রাজা আসেনি বাদ্য বাজাও by সুশান্ত মজুমদার
মাইল নিঃশ্বাসে রেখে অবিরাম দৌড়ে সে মুক্তাঞ্চলে এসে পড়ে। তার বুকের কলকব্জা তরুণ, জং পড়ার মতো কলঙ্ক ধারণ করেনি বলে অমন সুদীর্ঘ দৌড়ে সে কয়েক মাইল পেরে যায়। এই দূরপাল্লার দৌড়ে কোথা থেকে কোথায় এলো তা-ও জানে না। তার সচল পা ফসলহীন মাঠের পর মাঠ পার হয়েছে।
সে জানে না দক্ষিণের নোনা পানি ভেঙে, খাল ঝাঁপিয়ে, লতাপাতা ছিঁড়ে, উলু ঘাস মাড়িয়ে, মরা গুগলি-শামুক ভেঙে, উত্তরের উর্বর সমতলে এসে উঠেছে। তাকে থামিয়ে দিতে দুজন কৌতূহলী মুক্তিযোদ্ধা ঝাঁপিয়ে না পড়লে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে সে চলে যেতে পারত। তার পেছনে কোলাহল, যে কোলাহলের মর্মে রয়েছে জিজ্ঞাসা_কেন এই দৌড়, কোত্থেকে শুরু, কোথায় গিয়ে সাঙ্গ হবে_এসব নীরব প্রশ্নের কিছুই জানে না সে। তাকে থামিয়ে দিতেই সে ভেঙে পড়ে এবং পুরোপুরি জ্ঞানের বাইরে চলে যায়। আকাশের আগুন তখন মরে আসছে কমান্ডারের হুইসেল বেজেও অকেজো থেকে যায়। তিনি ভারি বিরক্ত হন_তাঁর নির্ধারিত বাণীদান আর সম্ভব হয় না।
লোকের পেছন ধরে সে ছিল হাটের পথে। বাদশা মিয়ার নিঃস্ব স্বর, তবু অভ্যাসে গলা চড়ে নির্দেশের মতো শোনায়_'বৎস, আমরা অন্নহীন। হাটে যাও।' হুকুম মান্য করে_'জ্বী, জাঁহাপনা' বলে, ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ হয়েও সে অচেনা হাটের পথে বেরিয়ে পড়ে। পথে পথে ঘাসের চাপড়া_দুপাশে হেজিপেজি লতাপাতার ঝাড়, ভেতরে দু-একটি দুর্দশাগ্রস্ত দোচালা_মনুষ্যহীন। সব মানুষই কি হাটে গেছে? হাটুরে লোকের হাতে ব্যাগ দেখে তার খেয়াল হয়_বাজারের জন্য সে কিছুই আনেনি, কেবল পকেটে বাদশা মিয়ার দেওয়া পনেরো টাকা। ব্যাগ ছাড়া বাজার, নতুন এই উদ্যোগে সে খুশি হয়। অনভ্যস্ত হলেও আনন্দে দুটি সাঁকো পেরিয়ে যেতে পারে পথের ধুলোয় লাথি মেরে মেরে নিজের গোড়ালি সাদা করে এনেও সে খুশি। তার এই খুশি তৎপরতা মানুষের চোখে পড়ে এবং গ্রামে এমন অচেনা তরুণ দেখে এক বয়সী হাটুরে ঘাড় ঘোরায়_'কোত্থেকে আসতিছ?' উত্তর দিতে সে দাঁড়ায় এবং হাত ঘুরিয়ে তলোয়ার চালনা করে_'এখনো শত্রুকে ক্ষমা? না মহারাজ। সুযোগ পেলে করেন।' 'আপনাকে হত্যা করবে' এই উচ্চারণে জানিয়ে দেয় সে যাত্রার লোক। লোকটা দারুণ অপছন্দ করে তাকে। সে গায়ে পড়ে খাতির জমাতে চায়। দাঁত ঘষে 'ফাজিল' বলে হাটুরে তাকে পোকার মতো ঝেড়ে ফেলে। সে বিস্মিত বা আহত হয় না। বরং চমৎকার কোনো বিশেষণ প্রাপ্তিতে সে লোকটার পেছন ধরে হেঁটে চলে। বাতাসে তলোয়ার চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ বজায় রাখতে ডান হাতের চার আঙুলের ভাঁজের ওপর রাখা বুড়ো আঙুলটা চাপ দিয়ে রাখে। এই বাড়তি চাপের সঙ্গে মানানসই ডান চোয়ালও দাঁত কিড়িমিড়ির সঙ্গে ঝুলে যায়_ডান ভ্রূও ওপরে উঠে যায় এবং মনে মনে আউড়ে চলা ডায়লগে প্রাণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অবিরাম তলোয়ার চালনা করে যেতে হয়। সহসা সে থামে। তার তলোয়ার দেখি নিপুণভাবে যাবি তো যা রাজার পেটের লক্ষ্যে চলে গেছে। রাজা আর্তনাদসহ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে_'তুই মন্টু, শেষে আমাকে বধ করলি?' সে তলোয়ার টেনে নিতে মনস্থির করেও আরো জোরে তলোয়ারের মাঝ অব্দি রাজার পেটে ঢুকিয়ে দেয়_'শালা, তুমি আমাকে রাত-দিন খাটাও, হাত-পা মালিশ করে দিই, চুলে বিলি করে দিই, তুমি শালা আমাকে আজ অব্দি পাট দেওয়ার কথা বলে তা রক্ষা করোনি।'
সহসা তার মতান্তর হয়। না, এভাবে রাজাকে সে হত্যা করতে পারে না। রাজা রাজাই আর সে প্রজা। তার মাথার আবির্ভূত রাগ জুড়িয়ে আসতে থাকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে সে যখন যাত্রাদলের পেছন পেছন লেজ নেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কেউই যখন জায়গা দিতে নারাজ তখন এই রাজা চরিত্রের বাদশা মিয়া তাকে টেনে নেয়_'বুঝলি' আমার শরীরটা টিপে দিবি।' কয়েক গাঁ পাড়ি দিয়ে বাপ তার ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। ততদিনে মন্টু বাদশা মিয়া ছাড়াও, মন্ত্রী নূরআলী, সেনাপতি জাকের খানসহ একঝাঁক ডানাকাটা পরী নাচিয়ে মেয়েদের থেকে পাত্তা পেতে শুরু করেছে। দুই দিন তো 'প্রতিশোধ' নামের শো চলাকালে স্টেজে ফাইট করে জয়নগরের সেনাপতি মুরাদাবাদের রাজার হাতে নিহত হলে তলোয়ার দুটি সে-ই কুড়িয়ে আনে। ম্যানেজার সুখলাল দাশ তার ওপর নজর রাখে। দৃশ্য পাল্টাতে, সিংহাসন সরাতে, তলোয়ার কুড়াতে রাখা ছোকরা বেদম জ্বরে নিষ্ক্রিয়। তার পিঠের ওপর চড় মেরে শুকলাল দা বলেন_'হবে তোর।'
শো শেষ হলে বাদশা মিয়া বাঙলা মদের বোতল হাতে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেন। মন্টু তাঁর গা হাত পা টেপে। দুই চুমুকের পর অভ্যাসে বাদশা মিয়া টলমল হয়ে তার উদ্দেশে হুংকার দেয়_'বৎস নাম কী?' পেটে মদ পড়লেই বাদশা মিয়া সচরাচর এই প্রশ্নটা দিয়ে কথোপকথন শুরু করে। তার ঝটপট উত্তর_'আমি মন্টু রাজা, আপনার খাদেম।' 'খাদেম' শোনামাত্রই কখনো এক, কখনো পাঁচ, দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় দরাজদিল বাদশা মিয়া। অমন রাজাকে কী করে দৃশ্য নেই, ঘটনা নেই, যুদ্ধ নেই সে হত্যা করে? বাদশা মিয়ার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় তার ভেতরটা তৈলাক্ত হওয়ার উপক্রম হলে হঠাৎ মাথার কোনো এলাকায় থেকে যাওয়া একখণ্ড হালকা রাগ উদয় হয়ে তাকে ছেয়ে ফেলে। 'শালা, তুমি রাজাগিরি করো, লম্বা লম্বা কথা দাও, কাজের কাজ কিছু করো না।' এই হালকা রাগ ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে তার চাঁদি গরম করে দিলে তলোয়ার দিয়ে রাজাকে বিভক্ত করে ফেলতে সে উদ্যোগী হয়_'তোমার এত ফাই-ফরমায়েশ, সব আমি পালন করি অথচ আমাকে পাট দেওয়ার কথা বলে ম্যানেজার কোথাকার জগদীশ নামের এক ছোকরাকে রাজপুত্র চরিত্রে মনোনীত করলে তুমি তা সমর্থন করেছ, মুখে এক, কাজে আরেক। আজ দু'ফাঁক করে ফেলব।' এই পাকাপাকি সিদ্ধান্তে মন্টু নিজেকে নিয়োজিত করে বাম পা পেছনে সরিয়ে, বাঁ হাত ওপরে তুলে শক্ত ডান হাতে তলোয়ার রাজার ঘাড়ের ওপর তুলে দেয়। কিন্তু কোথায় তলোয়ার! সে সজাগ হলে দ্যাখে হাটের দিক থেকে ছেলে-যুবক-বুড়ো মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। সবাই রাজার লোক কি? বাজারের ব্যাগ হাতে দুজন তার পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে_'এই চ্যামড়া, মেলেটারি' বলে উধাও হয়ে গেল। মেলেটারি মানে সেই দুশমন, গুলি করে যারা মানুষ মারে? তা মেলেটারি_কী বিদঘুটে নাম_মানুষের মতো দেখতে কি? তার কৌতূহল হয় মেলেটারি দর্শনে। কিন্তু কয়েকটা লাথি এসে পড়ে তার পাছায়_'মরতি চাও, দৌড়ো'। লাথি খেয়ে বা দৌড়ানোর নির্দেশ শুনে সে বিপুল তেজে দৌড়াতে শুরু করে। এই দৌড়ে সে অনক সঙ্গী পেয়ে যায়। তাকে পেছনে ফেলে কেউ কেউ দৌড়ে গেলে সে হেরে যাচ্ছে_এই বোধে দৌড় বাড়িয়ে দেয়। ফল হয়_মাইল মাইল দৌড়ে সত্বর সে সবাইকে হারিয়ে সামনে চলে যায়।
মন্টুর জ্ঞান এলে সে টের পায় তার হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত পাথর। দুই কুঁচকিতে ব্যথার টাটানি। সে কোথায়_এই বোধ জাগ্রত হলেও তৎক্ষণাৎ তা হেলে পড়ে। দুই চোখ বুজে আসতে থাকে। ওই নিমিষ সময়ে অনেক আঁকা-বাঁকা ধূসর রেখা দেখতে পায়_দূর থেকে কাছাকাছি এগিয়ে আসছে। রেখাগুলি অস্পষ্ট মানুষের আদল পায়।
'মন্টু মন্টু'। তার নাম ধরে কে ডাকে? মোলায়েম স্বরে সে জেগে ওঠার প্রাণপণ প্রয়াস নেয়। কিন্তু কিছুতেই চোখের আঠা সরাতে পারে না। মনে হয় মা-ই ডাকছে। লতাপাতার ক্ষেত তন্নতন্ন করে মা তার জন্য থানকুনির পাতা নিয়ে এসেছে। কদিন ধরে মন্টুর পেটে গোলমাল। উত্তরপাড়ার মওলানার ঝাড়ফুঁকের পরও, গোলমাল নিবৃত্ত হয়নি। 'মন্টু মন্টু'। কী মুশকিল! ডাকের স্বর অত দূরে সরে যায় কেন। মা কি তাকে খুঁজতে পাশের বাড়ির উঠোনের দিকে যাচ্ছে? মন্টু চোখের ওপর থেকে ভার সরিয়ে জেগে উঠতে পারে না। জলে ভেজা কাগজ থেকে কাগজ ছাড়িয়ে আলাদা করে নেয়ার মতো করে মন্টু চোখের পাপড়ি ছাড়াতে থাকে। আবছা আবছা সে দেখে_তার মুখের ওপর কারা ঝুঁকে আছে। ওই সব মুখের ভেতর মাকে সে পায় না। তাদের বাড়িতে এত লোক এলো কোত্থেকে? তবে কি বোনটা তার সত্যি সত্যি দড়ি দিয়ে গাছে ঝুলেছে? যদি ঝুলেই থাকে তবে আশরাফ আলীকে সে ক্ষমা করবে না। দোজবরে আশরাফ আলী, যে তার বাপের বয়সী, এই সে রাবেয়ার ওপর কথায় কথায় যাচ্ছেতাই নির্যাতন করছে। ছল-ছুতোর অন্ত নেই। কী ব্যাপার? রাবেয়া কেন পুকুরে চাল ধুতে গিয়ে এত দেরি করল? রাবেয়া কেন কামলাকিষেণের সামনে মাথার কাপড় ফেলে হেঁটে গেল? রাবেয়া কেন রান্নাঘরে এত রাত হাঁড়ি-পাতিল নাড়াচাড়া করে? অসহ্য হয়ে রাবেয়া বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসে সাফ সাফ জানিয়ে দেয় সে যখন বাপ-মায়ের কাঁটা তবে তার নিষ্কৃতির জন্য দড়িই যথেষ্ট। শুনে মন্টু শিউরে ওঠে। তার গোঁয়ার বোন যদি গলায় দড়ি দেয় তবে চিরজনমের মতো সে তাকে হারাচ্ছে। কিন্তু রাবেয়া আপা মারা গেলে তো কান্না, কি বিলাপ কানে আসার কথা। সে নিজেও তো চিৎকার করে কেঁদে-কেটে বাড়িতে শোক জমিয়ে তুলতে পারে। তার ভেতর আদৌ কান্না কেন প্রস্তুত নয়। মন্টু আর ভাবতে পারে না। তার নাকে মুখে কাসুন্দির ঝাঁজ টের পায়_মাথার তালু অব্দি সেই ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়লে ঝিমুনির ভেতর ভাবনা তলিয়ে যায়। চোখের কোণায় উদ্গত পানি জমে গেলে ঝাপসা ভাব আরো ঘন হয়ে আসে।
কিন্তু এ আবার কেমন কাণ্ড! কোথায় তার বাড়ি আর কোথায় যাত্রা প্যান্ডেল_লাফ দিয়ে দিয়ে ছবি দেখি বদল হয়ে চলেছে। সে দেখি খাপ থেকে তলোয়ার টেনে বের করে ফেলেছে। তার উচ্চ গম্ভীর স্বরে যাত্রা প্যান্ডেলের কোলাহল থেমে যায়_'এখন আদেশ করুন জাঁহাপনা, কোন রণাঙ্গনে যাব আমি।' মন্টু পারদর্শী সিপাহির_মতো ভনভন তলোয়ার ঘোরাতে থাকে। অমন অস্থির তলোয়ার চালনাকালে টের পায় তার গলার কাছে টক টক স্বাদ অস্বস্তি। পর মুহূর্তে পেটের ভেতর কাঁপুনি ওঠে আর ওই কাঁপুনি দৌড়ে চলে আসে উপরমুখো। নরম নরম কিছু বেরিয়ে যাওয়ার তীব্র চাপে মন্টু জেগে যায়। গর্জে ওঠে মাথার যন্ত্রণা। একজন টিনের গ্লাসে পানি ধরে তার মুখে। মন্টু চোঁ চোঁ শব্দে পানি শোষণ করে গ্লাসটি তার মুখের সামনে দিয়ে সরে যেতেই সব পানি তার পেটের ভেতর আরো একদফা আলোড়ন তুলে বেরিয়ে আসে। পানি বেরিয়ে যাওয়ার পর তিতে সাদা গ্যাজা উঠে আসে। পাকস্থলী ফাঁকা। মনে হয় কোনো দানা পানি পড়েনি। একজন নিশ্চিত স্বরে রায় দিলে গাল হাঁ করে শ্বাস টানতে টানতে মন্টু মন্থর চালে মাথা নেড়ে তা সমর্থন করে।
রাজা চরিত্রের বাদশা মিয়ার নির্দেশে সে ছিল হাটের পথে। হাটের পথ ছিল তার অচেনা। পুরো এই মুল্লুকেই সে নতুন। তাদের শুকতারা অপেরা যখন খুলনার কপিলমুনি, কি মুজগুন্নী, না শিরোমণিতে_জায়গার নাম পরিষ্কার মনে নেই, চারপাশে তখন তুমুল অস্থিরতা_খালিশপুরে ধুন্ধুমার সংঘর্ষে শ্রমিক মারা গেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ গরম। শুকতারা অপেরা কুষ্টিয়া থেকে ফরিদপুর, রাজবাড়ী হয়ে খুলনায় এসে থেমে গেছে। রাজবাড়ীতে দুই রাত যাত্রার পর বাদবাকি পালা নস্যাৎ হয়। খুলনায় এসে পেঁৗছানোর পর জানা গেল ঢাকায় আন্দোলন চরমে উঠেছে_আবহাওয়া উষ্ণ_সহসা দিনকালের মন্দভাব কেটে যাওয়ার লক্ষণ নেই। ওদিকে পুরো যাত্রা পার্টিকে বসিয়ে রাখা মানে খামখা রসদ খরচ। ম্যানেজার শুকলাল দাস ঘাগু লোক, মানুষ চরানো চাকরি তার_সে সবার ছুটি ঘোষণা করল। ছুটি_বলে কী লোকটা? সিজন পুরো হয়নি দলের রোজগার বন্ধে তাদের কোনো হাতও নেই, এমন সময়ে ছুটি বললেই কি ছুটি_পুরো সিজনের টাকা ছাড়েন মশাই। শুকলাল দাশ তার অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে সবার চেহারা পড়ল। আন্দোলনের আঁচ কি যাত্রা পার্টির গায়ে এসেও লাগল? 'পাবে, তোমরা পাবে' বলে_শুকলাল দাশ যাত্রা পার্টির ড্রেসপত্র, বাঙ্-পেটরা ফেলে রেখে সেই যে বের হয়ে গেল আর খোঁজ নেই। হঠাৎ কে একজন খবর নিয়ে এলো যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে গাড়ি গাড়ি আর্মি গুলি ছুড়তে ছুড়তে খুলনার দিকে আগুয়ান। খুলনার আর্মিও রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পড়েছে_সম্ভবত কারফিউ জারি হচ্ছে। প্রথমে মেয়েরা ভয়ার্ত কণ্ঠে গলা জড়াজড়ি করে কেঁদেকেটে একাকার হলো। এই কান্নার গমক গিয়ে আছড়ে পড়ে পুরুষদের ওপর। কিসের ম্যানেজারের জন্য অপেক্ষা, আর যাত্রার বাঙ্-পেটরা আগলে রাখা! জীবন বাঁচালে বোঝাপড়া করা যাবে। ঘোরতর দুর্দশার ভেতর এতগুলো স্টার অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ফেলে রেখে কী করে শুকতারা অপেরা পার পায়_লাথি মেরে বাণী, কি চারণ অপেরায় চলে যেতে কতক্ষণ! অরুণকুমার মিনতী রানীকে নিয়ে ডানাকাটা পরীরা চলে গেল স্টেজ, লাইট, প্যান্ডেল যুবকদের সঙ্গে। থাকে কুলসুম_তার জন্য বাদশা মিয়া হাত বাড়িয়ে দিলে কুলসুম তাকে উপেক্ষা করে পালার প্রমোটার হারুনের সঙ্গে তার ড্রেস ও কসমেটিকসের বাঙ্সহ উড়াল দিল।
বাদশা মিয়া বুক চেপে ধরে যেন 'রামগড়ের চক্রান্ত' পালার গুপ্তঘাতকের হাতে ছুরিকাহত যুবরাজের মতো ডায়লগ বলতে বলতে মঞ্চের ওপর শুয়ে যাবে। হয়তো যাত্রাই ঢঙে সে ভূমিশয্যাই গ্রহণ করত, মন্টুই তাকে জাগিয়ে রাখে_'বান্দা হাজির জাঁহাপনা।' প্রত্যুত্তরে বাদশা মিয়ার কোনো বাদশাহি মেজাজ প্রকাশিত হয় না। মনুষ্য পরিত্যক্ত প্রান্তরে রাজ্যহারা নবাবের বেদনার সঙ্গে সে জমে থাকে। তাঁর সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ_রাজপোশাক নেই, পাত্রমিত্র নেই, রানি নেই, বাইরে তখন কোলাহল, চিৎকারের স্তূপ গড়ে ভেঙে ভেঙে দূরে সরে যায়। মানুষের ঊর্ধ্বশ্বাস পলায়নের ভেতর মন্টু কোথায় যাবে? বাড়িতে ফেরার উপায় বন্ধ_আদৌ তার আর জায়গা নেই। চাল, বেড়া খসে পড়লে কী হবে, আশরাফ বংশের সন্তানের যাত্রাদলে যোগদান কিছুতেই অনুমোদন করেননি হাতেম আলী। ছেলেকে ফিরিয়ে নিতে এলে মন্টুর যাত্রাই সংলাপ শুনে হাতেম আলী ছেলের সাবালক পরিণতির দিকে চেয়ে ফিরে যায়। মন্টুর একমাত্র ভরসা এখন বাদশা মিয়া এবং তাঁকে ছেড়ে যেতে সে নারাজ। মাটির ওপর থাবা মেরে বাদশা মিয়া উঠে দাঁড়ালে মন্টুর মনে হয় সিংহাসন পুনরুদ্ধারের তেজ বুঝি রাজা ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু আগে জীবন, শত্রুর ঘেরাও থেকে বাঁচলে পর সিংহদরোজায় আবার নহবত বাজবে, পাত্রমিত্র প্রজার কণ্ঠে ধ্বনিত হবে জয়ধ্বনি। অতএব, রাজাকে একমাত্র সঙ্গীসহ রাজ্যের গভীরে, নগর থেকে গ্রামের পেটের ভেতর সরে যেতে হয়।
পালাতে পালাতে এঘাট-সেঘাট খুঁজে মালতী রানি নামে এক সাবেক যাত্রা নায়িকার কাছে বাদশা মিয়া উপস্থিত হলে মন্টু হতাশ হয়। এই হতাশা জোরালোভাবে তার ভেতর সক্রিয় হওয়ার আগেই ক্লান্তি, ক্ষুধা ও রাত্রি জাগরণে শরীর ভেঙে পড়ে। মালতী রানি সহসা কোনো জটিলতার ভেতর যেন গড়িয়ে যায়। সেদিনই তারা ভিটেমাটি ত্যাগ করে আরো ভেতরে সরে যাওয়ার চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়েছে। তাদেরই জীবন নিয়ে টানাটানি_এ সময় আরো দুজনের হুট করে আবির্ভাব হলে মালতী রানির পক্ষে মেয়েমানুষ হয়ে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া কিভাবে সম্ভব। যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে ঢুকে পড়তে পারে। মালতী রানির মুখ শুকিয়ে আসে। একসময় তার চেহারায় শাঁস ছিল। মালতী রানি হারানোর বেদনায় গলে যেতে যেতে জানায় যক্ষ্মা তার লাবণ্য নিংড়ে চুষে নিয়েছে। সেই যে কী শরীর ভাঙল আর তার দখলে আসেনি। যাত্রায় মা-মাসি চরিত্রেও আর স্থান হয়নি। কয়েক বছর পর তার পুরনো মানুষ কাছে পেয়েও আজ খুশি নিভে নিভে আসে। দুজন মুসলমানকে হিন্দুর ঘরে আশ্রয় দিতে আপত্তি নেই, এসবের বাছ-বিচার এখন আর নেই_উভয়ের বাঁচামরা একসঙ্গে, কিন্তু জীবন বাঁচানোর উপায় কী! রাজার পাট ছাড়া যাকে অন্য চরিত্র করতে হয়নি, যার গম্ভীর জলদস্বরে যাত্রার প্যান্ডেলের ছাউনি খসে পড়ার উপক্রম হয়, বাজনার সঙ্গে সঙ্গে ছন্দ রেখে তলোয়ার চালিয়ে পালায় উত্তেজনা এনে দিয়েছে, সেই বাদশা মিয়া মালতী রানিকে দেখে তার দশাসই শরীরের শক্তি হারিয়ে বসে পড়ল তো পড়ল দীর্ঘস্থায়ী সময়ের জন্য জমে গেল। মালতী রানিদের পরিত্যক্ত গোলপাতার জীর্ণঘরে বিপুল বিষাদে বাদশা মিয়া নিজের স্মৃতি ছিঁড়ে চলে।
ফুরিয়ে যেতে থাকা বিকেলের দিকে মন্টু সুস্থ হয়। লাউসিদ্ধ, ডাল আর মোটা চালের ভাত খেয়ে তার হারানো শরীর সে ফেরত পাচ্ছে। আহ, কী সুস্বাদু! কতদিন পর তার মুখে উঠল যেন অন্নব্যঞ্জন। পাকস্থলীতে খাদ্য পড়ার কারণে হোক, কিংবা খাওয়ার আরামে হোক এবার পরিষ্কার মনে করতে পারে_গতকাল বিকেলে সে দৌড় শুরু করে_মধ্যখানে একটি দিন তার জ্ঞানশূন্যতার ভেতর পার হয়ে গেছে। তা দৌড়ের শেষ কিভাবে কিছুতেই মনে আসে না, অর্থাৎ গোলমাল এখানেই। এর একটা উপযুক্ত উত্তরের জন্য মন্টুকে নতুন মুখগুলোর প্রতি মনোযোগী হতেই হয়। চারপাশে যারা ঘেরাও করে আছে তাদের কথাবার্তা শুনে মোটামুটি বোঝা যায় লোকমুখে শোনা সেই মুক্তিবাহিনী। রাইফেল আগেও দেখেছে। ফরিদপুরে একবার যাত্রার প্যান্ডেলে গোলযোগ বেধে যায়_উত্তেজিত একদল মিনতী রানির জন্য পাগল হয়ে তাকে ছিনিয়ে নিতে এলে ওই বোম্বাটেদের দমনে যারা আসে তাদের ঘাড়ে দেখেছে এই যন্ত্র। এই যন্ত্রের আওয়াজ সে কাছে থেকে শোনেনি। খুলনা থেকে পালিয়ে আসার সময় গল্লামারি না কোথায় রেডিও স্টেশনের দখল নিয়ে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছে। সে কী গুলির খই। ওই গুলির ভেতর নদী পার হতে গিয়ে ছোট একটা নৌকা মানুষের চাপে ডুবে যায় যায় অবস্থা। বাদশা মিয়া সাঁতার জানে না। মন্টুর হাত চেপে ধরে দাঁত কামড়ে থাকে। রাজার দুর্দশা দেখে নৌকা হালকা করতে তার একবার নদী সাঁতরে পার হওয়ার ইচ্ছে হয়। কে একজন জানাল গুলিতে একজনের পা উড়ে গেছে। শুনে মন্টু এমনই অবাক হয় যে নদী সাঁতরে পার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নীরবেই স্থগিত হয়। পা আবার উড়ে যায় কেমন করে? শুধু মানুষ মারা নয়, মানুষের হাত-পা-শরীরও তাহলে রাইফেল উড়িয়ে দিতে পারে? রাইফেলের কার্যক্ষমতার প্রতি ভয় ও শ্রদ্ধা তার বেড়ে যায়। কিন্তু গায়ে অসংখ্য ফুটো, হাত দেড় লম্বা এই যন্ত্রটা সে আগে দেখেনি ড্যাবড্যাবে খোকা চোখে যন্ত্রটার দিকে মন্টু ঘাড় ঘোরালে একজন তার কাছে প্রশ্ন রাখে_'নাম কী?' মন্টু নাম বলে। 'ছাত্র?' মন্টু মাথা নেড়ে 'ছাত্র' শব্দটা নাকচ করে 'যাত্রাদলে টিনের তলোয়ার কুড়াতাম। রাজার লোক।' শুনে সবাই হো হো হেসে ঘর ভাসিয়ে দেয়। সবাইকে চমকে দিতে বা নিজের জন্য স্থির দৃষ্টি আদায় করতে মন্টু বসে বসে তলোয়ার চালানোর মতো করে হাত ঘুরিয়ে মুখে শব্দ করে_খ্যাচ। শুকনো বারুদে-জীবনে সহসা মজা পেয়ে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা হুল্লোড় মেতে ওঠে।_'ভালোই যাত্রার লোক পাওয়া গেল।' বলে, গোঁফ ঝোলানো একজন মন্টুর সমর্থন চায় 'আছো আমাদের সঙ্গে?' মন্টু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে তলোয়ার চালানো অব্যাহত রাখে। হঠাৎ তলোয়ার তৎপরতা বন্ধ করে নীরব হয়। বাদশা মিয়া কোথায়? জায়গার নাম সে মনে করতে পারে না। রাজা এখন একা-একা হলে রাজার চলে কী করে? রাজা রইল কোন মুল্লুকে আর তার সেবক এখন আরেক মুল্লুকে_এখন রাজা যদি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়? মন্টু শাঁ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের তেজ প্রকাশ করে 'আমি চলে যাব।' খপ করে একজন তার ঘাড় ধরে 'মরতে চাও, মিলিটারি মানুষ সব শেষ করে দিচ্ছে।' মানুষ শেষ করে দিচ্ছে মানে রাজা শেষ_এই বোধের উত্থানে নিমিষে মন্টুর দৃঢ়তা শিথিল হয়। সে বুঝতে পারে না মিলিটারি যাত্রার মানুষ কেন মারতে যাবে? তারা তো সত্যিকার রাজা-উজির নয়, কোনো গোলমাল ঝগড়া ফ্যাসাদে নেই। তা মাঝেমধ্যে নিজেদের ভেতর কথাকাটাকাটি, কি দারু খেয়ে হৈচৈ হয় বটে_মিটেও যায়। উজির চরিত্রের মোহিতলাল স্টেজে যাওয়ার আগে ভরপেট দারু না খেলে নড়তেই চাইত না। তাঁর টলমল বেসামাল অবস্থা দেখে কে বলবে এই লোক স্টেজ মাত করে আসবে। বড়জোর সে দরজার মুখ অব্দি পেঁৗছাতে পারে, তার পরই ঢলে পড়ে তার চরিত্র ওখানেই খতম করে দেবে। এই মোহিতলালকে একদিন ম্যানেজার শুকলাল দাশ সাফ মুখের ওপর জবাব দিয়ে দেয়_রোজ রোজ পার্টির টাকায় তাঁকে দারু জোগাড় দেয়া সম্ভব না_অযথা খরচ। মোহিতলাল তার মহিমা বজায় রাখতে রেগে লাল হয়ে ম্যানেজার লালের ওপর তলোয়ার নিয়ে চড়াও হয়_সে এক বিশ্রী মারদাঙ্গা। তৎক্ষণাৎ মোহিতলাল শুকতারা অপেরা থেকে বরখাস্ত হয়ে গেল। এটাও তো নিজেরা নিজেরা_বাইরের কারো সঙ্গে হাঙ্গামা নয়। মন্টুর মাথায় আরো কী কী বুড়বুড়ি ছিল, তার আগেই তাকে ভাবনার ভেতর থেকে তুলে একজন বাইরে নিয়ে আসে। পড়ন্ত বিকেলের নিস্তেজ রং-বদল রোদ খাবলা খাবলা পড়ে আছে লম্বা গাছগুলোর মাথায়। 'কোথায় যাবে?' তার চেয়ে যৎকিঞ্চিত ঘাড়ে বড়, হালকা পাতলা, তবু গরম খইয়ের মতো ফুটতে থাকা এক মুক্তিযোদ্ধা পাখি পড়ানোর মতো করে বিভিন্ন বৃত্তান্ত মন্টুকে বুঝিয়ে দিতে থাকে। মন্টু তা মনোযোগ দিয়ে শোনে। চকিতে তার আপদমস্তকে ঝিন ঝিন শিহরণ বয়ে যায়। তার ক্লান্ত, ধ্বস্ত, ফ্যাকাশে মুখে জেগে ওঠে জোরালো উত্তেজনা। সেই উত্তেজনার খানিকটা বুঝি ছলকে চোখ যুগলে পেঁৗছে সাদা শিরাগুলোকে লাল করে দেয়। মন্টু এবার তার ধুলোমলিন, শুকনো কাদা-লাঞ্ছিত বেঢপ প্যান্টের ওপর চর মেড়ে নাটুকে ভঙ্গি করে 'এই কে কোথায় আছিস, বাদ্য বাজা। রাজা-মন্ত্রী-পাত্রমিত্র পলাতক, এই বান্দা হাজির, যায় যাক একটা জীবন।' মন্টুর তড়বড়ে যাত্রাই স্বর এবং তলোয়ার চালানো নাচুনি ভঙ্গি ঘিরে সোল্লাসে অভিনব রসের মজায় ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হতে থাকে।
লোকের পেছন ধরে সে ছিল হাটের পথে। বাদশা মিয়ার নিঃস্ব স্বর, তবু অভ্যাসে গলা চড়ে নির্দেশের মতো শোনায়_'বৎস, আমরা অন্নহীন। হাটে যাও।' হুকুম মান্য করে_'জ্বী, জাঁহাপনা' বলে, ভিন্ন অঞ্চলের মানুষ হয়েও সে অচেনা হাটের পথে বেরিয়ে পড়ে। পথে পথে ঘাসের চাপড়া_দুপাশে হেজিপেজি লতাপাতার ঝাড়, ভেতরে দু-একটি দুর্দশাগ্রস্ত দোচালা_মনুষ্যহীন। সব মানুষই কি হাটে গেছে? হাটুরে লোকের হাতে ব্যাগ দেখে তার খেয়াল হয়_বাজারের জন্য সে কিছুই আনেনি, কেবল পকেটে বাদশা মিয়ার দেওয়া পনেরো টাকা। ব্যাগ ছাড়া বাজার, নতুন এই উদ্যোগে সে খুশি হয়। অনভ্যস্ত হলেও আনন্দে দুটি সাঁকো পেরিয়ে যেতে পারে পথের ধুলোয় লাথি মেরে মেরে নিজের গোড়ালি সাদা করে এনেও সে খুশি। তার এই খুশি তৎপরতা মানুষের চোখে পড়ে এবং গ্রামে এমন অচেনা তরুণ দেখে এক বয়সী হাটুরে ঘাড় ঘোরায়_'কোত্থেকে আসতিছ?' উত্তর দিতে সে দাঁড়ায় এবং হাত ঘুরিয়ে তলোয়ার চালনা করে_'এখনো শত্রুকে ক্ষমা? না মহারাজ। সুযোগ পেলে করেন।' 'আপনাকে হত্যা করবে' এই উচ্চারণে জানিয়ে দেয় সে যাত্রার লোক। লোকটা দারুণ অপছন্দ করে তাকে। সে গায়ে পড়ে খাতির জমাতে চায়। দাঁত ঘষে 'ফাজিল' বলে হাটুরে তাকে পোকার মতো ঝেড়ে ফেলে। সে বিস্মিত বা আহত হয় না। বরং চমৎকার কোনো বিশেষণ প্রাপ্তিতে সে লোকটার পেছন ধরে হেঁটে চলে। বাতাসে তলোয়ার চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ বজায় রাখতে ডান হাতের চার আঙুলের ভাঁজের ওপর রাখা বুড়ো আঙুলটা চাপ দিয়ে রাখে। এই বাড়তি চাপের সঙ্গে মানানসই ডান চোয়ালও দাঁত কিড়িমিড়ির সঙ্গে ঝুলে যায়_ডান ভ্রূও ওপরে উঠে যায় এবং মনে মনে আউড়ে চলা ডায়লগে প্রাণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অবিরাম তলোয়ার চালনা করে যেতে হয়। সহসা সে থামে। তার তলোয়ার দেখি নিপুণভাবে যাবি তো যা রাজার পেটের লক্ষ্যে চলে গেছে। রাজা আর্তনাদসহ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে_'তুই মন্টু, শেষে আমাকে বধ করলি?' সে তলোয়ার টেনে নিতে মনস্থির করেও আরো জোরে তলোয়ারের মাঝ অব্দি রাজার পেটে ঢুকিয়ে দেয়_'শালা, তুমি আমাকে রাত-দিন খাটাও, হাত-পা মালিশ করে দিই, চুলে বিলি করে দিই, তুমি শালা আমাকে আজ অব্দি পাট দেওয়ার কথা বলে তা রক্ষা করোনি।'
সহসা তার মতান্তর হয়। না, এভাবে রাজাকে সে হত্যা করতে পারে না। রাজা রাজাই আর সে প্রজা। তার মাথার আবির্ভূত রাগ জুড়িয়ে আসতে থাকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে সে যখন যাত্রাদলের পেছন পেছন লেজ নেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, কেউই যখন জায়গা দিতে নারাজ তখন এই রাজা চরিত্রের বাদশা মিয়া তাকে টেনে নেয়_'বুঝলি' আমার শরীরটা টিপে দিবি।' কয়েক গাঁ পাড়ি দিয়ে বাপ তার ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। ততদিনে মন্টু বাদশা মিয়া ছাড়াও, মন্ত্রী নূরআলী, সেনাপতি জাকের খানসহ একঝাঁক ডানাকাটা পরী নাচিয়ে মেয়েদের থেকে পাত্তা পেতে শুরু করেছে। দুই দিন তো 'প্রতিশোধ' নামের শো চলাকালে স্টেজে ফাইট করে জয়নগরের সেনাপতি মুরাদাবাদের রাজার হাতে নিহত হলে তলোয়ার দুটি সে-ই কুড়িয়ে আনে। ম্যানেজার সুখলাল দাশ তার ওপর নজর রাখে। দৃশ্য পাল্টাতে, সিংহাসন সরাতে, তলোয়ার কুড়াতে রাখা ছোকরা বেদম জ্বরে নিষ্ক্রিয়। তার পিঠের ওপর চড় মেরে শুকলাল দা বলেন_'হবে তোর।'
শো শেষ হলে বাদশা মিয়া বাঙলা মদের বোতল হাতে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেন। মন্টু তাঁর গা হাত পা টেপে। দুই চুমুকের পর অভ্যাসে বাদশা মিয়া টলমল হয়ে তার উদ্দেশে হুংকার দেয়_'বৎস নাম কী?' পেটে মদ পড়লেই বাদশা মিয়া সচরাচর এই প্রশ্নটা দিয়ে কথোপকথন শুরু করে। তার ঝটপট উত্তর_'আমি মন্টু রাজা, আপনার খাদেম।' 'খাদেম' শোনামাত্রই কখনো এক, কখনো পাঁচ, দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দেয় দরাজদিল বাদশা মিয়া। অমন রাজাকে কী করে দৃশ্য নেই, ঘটনা নেই, যুদ্ধ নেই সে হত্যা করে? বাদশা মিয়ার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় তার ভেতরটা তৈলাক্ত হওয়ার উপক্রম হলে হঠাৎ মাথার কোনো এলাকায় থেকে যাওয়া একখণ্ড হালকা রাগ উদয় হয়ে তাকে ছেয়ে ফেলে। 'শালা, তুমি রাজাগিরি করো, লম্বা লম্বা কথা দাও, কাজের কাজ কিছু করো না।' এই হালকা রাগ ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে তার চাঁদি গরম করে দিলে তলোয়ার দিয়ে রাজাকে বিভক্ত করে ফেলতে সে উদ্যোগী হয়_'তোমার এত ফাই-ফরমায়েশ, সব আমি পালন করি অথচ আমাকে পাট দেওয়ার কথা বলে ম্যানেজার কোথাকার জগদীশ নামের এক ছোকরাকে রাজপুত্র চরিত্রে মনোনীত করলে তুমি তা সমর্থন করেছ, মুখে এক, কাজে আরেক। আজ দু'ফাঁক করে ফেলব।' এই পাকাপাকি সিদ্ধান্তে মন্টু নিজেকে নিয়োজিত করে বাম পা পেছনে সরিয়ে, বাঁ হাত ওপরে তুলে শক্ত ডান হাতে তলোয়ার রাজার ঘাড়ের ওপর তুলে দেয়। কিন্তু কোথায় তলোয়ার! সে সজাগ হলে দ্যাখে হাটের দিক থেকে ছেলে-যুবক-বুড়ো মানুষ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। সবাই রাজার লোক কি? বাজারের ব্যাগ হাতে দুজন তার পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে_'এই চ্যামড়া, মেলেটারি' বলে উধাও হয়ে গেল। মেলেটারি মানে সেই দুশমন, গুলি করে যারা মানুষ মারে? তা মেলেটারি_কী বিদঘুটে নাম_মানুষের মতো দেখতে কি? তার কৌতূহল হয় মেলেটারি দর্শনে। কিন্তু কয়েকটা লাথি এসে পড়ে তার পাছায়_'মরতি চাও, দৌড়ো'। লাথি খেয়ে বা দৌড়ানোর নির্দেশ শুনে সে বিপুল তেজে দৌড়াতে শুরু করে। এই দৌড়ে সে অনক সঙ্গী পেয়ে যায়। তাকে পেছনে ফেলে কেউ কেউ দৌড়ে গেলে সে হেরে যাচ্ছে_এই বোধে দৌড় বাড়িয়ে দেয়। ফল হয়_মাইল মাইল দৌড়ে সত্বর সে সবাইকে হারিয়ে সামনে চলে যায়।
মন্টুর জ্ঞান এলে সে টের পায় তার হাঁটু থেকে পা পর্যন্ত পাথর। দুই কুঁচকিতে ব্যথার টাটানি। সে কোথায়_এই বোধ জাগ্রত হলেও তৎক্ষণাৎ তা হেলে পড়ে। দুই চোখ বুজে আসতে থাকে। ওই নিমিষ সময়ে অনেক আঁকা-বাঁকা ধূসর রেখা দেখতে পায়_দূর থেকে কাছাকাছি এগিয়ে আসছে। রেখাগুলি অস্পষ্ট মানুষের আদল পায়।
'মন্টু মন্টু'। তার নাম ধরে কে ডাকে? মোলায়েম স্বরে সে জেগে ওঠার প্রাণপণ প্রয়াস নেয়। কিন্তু কিছুতেই চোখের আঠা সরাতে পারে না। মনে হয় মা-ই ডাকছে। লতাপাতার ক্ষেত তন্নতন্ন করে মা তার জন্য থানকুনির পাতা নিয়ে এসেছে। কদিন ধরে মন্টুর পেটে গোলমাল। উত্তরপাড়ার মওলানার ঝাড়ফুঁকের পরও, গোলমাল নিবৃত্ত হয়নি। 'মন্টু মন্টু'। কী মুশকিল! ডাকের স্বর অত দূরে সরে যায় কেন। মা কি তাকে খুঁজতে পাশের বাড়ির উঠোনের দিকে যাচ্ছে? মন্টু চোখের ওপর থেকে ভার সরিয়ে জেগে উঠতে পারে না। জলে ভেজা কাগজ থেকে কাগজ ছাড়িয়ে আলাদা করে নেয়ার মতো করে মন্টু চোখের পাপড়ি ছাড়াতে থাকে। আবছা আবছা সে দেখে_তার মুখের ওপর কারা ঝুঁকে আছে। ওই সব মুখের ভেতর মাকে সে পায় না। তাদের বাড়িতে এত লোক এলো কোত্থেকে? তবে কি বোনটা তার সত্যি সত্যি দড়ি দিয়ে গাছে ঝুলেছে? যদি ঝুলেই থাকে তবে আশরাফ আলীকে সে ক্ষমা করবে না। দোজবরে আশরাফ আলী, যে তার বাপের বয়সী, এই সে রাবেয়ার ওপর কথায় কথায় যাচ্ছেতাই নির্যাতন করছে। ছল-ছুতোর অন্ত নেই। কী ব্যাপার? রাবেয়া কেন পুকুরে চাল ধুতে গিয়ে এত দেরি করল? রাবেয়া কেন কামলাকিষেণের সামনে মাথার কাপড় ফেলে হেঁটে গেল? রাবেয়া কেন রান্নাঘরে এত রাত হাঁড়ি-পাতিল নাড়াচাড়া করে? অসহ্য হয়ে রাবেয়া বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসে সাফ সাফ জানিয়ে দেয় সে যখন বাপ-মায়ের কাঁটা তবে তার নিষ্কৃতির জন্য দড়িই যথেষ্ট। শুনে মন্টু শিউরে ওঠে। তার গোঁয়ার বোন যদি গলায় দড়ি দেয় তবে চিরজনমের মতো সে তাকে হারাচ্ছে। কিন্তু রাবেয়া আপা মারা গেলে তো কান্না, কি বিলাপ কানে আসার কথা। সে নিজেও তো চিৎকার করে কেঁদে-কেটে বাড়িতে শোক জমিয়ে তুলতে পারে। তার ভেতর আদৌ কান্না কেন প্রস্তুত নয়। মন্টু আর ভাবতে পারে না। তার নাকে মুখে কাসুন্দির ঝাঁজ টের পায়_মাথার তালু অব্দি সেই ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়লে ঝিমুনির ভেতর ভাবনা তলিয়ে যায়। চোখের কোণায় উদ্গত পানি জমে গেলে ঝাপসা ভাব আরো ঘন হয়ে আসে।
কিন্তু এ আবার কেমন কাণ্ড! কোথায় তার বাড়ি আর কোথায় যাত্রা প্যান্ডেল_লাফ দিয়ে দিয়ে ছবি দেখি বদল হয়ে চলেছে। সে দেখি খাপ থেকে তলোয়ার টেনে বের করে ফেলেছে। তার উচ্চ গম্ভীর স্বরে যাত্রা প্যান্ডেলের কোলাহল থেমে যায়_'এখন আদেশ করুন জাঁহাপনা, কোন রণাঙ্গনে যাব আমি।' মন্টু পারদর্শী সিপাহির_মতো ভনভন তলোয়ার ঘোরাতে থাকে। অমন অস্থির তলোয়ার চালনাকালে টের পায় তার গলার কাছে টক টক স্বাদ অস্বস্তি। পর মুহূর্তে পেটের ভেতর কাঁপুনি ওঠে আর ওই কাঁপুনি দৌড়ে চলে আসে উপরমুখো। নরম নরম কিছু বেরিয়ে যাওয়ার তীব্র চাপে মন্টু জেগে যায়। গর্জে ওঠে মাথার যন্ত্রণা। একজন টিনের গ্লাসে পানি ধরে তার মুখে। মন্টু চোঁ চোঁ শব্দে পানি শোষণ করে গ্লাসটি তার মুখের সামনে দিয়ে সরে যেতেই সব পানি তার পেটের ভেতর আরো একদফা আলোড়ন তুলে বেরিয়ে আসে। পানি বেরিয়ে যাওয়ার পর তিতে সাদা গ্যাজা উঠে আসে। পাকস্থলী ফাঁকা। মনে হয় কোনো দানা পানি পড়েনি। একজন নিশ্চিত স্বরে রায় দিলে গাল হাঁ করে শ্বাস টানতে টানতে মন্টু মন্থর চালে মাথা নেড়ে তা সমর্থন করে।
রাজা চরিত্রের বাদশা মিয়ার নির্দেশে সে ছিল হাটের পথে। হাটের পথ ছিল তার অচেনা। পুরো এই মুল্লুকেই সে নতুন। তাদের শুকতারা অপেরা যখন খুলনার কপিলমুনি, কি মুজগুন্নী, না শিরোমণিতে_জায়গার নাম পরিষ্কার মনে নেই, চারপাশে তখন তুমুল অস্থিরতা_খালিশপুরে ধুন্ধুমার সংঘর্ষে শ্রমিক মারা গেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ গরম। শুকতারা অপেরা কুষ্টিয়া থেকে ফরিদপুর, রাজবাড়ী হয়ে খুলনায় এসে থেমে গেছে। রাজবাড়ীতে দুই রাত যাত্রার পর বাদবাকি পালা নস্যাৎ হয়। খুলনায় এসে পেঁৗছানোর পর জানা গেল ঢাকায় আন্দোলন চরমে উঠেছে_আবহাওয়া উষ্ণ_সহসা দিনকালের মন্দভাব কেটে যাওয়ার লক্ষণ নেই। ওদিকে পুরো যাত্রা পার্টিকে বসিয়ে রাখা মানে খামখা রসদ খরচ। ম্যানেজার শুকলাল দাস ঘাগু লোক, মানুষ চরানো চাকরি তার_সে সবার ছুটি ঘোষণা করল। ছুটি_বলে কী লোকটা? সিজন পুরো হয়নি দলের রোজগার বন্ধে তাদের কোনো হাতও নেই, এমন সময়ে ছুটি বললেই কি ছুটি_পুরো সিজনের টাকা ছাড়েন মশাই। শুকলাল দাশ তার অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে সবার চেহারা পড়ল। আন্দোলনের আঁচ কি যাত্রা পার্টির গায়ে এসেও লাগল? 'পাবে, তোমরা পাবে' বলে_শুকলাল দাশ যাত্রা পার্টির ড্রেসপত্র, বাঙ্-পেটরা ফেলে রেখে সেই যে বের হয়ে গেল আর খোঁজ নেই। হঠাৎ কে একজন খবর নিয়ে এলো যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে গাড়ি গাড়ি আর্মি গুলি ছুড়তে ছুড়তে খুলনার দিকে আগুয়ান। খুলনার আর্মিও রাস্তাঘাটে বেরিয়ে পড়েছে_সম্ভবত কারফিউ জারি হচ্ছে। প্রথমে মেয়েরা ভয়ার্ত কণ্ঠে গলা জড়াজড়ি করে কেঁদেকেটে একাকার হলো। এই কান্নার গমক গিয়ে আছড়ে পড়ে পুরুষদের ওপর। কিসের ম্যানেজারের জন্য অপেক্ষা, আর যাত্রার বাঙ্-পেটরা আগলে রাখা! জীবন বাঁচালে বোঝাপড়া করা যাবে। ঘোরতর দুর্দশার ভেতর এতগুলো স্টার অভিনেতা-অভিনেত্রীকে ফেলে রেখে কী করে শুকতারা অপেরা পার পায়_লাথি মেরে বাণী, কি চারণ অপেরায় চলে যেতে কতক্ষণ! অরুণকুমার মিনতী রানীকে নিয়ে ডানাকাটা পরীরা চলে গেল স্টেজ, লাইট, প্যান্ডেল যুবকদের সঙ্গে। থাকে কুলসুম_তার জন্য বাদশা মিয়া হাত বাড়িয়ে দিলে কুলসুম তাকে উপেক্ষা করে পালার প্রমোটার হারুনের সঙ্গে তার ড্রেস ও কসমেটিকসের বাঙ্সহ উড়াল দিল।
বাদশা মিয়া বুক চেপে ধরে যেন 'রামগড়ের চক্রান্ত' পালার গুপ্তঘাতকের হাতে ছুরিকাহত যুবরাজের মতো ডায়লগ বলতে বলতে মঞ্চের ওপর শুয়ে যাবে। হয়তো যাত্রাই ঢঙে সে ভূমিশয্যাই গ্রহণ করত, মন্টুই তাকে জাগিয়ে রাখে_'বান্দা হাজির জাঁহাপনা।' প্রত্যুত্তরে বাদশা মিয়ার কোনো বাদশাহি মেজাজ প্রকাশিত হয় না। মনুষ্য পরিত্যক্ত প্রান্তরে রাজ্যহারা নবাবের বেদনার সঙ্গে সে জমে থাকে। তাঁর সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ_রাজপোশাক নেই, পাত্রমিত্র নেই, রানি নেই, বাইরে তখন কোলাহল, চিৎকারের স্তূপ গড়ে ভেঙে ভেঙে দূরে সরে যায়। মানুষের ঊর্ধ্বশ্বাস পলায়নের ভেতর মন্টু কোথায় যাবে? বাড়িতে ফেরার উপায় বন্ধ_আদৌ তার আর জায়গা নেই। চাল, বেড়া খসে পড়লে কী হবে, আশরাফ বংশের সন্তানের যাত্রাদলে যোগদান কিছুতেই অনুমোদন করেননি হাতেম আলী। ছেলেকে ফিরিয়ে নিতে এলে মন্টুর যাত্রাই সংলাপ শুনে হাতেম আলী ছেলের সাবালক পরিণতির দিকে চেয়ে ফিরে যায়। মন্টুর একমাত্র ভরসা এখন বাদশা মিয়া এবং তাঁকে ছেড়ে যেতে সে নারাজ। মাটির ওপর থাবা মেরে বাদশা মিয়া উঠে দাঁড়ালে মন্টুর মনে হয় সিংহাসন পুনরুদ্ধারের তেজ বুঝি রাজা ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু আগে জীবন, শত্রুর ঘেরাও থেকে বাঁচলে পর সিংহদরোজায় আবার নহবত বাজবে, পাত্রমিত্র প্রজার কণ্ঠে ধ্বনিত হবে জয়ধ্বনি। অতএব, রাজাকে একমাত্র সঙ্গীসহ রাজ্যের গভীরে, নগর থেকে গ্রামের পেটের ভেতর সরে যেতে হয়।
পালাতে পালাতে এঘাট-সেঘাট খুঁজে মালতী রানি নামে এক সাবেক যাত্রা নায়িকার কাছে বাদশা মিয়া উপস্থিত হলে মন্টু হতাশ হয়। এই হতাশা জোরালোভাবে তার ভেতর সক্রিয় হওয়ার আগেই ক্লান্তি, ক্ষুধা ও রাত্রি জাগরণে শরীর ভেঙে পড়ে। মালতী রানি সহসা কোনো জটিলতার ভেতর যেন গড়িয়ে যায়। সেদিনই তারা ভিটেমাটি ত্যাগ করে আরো ভেতরে সরে যাওয়ার চূড়ান্ত উদ্যোগ নিয়েছে। তাদেরই জীবন নিয়ে টানাটানি_এ সময় আরো দুজনের হুট করে আবির্ভাব হলে মালতী রানির পক্ষে মেয়েমানুষ হয়ে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া কিভাবে সম্ভব। যেকোনো মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে ঢুকে পড়তে পারে। মালতী রানির মুখ শুকিয়ে আসে। একসময় তার চেহারায় শাঁস ছিল। মালতী রানি হারানোর বেদনায় গলে যেতে যেতে জানায় যক্ষ্মা তার লাবণ্য নিংড়ে চুষে নিয়েছে। সেই যে কী শরীর ভাঙল আর তার দখলে আসেনি। যাত্রায় মা-মাসি চরিত্রেও আর স্থান হয়নি। কয়েক বছর পর তার পুরনো মানুষ কাছে পেয়েও আজ খুশি নিভে নিভে আসে। দুজন মুসলমানকে হিন্দুর ঘরে আশ্রয় দিতে আপত্তি নেই, এসবের বাছ-বিচার এখন আর নেই_উভয়ের বাঁচামরা একসঙ্গে, কিন্তু জীবন বাঁচানোর উপায় কী! রাজার পাট ছাড়া যাকে অন্য চরিত্র করতে হয়নি, যার গম্ভীর জলদস্বরে যাত্রার প্যান্ডেলের ছাউনি খসে পড়ার উপক্রম হয়, বাজনার সঙ্গে সঙ্গে ছন্দ রেখে তলোয়ার চালিয়ে পালায় উত্তেজনা এনে দিয়েছে, সেই বাদশা মিয়া মালতী রানিকে দেখে তার দশাসই শরীরের শক্তি হারিয়ে বসে পড়ল তো পড়ল দীর্ঘস্থায়ী সময়ের জন্য জমে গেল। মালতী রানিদের পরিত্যক্ত গোলপাতার জীর্ণঘরে বিপুল বিষাদে বাদশা মিয়া নিজের স্মৃতি ছিঁড়ে চলে।
ফুরিয়ে যেতে থাকা বিকেলের দিকে মন্টু সুস্থ হয়। লাউসিদ্ধ, ডাল আর মোটা চালের ভাত খেয়ে তার হারানো শরীর সে ফেরত পাচ্ছে। আহ, কী সুস্বাদু! কতদিন পর তার মুখে উঠল যেন অন্নব্যঞ্জন। পাকস্থলীতে খাদ্য পড়ার কারণে হোক, কিংবা খাওয়ার আরামে হোক এবার পরিষ্কার মনে করতে পারে_গতকাল বিকেলে সে দৌড় শুরু করে_মধ্যখানে একটি দিন তার জ্ঞানশূন্যতার ভেতর পার হয়ে গেছে। তা দৌড়ের শেষ কিভাবে কিছুতেই মনে আসে না, অর্থাৎ গোলমাল এখানেই। এর একটা উপযুক্ত উত্তরের জন্য মন্টুকে নতুন মুখগুলোর প্রতি মনোযোগী হতেই হয়। চারপাশে যারা ঘেরাও করে আছে তাদের কথাবার্তা শুনে মোটামুটি বোঝা যায় লোকমুখে শোনা সেই মুক্তিবাহিনী। রাইফেল আগেও দেখেছে। ফরিদপুরে একবার যাত্রার প্যান্ডেলে গোলযোগ বেধে যায়_উত্তেজিত একদল মিনতী রানির জন্য পাগল হয়ে তাকে ছিনিয়ে নিতে এলে ওই বোম্বাটেদের দমনে যারা আসে তাদের ঘাড়ে দেখেছে এই যন্ত্র। এই যন্ত্রের আওয়াজ সে কাছে থেকে শোনেনি। খুলনা থেকে পালিয়ে আসার সময় গল্লামারি না কোথায় রেডিও স্টেশনের দখল নিয়ে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ শুনেছে। সে কী গুলির খই। ওই গুলির ভেতর নদী পার হতে গিয়ে ছোট একটা নৌকা মানুষের চাপে ডুবে যায় যায় অবস্থা। বাদশা মিয়া সাঁতার জানে না। মন্টুর হাত চেপে ধরে দাঁত কামড়ে থাকে। রাজার দুর্দশা দেখে নৌকা হালকা করতে তার একবার নদী সাঁতরে পার হওয়ার ইচ্ছে হয়। কে একজন জানাল গুলিতে একজনের পা উড়ে গেছে। শুনে মন্টু এমনই অবাক হয় যে নদী সাঁতরে পার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নীরবেই স্থগিত হয়। পা আবার উড়ে যায় কেমন করে? শুধু মানুষ মারা নয়, মানুষের হাত-পা-শরীরও তাহলে রাইফেল উড়িয়ে দিতে পারে? রাইফেলের কার্যক্ষমতার প্রতি ভয় ও শ্রদ্ধা তার বেড়ে যায়। কিন্তু গায়ে অসংখ্য ফুটো, হাত দেড় লম্বা এই যন্ত্রটা সে আগে দেখেনি ড্যাবড্যাবে খোকা চোখে যন্ত্রটার দিকে মন্টু ঘাড় ঘোরালে একজন তার কাছে প্রশ্ন রাখে_'নাম কী?' মন্টু নাম বলে। 'ছাত্র?' মন্টু মাথা নেড়ে 'ছাত্র' শব্দটা নাকচ করে 'যাত্রাদলে টিনের তলোয়ার কুড়াতাম। রাজার লোক।' শুনে সবাই হো হো হেসে ঘর ভাসিয়ে দেয়। সবাইকে চমকে দিতে বা নিজের জন্য স্থির দৃষ্টি আদায় করতে মন্টু বসে বসে তলোয়ার চালানোর মতো করে হাত ঘুরিয়ে মুখে শব্দ করে_খ্যাচ। শুকনো বারুদে-জীবনে সহসা মজা পেয়ে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা হুল্লোড় মেতে ওঠে।_'ভালোই যাত্রার লোক পাওয়া গেল।' বলে, গোঁফ ঝোলানো একজন মন্টুর সমর্থন চায় 'আছো আমাদের সঙ্গে?' মন্টু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে তলোয়ার চালানো অব্যাহত রাখে। হঠাৎ তলোয়ার তৎপরতা বন্ধ করে নীরব হয়। বাদশা মিয়া কোথায়? জায়গার নাম সে মনে করতে পারে না। রাজা এখন একা-একা হলে রাজার চলে কী করে? রাজা রইল কোন মুল্লুকে আর তার সেবক এখন আরেক মুল্লুকে_এখন রাজা যদি শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়? মন্টু শাঁ করে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের তেজ প্রকাশ করে 'আমি চলে যাব।' খপ করে একজন তার ঘাড় ধরে 'মরতে চাও, মিলিটারি মানুষ সব শেষ করে দিচ্ছে।' মানুষ শেষ করে দিচ্ছে মানে রাজা শেষ_এই বোধের উত্থানে নিমিষে মন্টুর দৃঢ়তা শিথিল হয়। সে বুঝতে পারে না মিলিটারি যাত্রার মানুষ কেন মারতে যাবে? তারা তো সত্যিকার রাজা-উজির নয়, কোনো গোলমাল ঝগড়া ফ্যাসাদে নেই। তা মাঝেমধ্যে নিজেদের ভেতর কথাকাটাকাটি, কি দারু খেয়ে হৈচৈ হয় বটে_মিটেও যায়। উজির চরিত্রের মোহিতলাল স্টেজে যাওয়ার আগে ভরপেট দারু না খেলে নড়তেই চাইত না। তাঁর টলমল বেসামাল অবস্থা দেখে কে বলবে এই লোক স্টেজ মাত করে আসবে। বড়জোর সে দরজার মুখ অব্দি পেঁৗছাতে পারে, তার পরই ঢলে পড়ে তার চরিত্র ওখানেই খতম করে দেবে। এই মোহিতলালকে একদিন ম্যানেজার শুকলাল দাশ সাফ মুখের ওপর জবাব দিয়ে দেয়_রোজ রোজ পার্টির টাকায় তাঁকে দারু জোগাড় দেয়া সম্ভব না_অযথা খরচ। মোহিতলাল তার মহিমা বজায় রাখতে রেগে লাল হয়ে ম্যানেজার লালের ওপর তলোয়ার নিয়ে চড়াও হয়_সে এক বিশ্রী মারদাঙ্গা। তৎক্ষণাৎ মোহিতলাল শুকতারা অপেরা থেকে বরখাস্ত হয়ে গেল। এটাও তো নিজেরা নিজেরা_বাইরের কারো সঙ্গে হাঙ্গামা নয়। মন্টুর মাথায় আরো কী কী বুড়বুড়ি ছিল, তার আগেই তাকে ভাবনার ভেতর থেকে তুলে একজন বাইরে নিয়ে আসে। পড়ন্ত বিকেলের নিস্তেজ রং-বদল রোদ খাবলা খাবলা পড়ে আছে লম্বা গাছগুলোর মাথায়। 'কোথায় যাবে?' তার চেয়ে যৎকিঞ্চিত ঘাড়ে বড়, হালকা পাতলা, তবু গরম খইয়ের মতো ফুটতে থাকা এক মুক্তিযোদ্ধা পাখি পড়ানোর মতো করে বিভিন্ন বৃত্তান্ত মন্টুকে বুঝিয়ে দিতে থাকে। মন্টু তা মনোযোগ দিয়ে শোনে। চকিতে তার আপদমস্তকে ঝিন ঝিন শিহরণ বয়ে যায়। তার ক্লান্ত, ধ্বস্ত, ফ্যাকাশে মুখে জেগে ওঠে জোরালো উত্তেজনা। সেই উত্তেজনার খানিকটা বুঝি ছলকে চোখ যুগলে পেঁৗছে সাদা শিরাগুলোকে লাল করে দেয়। মন্টু এবার তার ধুলোমলিন, শুকনো কাদা-লাঞ্ছিত বেঢপ প্যান্টের ওপর চর মেড়ে নাটুকে ভঙ্গি করে 'এই কে কোথায় আছিস, বাদ্য বাজা। রাজা-মন্ত্রী-পাত্রমিত্র পলাতক, এই বান্দা হাজির, যায় যাক একটা জীবন।' মন্টুর তড়বড়ে যাত্রাই স্বর এবং তলোয়ার চালানো নাচুনি ভঙ্গি ঘিরে সোল্লাসে অভিনব রসের মজায় ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা জড়ো হতে থাকে।
No comments