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে কোনো শক্তিশালী কৃষক সংগঠনও নেই, যারা কৃষকদের স্বার্থ দেখবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশে শক্তিশালী কৃষক সংগঠন আছে।
৫ শতাংশ ধানের জমিতে ধান চাষে ব্যয় হয়: বীজ ৫০ টাকা, বীজ রোপণ ১০০ টাকা, চাষ করা ১৬০ টাকা, রোপণ মজুরি ১৫০ টাকা, নিড়ানি (দুবার) ২০০ টাকা, সার ১৫০ টাকা, কাটা ১৫০ টাকা, কীটনাশক ১০০ টাকা, মাড়াই ও হাটে নেওয়া ৬০ টাকা = মোট এক হাজার ১২০ টাকা। ৫ শতাংশ জমিতে ধান হবে দুই মণ অর্থাৎ ৮০ কেজি, এতে করে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ব্যয় ১৪ টাকা। জমির পরিমাণ বেড়ে গেলে ব্যয় কিছুটা কমে আসে। জমির ভাড়া ও তত্ত্বাবধায়কের পারিশ্রমিক ধরলে সেই হিসাব করে চলতি আমন মৌসুমে স্থানবিশেষে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪ দশমিক ৫০ থেকে ১৬ দশমিক ৫০ টাকা। বোরো মৌসুমের উৎপাদনে আরও বেশি ব্যয় হয়। কৃষকেরা কৃষিঋণ নিয়ে হোক, মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে হোক ধান উৎপাদন করেন। ফলে তাঁদের সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য হলেও মৌসুমেই ধান বিক্রি করতে হয়।
২৪ অক্টোবর প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি খবরে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেখানকার কৃষকদের দুর্গতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘আগের দাদনের টাকা তাঁরা শোধ করতে পারছেন না, আবার নতুন করে দাদন নিতে হচ্ছে।’ ফলে উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বিক্রয়মূল্য কম হলে এসব কৃষক চোখে সরষে ফুল দেখবেন। সরকার হয়তো কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার নামে বেশ কিছু ধান ক্রয় করবে নির্ধারিত বেশি মূল্যে। প্রতিবছর সরকার যখন ধান ক্রয় করে, সেই ধান কৃষকের কাছ থেকে খুব কমই কেনা হয়। সেই ধান কেনা হয় মধ্যস্বত্বভোগী ধান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে; যার মূলে নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকারদলীয়দের বৃত্তবন্দী। প্রকৃত অর্থে যদি সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে চায়, তা হলে প্রতি ইউনিয়ন থেকেও নয়, প্রতি ওয়ার্ড থেকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে। এতে করে সামান্য পরিমাণ হলেও ক্ষতি পূরণ হবে।
যদি ধানচাষের উপযোগী প্রতি শতাংশ জমির মূল্য হয় ২০ হাজার টাকা, তা হলে ৫ শতাংশ জমির মূল্য হবে এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাখলে এক বছরে ১২ হাজার টাকা পাওয়া সম্ভব। সেই ১২ হাজার টাকায় প্রায় ২৪ মণ ধান পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে কৃষির উন্নয়নের ভেতর দিয়ে অনেক হতদরিদ্রেরও তিন বেলা খাওয়ার অনেকখানি নিশ্চয়তা হয়েছে। বিশেষ করে ধানের মূল্য কম হওয়ার কারণে এক দিন একজন দিনমজুর কাজ করে যে টাকা পান, সেই টাকায় প্রায় ১০ থেকে ১৫ কেজি চাল ক্রয় করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে দিনমজুরদের এই সুবিধা সৃষ্টি করতে পারাটা অনেক বড় ব্যাপার। এখন যে কৃষক মাঠে ধান ফলান, তাঁর ব্যয়ের মাত্রাটা কমাতে পারলে কৃষকসহ দেশবাসী উপকৃত হবেন। ধানের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আনাটা তখন ইতিবাচক হবে, যখন উৎপাদনকারী লোকসান করবে না। ধান উৎপাদনকারীদের সংখ্যাই দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী।
যে কাজটি সরকারের করাটা ভীষণ প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে কৃষি উৎপাদনে ভর্তুকি বাড়ানো। সার, সেচ, কীটনাশক, জ্বালনি নামমাত্র মূল্যে অথবা বিনা মূল্যে নিয়ে এসে কৃষকদের পাশে সরকার দাঁড়াতে সমর্থ হলে কৃষিজগতের অস্থিরতা হ্রাস পাবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় কৃষিকে ব্যাপক হারে যন্ত্রনির্ভর করতে হবে। এতে করেও কৃষি উৎপাদনে ব্যয় অনেক কমে আসবে, সময় সাশ্রয় হবে। এই প্রকল্পে যত টাকাই ভর্তুকি দেওয়া হোক না কেন, তা দেশের কল্যাণই বয়ে আনবে।
কয়েক বছর আগেও কৃষকেরা অপেক্ষা করে থাকতেন, ধান কাটা হলে সেই ধান বাজারে বিক্রি করেন সন্তানের নতুন জামা, স্ত্রীর নতুন শাড়ি, নিজের নতুন লুঙ্গি কেনার জন্য। সংসারের যত আর্থিক সমস্যা আছে, তা সমাধানের জন্যও অপেক্ষা করে থাকতেন কৃষক ফসল কাটা পর্যন্ত। নতুন ধানে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠত। সেই নতুন ধান এখনো আছে, কিন্তু সেই ধানে আর আগের মতো আনন্দ লেগে নেই।
হতাশ হয়ো না কৃষকবন্ধু, মনে রেখো দিনেশ দাশের লেখা কবিতার পঙিক্ত—বেয়নেট হ’ক যত ধারালো/ কাস্তেটা ধার দিও বন্ধু।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com
৫ শতাংশ ধানের জমিতে ধান চাষে ব্যয় হয়: বীজ ৫০ টাকা, বীজ রোপণ ১০০ টাকা, চাষ করা ১৬০ টাকা, রোপণ মজুরি ১৫০ টাকা, নিড়ানি (দুবার) ২০০ টাকা, সার ১৫০ টাকা, কাটা ১৫০ টাকা, কীটনাশক ১০০ টাকা, মাড়াই ও হাটে নেওয়া ৬০ টাকা = মোট এক হাজার ১২০ টাকা। ৫ শতাংশ জমিতে ধান হবে দুই মণ অর্থাৎ ৮০ কেজি, এতে করে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ব্যয় ১৪ টাকা। জমির পরিমাণ বেড়ে গেলে ব্যয় কিছুটা কমে আসে। জমির ভাড়া ও তত্ত্বাবধায়কের পারিশ্রমিক ধরলে সেই হিসাব করে চলতি আমন মৌসুমে স্থানবিশেষে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৪ দশমিক ৫০ থেকে ১৬ দশমিক ৫০ টাকা। বোরো মৌসুমের উৎপাদনে আরও বেশি ব্যয় হয়। কৃষকেরা কৃষিঋণ নিয়ে হোক, মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে হোক ধান উৎপাদন করেন। ফলে তাঁদের সেই ঋণ পরিশোধ করার জন্য হলেও মৌসুমেই ধান বিক্রি করতে হয়।
২৪ অক্টোবর প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি খবরে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সেখানকার কৃষকদের দুর্গতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘আগের দাদনের টাকা তাঁরা শোধ করতে পারছেন না, আবার নতুন করে দাদন নিতে হচ্ছে।’ ফলে উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে বিক্রয়মূল্য কম হলে এসব কৃষক চোখে সরষে ফুল দেখবেন। সরকার হয়তো কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার নামে বেশ কিছু ধান ক্রয় করবে নির্ধারিত বেশি মূল্যে। প্রতিবছর সরকার যখন ধান ক্রয় করে, সেই ধান কৃষকের কাছ থেকে খুব কমই কেনা হয়। সেই ধান কেনা হয় মধ্যস্বত্বভোগী ধান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে; যার মূলে নিয়ন্ত্রণ থাকে সরকারদলীয়দের বৃত্তবন্দী। প্রকৃত অর্থে যদি সরকার কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে চায়, তা হলে প্রতি ইউনিয়ন থেকেও নয়, প্রতি ওয়ার্ড থেকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করতে হবে। এতে করে সামান্য পরিমাণ হলেও ক্ষতি পূরণ হবে।
যদি ধানচাষের উপযোগী প্রতি শতাংশ জমির মূল্য হয় ২০ হাজার টাকা, তা হলে ৫ শতাংশ জমির মূল্য হবে এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাখলে এক বছরে ১২ হাজার টাকা পাওয়া সম্ভব। সেই ১২ হাজার টাকায় প্রায় ২৪ মণ ধান পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে কৃষির উন্নয়নের ভেতর দিয়ে অনেক হতদরিদ্রেরও তিন বেলা খাওয়ার অনেকখানি নিশ্চয়তা হয়েছে। বিশেষ করে ধানের মূল্য কম হওয়ার কারণে এক দিন একজন দিনমজুর কাজ করে যে টাকা পান, সেই টাকায় প্রায় ১০ থেকে ১৫ কেজি চাল ক্রয় করা সম্ভব। নিঃসন্দেহে দিনমজুরদের এই সুবিধা সৃষ্টি করতে পারাটা অনেক বড় ব্যাপার। এখন যে কৃষক মাঠে ধান ফলান, তাঁর ব্যয়ের মাত্রাটা কমাতে পারলে কৃষকসহ দেশবাসী উপকৃত হবেন। ধানের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আনাটা তখন ইতিবাচক হবে, যখন উৎপাদনকারী লোকসান করবে না। ধান উৎপাদনকারীদের সংখ্যাই দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠী।
যে কাজটি সরকারের করাটা ভীষণ প্রয়োজন, সেটা হচ্ছে কৃষি উৎপাদনে ভর্তুকি বাড়ানো। সার, সেচ, কীটনাশক, জ্বালনি নামমাত্র মূল্যে অথবা বিনা মূল্যে নিয়ে এসে কৃষকদের পাশে সরকার দাঁড়াতে সমর্থ হলে কৃষিজগতের অস্থিরতা হ্রাস পাবে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের আওতায় কৃষিকে ব্যাপক হারে যন্ত্রনির্ভর করতে হবে। এতে করেও কৃষি উৎপাদনে ব্যয় অনেক কমে আসবে, সময় সাশ্রয় হবে। এই প্রকল্পে যত টাকাই ভর্তুকি দেওয়া হোক না কেন, তা দেশের কল্যাণই বয়ে আনবে।
কয়েক বছর আগেও কৃষকেরা অপেক্ষা করে থাকতেন, ধান কাটা হলে সেই ধান বাজারে বিক্রি করেন সন্তানের নতুন জামা, স্ত্রীর নতুন শাড়ি, নিজের নতুন লুঙ্গি কেনার জন্য। সংসারের যত আর্থিক সমস্যা আছে, তা সমাধানের জন্যও অপেক্ষা করে থাকতেন কৃষক ফসল কাটা পর্যন্ত। নতুন ধানে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠত। সেই নতুন ধান এখনো আছে, কিন্তু সেই ধানে আর আগের মতো আনন্দ লেগে নেই।
হতাশ হয়ো না কৃষকবন্ধু, মনে রেখো দিনেশ দাশের লেখা কবিতার পঙিক্ত—বেয়নেট হ’ক যত ধারালো/ কাস্তেটা ধার দিও বন্ধু।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com
No comments