ওবামা কেন জিতলেন, কীভাবে জিতলেন by আলী রীয়াজ
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আশাতীত সাফল্যের পেছনে কী কারণ কাজ করেছে, ফলাফলের দিকে তাকিয়ে এখন অনেকেই সেটা বোঝার চেষ্টা করবেন। কেননা, গত দিনগুলোতে এ রকমই মনে হচ্ছিল যে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী মিট রমনি সম্ভবত ওবামাকে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলতে পারবেন এবং দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর কয়েকটা ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করতে সক্ষম হবেন।
কিন্তু ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এসব আশঙ্কা বাস্তবের মুখ দেখেনি।
অনেকেই আশঙ্কা করছিল যে বেকারত্বের হার ৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকলে প্রেসিডেন্টের পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনা খুব কম। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো হলেও অধিকাংশ মানুষ এখনো দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব বুঝতে পারছে না। এ জন্য তারা হয়তো ওবামার নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখতে পারবে না—এমন ধারণাও ছিল। দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবাও অসংগত ছিল না যে ক্রমবর্ধমান আদর্শিক বিভাজনের কারণে সাধারণ ভোটাররা হয়তো ওবামার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এ কারণে যে তিনি এই বিভাজনের সময় সবাইকে একত্রিত করতে পারেননি। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একটা বড় ধরনের আশঙ্কা, ২০০৮ সালে যে লিবারেল বা উদারনৈতিক জনগোষ্ঠী বড় ধরনের পরিবর্তনের আশা করে ওবামার সমর্থনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসেছিল, তারা এতটাই হতাশ হয়ে পড়ে যে এবার তাদের ভোটকেন্দ্রে পর্যন্ত হাজির করানো যাবে না বলে মনে করা হয়েছিল।
কিন্তু এসব বিরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও ওবামার বিজয় সম্ভব হয়েছে কেবল তাঁর প্রশাসনের গত চার বছরের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণেই নয়; বরং তাঁর রাজনৈতিক ও নির্বাচনী কৌশলের কারণেও।
ওবামার রাজনৈতিক কৌশলের বিষয়টা নির্ধারিত হয়েছে তাঁর আদর্শিক অবস্থান থেকে তিনি ভোটারদের কোন অংশের কাছে পৌঁছাতে চান। নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০০৮ সালের মতোই তাঁর সমর্থনে একটি বহুমাত্রিক কোয়ালিশন গড়ে তুলতে এবং তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর সমর্থনের ভিত্তি কেবল একধরনের ভোটার নন, দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, কর্মজীবী, শ্বেতাঙ্গ, সংখ্যালঘু, সমকামী নারী ও পুরুষ, তরুণ এবং মাঝ বয়সীদের যে সমর্থকগোষ্ঠী তাঁকে ঘিরে ডেমোক্রেটিক পার্টির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা জানে যে প্রতিশ্রুত পরিবর্তনের সবটা ওবামা গত চার বছরে বাস্তবায়িত করতে না পারলেও রিপাবলিকান পার্টি এবং বিশেষ করে মিট রমনি সেই ধারায় চিন্তা করতে পর্যন্ত রাজি নন। ওবামা এই কোয়ালিশনের অংশীদার সব গোষ্ঠীর যাবতীয় প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি, তার উদাহরণ দেওয়ার জন্য খুব কষ্ট করতে হয় না। কৃষ্ণাঙ্গদের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেনি, হিস্পানিকদের জন্য অভিবাসনব্যবস্থার সংস্কার হয়নি কিংবা সমকামীদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিবাহ সুরক্ষা আইন (ডিফেন্স অব মেরেজ অ্যাক্ট) বাতিল হয়নি ইত্যাদি। নির্বাচনী প্রচারের একপর্যায়ে ওবামাকে দুর্বল বলে মনে হয়েছিল। কেননা, সেটা ছিল তাঁর সমর্থকদের আত্মসমীক্ষার সময়, এসবের কিছু যদি অর্জিত না হয় তার পরও ওবামার প্রতি সমর্থনের ভিত্তি কোথায়, সেটাই ছিল তাঁর সমর্থকদের মনের প্রশ্ন। কিন্তু যতই নির্বাচনের সময় কাছে এসেছে, শেষ সপ্তাহের দিকে নারীরা যেমন বুঝতে পেরেছেন যে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি ও তাঁর রানিং মেট পল রায়ান ওবামার বিকল্প নন, তেমনি ওবামার তৈরি করা কোয়ালিশনের অন্যরাও এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় ওবামা যে বারবার এই কথাগুলোই বলেছেন, তাতে তাঁর সমর্থকেরা আশ্বস্ত হয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট তাঁর অবস্থান থেকে সরে যাননি। আগামী দিনে তা অর্জিত হোক বা না হোক, এখন এখান থেকে সরে দাঁড়ালে যে সামান্য অর্জন হয়েছে, তা-ও ধরে রাখা যাবে না।
এখানেই ওবামার নির্বাচনী কৌশলের দিকটি প্রাসঙ্গিক। রিপাবলিকান পার্টি ও মিট রমনি বারবার চেষ্টা করেও এই নির্বাচনকে প্রেসিডেন্ট ওবামার চার বছরের শাসনের বিষয়ে গণভোটে পরিণত করতে পারেননি। বরং ওবামার নির্বাচনী কর্মীরা এই নির্বাচনকে পরিণত করেছেন পছন্দের নির্বাচনে। তাঁরা দেখাতে পেরেছেন যে ওবামার সাফল্য নয়, লক্ষ করার বিষয় হলো বিকল্পটি কী। এমনকি মিট রমনি প্রার্থী হওয়ার আগে থেকেই ওবামা-শিবির তাঁকে ‘একজন ধনী ব্যবসায়ী, যিনি মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে পারেন না’—এমন একজন মানুষ হিসেবে দেখাতে পেরেছেন। মিট রমনি যতই তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যকে দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন, ততই নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে ওবামা-শিবিরের দেওয়া ধারণা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তাতে করে ওবামার কোয়ালিশনের অংশীদাররা তাঁকে আরও গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। রমনির রানিং মেট হিসেবে পল রায়ান যত বেশি রিপাবলিকান পার্টির রক্ষণশীলদের কাছে তাঁদের প্রার্থিতার আবেদন বাড়িয়েছেন, যত বেশি রক্ষণশীলদের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন, ততই ওবামা-শিবির দেখাতে পেরেছে নারীর অধিকারের প্রশ্নে রমনি প্রশাসন কতটা পশ্চাদমুখী হবে। একই সময়ে ধর্ষণ বিষয়ে একাধিক রিপাবলিকান সিনেট প্রার্থীর আপত্তিকর মন্তব্য এবং এ বিষয়ে রমনি বা রায়ানের সমর্থনসূচক মনোভাব নারীদের ভেতরে যাঁরা অর্থনীতির বিবেচনায় ওবামার বিষয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভাবতে শুরু করেছিলেন, তাঁদের এক বড় অংশকে আবারও ওবামার-শিবিরে ফিরিয়ে এনেছে।
মনে করা যেতে পারে যে প্রথম বিতর্কের পর ওবামার জনপ্রিয়তায় একটা বড় রকমের হ্রাস হয়েছিল। তার কারণ কেবল এটা নয় যে ওবামা ওই বিতর্কে ভালো করেননি। কারণ এটাও যে ওই বিতর্কে রমনি তাঁর আগের সব বক্তব্য থেকে সরে এসে একটি মধ্যপন্থী অবস্থান নেন। কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্টের বিতর্কে পল রায়ানের বক্তব্য আবারও তাঁদের কট্টর অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শুধু যে ওবামা-শিবিরই রমনির জন্য বিপদ ডেকে আনতে পেরেছে তা নয়, রমনি ও তাঁর শিবিরের লোকজন তাতে অবদান রেখেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রথম বিতর্কের পর অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা রমনি-শিবির তাঁর জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। সে ক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য ছিল রমনিকে এক আত্মবিশ্বাসী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির পর ওবামার ভূমিকা সেই সম্ভাবনাকেও তিরোহিত করে। এ জন্য রিপাবলিকান পার্টি ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডিকে যতটা দায়ী করবে, সম্ভবত তার চেয়ে কোনো অংশেই কম করবে না নিউজার্সির গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টিকে। অন্যদিকে দেশের সংকটে তিনি সবাইকে এক করতে পারায় আদর্শিক বিভাজনের কারণ তাঁর নেতৃত্বের অভাব যে নয়, সেটাও প্রমাণ করতে পেরেছেন ওবামা।
ওবামার এই সাফল্যের আরেক বড় কৌশলগত দিক হলো, তাঁর ঘাঁটিগুলো আগলে রাখা। নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই ওবামা-শিবির আগলে রেখেছে দেশের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য মিনেসোটা, উইসকনসিন, মিশিগান, আইওয়া। আর ওহাইও থেকে এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরায়নি ওবামা-শিবির। তারা জানত যে বিজয়ের জন্য দরকার নিশ্চিতভাবে তাদের শিবিরের অঙ্গরাজ্যগুলোর (দেশের পূর্বাঞ্চল আর উত্তর পূর্বাঞ্চলের) বাইরে শক্তিশালী ঘাঁটি এমনভাবে আগলে রাখা, যাতে করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ব্যস্ত রাখা যায় তাঁর নিজের রাজ্যগুলোতে। ওবামা-শিবির যে তাতে সফল হয়েছে, তা তাঁর জেতা অঙ্গরাজ্যগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। যে কারণে শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে জেতা অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ইন্ডিয়ানা ও নর্থ ক্যারোলাইনা ছাড়া কিছুই হারাতে হয়নি ওবামাকে। এই দুটি অঙ্গরাজ্য সবসময় রিপাবলিকানদের সমর্থন দিয়েছে।
হোয়াইট হাউসে ফিরে যাওয়ার জন্য ওবামা কেবল তাঁর সমর্থকদের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এক আশাবাদী কোয়ালিশনকেই ধরে রাখেননি, তৈরি করেছেন বিভিন্ন পথ। মঙ্গলবার সারা দিন তাঁর সমর্থকেরা যে যেখানেই থেকেছেন, নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে তাঁর বাড়ির আঙিনার পথ যেন মসৃণ হয়, যেন ওবামা এই পথেই ফিরতে পারেন হোয়াইট হাউসে। তাই সন্ধ্যায় ফল বের হওয়া শুরু হতে না হতেই দেখা গেল ওবামার প্রত্যাবর্তনের পথ অনেক। তিনি যেকোনো পথই নিতে পারেন।
অনেকেই আশঙ্কা করছিল যে বেকারত্বের হার ৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকলে প্রেসিডেন্টের পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনা খুব কম। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো হলেও অধিকাংশ মানুষ এখনো দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব বুঝতে পারছে না। এ জন্য তারা হয়তো ওবামার নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখতে পারবে না—এমন ধারণাও ছিল। দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে এমন ভাবাও অসংগত ছিল না যে ক্রমবর্ধমান আদর্শিক বিভাজনের কারণে সাধারণ ভোটাররা হয়তো ওবামার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন এ কারণে যে তিনি এই বিভাজনের সময় সবাইকে একত্রিত করতে পারেননি। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল একটা বড় ধরনের আশঙ্কা, ২০০৮ সালে যে লিবারেল বা উদারনৈতিক জনগোষ্ঠী বড় ধরনের পরিবর্তনের আশা করে ওবামার সমর্থনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসেছিল, তারা এতটাই হতাশ হয়ে পড়ে যে এবার তাদের ভোটকেন্দ্রে পর্যন্ত হাজির করানো যাবে না বলে মনে করা হয়েছিল।
কিন্তু এসব বিরূপ পরিস্থিতি সত্ত্বেও ওবামার বিজয় সম্ভব হয়েছে কেবল তাঁর প্রশাসনের গত চার বছরের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণেই নয়; বরং তাঁর রাজনৈতিক ও নির্বাচনী কৌশলের কারণেও।
ওবামার রাজনৈতিক কৌশলের বিষয়টা নির্ধারিত হয়েছে তাঁর আদর্শিক অবস্থান থেকে তিনি ভোটারদের কোন অংশের কাছে পৌঁছাতে চান। নির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০০৮ সালের মতোই তাঁর সমর্থনে একটি বহুমাত্রিক কোয়ালিশন গড়ে তুলতে এবং তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর সমর্থনের ভিত্তি কেবল একধরনের ভোটার নন, দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, কর্মজীবী, শ্বেতাঙ্গ, সংখ্যালঘু, সমকামী নারী ও পুরুষ, তরুণ এবং মাঝ বয়সীদের যে সমর্থকগোষ্ঠী তাঁকে ঘিরে ডেমোক্রেটিক পার্টির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা জানে যে প্রতিশ্রুত পরিবর্তনের সবটা ওবামা গত চার বছরে বাস্তবায়িত করতে না পারলেও রিপাবলিকান পার্টি এবং বিশেষ করে মিট রমনি সেই ধারায় চিন্তা করতে পর্যন্ত রাজি নন। ওবামা এই কোয়ালিশনের অংশীদার সব গোষ্ঠীর যাবতীয় প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি, তার উদাহরণ দেওয়ার জন্য খুব কষ্ট করতে হয় না। কৃষ্ণাঙ্গদের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেনি, হিস্পানিকদের জন্য অভিবাসনব্যবস্থার সংস্কার হয়নি কিংবা সমকামীদের প্রতি বৈষম্যমূলক বিবাহ সুরক্ষা আইন (ডিফেন্স অব মেরেজ অ্যাক্ট) বাতিল হয়নি ইত্যাদি। নির্বাচনী প্রচারের একপর্যায়ে ওবামাকে দুর্বল বলে মনে হয়েছিল। কেননা, সেটা ছিল তাঁর সমর্থকদের আত্মসমীক্ষার সময়, এসবের কিছু যদি অর্জিত না হয় তার পরও ওবামার প্রতি সমর্থনের ভিত্তি কোথায়, সেটাই ছিল তাঁর সমর্থকদের মনের প্রশ্ন। কিন্তু যতই নির্বাচনের সময় কাছে এসেছে, শেষ সপ্তাহের দিকে নারীরা যেমন বুঝতে পেরেছেন যে রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি ও তাঁর রানিং মেট পল রায়ান ওবামার বিকল্প নন, তেমনি ওবামার তৈরি করা কোয়ালিশনের অন্যরাও এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় ওবামা যে বারবার এই কথাগুলোই বলেছেন, তাতে তাঁর সমর্থকেরা আশ্বস্ত হয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট তাঁর অবস্থান থেকে সরে যাননি। আগামী দিনে তা অর্জিত হোক বা না হোক, এখন এখান থেকে সরে দাঁড়ালে যে সামান্য অর্জন হয়েছে, তা-ও ধরে রাখা যাবে না।
এখানেই ওবামার নির্বাচনী কৌশলের দিকটি প্রাসঙ্গিক। রিপাবলিকান পার্টি ও মিট রমনি বারবার চেষ্টা করেও এই নির্বাচনকে প্রেসিডেন্ট ওবামার চার বছরের শাসনের বিষয়ে গণভোটে পরিণত করতে পারেননি। বরং ওবামার নির্বাচনী কর্মীরা এই নির্বাচনকে পরিণত করেছেন পছন্দের নির্বাচনে। তাঁরা দেখাতে পেরেছেন যে ওবামার সাফল্য নয়, লক্ষ করার বিষয় হলো বিকল্পটি কী। এমনকি মিট রমনি প্রার্থী হওয়ার আগে থেকেই ওবামা-শিবির তাঁকে ‘একজন ধনী ব্যবসায়ী, যিনি মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে পারেন না’—এমন একজন মানুষ হিসেবে দেখাতে পেরেছেন। মিট রমনি যতই তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যকে দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করেছেন, ততই নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে ওবামা-শিবিরের দেওয়া ধারণা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তাতে করে ওবামার কোয়ালিশনের অংশীদাররা তাঁকে আরও গ্রহণযোগ্য মনে করেছেন। রমনির রানিং মেট হিসেবে পল রায়ান যত বেশি রিপাবলিকান পার্টির রক্ষণশীলদের কাছে তাঁদের প্রার্থিতার আবেদন বাড়িয়েছেন, যত বেশি রক্ষণশীলদের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন, ততই ওবামা-শিবির দেখাতে পেরেছে নারীর অধিকারের প্রশ্নে রমনি প্রশাসন কতটা পশ্চাদমুখী হবে। একই সময়ে ধর্ষণ বিষয়ে একাধিক রিপাবলিকান সিনেট প্রার্থীর আপত্তিকর মন্তব্য এবং এ বিষয়ে রমনি বা রায়ানের সমর্থনসূচক মনোভাব নারীদের ভেতরে যাঁরা অর্থনীতির বিবেচনায় ওবামার বিষয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভাবতে শুরু করেছিলেন, তাঁদের এক বড় অংশকে আবারও ওবামার-শিবিরে ফিরিয়ে এনেছে।
মনে করা যেতে পারে যে প্রথম বিতর্কের পর ওবামার জনপ্রিয়তায় একটা বড় রকমের হ্রাস হয়েছিল। তার কারণ কেবল এটা নয় যে ওবামা ওই বিতর্কে ভালো করেননি। কারণ এটাও যে ওই বিতর্কে রমনি তাঁর আগের সব বক্তব্য থেকে সরে এসে একটি মধ্যপন্থী অবস্থান নেন। কিন্তু ভাইস প্রেসিডেন্টের বিতর্কে পল রায়ানের বক্তব্য আবারও তাঁদের কট্টর অবস্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শুধু যে ওবামা-শিবিরই রমনির জন্য বিপদ ডেকে আনতে পেরেছে তা নয়, রমনি ও তাঁর শিবিরের লোকজন তাতে অবদান রেখেছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। প্রথম বিতর্কের পর অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা রমনি-শিবির তাঁর জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি। সে ক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য ছিল রমনিকে এক আত্মবিশ্বাসী নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির পর ওবামার ভূমিকা সেই সম্ভাবনাকেও তিরোহিত করে। এ জন্য রিপাবলিকান পার্টি ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডিকে যতটা দায়ী করবে, সম্ভবত তার চেয়ে কোনো অংশেই কম করবে না নিউজার্সির গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টিকে। অন্যদিকে দেশের সংকটে তিনি সবাইকে এক করতে পারায় আদর্শিক বিভাজনের কারণ তাঁর নেতৃত্বের অভাব যে নয়, সেটাও প্রমাণ করতে পেরেছেন ওবামা।
ওবামার এই সাফল্যের আরেক বড় কৌশলগত দিক হলো, তাঁর ঘাঁটিগুলো আগলে রাখা। নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবেই ওবামা-শিবির আগলে রেখেছে দেশের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য মিনেসোটা, উইসকনসিন, মিশিগান, আইওয়া। আর ওহাইও থেকে এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরায়নি ওবামা-শিবির। তারা জানত যে বিজয়ের জন্য দরকার নিশ্চিতভাবে তাদের শিবিরের অঙ্গরাজ্যগুলোর (দেশের পূর্বাঞ্চল আর উত্তর পূর্বাঞ্চলের) বাইরে শক্তিশালী ঘাঁটি এমনভাবে আগলে রাখা, যাতে করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ব্যস্ত রাখা যায় তাঁর নিজের রাজ্যগুলোতে। ওবামা-শিবির যে তাতে সফল হয়েছে, তা তাঁর জেতা অঙ্গরাজ্যগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। যে কারণে শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে জেতা অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ইন্ডিয়ানা ও নর্থ ক্যারোলাইনা ছাড়া কিছুই হারাতে হয়নি ওবামাকে। এই দুটি অঙ্গরাজ্য সবসময় রিপাবলিকানদের সমর্থন দিয়েছে।
হোয়াইট হাউসে ফিরে যাওয়ার জন্য ওবামা কেবল তাঁর সমর্থকদের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ এক আশাবাদী কোয়ালিশনকেই ধরে রাখেননি, তৈরি করেছেন বিভিন্ন পথ। মঙ্গলবার সারা দিন তাঁর সমর্থকেরা যে যেখানেই থেকেছেন, নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে তাঁর বাড়ির আঙিনার পথ যেন মসৃণ হয়, যেন ওবামা এই পথেই ফিরতে পারেন হোয়াইট হাউসে। তাই সন্ধ্যায় ফল বের হওয়া শুরু হতে না হতেই দেখা গেল ওবামার প্রত্যাবর্তনের পথ অনেক। তিনি যেকোনো পথই নিতে পারেন।
No comments