শাহজালালে সাড়ে ১৩ কেজি সোনার চালান ধরা পড়েছে- গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা জড়িত ॥ ৬০ লাখ ভারতীয় রুপী উদ্ধার

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে প্রতিদিনই স্বর্ণ ও মুদ্রা পাচার হচ্ছে। এতদিন শুধু চোরাকারবারিরাই এতে জড়িত ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারাও এতে জড়িয়ে পড়ছে। সোমবার স্বর্ণ ও মুদ্রা পাচারের বড় দুটো চালান আটকের পর ফাঁস হয়েছে কিভাবে বিমানবন্দরের গোয়েন্দারা চোরাচালানে কতোটা


বেপরোয়া। এদিন আর্মড পুলিশের বিশেষ ফাঁদে সাড়ে ১৩ কেজি স্বর্ণসহ ধরা পড়ে দুবাই থেকে আগত এক চোরাকারবারি। তার নাম মনোয়ারুল হক। তাকে সহযোগিতা করার দায়ে আজিজ নামের এক গোয়েন্দা অফিসারক বিমানবন্দর থেকে সদর দফতরে ক্লোজ করা হয়। এ ছাড়া কাস্টমস অভিযানেও ৬০ লাখ ভারতীয় রূপাসহ ধরা পড়ে পাকিস্তানের এক নাগরিক। তার নাম মোত্তাকিম হোসেন। দুটি ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে।
জানা যায়, আর্মড পুলিশের একটি চৌকস দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ অভিযান চালায়। এএসপি মিনহাজের নেতৃত্বে একাধিক টিম সকাল থেকেই বিমানবন্দরের একাধিক পয়েন্টে অবস্থান নেয়। সকাল সাড়ে দশটায় দুবাইয়ের একটি ফ্লাইট (এফ জেড ৫৮৩) অবতরণের পরই বের হয়ে আসেন মনোয়ারুল হক। তাকে দেখেই আগে পিছে সাদা পোশাকধারী আর্মড পুলিশ মানব বেষ্টনী গড়ে তোলে। তখন মনোয়ার বোর্ডিং ব্রিজ থেকে সরাসরি ইমিগ্রেশানে না গিয়ে দোতলার একটি বাথরুমে আশ্রয় নেয়। এএসপি আতিক বলেন, বোর্ডিং ব্রিজে এর আগমনী গেট দিয়ে বের হয়ে উক্ত যাত্রী ছোট ট্রলিব্যাগসহ টয়লেটে প্রবেশ করেন। বোর্ডিং ব্রিজ এলাকায় সাদা পোশাকে কর্মরত এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের সদস্যও বাথরুমে ঢুকেন। টয়লেটের বাইরে দাঁড়িয়ে কোন আওয়াজ না পেলে দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় সন্দেহ ঘনীভূত হয়। এক পর্যায়ে মনোয়ার বাথরুম থেকে বের হয়ে গেলে অপর এক সদস্যকে মনোয়ারকে অনুসরণের দায়িত্ব দিয়ে ঐ টয়লেটে ঢুকেন। গোয়েন্দা সদস্য বাথরুমের ফ্লাশ ট্যাংকের ঢাকনা কিছুটা উঠানো দেখতে পান এবং কালো পলিথিনের একটা ব্যাগ তার ভেতরে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ফ্লাশটি আলগা করে তুলে তিনি গাঢ় কফি রংয়ের একটি ছোট পলিথিনে মোড়ানো কিছু দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দায়িত্বরত এপিবিএন কর্মকর্তা এএসপি মিনহাজুল ইসলামকে অবহিত করেন। মিনহাজ সঙ্গে সঙ্গে বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেটসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তারা বাথরুমের ফ্লাশ ট্যাংকের ভিতর থেকে পলিথিনে মোড়ানো স্বর্ণের বারগুলো উদ্ধার করেন। স্বর্ণের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ায় এপিবিএন এর অপর গোয়েন্দা সদস্যের মাধ্যমে মনোয়ারকে ফলো করতে করতে বিমানবন্দরের আগমনী কনকোর্স হল থেকে আটক করেন। পরবর্তীতে সকল গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যের উপস্থিতিতে স্বর্ণের ওজন করা হলে প্যাকেটে ১৩.৬ কেজি ওজন পাওয়া যায়। ৬টি স্বর্ণের বার আকারে টেপে মোড়ানো প্রতিটি বারে বিভিন্ন সংখ্যক স্বর্ণের বিস্কিট ছিল। মোট বিস্কিটের সংখ্যা ১১৭টি। গ্রেফতারকৃত মনোয়ারুল ৫বার সংক্ষিপ্ততম সফরে দুবাই সফর করেন এবং একাধিকবার সিঙ্গাপুর যাতায়াত করেন। দেবু নামের এক ব্যক্তি এ স্বর্ণের মালিক এবং দুবাই থেকে ফেরদৌস নামের এক ব্যক্তি তাকে বাংলাদেশে আজিজ নামের এক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করার জন্য দেন বলে মনোয়ার জিজ্ঞাসাবাদে জানায়। মনোয়ার গত রবিবার দুবাই যান এবং পরদিন সোমবার ফেরত আসেন। স্বর্ণ ছাড়াও মনোয়ারের সঙ্গে থাকা লাগেজে বেশ ৫টি সনি এরিকসনের দামী মোবাইল, কিছু মেমোরী কার্ড ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স মাল পাওয়া যায় যার আনুমানিক মূল্য ৩ লাখ টাকারও বেশি।
বিকেলে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সামনে আটক মনোয়ারুল হককে হাজির করা হলে তিনি চোরাচালানের ব্যাপারে কথা বলেন। তিনি বলেন, এর সঙ্গে বিমানবন্দরে কর্মরত এনএসআই ফিল্ড অফিসার আজিজ জড়িত। এই আজিজেরই স্বর্ণের ব্যাগটা টয়লেট থেকে বাইরে নিয়ে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ধরা পড়ে যাওয়ায় আজিজ কেটে পড়েন। মনোয়ার জানান-এই আজিজই তাকে এর আগেও আড়াই কেজি স্বর্ণের একটি চালান পাচারে সহযোগিতা করেছিল।
এপিবিএন পুলিশ জানায়, মনোয়ারের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আজিজকে আসামি করা হতে পারে। তবে ইতোমধ্যে তাকে বিমানবন্দর থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। সোমবার সকাল ৯টা থেকে তিনি বিমানবন্দরে ডিউটিতে আসেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় সাংবাদিকরা বিমানবন্দর পৌঁছার আগেই আজিজকে ক্লোজ করা হয় হেড অফিসে।
এদিকে সোমবার ভোরে আগত ইতিহাদ ফ্লাইটের পাকিস্তানী নাগরিক মোত্তাকিম হোসেনের কাছ থেকে উদ্বার করা হয় ৬০ লাখ ভারতীয় রুপী। কাস্টমস এসি শওকত আরার শিফটে এসব মুদ্রা ধরা পড়ে। ঐ ফ্লাইটের আগত প্রতিটি পাকিস্তানী যাত্রীরই লাগেজ স্ক্যান করায় ধরা পড়েন মোত্তাকিম। তার লাগেজের ভেতরে চকলেটের প্যাকেটের ভেতর এসব মুদ্রা মোড়ানো ছিল। মুদ্রাগুলো জব্দ করার পর তাকে পাঠানো হয় বিমানবন্দর থানায়। এ ব্যাপারে ঢাকা কাস্টমস হাউসের কমিশনার জাকিয়া সুলতানা বলেন, বিমানবন্দরে কাস্টমস ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেও স্বীকৃতি পায় না। উল্টো দুর্নামের আর সমালোচনার শিকার হতে হচ্ছে। বিশেষ করে এপিবিএন যেভাবে কাস্টমসের কাছে এখতিয়ার বহির্ভূত কাজ করছে তা দুর্ভাগ্যজনক। এর প্রতিকার হওয়া উচিত।
এদিকে গত ৬ সেপ্টেম্বর বিমানবন্দরে রাজস্ব কর্মকর্তা সেলিনাকে এপিবিএন হয়রানি করার প্রতিবাদ জানিয়েছে কাস্টমস বিভাগ। এক বিবৃতিতে কাস্টমস এসি সাদিয়া আফরোজা বলেন, এপিবিএন রাজ্স্ব কর্মকর্তা সেলিনাকে এখতিয়ার বহির্ভূত তল্লাশি করেও কিছু পায়নি। এটা এক ধরনের হয়রানি। তিনি অবিলম্বে এ ধরণের হয়রানি বন্ধের দাবি জানান।

No comments

Powered by Blogger.