সুখের পিঠে সুখ by সেলিনা হোসেন
অনেকক্ষণ ধরে লোকটা বসে আছে। বসে আছে পথের মোড়ে। অর্থাৎ আড়েপাথালে পথটি যেখানে শেষ হয়ে বাঁক নিয়েছে। সে বাঁকের দিকচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাকুড় গাছের ছায়া লোকটা বাপের ভিটের মতো দখল করেছে। কেউ জানে না কোথা থেকে এসেছে। তবে কেউ কেউ দেখেছে অনেক দূর থেকে লিরলিরা শরীরটা টানতে টানতে এসেছে লোকটা।
এ গাঁয়ে তার আনুকা আগমন সকলের চোখে পড়েছে। হাত-পা ছড়িয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে। মাঝে মাঝে মুখ হাঁ করে বড়ো বড়ো শ্বাস নেয়। বোঝা যায় ভেতরে ভেতরে কোথায় যেন কষ্ট হচ্ছে। পথের ক্লান্তি সারা দেহে। হাউপশান তাকে ঘায়েল করে রেখেছে। মাথা ঝুলে আসে বারবার। কারো সঙ্গে কথা বলে না।
একবার কেবল গাঁয়ের জমির মোল্লাকে জিজ্ঞেস করে, এডা সোনাদিগি তো?
হ!
আপনে কার বাড়ি যাবেন?
আর কোনো কথা নেই। একমাথা বাবরির মধ্যে হাত চালিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। সে দৃষ্টি যে কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ে তা কেউ ধরতে পারে না। সন্ন্যাসীর মতো নির্বিকার বসে থাকে লোকটা। মাঝে মাঝে লুরালুরা ঘাস মুঠো করে চেপে ধরে। মুখটা হাঁ করলে ভক করে গন্ধ বেরোয়। সোনামুখি পোকা লোকটার মাথার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। লোকটার চাউনি যেন বিতিবিতি কাকে খোঁজে। ও এখন শাবপবন চায় না। চায় ভীষণ সাঁইসিট পরিবেশ। আর সেজন্যেই ও কারো প্রশ্নের জবাব দেয় না। প্রশ্নের জবাব দেয় না বলে দুষ্টু ছেলেরা জ্বালাতন করে। মুখ বুজে সয়ে যায়। বিরক্তি নেই, প্রতিবাদও নেই। ফুটবলের মতো ছেলেদের খেলার উপকরণ হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। ছেলেদের রৌ-রৌ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সব ধরনের উৎপাত করে ওরা। তাছাড়া ছেলেদের বিনদাতালির তো অভাব নেই। শুধু মানুষ বলে ফুটবলের মতো পায়ে পায়ে গড়িয়ে নিয়ে যায় না। অন্য কিছু হলে তাই করত এবং ফাটিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত। খুব বেশি করলে এক লাথিতে বিলের জলে ফেলে দিত। কিন্তু হয় না বলে এক সময় ছেলেরা নিজেরাই বিরক্ত হয়ে চলে যায়। আর তখন কাপড়ের বোচকাটা মাথার নিচে দিয়ে গুটিসুটি শুয়ে থাকে লোকটা। সোনাদিঘি নামটা লোকটার বুকের ভেতর স্রোতের মতো অনবরত বয়ে যায়। অনেকদিন আগে থেকেই সোনাদিঘিতে আসতে চাচ্ছিল ও। পারেনি। পেটের ভেতরের সেই অসুখটা যখন দগদগিয়ে বাড়তে থাকে তখন মনে হয় এখনই সোনাদিঘিতে আসা দরকার। সেই ভেবেই এসেছে লোকটা। এতকাল যাবৎ সোনাদিঘি ছাড়া আর কোনো নামই ওর দোতারায় বাজেনি। জায়গাটা না দেখলেও মনে মনে তার একটা ছবি কল্পনা করে রেখেছিল। যেখানেই থাকুক-না কেন একবারের জন্যে হলেও এখানেই আসতে হবে ওর। লোকটার গোটা মুখজুড়ে জ্বলজ্বল করে বাম গালের উপর বড়ো একটা জড়ুল। কাঠির মতো হাত পায়ে মাংস বলতে নেই। কেবল একটা চামড়ার খোলস ঢল ঢল করে। মনে হয় শরীরের খাঁচার চাইতে ঐ চামড়ার জামাটা অনেক বড়ো। বেমানানভাবে বড়ো। তখন লোকটার মনে হয় এককালে ও ভীষণ জোয়ান তাগড়া ছিল। ওর সঙ্গে গাঁয়ের কেউ পারত না। একবার ওর এক থাপ্পড়ে তাহেরের দুটো দাঁত পড়ে গিয়েছিল। লোকটার কষ্ট বাড়তে থাকে, কিন্তু সেটা সে তেমন আমল দিতে চায় না। ওর ধারণা কষ্টের কথা আমল দিতে চাইলেই ওটা ঘাড়ে চেপে বসে। তাই লোকটা দুপুরের আগেই গাঁয়ের ভেতরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। শিয়ালগানচু লোকটার লুঙ্গি আঁকড়ে ধরে। মনে হয় এই সোনাদিঘিতে কোনো দিন না এলে কী হবে সব তার চেনা। এই আদাড়-পাদাড়ে ও কতদিন না-এলে কী হবে, সব তার চেনা। এই আদাড়-পাদাড়ে ও কতদিন হেঁটেছে। ঐ মাঠ-প্রান্তরে কোথায় কী আছে সব ওর জানা। শুধু এখানে ওর এক টুকরো ফসলের জমি হারিয়ে গেছে। এক-দুই করে লোকটা সময়ের হিসাব করে। হ্যাঁ দশ বছর পার হয়ে গেছে। এই কয়েকটা বছর ও ঘুরে ঘুরে কত অচেনা জায়গায় কাটিয়ে দিয়েছে। আর পেটের ভেতরের দগদগে অসুখটাকে বাচ্চা বেড়ালের মতো পুষে পুষে বড়ো করেছে। বেড়ালটার এখন ইঁদুর ধরার বয়স হয়েছে। ও জানে ওর কলজেটা এখন কালো মিশমিশে ইঁদুর। বেড়ালটা এক কামড়ে কলজেটা ধরলে ও মরে যাবে। বেড়ালটা এখন চোখ গরম করে ইঁদুরটার দিকে তাকিয়ে আছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। লোকটার বুক কেমন করে। আড়পথে যেন অনেকদূর চলে এসেছে। ওর দৃষ্টিতে কেবল একটা মুখের বুড়বুড়ি ওঠে। হিসাব করে দেখল ওর বয়স এখন বিয়ালি্লশ। নেহাত কম নয়। এ বয়সের মধ্যে একটা মানুষের সাধ-আল্লাদ অনেক কমে আসে। কারো কারো ক্ষেত্রে কমতে কমতে একদম মরে যায়। ওর বেলায় তাই হয়েছে। ঐ মিশমিশে কালো ইঁদুরটা বেড়ালের মুখে ঢুকে গেলেই ও বাঁচে। ওর যেন মনে হয় বেঁচে থাকার অর্থ কেবল নিঃশ্বাস ফেলা নয়। কখনো বেঁচে থাকা মানে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াও। শেষের বেঁচে যাওয়াটার মতো প্রশান্তি আর কী আছে! দশ বছর আগে ও যখন জোয়ান তাগড়া ছিল তখন ঘুমের ঘোরে হাঁফ ধরে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলে ও সঙ্গে সঙ্গে খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়াত! বুক ভরে শ্বাস নিত। কত যে ভালো লাগত! সেই সময়ের শ্বাস নেওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে লোকটা মণ্ডলের কাছারিঘরের বারান্দায় এসে বসে। কথা বলে না বলে ওকে কেন্দ্র করে লোকের সলমবলম আর নেই। কেউ এখন আর আগের মতো ভিড় করে না। দুষ্টু ছেলেদের উত্তেজনা শেষ। সামনের পুকুরে নারকেল গাছের আড়াআড়ি ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে লোকটা বেলা বুঝতে চেষ্টা করে। তখনি কালো থেকে শাদায় রং বদলানো ছাতাটা বগলদাবা করে মণ্ডল বেরিয়ে আসে। লোকটাকে নিজের কাছারিঘরের বারান্দায় দেখে থমকে দাঁড়ায়। এখানে আসবে ভাবতে পারেনি। তার কথা ও আগেই শুনেছে। কারো সঙ্গে যে কথা বলে না তা-ও জেনেছে। তখন থেকেই মণ্ডলের ধারণা হয়েছে লোকটার মধ্যে নিশ্চয় কোনো অলৌকিক শক্তি আছে। মারফতি লাইনের লোকজন দেখলেই মণ্ডলের মধ্যে একটা ভক্তিভাব জাগে। এবং সে ভাব তাকে তার অন্য সমস্ত ইচ্ছেশক্তির কাছে পরাভূত করে রাখে। মণ্ডল কিছুক্ষণ লোকটার মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। বোঝে যে সারাদিন খাওয়া হয়নি। লোকটার অভুক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভাত খাবেন?
খামো।
মণ্ডল তার ছেলেকে ভাত আনতে বলে। পরক্ষণে জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কুঠি?
জামতলী।
জামতলীত কার বাড়ি?
লোকটা আর কথা বলে না। মণ্ডল ওর নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই বলে হামার ছোট বৌয়ের বাপের বাড়ি জামতলী। উযে দশ বছর আগে বিয়ার সময় একবার গেছনু। আর কোনো দিনও উদিক যাইনি।
লোকটার মাথা বুকের দিকে নেমে আসে। মণ্ডলের ঐ একটা কথায় দপ করে জ্বলে উঠেছিল লোকটা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার তা নিভে যায়। ঐ চোখজোড়ায় এখন আর আগুন নেই। ওটা হারিয়ে যাওয়া দিঘির মতো।
আপনে ভাত খান। আমি অ্যানা ঘুরা আসি।
মণ্ডলের ছেলে ভাতের থালা সামনে এনে রাখে। লোকটা গপাগপ খেয়ে নেবার চেষ্টা করে, পারে না। একটা যেন যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও আস্তে আস্তে ভাত খায়, দম নেয়, আবার খায়। খেতে খেতে দেখে পুকুরের বুকে সূর্যের ছায়া লাল হয়ে যাচ্ছে। মণ্ডলের ছেলেটা একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে।
আপনে ফকির বাবা লয়?
না।
লোকটার গভীর কণ্ঠে ছেলেটা হকচকিয়ে যায়। হঠাৎ করে লোকটার ভাত খাওয়া থেমে যায়। বুকটা মুচড়িয়ে ওঠে। ছেলেটা না-জেনে যে প্রশ্ন করেছে, সে প্রশ্ন ধরে তার সমগ্র অতীতের দিকে একবার ফিরে তাকায়। না, ও কোনো দিন মারফতি ফকির হতে চায়নি। জীবনের জন্যে ওর ভালোবাসা ছিল প্রবল। জামতলীর তাগড়া ছেলেরা ওর সঙ্গে কোনো দিন পারত না। প্রচণ্ড দাপটে ও সবাইকে দমিয়ে রাখত। হৈ হুল্লোড়, খেলাধুলা, চড়া গলায় গান, দলবেঁধে ঘোরা, সবার ওপর মাতব্বরি_এসব না হলে ওর ভালো লাগত না। তাছাড়া এক টুকরো কাজলকালো দিঘির জলে নেয়ে ওঠার প্রবল তৃষ্ণা ওকে সারাক্ষণ পাগল করে রাখত। সেই লমশমি যৌবন ওকে হটহটটা বোধের দিকে ঠেলে দিত। বুকের লটাবনে হাঁকরা বাতাসের ঝড় বইত। অথচ দশ বছরের ব্যবধানে ও সবকিছু থেকে ছিটকে পড়েছে। মনে হলো, হিসাবে কোথাও ভুল হয়েছে। নইলে ওর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সব আচরণই তো ছিল জীবনের পক্ষে। জীবনবিমুখ কোনো ভাবনা ওকে কখনো ঘায়েল করেনি অথচ কালো জলের সেই দিঘিটা হারিয়ে যাবার পর থেকে ও জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। এখন সেই ঐ দিকে পিঠ রেখে হাঁটে। উল্টো হাঁটার এখন আর ওর কোনো কষ্ট নেই। লোকটা তখন ছেলেটার মুখের দিকে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।
হ্যমাক কি ফকিরের লাকান লাগে?
না।
ছেলেটা খুব তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়।
লোকটা দমে যায়। বুঝতে পারে ছেলেটা ভয়ে মিথ্যে কথা বলেছে। হঠাৎ ও ভাতের থালা ঠেলে ফেলে দিয়ে ছেলেটাকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। ওর চুলে মুখ ঘষটায়।
তুই ঠিক করা ক' হামাক ফকিরের লাকান লাগে লিকিন? তোর অ্যানাও ভয় নাই। হামি তোক কিছু কমো না।
না লাগে না। সত্যি কচ্চি লাগে না।
ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। লোকটার ভেতর তখন ভীষণ কান্না ঠেলাঠেলি করছে। সেই দশটা বছর ফিরে পাবার জন্যে ও ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মনে হয় এই ছেলেটার সারা শরীরে সেই দশ বছর আগের একটা স্বাপি্নক গন্ধ রয়েছে। লোকটার বুক খালি হয়ে যায়। ছেলেটা জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। ভাতের থালা, গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়।
লোকটা আবার তার আপন জগতে ফিরে আসে। এখানে আসার পর থেকেই ও লক্ষ করেছে সারাদিন দুটি শালিক ওর মাথার উপরে ঘর বাঁধায় ব্যস্ত। এখন সে গভীর মনোযোগে শালিকের খয়েরি ডানা, হলুদ ঠোঁটে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে রাখে। ছাদের এক কোনায় দুটো বাঁশের ফাঁকে এগুলো অনবরত আনাগোনা করে। কখনো খড়ের কুটো, কখনো পাতা, কখনো চিকন ঘাস ওদের নীড়ের স্বপ্নে জোগানদার। লোকটা চেয়ে দেখে। ভাবে এটা একটা চমৎকার কাজ। এবং সে নিজেও এ কাজের অংশীদার। লোকটারও ইচ্ছে করে ঐ শালিকের মতো শুকনো ঘাস মুখে নিয়ে ঐ উঁচু ছাদে উড়ে যেতে। আর পারে না বলেই মাঝে মাঝে চোখ বুজে সে কাজের আমোদ উপভোগ করে। কখনো বাসা থেকে খড়ের কুটো গড়িয়ে পড়ে লোকটার গায়ে। ছেলেবেলায় ওর ভীষণ শখ ছিল অবিরল বৃষ্টির স্রোতে চুপচাপ গা পেতে দাঁড়িয়ে থাকা। বাবা-মার বকুনি, সর্দিজ্বরের ভয় কোনো কিছু ওকে দমাতে পারত না। সেই শখের কথা ভাবতে ভাবতে লোকটার মনে হয় শালিকের ঠোঁটের খড়গুলো অবিরল বৃষ্টির স্রোতের মতো ঝরুক। নেশাগ্রস্তের মতো ও গায়ের জামা খুলে ফেলে। উদোম গায়ে বৃষ্টির স্রোত অপূর্ব। আঃ। চারিদিক তোলপাড় করে বৃষ্টির স্রোত নামুক।
পরপর কয়েকটা শুকনো পাতা ওর কোলের ওপরে এসে পড়ে। লোকটা একটু থমকে থাকে। পাখি দুটো ওর অস্তিত্বে তেমন আমল দিচ্ছে না। সে ভেবেই একটু দূরে পাতাটা রেখে দেয় ও। শালিক দুটো নির্ভয়ে ওখান থেকে পাতা উঠিয়ে নিয়ে যায়। ও সেই নীড় বাঁধার কাজের অংশীদার হয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বারান্দার নিচে নেমে হালকা লতাপাতা, খড়ের কুটো বারান্দার কোণে এনে রাখে। শালিক দুটো অনায়াসে ওখান থেকে ঠোঁটে করে উঠিয়ে নিয়ে যায়। কাজ করতে করতে লোকটা পেটের ভেতরের শিকারি বেড়ালটার কথা ভুলে যায়। কোনো কিছুই তখন আর ওর মনে থাকে না। তন্ময় হয়ে কাজ করে। খড়ের কুটায় বারান্দার কোণ ভরে ফেলে। ওর মনে হয় সারা জীবনে ও অন্তত এই একটা ভালো কাজ করছে। এ কাজ ওর সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে। কলজেটা এখন কালো মিশমিশে ইঁদুরের বদলে একটা চমৎকার পাখির বাসা হয়ে গেছে। ও মনে মনে শিকারি বেড়ালটাকে গাল দেয়। গাল দিতে দিতে প্রার্থনা করে যেন বেড়ালটা মরে যায়। লোকটার খড়কুটো সংগ্রহের মাঝ দিয়ে সাঁঝ নামে। পুকুরের বুকে নারকেলের ছায়া আর নেই। বিতলামি করতে করতে ডুব দিয়েছে। হঠাৎ ও খেয়াল করে খড়কুটোতে বারান্দার কোনা ভরিয়ে ফেলেছে, কিন্তু শালিক দুটো নেই। সন্ধ্যার অন্ধকার দেখে ও দুটো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। লোকটা অবাক হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। কোনো কিচিরমিচির নেই। তাকিয়ে থাকতে থাকতে লোকটি দমে যায়। ওর চোখের সামনে বিশাল অন্ধকার খয়েরি থেকে হলুদ হয়। হলুদ থেকে খয়েরি। এক সময় ও অনুভব করে ওর কলজের মধ্যে শালিকের একজোড়া ঠোঁট বিঁধে আছে। লোকটা জামা গায়ে দিয়ে আবার বারান্দার কোণে বসে। মনে হয় শরীরের কোথাও কোনো শক্তি নেই। আস্তে আস্তে ওর মন থেকে সব ভাবনা মিলিয়ে যায়। কেবলই অনুভব করে শিকারি বিড়ালটা ভীষণ গর্জন করছে। ওকে আর ঠেকিয়ে রাখার উপায় নেই। লোকটা বসে বসে ধুঁকতে থাকে।
তখুনি মণ্ডল আসে। ফকির বাবা অযাচিতভাবে তার দুয়ারে এসেছে। যদি কোনো আশীর্বাদ করে। তড়িঘড়ি কাজ সেরে ফকির বাবার দোয়া নিতে এসেছে ও। ছাতা বিছিয়ে কাছে বসে। লোকটার মনে তখন কোনো উত্থালপাথাল ঢেউ নেই। মনে নদীতে চড়া পড়েছে।
সোনাদিঘিত আপনি আগে কোনো দিনও আচচেন?
না।
এটি ব্যান আপনের কেউ নাই?
না।
ও এমনিই ঘুরতে ঘুরতে আচচেন ব্যান?
না।
তা লে?
এটি আমার আবাদের জমি হারাচে?
আবাদের জমি? আবাদের জমি আবার ক্যাংকা কর্যা হারায়?
লোকটা মণ্ডলের কথা না শুনেই বলে, খালি আবাদের জমি লয়, অ্যাডা দত্তআলা কালো দিগিও হারাচে?
কিচ্চু বুজবার পারতিচ্চি না।
বুজবার পারবেনও না।
লোকটা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ওঠে। মণ্ডল চুপ মেরে যায়। ঘাটানো উচিত না! রুষ্ট হলে অঘটনও ঘটতে পারে। কিন্তু কী বলবে ভেবে পায় না। হঠাৎ ভাবে লোকটার গাঁয়ের কথা আলাপ করলে মন্দ হয় না। হয়তো গাঁয়ের কথা শুনলে খুশি হবে। কিন্তু নিজের বৌ ছাড়া জামতলীর বিশেষ কিছুই জানে না মণ্ডল। তাই বলতে থাকে।
জামতলীত হামার ছোট বৌয়ের বাপের বাড়ি। বিয়ার পর হামার সাতে যে আচ্চে আর কোনো দিন যাবার চায়নি। পরে শুনছিনু ওর সাথে লিকিন কার মহবত আছলো। ওর বাপের জন্যে বিয়াডা হয়নি। বিয়ের পর ঐ লোক লিকিন দুঃখে ববাগি হচে। আর কোনো দিনও লিকিন গাঁয়েত ফেরেনি। আপনে জানেন?
না।
হামার ছোটো বৌয়ের নাম ময়না, চেনেন?
না।
লোকটার ভেতরে ভেতরে এক অস্থিরতা দানা পাকিয়ে উঠতে থাকে। না বলতে কষ্ট হয়। ঐ 'না' শব্দটা যেন লবকুশা যৌবনের মতো বেপরোয়া। বুকের ভেতর থাকতে চায় না। এদিকে মণ্ডল একটানা কথা বলে যায়।
এদিকিন হামার ছোটো বউয়ের মনডাও হামি কোনো দিনও প্যানু না। খালি ব্যাঁচা থ্যাকবার জন্যে সংসার করিচ্চে। গাল পাড়লে চুপ কর্যা থাকে। চুপে চুপে কান্দে। আওচায় করে না। অ্যাংকা মানুষের সাথে ক্যাংকরা পারা যায় কন দিকিন? মদ্যে মদ্যে ভাবি ফিরত দিয়া আসব জামতলীত। আবার নিজের সম্মানের দিকে চ্যায়া চুপ কর্যা যাই। এমন জানলে কোন শালায় বিয়া করলে হিনি। বিয়া কর্যা একন ঠেকা গেচি।
থামেন!
লোকটার ধমকে মণ্ডলের জমানো দুঃখ বাষ্পের মতো উড়ে যায়। হকচকিয়ে চুপ করে থাকে। লোকটা একটু বেশি জোরেই ধমক দিয়ে উঠেছে। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে মণ্ডলের মনে ভক্তিভাবও বাড়ে।
লোকটার মনে হয় শরীরের ভেতরে ভেতরে সব জায়গা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। রক্তের স্রোত দেখা যায় না, কিন্তু সে স্রোত ওকে কাবু করে ফেলে। ইচ্ছে করে কোনো দিকে হেঁটে চলে যেতে। সেই সেদিকে যেখানে কেউ অন্যের জন্যে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না।
আঃ ময়না কার জন্যে বেঁচে থাকতে চায়? উঠতে গিয়ে পড়ে যায় লোকটা। শরীরে আর কোনো শক্তি নেই। শিকারি বেড়ালটা কালো ইঁদুরটার দিকে ছুটছে। তীব্রবেগে ছুটছে। দুহাতে পেট চেপে ধরে ও।
আপনের কষ্ট হচ্চে?
হ।
ঘুমাবেন?
হ।
এটি শুয়া পড়েন। গাঁয়ে একনা ভালো ডাকতর আচে। ব্যানা তাক ড্যাকা পাঠামো।
লোকটা কথা বলে না। চিত হয়ে শুয়ে ছাদ বরাবর তাকিয়ে থাকে। সেখানে এক জোড়া শালিক আজ সারা দিন ধরে বাসা বেঁধেছে। লোকটার নিষ্পলক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মণ্ডল ছাতা বগল-দাবা করে উঠে দাঁড়ায়। হামার ছোটো বৌয়ের মনডা য্যান ভালো হয় তার জন্যে অ্যানা দোয়া করবেন ফকির বাবা?
উত্তর না পেয়ে মণ্ডল নেমে চলে যায়। লোকটার তখন বিকট শব্দে হো হো করে হাসতে ইচ্ছে করে। ফকির বাবা? ফকির বাবা? শব্দ দুটো ছাদ থেকে বারান্দায় ফাঁকা জায়গাটুকুর মধ্যে ছুটোছুটি করে। লোকটা সেই পরিচিত শব্দ দুটো বুকের মধ্যে নিয়ে জামতলী থেকে সোনাদিঘি পর্যন্ত দৌড়ে আসে। অনবরত আসা যাওয়া করে। যৌবনের প্রচণ্ড দিনগুলো ফকির বাবা শব্দটার মধ্যে গুঁড়িয়ে যায়।
এবার উপুড় হয়ে শোয়। সমস্ত শরীর ঝিম মেরে আছে। যে কোনো মুহূর্তে মাছের মতো ফাল দিয়ে ডুবে যেতে পারে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় সোনাদিঘিতে ও পেঁৗছতে পারেনি। আর কত দূর সোনাদিঘি? আর কত দূর? লোকটার হঠাৎ মনে হয় ও জামতলী ছেড়ে কোথাও যেতে পারছে না। জামতলীর বড়ো জামগাছটার আড়ালে এখন সাঁঝের আঁধার। ময়নার লমশমি শরীরে অফুরন্ত গাঙের ঢেউ। সে ঢেউয়ে সোনমোন ছিল না। আলুকা স্বাদ দুজনকে অবশ করে রেখেছিল। লোকটার এখন ঐ ঘটনাটা ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ছে না। সে কত কাল আগের কথা। তবু মনে হয় এখন যৌবনের ঐ একটি দিনই সম্বল। আর কিছুই মনে নেই। ও বিড়বিড় করে ঐ একটি দিনকেই স্মরণ করে।
পরদিন সকালে মণ্ডলের ছেলেই আবিষ্কার করে যে লোকটা মরে গেছে। লোকটার ঠোঁটের পাশে রক্তের দাগ। শুকনো কালো রেখাটা গ্রীষ্মের চৌচির মাঠ। চোখজোড়া খোলা। সাদাকালো মেশানো মার্বেলের মতো শক্ত। ঘা দিলে ওখান থেকে আর কোনো বিদ্যুৎ চমকাবে না। গায়ের চাদরটা এলোমেলো। লুঙ্গি হাঁটুর উপর ওঠানো হাতের মুঠিতে চাদরের এক কোণ চেপে ধরা। ঠিক পেটের উপর শালিকের একজোড়া ডিম ভেঙে পড়ে আছে। ডিমের হলুদ অংশ শিশু-হাতে আঁকা সূর্যের মতো ছড়িয়ে আছে। শাদা খোলসের টুকরোগুলো নিয়ে দুটো শালিক কেবলই কিচিরমিচির করে। মণ্ডল এখন ছোটো গিনি্নকে বলে, আহা! ফকির বাবা মর্যা গ্যালো? জানো লোকডা না তোমার বাপের গাঁয়ের।
নাম কী?
সেডা ত জানি না।
দেখতে ক্যাংকা?
অনেকডা হামাকেরে হানিফ খাঁর লাকান।
ও।
তোমার কতা কছলাম ওনাক।
কী কলো?
কিচ্চু লয়।
গাঁয়ের মানষে এ্যাতদিনে হামাক ভুলা গ্যাচে।
জানো লোগডার বাম গালোত না একনা বড়ো জড়ুল আচলো?
তাই লিকিন? খুব বুজি জোয়ান তাগড়া?
ছোট্টো গিনি্নর ব্যগ্র কণ্ঠে মণ্ডল একটুক্ষণ সে মুখ জরিপ করে।
তারপর আস্তে বলে_না শুকনা কাঠির লাকান।
ছোট গিনি্ন আর কথা না বলেই হাতের কাজে মনোযোগী হয়। মণ্ডল বৌ-র মনোভাব বুঝতে পারে না। আর কিছু বলতেও ভালো লাগে না। ইতস্তত করে নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে, যাই দাফনের বন্দোবস্ত করিগ্যা।
মণ্ডল চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ছোটো গিনি্ন পুকুরঘাটে চলে আসে। ভিজে-ওঠা চোখ দুটোয় বারবার পানির ঝাপটা দেয়। দশ বছর পার হয়ে গেছে মনেই হয় না। সব স্মৃতি এখনো দগদগে। ছোটো গিনি্নর মনে তখন জামতলীর বড়ো জামগাছটার নিচের একটা দিনের কথা মনে হয়। ঐ একটা দিনই সম্বল। সেই শেষ দেখা। সেদিন লোকটা ওকে একটা চমৎকার অজানিত স্পর্শের সুখ দিয়েছিল। সেই শাতাল স্মৃতির ওপর আর কতকাল শুয়ে থাকা? সে স্পর্শ সম্বল করে কী ওকে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে?
এক সময় ছোটো গিনি্ন ডুকরে ওঠে।
বিয়ের পর থেকে শুধু তোমার অপেক্ষাতেই আছি। আর কতকাল জীবনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে হাঁটব আসকার। আর তো পারি না। তুমি আসো না কেন? তুমি এলে এখনো আমি ঘর ভাঙতে পারি।
একবার কেবল গাঁয়ের জমির মোল্লাকে জিজ্ঞেস করে, এডা সোনাদিগি তো?
হ!
আপনে কার বাড়ি যাবেন?
আর কোনো কথা নেই। একমাথা বাবরির মধ্যে হাত চালিয়ে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। সে দৃষ্টি যে কোথায় গিয়ে আছড়ে পড়ে তা কেউ ধরতে পারে না। সন্ন্যাসীর মতো নির্বিকার বসে থাকে লোকটা। মাঝে মাঝে লুরালুরা ঘাস মুঠো করে চেপে ধরে। মুখটা হাঁ করলে ভক করে গন্ধ বেরোয়। সোনামুখি পোকা লোকটার মাথার চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। লোকটার চাউনি যেন বিতিবিতি কাকে খোঁজে। ও এখন শাবপবন চায় না। চায় ভীষণ সাঁইসিট পরিবেশ। আর সেজন্যেই ও কারো প্রশ্নের জবাব দেয় না। প্রশ্নের জবাব দেয় না বলে দুষ্টু ছেলেরা জ্বালাতন করে। মুখ বুজে সয়ে যায়। বিরক্তি নেই, প্রতিবাদও নেই। ফুটবলের মতো ছেলেদের খেলার উপকরণ হয়ে চুপচাপ বসে থাকে। ছেলেদের রৌ-রৌ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সব ধরনের উৎপাত করে ওরা। তাছাড়া ছেলেদের বিনদাতালির তো অভাব নেই। শুধু মানুষ বলে ফুটবলের মতো পায়ে পায়ে গড়িয়ে নিয়ে যায় না। অন্য কিছু হলে তাই করত এবং ফাটিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত। খুব বেশি করলে এক লাথিতে বিলের জলে ফেলে দিত। কিন্তু হয় না বলে এক সময় ছেলেরা নিজেরাই বিরক্ত হয়ে চলে যায়। আর তখন কাপড়ের বোচকাটা মাথার নিচে দিয়ে গুটিসুটি শুয়ে থাকে লোকটা। সোনাদিঘি নামটা লোকটার বুকের ভেতর স্রোতের মতো অনবরত বয়ে যায়। অনেকদিন আগে থেকেই সোনাদিঘিতে আসতে চাচ্ছিল ও। পারেনি। পেটের ভেতরের সেই অসুখটা যখন দগদগিয়ে বাড়তে থাকে তখন মনে হয় এখনই সোনাদিঘিতে আসা দরকার। সেই ভেবেই এসেছে লোকটা। এতকাল যাবৎ সোনাদিঘি ছাড়া আর কোনো নামই ওর দোতারায় বাজেনি। জায়গাটা না দেখলেও মনে মনে তার একটা ছবি কল্পনা করে রেখেছিল। যেখানেই থাকুক-না কেন একবারের জন্যে হলেও এখানেই আসতে হবে ওর। লোকটার গোটা মুখজুড়ে জ্বলজ্বল করে বাম গালের উপর বড়ো একটা জড়ুল। কাঠির মতো হাত পায়ে মাংস বলতে নেই। কেবল একটা চামড়ার খোলস ঢল ঢল করে। মনে হয় শরীরের খাঁচার চাইতে ঐ চামড়ার জামাটা অনেক বড়ো। বেমানানভাবে বড়ো। তখন লোকটার মনে হয় এককালে ও ভীষণ জোয়ান তাগড়া ছিল। ওর সঙ্গে গাঁয়ের কেউ পারত না। একবার ওর এক থাপ্পড়ে তাহেরের দুটো দাঁত পড়ে গিয়েছিল। লোকটার কষ্ট বাড়তে থাকে, কিন্তু সেটা সে তেমন আমল দিতে চায় না। ওর ধারণা কষ্টের কথা আমল দিতে চাইলেই ওটা ঘাড়ে চেপে বসে। তাই লোকটা দুপুরের আগেই গাঁয়ের ভেতরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। শিয়ালগানচু লোকটার লুঙ্গি আঁকড়ে ধরে। মনে হয় এই সোনাদিঘিতে কোনো দিন না এলে কী হবে সব তার চেনা। এই আদাড়-পাদাড়ে ও কতদিন না-এলে কী হবে, সব তার চেনা। এই আদাড়-পাদাড়ে ও কতদিন হেঁটেছে। ঐ মাঠ-প্রান্তরে কোথায় কী আছে সব ওর জানা। শুধু এখানে ওর এক টুকরো ফসলের জমি হারিয়ে গেছে। এক-দুই করে লোকটা সময়ের হিসাব করে। হ্যাঁ দশ বছর পার হয়ে গেছে। এই কয়েকটা বছর ও ঘুরে ঘুরে কত অচেনা জায়গায় কাটিয়ে দিয়েছে। আর পেটের ভেতরের দগদগে অসুখটাকে বাচ্চা বেড়ালের মতো পুষে পুষে বড়ো করেছে। বেড়ালটার এখন ইঁদুর ধরার বয়স হয়েছে। ও জানে ওর কলজেটা এখন কালো মিশমিশে ইঁদুর। বেড়ালটা এক কামড়ে কলজেটা ধরলে ও মরে যাবে। বেড়ালটা এখন চোখ গরম করে ইঁদুরটার দিকে তাকিয়ে আছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। লোকটার বুক কেমন করে। আড়পথে যেন অনেকদূর চলে এসেছে। ওর দৃষ্টিতে কেবল একটা মুখের বুড়বুড়ি ওঠে। হিসাব করে দেখল ওর বয়স এখন বিয়ালি্লশ। নেহাত কম নয়। এ বয়সের মধ্যে একটা মানুষের সাধ-আল্লাদ অনেক কমে আসে। কারো কারো ক্ষেত্রে কমতে কমতে একদম মরে যায়। ওর বেলায় তাই হয়েছে। ঐ মিশমিশে কালো ইঁদুরটা বেড়ালের মুখে ঢুকে গেলেই ও বাঁচে। ওর যেন মনে হয় বেঁচে থাকার অর্থ কেবল নিঃশ্বাস ফেলা নয়। কখনো বেঁচে থাকা মানে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াও। শেষের বেঁচে যাওয়াটার মতো প্রশান্তি আর কী আছে! দশ বছর আগে ও যখন জোয়ান তাগড়া ছিল তখন ঘুমের ঘোরে হাঁফ ধরে দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইলে ও সঙ্গে সঙ্গে খোলা হাওয়ায় এসে দাঁড়াত! বুক ভরে শ্বাস নিত। কত যে ভালো লাগত! সেই সময়ের শ্বাস নেওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে লোকটা মণ্ডলের কাছারিঘরের বারান্দায় এসে বসে। কথা বলে না বলে ওকে কেন্দ্র করে লোকের সলমবলম আর নেই। কেউ এখন আর আগের মতো ভিড় করে না। দুষ্টু ছেলেদের উত্তেজনা শেষ। সামনের পুকুরে নারকেল গাছের আড়াআড়ি ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে লোকটা বেলা বুঝতে চেষ্টা করে। তখনি কালো থেকে শাদায় রং বদলানো ছাতাটা বগলদাবা করে মণ্ডল বেরিয়ে আসে। লোকটাকে নিজের কাছারিঘরের বারান্দায় দেখে থমকে দাঁড়ায়। এখানে আসবে ভাবতে পারেনি। তার কথা ও আগেই শুনেছে। কারো সঙ্গে যে কথা বলে না তা-ও জেনেছে। তখন থেকেই মণ্ডলের ধারণা হয়েছে লোকটার মধ্যে নিশ্চয় কোনো অলৌকিক শক্তি আছে। মারফতি লাইনের লোকজন দেখলেই মণ্ডলের মধ্যে একটা ভক্তিভাব জাগে। এবং সে ভাব তাকে তার অন্য সমস্ত ইচ্ছেশক্তির কাছে পরাভূত করে রাখে। মণ্ডল কিছুক্ষণ লোকটার মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। বোঝে যে সারাদিন খাওয়া হয়নি। লোকটার অভুক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ভাত খাবেন?
খামো।
মণ্ডল তার ছেলেকে ভাত আনতে বলে। পরক্ষণে জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কুঠি?
জামতলী।
জামতলীত কার বাড়ি?
লোকটা আর কথা বলে না। মণ্ডল ওর নিশ্চুপ মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই বলে হামার ছোট বৌয়ের বাপের বাড়ি জামতলী। উযে দশ বছর আগে বিয়ার সময় একবার গেছনু। আর কোনো দিনও উদিক যাইনি।
লোকটার মাথা বুকের দিকে নেমে আসে। মণ্ডলের ঐ একটা কথায় দপ করে জ্বলে উঠেছিল লোকটা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার তা নিভে যায়। ঐ চোখজোড়ায় এখন আর আগুন নেই। ওটা হারিয়ে যাওয়া দিঘির মতো।
আপনে ভাত খান। আমি অ্যানা ঘুরা আসি।
মণ্ডলের ছেলে ভাতের থালা সামনে এনে রাখে। লোকটা গপাগপ খেয়ে নেবার চেষ্টা করে, পারে না। একটা যেন যন্ত্রণা হচ্ছে। তবুও আস্তে আস্তে ভাত খায়, দম নেয়, আবার খায়। খেতে খেতে দেখে পুকুরের বুকে সূর্যের ছায়া লাল হয়ে যাচ্ছে। মণ্ডলের ছেলেটা একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছে।
আপনে ফকির বাবা লয়?
না।
লোকটার গভীর কণ্ঠে ছেলেটা হকচকিয়ে যায়। হঠাৎ করে লোকটার ভাত খাওয়া থেমে যায়। বুকটা মুচড়িয়ে ওঠে। ছেলেটা না-জেনে যে প্রশ্ন করেছে, সে প্রশ্ন ধরে তার সমগ্র অতীতের দিকে একবার ফিরে তাকায়। না, ও কোনো দিন মারফতি ফকির হতে চায়নি। জীবনের জন্যে ওর ভালোবাসা ছিল প্রবল। জামতলীর তাগড়া ছেলেরা ওর সঙ্গে কোনো দিন পারত না। প্রচণ্ড দাপটে ও সবাইকে দমিয়ে রাখত। হৈ হুল্লোড়, খেলাধুলা, চড়া গলায় গান, দলবেঁধে ঘোরা, সবার ওপর মাতব্বরি_এসব না হলে ওর ভালো লাগত না। তাছাড়া এক টুকরো কাজলকালো দিঘির জলে নেয়ে ওঠার প্রবল তৃষ্ণা ওকে সারাক্ষণ পাগল করে রাখত। সেই লমশমি যৌবন ওকে হটহটটা বোধের দিকে ঠেলে দিত। বুকের লটাবনে হাঁকরা বাতাসের ঝড় বইত। অথচ দশ বছরের ব্যবধানে ও সবকিছু থেকে ছিটকে পড়েছে। মনে হলো, হিসাবে কোথাও ভুল হয়েছে। নইলে ওর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সব আচরণই তো ছিল জীবনের পক্ষে। জীবনবিমুখ কোনো ভাবনা ওকে কখনো ঘায়েল করেনি অথচ কালো জলের সেই দিঘিটা হারিয়ে যাবার পর থেকে ও জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। এখন সেই ঐ দিকে পিঠ রেখে হাঁটে। উল্টো হাঁটার এখন আর ওর কোনো কষ্ট নেই। লোকটা তখন ছেলেটার মুখের দিকে জ্বলজ্বলে দৃষ্টি নিয়ে তাকায়।
হ্যমাক কি ফকিরের লাকান লাগে?
না।
ছেলেটা খুব তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়।
লোকটা দমে যায়। বুঝতে পারে ছেলেটা ভয়ে মিথ্যে কথা বলেছে। হঠাৎ ও ভাতের থালা ঠেলে ফেলে দিয়ে ছেলেটাকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। ওর চুলে মুখ ঘষটায়।
তুই ঠিক করা ক' হামাক ফকিরের লাকান লাগে লিকিন? তোর অ্যানাও ভয় নাই। হামি তোক কিছু কমো না।
না লাগে না। সত্যি কচ্চি লাগে না।
ছেলেটা মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে বলতে কেঁদে ফেলে। লোকটার ভেতর তখন ভীষণ কান্না ঠেলাঠেলি করছে। সেই দশটা বছর ফিরে পাবার জন্যে ও ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মনে হয় এই ছেলেটার সারা শরীরে সেই দশ বছর আগের একটা স্বাপি্নক গন্ধ রয়েছে। লোকটার বুক খালি হয়ে যায়। ছেলেটা জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। ভাতের থালা, গ্লাস উঠিয়ে নিয়ে চলে যায়।
লোকটা আবার তার আপন জগতে ফিরে আসে। এখানে আসার পর থেকেই ও লক্ষ করেছে সারাদিন দুটি শালিক ওর মাথার উপরে ঘর বাঁধায় ব্যস্ত। এখন সে গভীর মনোযোগে শালিকের খয়েরি ডানা, হলুদ ঠোঁটে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে রাখে। ছাদের এক কোনায় দুটো বাঁশের ফাঁকে এগুলো অনবরত আনাগোনা করে। কখনো খড়ের কুটো, কখনো পাতা, কখনো চিকন ঘাস ওদের নীড়ের স্বপ্নে জোগানদার। লোকটা চেয়ে দেখে। ভাবে এটা একটা চমৎকার কাজ। এবং সে নিজেও এ কাজের অংশীদার। লোকটারও ইচ্ছে করে ঐ শালিকের মতো শুকনো ঘাস মুখে নিয়ে ঐ উঁচু ছাদে উড়ে যেতে। আর পারে না বলেই মাঝে মাঝে চোখ বুজে সে কাজের আমোদ উপভোগ করে। কখনো বাসা থেকে খড়ের কুটো গড়িয়ে পড়ে লোকটার গায়ে। ছেলেবেলায় ওর ভীষণ শখ ছিল অবিরল বৃষ্টির স্রোতে চুপচাপ গা পেতে দাঁড়িয়ে থাকা। বাবা-মার বকুনি, সর্দিজ্বরের ভয় কোনো কিছু ওকে দমাতে পারত না। সেই শখের কথা ভাবতে ভাবতে লোকটার মনে হয় শালিকের ঠোঁটের খড়গুলো অবিরল বৃষ্টির স্রোতের মতো ঝরুক। নেশাগ্রস্তের মতো ও গায়ের জামা খুলে ফেলে। উদোম গায়ে বৃষ্টির স্রোত অপূর্ব। আঃ। চারিদিক তোলপাড় করে বৃষ্টির স্রোত নামুক।
পরপর কয়েকটা শুকনো পাতা ওর কোলের ওপরে এসে পড়ে। লোকটা একটু থমকে থাকে। পাখি দুটো ওর অস্তিত্বে তেমন আমল দিচ্ছে না। সে ভেবেই একটু দূরে পাতাটা রেখে দেয় ও। শালিক দুটো নির্ভয়ে ওখান থেকে পাতা উঠিয়ে নিয়ে যায়। ও সেই নীড় বাঁধার কাজের অংশীদার হয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বারান্দার নিচে নেমে হালকা লতাপাতা, খড়ের কুটো বারান্দার কোণে এনে রাখে। শালিক দুটো অনায়াসে ওখান থেকে ঠোঁটে করে উঠিয়ে নিয়ে যায়। কাজ করতে করতে লোকটা পেটের ভেতরের শিকারি বেড়ালটার কথা ভুলে যায়। কোনো কিছুই তখন আর ওর মনে থাকে না। তন্ময় হয়ে কাজ করে। খড়ের কুটায় বারান্দার কোণ ভরে ফেলে। ওর মনে হয় সারা জীবনে ও অন্তত এই একটা ভালো কাজ করছে। এ কাজ ওর সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে। কলজেটা এখন কালো মিশমিশে ইঁদুরের বদলে একটা চমৎকার পাখির বাসা হয়ে গেছে। ও মনে মনে শিকারি বেড়ালটাকে গাল দেয়। গাল দিতে দিতে প্রার্থনা করে যেন বেড়ালটা মরে যায়। লোকটার খড়কুটো সংগ্রহের মাঝ দিয়ে সাঁঝ নামে। পুকুরের বুকে নারকেলের ছায়া আর নেই। বিতলামি করতে করতে ডুব দিয়েছে। হঠাৎ ও খেয়াল করে খড়কুটোতে বারান্দার কোনা ভরিয়ে ফেলেছে, কিন্তু শালিক দুটো নেই। সন্ধ্যার অন্ধকার দেখে ও দুটো নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেছে। লোকটা অবাক হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। কোনো কিচিরমিচির নেই। তাকিয়ে থাকতে থাকতে লোকটি দমে যায়। ওর চোখের সামনে বিশাল অন্ধকার খয়েরি থেকে হলুদ হয়। হলুদ থেকে খয়েরি। এক সময় ও অনুভব করে ওর কলজের মধ্যে শালিকের একজোড়া ঠোঁট বিঁধে আছে। লোকটা জামা গায়ে দিয়ে আবার বারান্দার কোণে বসে। মনে হয় শরীরের কোথাও কোনো শক্তি নেই। আস্তে আস্তে ওর মন থেকে সব ভাবনা মিলিয়ে যায়। কেবলই অনুভব করে শিকারি বিড়ালটা ভীষণ গর্জন করছে। ওকে আর ঠেকিয়ে রাখার উপায় নেই। লোকটা বসে বসে ধুঁকতে থাকে।
তখুনি মণ্ডল আসে। ফকির বাবা অযাচিতভাবে তার দুয়ারে এসেছে। যদি কোনো আশীর্বাদ করে। তড়িঘড়ি কাজ সেরে ফকির বাবার দোয়া নিতে এসেছে ও। ছাতা বিছিয়ে কাছে বসে। লোকটার মনে তখন কোনো উত্থালপাথাল ঢেউ নেই। মনে নদীতে চড়া পড়েছে।
সোনাদিঘিত আপনি আগে কোনো দিনও আচচেন?
না।
এটি ব্যান আপনের কেউ নাই?
না।
ও এমনিই ঘুরতে ঘুরতে আচচেন ব্যান?
না।
তা লে?
এটি আমার আবাদের জমি হারাচে?
আবাদের জমি? আবাদের জমি আবার ক্যাংকা কর্যা হারায়?
লোকটা মণ্ডলের কথা না শুনেই বলে, খালি আবাদের জমি লয়, অ্যাডা দত্তআলা কালো দিগিও হারাচে?
কিচ্চু বুজবার পারতিচ্চি না।
বুজবার পারবেনও না।
লোকটা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ওঠে। মণ্ডল চুপ মেরে যায়। ঘাটানো উচিত না! রুষ্ট হলে অঘটনও ঘটতে পারে। কিন্তু কী বলবে ভেবে পায় না। হঠাৎ ভাবে লোকটার গাঁয়ের কথা আলাপ করলে মন্দ হয় না। হয়তো গাঁয়ের কথা শুনলে খুশি হবে। কিন্তু নিজের বৌ ছাড়া জামতলীর বিশেষ কিছুই জানে না মণ্ডল। তাই বলতে থাকে।
জামতলীত হামার ছোট বৌয়ের বাপের বাড়ি। বিয়ার পর হামার সাতে যে আচ্চে আর কোনো দিন যাবার চায়নি। পরে শুনছিনু ওর সাথে লিকিন কার মহবত আছলো। ওর বাপের জন্যে বিয়াডা হয়নি। বিয়ের পর ঐ লোক লিকিন দুঃখে ববাগি হচে। আর কোনো দিনও লিকিন গাঁয়েত ফেরেনি। আপনে জানেন?
না।
হামার ছোটো বৌয়ের নাম ময়না, চেনেন?
না।
লোকটার ভেতরে ভেতরে এক অস্থিরতা দানা পাকিয়ে উঠতে থাকে। না বলতে কষ্ট হয়। ঐ 'না' শব্দটা যেন লবকুশা যৌবনের মতো বেপরোয়া। বুকের ভেতর থাকতে চায় না। এদিকে মণ্ডল একটানা কথা বলে যায়।
এদিকিন হামার ছোটো বউয়ের মনডাও হামি কোনো দিনও প্যানু না। খালি ব্যাঁচা থ্যাকবার জন্যে সংসার করিচ্চে। গাল পাড়লে চুপ কর্যা থাকে। চুপে চুপে কান্দে। আওচায় করে না। অ্যাংকা মানুষের সাথে ক্যাংকরা পারা যায় কন দিকিন? মদ্যে মদ্যে ভাবি ফিরত দিয়া আসব জামতলীত। আবার নিজের সম্মানের দিকে চ্যায়া চুপ কর্যা যাই। এমন জানলে কোন শালায় বিয়া করলে হিনি। বিয়া কর্যা একন ঠেকা গেচি।
থামেন!
লোকটার ধমকে মণ্ডলের জমানো দুঃখ বাষ্পের মতো উড়ে যায়। হকচকিয়ে চুপ করে থাকে। লোকটা একটু বেশি জোরেই ধমক দিয়ে উঠেছে। ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে মণ্ডলের মনে ভক্তিভাবও বাড়ে।
লোকটার মনে হয় শরীরের ভেতরে ভেতরে সব জায়গা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। রক্তের স্রোত দেখা যায় না, কিন্তু সে স্রোত ওকে কাবু করে ফেলে। ইচ্ছে করে কোনো দিকে হেঁটে চলে যেতে। সেই সেদিকে যেখানে কেউ অন্যের জন্যে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে না।
আঃ ময়না কার জন্যে বেঁচে থাকতে চায়? উঠতে গিয়ে পড়ে যায় লোকটা। শরীরে আর কোনো শক্তি নেই। শিকারি বেড়ালটা কালো ইঁদুরটার দিকে ছুটছে। তীব্রবেগে ছুটছে। দুহাতে পেট চেপে ধরে ও।
আপনের কষ্ট হচ্চে?
হ।
ঘুমাবেন?
হ।
এটি শুয়া পড়েন। গাঁয়ে একনা ভালো ডাকতর আচে। ব্যানা তাক ড্যাকা পাঠামো।
লোকটা কথা বলে না। চিত হয়ে শুয়ে ছাদ বরাবর তাকিয়ে থাকে। সেখানে এক জোড়া শালিক আজ সারা দিন ধরে বাসা বেঁধেছে। লোকটার নিষ্পলক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মণ্ডল ছাতা বগল-দাবা করে উঠে দাঁড়ায়। হামার ছোটো বৌয়ের মনডা য্যান ভালো হয় তার জন্যে অ্যানা দোয়া করবেন ফকির বাবা?
উত্তর না পেয়ে মণ্ডল নেমে চলে যায়। লোকটার তখন বিকট শব্দে হো হো করে হাসতে ইচ্ছে করে। ফকির বাবা? ফকির বাবা? শব্দ দুটো ছাদ থেকে বারান্দায় ফাঁকা জায়গাটুকুর মধ্যে ছুটোছুটি করে। লোকটা সেই পরিচিত শব্দ দুটো বুকের মধ্যে নিয়ে জামতলী থেকে সোনাদিঘি পর্যন্ত দৌড়ে আসে। অনবরত আসা যাওয়া করে। যৌবনের প্রচণ্ড দিনগুলো ফকির বাবা শব্দটার মধ্যে গুঁড়িয়ে যায়।
এবার উপুড় হয়ে শোয়। সমস্ত শরীর ঝিম মেরে আছে। যে কোনো মুহূর্তে মাছের মতো ফাল দিয়ে ডুবে যেতে পারে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মনে হয় সোনাদিঘিতে ও পেঁৗছতে পারেনি। আর কত দূর সোনাদিঘি? আর কত দূর? লোকটার হঠাৎ মনে হয় ও জামতলী ছেড়ে কোথাও যেতে পারছে না। জামতলীর বড়ো জামগাছটার আড়ালে এখন সাঁঝের আঁধার। ময়নার লমশমি শরীরে অফুরন্ত গাঙের ঢেউ। সে ঢেউয়ে সোনমোন ছিল না। আলুকা স্বাদ দুজনকে অবশ করে রেখেছিল। লোকটার এখন ঐ ঘটনাটা ছাড়া আর কিছুই মনে পড়ছে না। সে কত কাল আগের কথা। তবু মনে হয় এখন যৌবনের ঐ একটি দিনই সম্বল। আর কিছুই মনে নেই। ও বিড়বিড় করে ঐ একটি দিনকেই স্মরণ করে।
পরদিন সকালে মণ্ডলের ছেলেই আবিষ্কার করে যে লোকটা মরে গেছে। লোকটার ঠোঁটের পাশে রক্তের দাগ। শুকনো কালো রেখাটা গ্রীষ্মের চৌচির মাঠ। চোখজোড়া খোলা। সাদাকালো মেশানো মার্বেলের মতো শক্ত। ঘা দিলে ওখান থেকে আর কোনো বিদ্যুৎ চমকাবে না। গায়ের চাদরটা এলোমেলো। লুঙ্গি হাঁটুর উপর ওঠানো হাতের মুঠিতে চাদরের এক কোণ চেপে ধরা। ঠিক পেটের উপর শালিকের একজোড়া ডিম ভেঙে পড়ে আছে। ডিমের হলুদ অংশ শিশু-হাতে আঁকা সূর্যের মতো ছড়িয়ে আছে। শাদা খোলসের টুকরোগুলো নিয়ে দুটো শালিক কেবলই কিচিরমিচির করে। মণ্ডল এখন ছোটো গিনি্নকে বলে, আহা! ফকির বাবা মর্যা গ্যালো? জানো লোকডা না তোমার বাপের গাঁয়ের।
নাম কী?
সেডা ত জানি না।
দেখতে ক্যাংকা?
অনেকডা হামাকেরে হানিফ খাঁর লাকান।
ও।
তোমার কতা কছলাম ওনাক।
কী কলো?
কিচ্চু লয়।
গাঁয়ের মানষে এ্যাতদিনে হামাক ভুলা গ্যাচে।
জানো লোগডার বাম গালোত না একনা বড়ো জড়ুল আচলো?
তাই লিকিন? খুব বুজি জোয়ান তাগড়া?
ছোট্টো গিনি্নর ব্যগ্র কণ্ঠে মণ্ডল একটুক্ষণ সে মুখ জরিপ করে।
তারপর আস্তে বলে_না শুকনা কাঠির লাকান।
ছোট গিনি্ন আর কথা না বলেই হাতের কাজে মনোযোগী হয়। মণ্ডল বৌ-র মনোভাব বুঝতে পারে না। আর কিছু বলতেও ভালো লাগে না। ইতস্তত করে নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে, যাই দাফনের বন্দোবস্ত করিগ্যা।
মণ্ডল চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ছোটো গিনি্ন পুকুরঘাটে চলে আসে। ভিজে-ওঠা চোখ দুটোয় বারবার পানির ঝাপটা দেয়। দশ বছর পার হয়ে গেছে মনেই হয় না। সব স্মৃতি এখনো দগদগে। ছোটো গিনি্নর মনে তখন জামতলীর বড়ো জামগাছটার নিচের একটা দিনের কথা মনে হয়। ঐ একটা দিনই সম্বল। সেই শেষ দেখা। সেদিন লোকটা ওকে একটা চমৎকার অজানিত স্পর্শের সুখ দিয়েছিল। সেই শাতাল স্মৃতির ওপর আর কতকাল শুয়ে থাকা? সে স্পর্শ সম্বল করে কী ওকে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে?
এক সময় ছোটো গিনি্ন ডুকরে ওঠে।
বিয়ের পর থেকে শুধু তোমার অপেক্ষাতেই আছি। আর কতকাল জীবনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে হাঁটব আসকার। আর তো পারি না। তুমি আসো না কেন? তুমি এলে এখনো আমি ঘর ভাঙতে পারি।
No comments