ঘরে ঘরে রোজা আসে, ঈদ আসে কি? by খোমেনী ইহসান

কবি আল মাহমুদ কার্তিক মাসের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-‘না শীত না গ্রীষ্ম, মেঘেরও কোনো আনাগোনা নেই আকাশে। আকাশ ঘন নীল, সন্ধ্যার সমাগমে আকাশের সব তারা গুনে গুনে খুঁজে পাওয়া যায়। বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকে কালপুরুষ।’  তার মতে ‘কার্তিকে সুবেশা মধ্যবয়স্ক নারীদের লাবণ্য ঢলঢল করে।’  আর ‘কার্তিকের শ্রেষ্ঠ খাদ্য হলো শোলমাছ ও কচি লাউ।’

৪১ বছর আগের কার্তিক মাসের আবহও এমনই ছিল। কিন্তু মধ্যবয়স্ক নারীদের লাবণ্য ঢল ঢল করেনি। শ্রেষ্ঠ খাদ্য শোল মাছ ও কচি লাউও সবার পাতে জোটেনি। চারদিকে নির্বিচার বিরাজমান ছিল গণহত্যার বিভীষিকা, স্বজন হারানো শোকার্ত মানুষের বিলাপ, নিষ্ঠুরতায় অবশ হয়ে যাওয়া বীরাঙ্গনাদের ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার পরিস্থিতি। সেই সময় বাংলার ঘরে ঘরে রোজা এসেছিল। যদিও মার্চ থেকেই বাংলাদেশের বয়স্ক নারী ও পুরুষরা নফল রোজা রাখতে শুরু করেছিল এই প্রার্থনা নিয়ে যেন তাদের প্রিয় মার্তৃভূমি হানাদার মুক্ত হয়। দেশ স্বাধীন হয়। তাদের জীবন থেকে দূর হয় অর্থনৈতিক বঞ্চনা, শোষণ, নিপীড়ন ও নিরাপত্তাহীনতা।

রমজানের রোজা এসেছিল কার্তিকের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিন বা দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিন। ঈসায়ী সনের দিন তারিখের হিসেবে সময়টা ছিল অক্টোবর মাসের ২১ বা ২২ তারিখ। সেই সময়ের রোজা রেখেছিল বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধের বিভিষীকার মুখোমুখি মানুষেরা যেমন, তেমনি ইনডিয়ার নানা শিবিরে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীরা ও লড়াকু বীর মুক্তিযোদ্ধারাও। প্রথম রোজা পালনের বর্ণনা পাই আমরা ১১ নং সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মোঃ রহমতুল্লাহর ভাষ্য থেকে।

২০০৬ সালে প্রথম রমজানে দৈনিক আমার দেশে প্রকাশিত এক লেখায় মোঃ রহমতুল্লাহ বলেন, ‘মিত্রবাহিনীর কর্নেল রাও নির্দেশ দিলেন, সকাল ৮টায় বিশেষ ট্রেনিংয়ে তুরা (ভারত) যেতে হবে। তখন ভোর ৫টা। সেদিন ছিল পয়লা রমজান। আগেই সাহরী খেয়ে নিয়েছি। সব যোদ্ধাকে প্রস্তুত হতে আদেশ দিলাম। যথাসময়ে ১০/১২টি ট্রাক এসে পড়ল। তুরা পার হওয়ার পর ইফতারের সময় হলো, ট্রাকেই আছি। কারো কাছে ইফতার করার মতো কোনো খাবার, এমনকি পানি পর্যন্ত ছিল না। আমার পকেটে সিগারেট ছিল, অগত্যা তা দিয়েই ইফতার (তখন জানতাম না এটি ইসলাম সমর্থন করে কিনা)। আমাদের সঙ্গে ইপিআর রফিক অবশ্য ধূমপান করেন না বিধায় কলেমা পাঠ করতঃ আল্লাহর নামে ইফতার করলেন। তুরা ট্রেনিংয়ের স্থানটির নাম এখন মনে করতে পারছি না। তবে, তুরা জেলা সদর শহর পেরিয়ে আরো ৪/৫ ঘণ্টা ট্রাক যাওয়ার পর একটি স্কুলের সামনে ট্রেনিং কমান্ডার যাত্রা স্থগিত করলেন। এখানে খাওয়া-থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। ট্রেনিং কমান্ডার বললেন, সময়মত খাদ্য আসবে। সারাদিন রোজা রাখা, ইফতারের পর ক্ষুধা বোধ করলাম। চারদিকে শুধু পাহাড়-জঙ্গল-অন্ধকার। ভাগ্য ভালো, স্কুলে হারিকেন জাতীয় বাতি ছিল। রাত যখন ১০টা তখন রুটি-ডাল আসলো সবাই খেয়ে নিলাম।’

সেই সময় সেহরি খেতে পারলেও যেমন ইফতার করার ব্যবস্থা ছিল না তেমনি অনেকের পাতে সেহেরিও জোটেনি। পানি খেয়েই রোজা রাখতে হয়েছে এ দেশের মানুষকে। আবার রোজার দিন বলে পাকিস্তানি হানাদাররা নিষ্ঠুরতা বন্ধ করেনি। শবে কদরের মহান রাত শেষে সকালেই মুখোমুখি হতে হয়েছে স্বজন হারানোর অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়েছে এদেশের অনেক মানুষকে।

কবি সুফিয়া কামাল তার ‘একাত্তরের ডায়ের’"তে লেখেন “নভেম্বর ১৭ বুধবার :আজ কি দিন! আজ ২৭শে রমজান, রোজার মাসের শ্রেষ্ঠ দিবস। কাল রাত গেছে হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। আর সেই রাত পোহালে আজ সকাল আটটায় হারালাম আমার শ্রেষ্ঠ ধনকে।”

আমরা মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতি কথা ও দলিল দস্তাবেজে রোজার বর্ণনা পেলেও ঈদের বর্ণনা পাই না কোথাও। সময়ের হিসেবে ঈদুল ফিতর হয়েছিল ২০ কি ২১ নভেম্বর। বাংলা সনের হিসাবে অগ্রহায়ণ মাসের ৭ কি ৮ তারিখে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একমাত্র ঈদের কথা আমরা কোথাও কেন পাই না তার একটা সহজ-সরল ব্যাখ্যা দাড় করানোই যায়। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়। হানাদারদের বিরুদ্ধে সারা দেশেই প্রতিরোধ জমে ওঠেছিল। ওই সময় ঈদ উদযাপিত না হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঈদ উদযাপনের জন্য যে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির প্রয়োজন হয় তা ওই সময় ছিল না। আর যুদ্ধের সময় যোদ্ধা জাতির একমাত্র অপেক্ষা থাকে বিজয় উদযাপনের জন্যই। সেই মোতাবেক ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের বিপুল বিজয়ের মধ্যেই যেন উদযাপন করতে না পারা ঈদের আনন্দও ষোলআনা উসুল হয়ে গিয়েছিল।

২.
আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার দুঃসময় ৪১ বছর আগেই পার করেছি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্র গড়েছি। ১৯৭২ ঈসায়ী সনে যেই রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে অঙ্গীকার করেছি যে ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’

গঠনতন্ত্রের দ্বিতীয়ভাগের ১০ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতিতে বলেছি যে ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ আর ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলেছি যে ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা৷’

গঠনতন্ত্রে এমন অঙ্গীকার, কর্তব্য ও মৌলিক দায়িত্বের কথা বলার পরে ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে কি আমরা সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করতে পেরেছি? মানুষের ওপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি কায়েম করেছি? রাষ্ট্রকে কখনো দেখেছি মেহনতী মানুষকে-কৃষক ও শ্রমিককে-এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করার অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব পালন করতে। নাকি আমরা দেখেছি বিগত ৪০টি বছর ধরে আমরা এক বৈষম্যপূর্ণ সমাজ  নির্মাণ করে চলেছি?

ফি বছর ঈদকে কেন্দ্র করে যে নগ্ন সত্য হাজির হচ্ছে তাতে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না যে আমরা এক বৈষম্যপূর্ণ সমাজ  নির্মাণ করে চলেছি। একদিকে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ঈদের ছুটি কাটাতে বিদেশের নানা বিনোদন কেন্দ্রে পাড়ি জমাচ্ছেন।অন্যদিকে অভাবের তাড়নায় বাবা নিজ হাতে সন্তানকে নদীতে ফেলে দিচ্ছেন।

গত ১৮ আগস্ট দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে “কমপক্ষে পাঁচ লাখ লোক এবার বিদেশের মাটিতে ঈদ উদযাপন করছেন। ইতোমধ্যেই তারা দেশ ছেড়েছেন।রবিবার ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হওয়ার সময় ধরে নিয়ে শুক্রবার পর্যন্ত এরা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। শনিবারও ঢাকা ছাড়ছেন অনেকে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের সঙ্গে আলাপ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। দীর্ঘ ছুটি আর পরিবেশ অনুকূল থাকায় এত বিপুলসংখ্যক লোক এবার দেশের বাইরে ঈদ করছেন। এছাড়া রমজানে ওমরাহ করতে যাওয়া বিপুলসংখ্যক ধর্মানুরাগীও হেরেম শরীফে ঈদের নামাজ আদায় করেই দেশে ফিরবেন। এদের বেশিরভাগই বিত্তবান ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিক।”

গত ১৭ আগস্ট কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বারদাগ গ্রামের বাসিন্দা আবদুল মালেক তার  পাঁচ বছর বয়সী ছেলে মানসুর ও দশ বছর বয়সী মেয়ে মুন্নিকে  লালন শাহ সেতু হতে পদ্মায় ফেলে দেন। ১৮ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আব্দুল  মালেকের এ বক্তব্য ছাপানো হয়েছে, “অভাবের সংসার, পেটে ভাত নাই, সন্তান বাঁচি রাখি কী করব। তাই ব্রিজের ওপর নি ফেলি দিছি।” তার ভাষ্যমতে, সকালে দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি একটি নসিমনে করে লালন শাহ সেতুর ওপর নামেন। মুন্নি ও মানসুরকে সেতুর রেলিংয়ের ওপর বসিয়ে প্রথমে মুন্নিকে ফেলে দেন। ভয়ে মানসুর দৌড় দিলে তাকে ধরে নদীতে ফেলে দেন। এরপর তিনি গ্রামে ফিরে আসেন।’ যদিও প্রথম আলোর প্রতিবেদনে একটি তথ্য চেপে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলানিউজ২৪ডটকম বলেছে যে, ঈদের জন্য ছেলে-মেয়েকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দিতে পারেননি বলেই  আব্দুল মালেক দুই সন্তানকে নদীতে নিক্ষেপ করেছে।

৩.
আমরা মনে করি, বাংলাদেশে যে লুটপাটের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে, তা ধনীকে দিনে দিনে আরো ধনী করে তুলছে। আর গরীবকে করে তুলছে নিঃস্ব-অসহায়। এর অবসান ঘটানো না হলে এই দেশে ফি বছর ঘরে ঘরে রোজা আসবে ঠিকই। কিন্তু ঈদ আসবে শুধু ধনীদের ঘরেই। যার ফলে ঈদকে কেন্দ্র করে কেউ বিদেশে পাড়ি জমাবে, কেউবা দেশেই ভোগে মত্ত হবে। আর কেউ কেউ আবার সন্তানকে নদীতে নিক্ষেপ করবে। এই অবস্থার অবসান ঘটানোর দায় কোনোভাবেই রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না। তাকে বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ হাজির করতেই হবে। পাশাপাশি ধনীর সম্পদে গরীবের যে নির্দিষ্ট হক রয়েছে, যাকে জাকাত বলে, তা আদায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই হয়তো এদেশে এক দিন ঘরে ঈদ উদযাপিত হবে।

আর তা যদি কখনো সম্ভব না হয় তাহলে কী হবে? কবি আশরাফ আলী খানের ‘ঈদ’ কবিতার শেষ স্তবক উদ্ধৃত করছি:

সাঁঝের আকাশে দেখা দেয় চাঁদ, ঘরে ঘরে লাগে ধুম,
সারা রাত ধরি চলে উৎসব, কারো চোখে নাই ঘুম।
মওলভী কন ‘আল্লার শান
ঈদে হয় তাজা সকলের প্রাণ।’
প্রজা কেঁদে কয়-‘ঈদের জুলুমে মরিল গরীব মজলুম।’
‘ঈদ একেবারে ব্যর্থ হইল’-আল্লা ভাবেন হয়ে গুম।

খোমেনী ইহসান: সাংবাদিক
                       ইমেইল: khomenee.ehsan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.