আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন
(শেষাংশ) সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান, শাহরিয়ার কবির ও জাহানারা ইমামের উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। প্রথম সভায় আমরা কয়েকজন উপস্থিত ছিলাম। পরে সবার সম্মতি নিয়ে ১০১ বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে কমিটি গঠিত হয়।
নির্মূল কমিটির বৈশিষ্ট্য ছিল বাংলাদেশের পরিচিত বিশিষ্টজনরা সবাই এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন যেমন : সুফিয়া কামাল, কলিম শরাফী, শামসুর রাহমান, আহমদ শরীফ, শওকত ওসমান, নীলিমা ইব্রাহিম, ব্যারিস্টার ইশতিয়াক আহমদ; কে নয়? অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তো মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ছিলেন এর উপদেষ্টাম-লীর সভাপতি।
নির্মূল কমিটির প্রধান লক্ষ্য ছিল একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার। আমরা তখন থেকে অনুধাবন করেছিলাম, বিচার হতে হলে রাজনৈতিক দলের সমর্থন জরুরী। সে জন্য কিছুদিনের মধ্যেই ৭২টি সংগঠন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। জাহানারা ইমাম হন আহ্বায়ক। সংক্ষেপে এই কমিটি সমন্বয় কমিটি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। নির্মূল কমিটি তখন আর আলাদাভাবে কাজ করেনি। সমন্বয় কমিটির কাজ পরিচালনার জন্য একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, জাসদের প্রয়াত কাজী আরেফ আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির নুরুল ইসলাম নাহিদ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চের’ পক্ষে আহাদ চৌধুরী ও অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, নির্মূল কমিটির পক্ষে সৈয়দ হাসান ইমাম ও শাহরিয়ার কবির। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৭২ সালের দু’দশক পর ফের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনমত কীভাবে সংগঠিত হয়েছিল।
নির্মূল সমন্বয় কমিটির বড় অবদান ঘাতকদের বিরুদ্ধে দুটি গণতদন্ত কমিশন গঠন ও রিপোর্ট প্রকাশ এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের প্রতীকী বিচার। এ ধরনের উদ্যোগ এ দেশে প্রথম। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করেছিল। এই মামলা নিয়েই জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালে পরলোকগমন করেন। আর বিএনপি নিজেকে চিহ্নিত করেছিল পাকিস্তানমনা দল হিসেবে।
জাহানারা ইমামের আকস্মিক মৃত্যুর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে খানিকটা ভাটা পড়ে। সমন্বয় কমিটির কর্মোদ্যোগ শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে তখই নতুন করে শাহরিয়ার কবির ও কাজী মুকুলের উদ্যোগে নির্মূল কমিটির কার্যক্রম বেগবান হয়েছে। কবি শামসুর রাহমান দীর্ঘদিন এর সভাপতি ছিলেন। আমরাও অনেকে কমিটিতে ছিলাম এবং আছি। তবে শাহরিয়ার ও মুকুল এখনও নির্মূল কমিটির প্রাণশক্তি। দু’জন দু’জনের পরিপূরকও। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর অবদানের কথাও মনে রাখার মতো।
আমাদের মনে আছে, আমরা যখন আন্দোলন শুরু করেছিলাম, তখন ছিল আলবদরদের যুগ। অনেকেই আমাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছে। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনেকে চাঁদা দিতে চাননি, দেখা করতে চাননি। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সমর্থকরাও আছেন। ক্রমে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দাবির সঙ্গে সাংস্কৃতিক জোট, মহিলা পরিষদ, উদীচী অনেকেই এগিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আস্তে আস্তে জনমত গড়ে উঠতে থাকে ঘাতকদের বিচারের দাবিতে। তত্ত্বাবধায়ক সামরিক সরকারের সময় গঠিত হয় ‘সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম।’ আলবদর-রাজাকার বা অন্য কথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বেগবান হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে একটি অত্যাশ্চার্য ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত দলসমূহ নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে ঘোষণা করে ক্ষমতায় গেলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য সবসময়ই এই বিচারের কথা বলেছিলেন। তাই ১৯৯৬ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর অনেকে মনে করেছিলেন, বিচার হবে। কিন্তু হয়নি। ২০০৭-৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ঘোষণা আলোড়িত করে নতুন প্রজন্মকে। এমনকি আলবদরদের এক সময়ের পৃষ্ঠপোষক লে. জেনারেল এরশাদও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেন। তাতে বোঝা যায়, এ দাবি জনদাবি হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে আলবদররা ও তাদের সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হয়ে নির্বাচনে নামে এবং বিপুলভাবে পরাজিত হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও কেউ কল্পনা করেনি, আসলে ঠিক ঠিকই যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে। আলবদররাও ভাবেনি, কারণ তাদের আর্থিক সামাজিক শক্তি অত্যন্ত প্রবল। কিন্তু যাবতীয় জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেখ হাসিনা ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে যে আইন করে গিয়েছিলেন সেই আইন অনুযায়ীই বিচার শুরু হয়। গ্রেফতার হয় জামায়াতের নেতৃবৃন্দ বিএনপিতে যোগ দেয়া পূর্বতন আলবদরের নেতারা। আলবদরদের সুপ্রিমো গোলাম আযম, নাজিম-এ আলা মতিউর রহমান নিজামী, নাজিম মুজাহিদ, কুখ্যাত আলবদর নেতা কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী ও কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ও বিচার চলছে। আলবদরদের সঙ্গে জড়িত হয়ে কাজ করছে এমন কয়েকজন যেমন সাকা চৌধুরী, আবদুল আলীম বা সাঈদীরও বিচার চলছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম। শেখ হাসিনা অন্তত এই একটি কারণে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আগেই বলেছি, আলবদররা অত্যন্ত সুসংগঠিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য তারা তাদের অর্থ ভা-ার নিয়ে নেমেছে। সারা পৃথিবীজুড়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। মীর কাসেম আলী এ বিচার বানচালের জন্য ২৫ লাখ ডলার খরচ করেছেন। ১৯৭২ সালের মতোই সরকার এখন এক্ষেত্রে উদাসীন। তারা অপপ্রচার রোধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমন কী প্রশ্নও তোলা হয়নি মীর কাসেম যে ২৫ লাখ ডলার লবিস্টকে দিলেন, তা কীভাবে দিলেন? বিচারিক অবকাঠামো দুর্বল। তাতেও তারা সহায়তা করতে নারাজ। ভাবটা এই, ট্রাইব্যুনাল চেয়েছিল দিয়েছি। জনগণ আর কী চায়? বাকি সব আল্লাহর ইচ্ছা।
১৯৭১ সালে আল্লাহ্কে বারবার ডেকেও আলবদরদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়নি। এটি ব্ল্যাসফেমি নয়। আল্লাহ বলেছেন, নিজেকে নিজে সাহায্য না করলে কীভাবে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে? যেমনএবার যথাসময়ে যদি বিচার না হয় বা বিচারের প্রসিকিউশনের দুর্বলতার জন্য যদি তারা মুক্তি পায় তা’হলে ভোটযুদ্ধে আওয়ামী লীগের পরাজয় অনিবার্য। ১৯৭১ সাল থেকে তাদের হত্যাকা-ের সপক্ষে যুক্তি ছিল, তারা অখ- পাকিস্তানের পক্ষে এটিই তাদের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। সেটি তাদের রাজনীতি। সুতরাং রাজনৈতিক কারণে তাদের বিচার হতে পারে না। এখন পর্যন্ত এই থিসিসই তারা বারবার তুলে ধরছে এবং ঘোষণা করছে, এটি যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, এটি রাজনৈতিক বিচার। নতুন প্রজন্ম যারা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা এই থিসিস বিশ্বাস করবে। তাহলে ১৯৪৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাজনীতির বিকাশ হয়েছিল তার মৃত্যু ঘটবে।
এখানে দুঃখের সঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই। কারণ, আমাদের দুঃখ রাখার জায়গা নেই। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আমরা বাম ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছি এবং করছি। এবং এ পক্ষকে আমরা বলছি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তারা দু’বার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সামগ্রিক কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। আলবদরদের কথা ধরা যাক। ১৯৭১ সালে প্রতিপক্ষ ও প্রতিপক্ষের রাজনীতি বিনাশের জন্য তারা কার্যকর পরিকল্পনা নিয়েছে। পরাজয়ের পরও দমেনি। নতুন মিত্রের সন্ধান তারা পেয়েছে সেনাবাহিনীর ভেতরে। এ মন্তব্যের কারণ এই যে জিয়াউর রহমান যখন আলবদরদের পক্ষে কার্যক্রম গ্রহণ করেন তখন সেনাবাহিনীর কেউ-ই প্রতিবাদ করেননি। এমন কী খুনীদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াননি। এটি বাস্তব সত্য।
আলবদররা এই মিত্রের সাহায্যে বিকশিত হয়েছে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করে। সমাজ, অর্থনীতিতে তারা নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা ইতিহাসকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করেছে হাতিয়ার হিসেবে। আমরা ভুলে যাই, মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের একটি উপাদান হিসেবে।
তাদের সামগ্রিক কার্যক্রম দু’ভাবে পরিচালিত হয়েছে। এক, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পুরনো মিত্রদের সঙ্গে তারা সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছে। দুই, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা/মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিনষ্ট করেছে। যেমনÑ তারা জিয়াউর রহমান জাদুঘর করেছে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করেনি। বিএনপিকে তারা নতুন ফ্রন্ট হিসেবে তৈরি করেছে। পরবর্তীকালে জাতীয় পার্টিকে, ধর্ম ব্যবসায়ী অন্যান্য দলকে মিত্র রূপে গড়ে তুলেছে। একই সঙ্গে জঙ্গী-মৌলবাদের তারা বিস্তৃতি ঘটিয়েছে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় দিয়ে, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। একই সঙ্গে সেক্যুলার সমর্থকদেরকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে দমন করতে চেয়েছে। এই ধারার প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে তারা বারবার হত্যা করতে চেয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এর উদাহরণ। জঙ্গী-মৌলবাদ তাদের আরেকটি ফ্রন্টÑ যা আন্তর্জাতিক মিত্রদের দ্বারা তৈরি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষের প্রচারণা-শক্তি অসম্ভব, তাদের কর্মীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কমিটেড এবং বিরোধী পক্ষকে তারা কোন ছাড় দেয় না। একটি জেনারেশনের ভাবনার জগতে তারা আধিপত্য বিস্তার করে আছে এবং তা প্রসারণের জন্য স্বাধীন আর্থিক ভা-ার গড়ে তুলেছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক বঙ্গবন্ধু। তাই প্রথমে তারা তাঁকে হত্যা করেছে এবং সপরিবারে। আওয়ামী লীগের একাংশ বামধারার একাংশকে মিত্র হিসেবে পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত হয়ে গেছে। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ, বিশেষ করে যারা শহরে ছিল, তারা সম্পদ কুক্ষিগত করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। এ সম্পদ রক্ষার কারণে কমিটমেন্ট রক্ষা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ ধারার মানুষজন সার্বিকভাবে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করে না, খ- খ- এডহক কার্যক্রম গ্রহণ করে মাত্র। সরকার গঠন করলে এরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আমি দুয়েকটি উদাহরণ দিই। ভাবনার জগতে আধিপত্য বিস্তারে এদের কোন কার্যক্রম নেই। সর্বপর্যায়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করার যে আবেদন আমরা করেছি ১৯৯৬ সালের ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল সমস্ত অনৈতিহাসিক স্থাপনা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুক্ত করতে। পূর্তমন্ত্রী সে ক্ষেত্রে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেননি। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ এবং ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপনা শেষ করতে পারেনি। এই নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। জঙ্গী দমনে সরকার আন্তরিক, কিন্তু তা বিনাশ করার জন্য যে ভাবনার জগতে আধিপত্য বিস্তার করা দরকার সে বিষয়ে কোন চিন্তাভাবনা নেই।
আরেকটি উদাহরণ দিই। মাদ্রাসার দু’টি ডিগ্রীকে প্রচলিত স্কুল-কলেজের ডিগ্রীর সমমর্যাদা দেয়া হয়েছেÑ যদিও দুটি আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমাদের ভর্তি ব্যবস্থায় ৬০% নম্বর রাখা হয়েছে ঐ দু’টি ডিগ্রীর ফলের ওপর। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের ছাত্রদের ৯০-৯৫ ভাগের কম নম্বর দেয় না। এবং যেহেতু তারা মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী, সেহেতু টিক চিহ্ন প্রশ্নে তারা নম্বর বেশি পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সমাজ বিজ্ঞান প্রভৃতি অনুষদে এখন মাদ্রাসার ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিভিল প্রশাসনের ক্যাডারেও এ ব্যবস্থা বদলবার কোন চিন্তাভাবনা এ সরকার করেনি। শুধু তাই নয়, আলবদরদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জমিয়াতুল মোদাররেসিনের দাবি অনুযায়ী কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে আরবী বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এ রকম দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অধিকাংশ ছাত্র প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে। শুধু তাই নয়, শুনেছি, মোদাররেসিনের দাবি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের উপাধি হবে ‘গ্র্যান্ড মুফতি’। অতঃপর এই গ্র্যান্ড মুফতি সর্বক্ষেত্রে ফতোয়া কার্যকর করবেন। আওয়ামী নেতৃবৃন্দের ধারণা, এতে তাদের সমর্থন বাড়বে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আওয়ামী লীগকে ঘোষণা করতে হবে পাকিস্তানের সঙ্গে তারা মিলে যাবে, তাহলে হয়ত ভোট পেতেও পারে; কিন্তু তাদের কখনও বিশ্বাস করা হবে না। ধর্মভীরুতাকে চুয়িংগামের মতো টেনে মৌলবাদ দৃঢ় করার ক্ষেত্রে তারা কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব।
হাইকোর্টের নির্দেশে জনাব শাহাবুদ্দীন সংখ্যালঘু অত্যাচারের যে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন, সরকার সে ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, রিপোর্টটিও প্রকাশিত হয়নি। এমন কী ১/১১-তে যারা যুক্ত ছিল [বা এর বিরুদ্ধে নিশ্চুপ ছিল], তাদের প্রশাসনে রেখেছে, মন্ত্রিসভায়ও। এই নিয়ে আলোচনা তুললে আলোচনাকারীকে সঙ্গে সঙ্গে সরকারবিরোধী বিএনপির পক্ষের লোক বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এভাবে, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য যারা ছিলেন শেখ হাসিনার সমর্থক, তারা সরে যাচ্ছেন। আলবদরদের মতো এ পক্ষের কমিটমেন্ট তেমন দৃঢ় নয়। সে কারণেই দেখা যায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী সচিবের স্টাফের সংখ্যা কুড়ির বেশি। অথচ মানবতাবিরোধী অপরাধে দুটি ট্রাইব্যুনালে ১৩ জন স্টাফ নিয়োগ মন্ত্রীরা মনে করছেন মাত্রাতিরিক্ত। এ নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছে তাদের বলা হচ্ছে এ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। এই ধারণাহীনরা ৪০ বছর এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। আর মন্ত্রীরা? আমি ফিরিস্তি আর বাড়াব না। আমি একটি বিষয় বুঝতে অক্ষম, ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতাবানদের চেহারাটা, এজেন্ডা বদলে যায় কেন?
সবশেষে আমরা অভিনন্দন জানাই এ সরকারকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বলি, মন্ত্রীদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য যদি যথাসময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হয় এবং এ কারণে যদি আওয়ামী লীগ পরাজয় বরণ করে তা’হলে তারা বুদ্ধিজীবীদের, পেশাদারদের [যারা অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশ্বাসী] নির্মূল করে দেবে। তাদের যুক্তি খুব পরিষ্কার, আগে খুন তারপর দেখা যাক কী হয়। ১৯৭১ সালে আলবদরদের হাতে যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা তো ফিরে আসেননি। আলবদররা শুধু বেঁচেই রইল না, ফিরেও এল। এখন মাত্র কয়েকজনের বিচার হচ্ছে। মাঝারি পর্যায়ের আলবদরদের ব্যাপারে কোন চিন্তাভাবনা করা হয়নি। মাঠ পর্যায়ে যারা আছে তাদের কথা বাদই দিলাম। এসব আলবদর এখন অস্ত্র শানাচ্ছে, আমাদের যে কোন একটি ভুলের জন্য অপেক্ষা করছে মাত্র।
কয়েক দিন পর পর আলী আহসান মুজাহিদের ভি চিহ্ন দেখিয়ে হাসি বা হাত নেড়ে গোলাম আযমের মৃদু হাসি কি দেখেননি?
লে. জে. জিয়াউর রহমান, লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া শহীদের যে অবমাননা করেছিলেন এবং এখনও করছেন, সেখানে শেখ হাসিনা শহীদদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আলবদর এখন ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করছে। নিজেকে ও পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে চাইলে এখনই ঠিক করুন আলবদরদের আবার ক্ষমতায় আনবেন, নাকি যারা এখন খুনি আলবদরদের বিচার করছে তাদের সমর্থন করবেন।
নির্মূল কমিটির প্রধান লক্ষ্য ছিল একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার। আমরা তখন থেকে অনুধাবন করেছিলাম, বিচার হতে হলে রাজনৈতিক দলের সমর্থন জরুরী। সে জন্য কিছুদিনের মধ্যেই ৭২টি সংগঠন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। জাহানারা ইমাম হন আহ্বায়ক। সংক্ষেপে এই কমিটি সমন্বয় কমিটি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। নির্মূল কমিটি তখন আর আলাদাভাবে কাজ করেনি। সমন্বয় কমিটির কাজ পরিচালনার জন্য একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, জাসদের প্রয়াত কাজী আরেফ আহমদ, কমিউনিস্ট পার্টির নুরুল ইসলাম নাহিদ, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্র প্রতিরোধ মঞ্চের’ পক্ষে আহাদ চৌধুরী ও অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, নির্মূল কমিটির পক্ষে সৈয়দ হাসান ইমাম ও শাহরিয়ার কবির। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৭২ সালের দু’দশক পর ফের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জনমত কীভাবে সংগঠিত হয়েছিল।
নির্মূল সমন্বয় কমিটির বড় অবদান ঘাতকদের বিরুদ্ধে দুটি গণতদন্ত কমিশন গঠন ও রিপোর্ট প্রকাশ এবং ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতের প্রতীকী বিচার। এ ধরনের উদ্যোগ এ দেশে প্রথম। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি সরকার জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করেছিল। এই মামলা নিয়েই জাহানারা ইমাম ১৯৯৪ সালে পরলোকগমন করেন। আর বিএনপি নিজেকে চিহ্নিত করেছিল পাকিস্তানমনা দল হিসেবে।
জাহানারা ইমামের আকস্মিক মৃত্যুর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে খানিকটা ভাটা পড়ে। সমন্বয় কমিটির কর্মোদ্যোগ শ্লথ হয়ে গিয়েছিল। এ পরিপ্রেক্ষিতে তখই নতুন করে শাহরিয়ার কবির ও কাজী মুকুলের উদ্যোগে নির্মূল কমিটির কার্যক্রম বেগবান হয়েছে। কবি শামসুর রাহমান দীর্ঘদিন এর সভাপতি ছিলেন। আমরাও অনেকে কমিটিতে ছিলাম এবং আছি। তবে শাহরিয়ার ও মুকুল এখনও নির্মূল কমিটির প্রাণশক্তি। দু’জন দু’জনের পরিপূরকও। শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর অবদানের কথাও মনে রাখার মতো।
আমাদের মনে আছে, আমরা যখন আন্দোলন শুরু করেছিলাম, তখন ছিল আলবদরদের যুগ। অনেকেই আমাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছে। কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনেকে চাঁদা দিতে চাননি, দেখা করতে চাননি। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সমর্থকরাও আছেন। ক্রমে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দাবির সঙ্গে সাংস্কৃতিক জোট, মহিলা পরিষদ, উদীচী অনেকেই এগিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখালেখির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আস্তে আস্তে জনমত গড়ে উঠতে থাকে ঘাতকদের বিচারের দাবিতে। তত্ত্বাবধায়ক সামরিক সরকারের সময় গঠিত হয় ‘সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম।’ আলবদর-রাজাকার বা অন্য কথায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বেগবান হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম এতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে একটি অত্যাশ্চার্য ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত দলসমূহ নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে ঘোষণা করে ক্ষমতায় গেলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য সবসময়ই এই বিচারের কথা বলেছিলেন। তাই ১৯৯৬ সালে তিনি ক্ষমতায় আসার পর অনেকে মনে করেছিলেন, বিচার হবে। কিন্তু হয়নি। ২০০৭-৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ঘোষণা আলোড়িত করে নতুন প্রজন্মকে। এমনকি আলবদরদের এক সময়ের পৃষ্ঠপোষক লে. জেনারেল এরশাদও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেন। তাতে বোঝা যায়, এ দাবি জনদাবি হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে আলবদররা ও তাদের সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলো একাট্টা হয়ে নির্বাচনে নামে এবং বিপুলভাবে পরাজিত হয়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও কেউ কল্পনা করেনি, আসলে ঠিক ঠিকই যুদ্ধাপরাধের বিচার হবে। আলবদররাও ভাবেনি, কারণ তাদের আর্থিক সামাজিক শক্তি অত্যন্ত প্রবল। কিন্তু যাবতীয় জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেখ হাসিনা ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে যে আইন করে গিয়েছিলেন সেই আইন অনুযায়ীই বিচার শুরু হয়। গ্রেফতার হয় জামায়াতের নেতৃবৃন্দ বিএনপিতে যোগ দেয়া পূর্বতন আলবদরের নেতারা। আলবদরদের সুপ্রিমো গোলাম আযম, নাজিম-এ আলা মতিউর রহমান নিজামী, নাজিম মুজাহিদ, কুখ্যাত আলবদর নেতা কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী ও কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়েছে ও বিচার চলছে। আলবদরদের সঙ্গে জড়িত হয়ে কাজ করছে এমন কয়েকজন যেমন সাকা চৌধুরী, আবদুল আলীম বা সাঈদীরও বিচার চলছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম। শেখ হাসিনা অন্তত এই একটি কারণে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আগেই বলেছি, আলবদররা অত্যন্ত সুসংগঠিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য তারা তাদের অর্থ ভা-ার নিয়ে নেমেছে। সারা পৃথিবীজুড়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। মীর কাসেম আলী এ বিচার বানচালের জন্য ২৫ লাখ ডলার খরচ করেছেন। ১৯৭২ সালের মতোই সরকার এখন এক্ষেত্রে উদাসীন। তারা অপপ্রচার রোধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এমন কী প্রশ্নও তোলা হয়নি মীর কাসেম যে ২৫ লাখ ডলার লবিস্টকে দিলেন, তা কীভাবে দিলেন? বিচারিক অবকাঠামো দুর্বল। তাতেও তারা সহায়তা করতে নারাজ। ভাবটা এই, ট্রাইব্যুনাল চেয়েছিল দিয়েছি। জনগণ আর কী চায়? বাকি সব আল্লাহর ইচ্ছা।
১৯৭১ সালে আল্লাহ্কে বারবার ডেকেও আলবদরদের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়নি। এটি ব্ল্যাসফেমি নয়। আল্লাহ বলেছেন, নিজেকে নিজে সাহায্য না করলে কীভাবে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে? যেমনএবার যথাসময়ে যদি বিচার না হয় বা বিচারের প্রসিকিউশনের দুর্বলতার জন্য যদি তারা মুক্তি পায় তা’হলে ভোটযুদ্ধে আওয়ামী লীগের পরাজয় অনিবার্য। ১৯৭১ সাল থেকে তাদের হত্যাকা-ের সপক্ষে যুক্তি ছিল, তারা অখ- পাকিস্তানের পক্ষে এটিই তাদের রাজনীতি। আওয়ামী লীগ ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। সেটি তাদের রাজনীতি। সুতরাং রাজনৈতিক কারণে তাদের বিচার হতে পারে না। এখন পর্যন্ত এই থিসিসই তারা বারবার তুলে ধরছে এবং ঘোষণা করছে, এটি যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, এটি রাজনৈতিক বিচার। নতুন প্রজন্ম যারা এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ তারা এই থিসিস বিশ্বাস করবে। তাহলে ১৯৪৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাজনীতির বিকাশ হয়েছিল তার মৃত্যু ঘটবে।
এখানে দুঃখের সঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই। কারণ, আমাদের দুঃখ রাখার জায়গা নেই। একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য আমরা বাম ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছি এবং করছি। এবং এ পক্ষকে আমরা বলছি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। তারা দু’বার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সামগ্রিক কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। আলবদরদের কথা ধরা যাক। ১৯৭১ সালে প্রতিপক্ষ ও প্রতিপক্ষের রাজনীতি বিনাশের জন্য তারা কার্যকর পরিকল্পনা নিয়েছে। পরাজয়ের পরও দমেনি। নতুন মিত্রের সন্ধান তারা পেয়েছে সেনাবাহিনীর ভেতরে। এ মন্তব্যের কারণ এই যে জিয়াউর রহমান যখন আলবদরদের পক্ষে কার্যক্রম গ্রহণ করেন তখন সেনাবাহিনীর কেউ-ই প্রতিবাদ করেননি। এমন কী খুনীদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াননি। এটি বাস্তব সত্য।
আলবদররা এই মিত্রের সাহায্যে বিকশিত হয়েছে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ক্ষমতা দখল করে। সমাজ, অর্থনীতিতে তারা নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা ইতিহাসকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করেছে হাতিয়ার হিসেবে। আমরা ভুলে যাই, মনোজগতে আধিপত্য বিস্তারের একটি উপাদান হিসেবে।
তাদের সামগ্রিক কার্যক্রম দু’ভাবে পরিচালিত হয়েছে। এক, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পুরনো মিত্রদের সঙ্গে তারা সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেছে। দুই, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা/মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিনষ্ট করেছে। যেমনÑ তারা জিয়াউর রহমান জাদুঘর করেছে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করেনি। বিএনপিকে তারা নতুন ফ্রন্ট হিসেবে তৈরি করেছে। পরবর্তীকালে জাতীয় পার্টিকে, ধর্ম ব্যবসায়ী অন্যান্য দলকে মিত্র রূপে গড়ে তুলেছে। একই সঙ্গে জঙ্গী-মৌলবাদের তারা বিস্তৃতি ঘটিয়েছে রাজনৈতিকভাবে প্রশ্রয় দিয়ে, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। একই সঙ্গে সেক্যুলার সমর্থকদেরকে শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে দমন করতে চেয়েছে। এই ধারার প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে তারা বারবার হত্যা করতে চেয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এর উদাহরণ। জঙ্গী-মৌলবাদ তাদের আরেকটি ফ্রন্টÑ যা আন্তর্জাতিক মিত্রদের দ্বারা তৈরি। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষের প্রচারণা-শক্তি অসম্ভব, তাদের কর্মীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কমিটেড এবং বিরোধী পক্ষকে তারা কোন ছাড় দেয় না। একটি জেনারেশনের ভাবনার জগতে তারা আধিপত্য বিস্তার করে আছে এবং তা প্রসারণের জন্য স্বাধীন আর্থিক ভা-ার গড়ে তুলেছে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক বঙ্গবন্ধু। তাই প্রথমে তারা তাঁকে হত্যা করেছে এবং সপরিবারে। আওয়ামী লীগের একাংশ বামধারার একাংশকে মিত্র হিসেবে পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা বিভক্ত হয়ে গেছে। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশ, বিশেষ করে যারা শহরে ছিল, তারা সম্পদ কুক্ষিগত করার প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। এ সম্পদ রক্ষার কারণে কমিটমেন্ট রক্ষা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ ধারার মানুষজন সার্বিকভাবে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করে না, খ- খ- এডহক কার্যক্রম গ্রহণ করে মাত্র। সরকার গঠন করলে এরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
আমি দুয়েকটি উদাহরণ দিই। ভাবনার জগতে আধিপত্য বিস্তারে এদের কোন কার্যক্রম নেই। সর্বপর্যায়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করার যে আবেদন আমরা করেছি ১৯৯৬ সালের ও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর কাছে তা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল সমস্ত অনৈতিহাসিক স্থাপনা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মুক্ত করতে। পূর্তমন্ত্রী সে ক্ষেত্রে কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেননি। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ এবং ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্থাপনা শেষ করতে পারেনি। এই নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। জঙ্গী দমনে সরকার আন্তরিক, কিন্তু তা বিনাশ করার জন্য যে ভাবনার জগতে আধিপত্য বিস্তার করা দরকার সে বিষয়ে কোন চিন্তাভাবনা নেই।
আরেকটি উদাহরণ দিই। মাদ্রাসার দু’টি ডিগ্রীকে প্রচলিত স্কুল-কলেজের ডিগ্রীর সমমর্যাদা দেয়া হয়েছেÑ যদিও দুটি আকাশ-পাতাল তফাৎ। আমাদের ভর্তি ব্যবস্থায় ৬০% নম্বর রাখা হয়েছে ঐ দু’টি ডিগ্রীর ফলের ওপর। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ তাদের ছাত্রদের ৯০-৯৫ ভাগের কম নম্বর দেয় না। এবং যেহেতু তারা মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী, সেহেতু টিক চিহ্ন প্রশ্নে তারা নম্বর বেশি পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সমাজ বিজ্ঞান প্রভৃতি অনুষদে এখন মাদ্রাসার ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সিভিল প্রশাসনের ক্যাডারেও এ ব্যবস্থা বদলবার কোন চিন্তাভাবনা এ সরকার করেনি। শুধু তাই নয়, আলবদরদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান জমিয়াতুল মোদাররেসিনের দাবি অনুযায়ী কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে আরবী বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এ রকম দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না। এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অধিকাংশ ছাত্র প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে। শুধু তাই নয়, শুনেছি, মোদাররেসিনের দাবি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানের উপাধি হবে ‘গ্র্যান্ড মুফতি’। অতঃপর এই গ্র্যান্ড মুফতি সর্বক্ষেত্রে ফতোয়া কার্যকর করবেন। আওয়ামী নেতৃবৃন্দের ধারণা, এতে তাদের সমর্থন বাড়বে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আওয়ামী লীগকে ঘোষণা করতে হবে পাকিস্তানের সঙ্গে তারা মিলে যাবে, তাহলে হয়ত ভোট পেতেও পারে; কিন্তু তাদের কখনও বিশ্বাস করা হবে না। ধর্মভীরুতাকে চুয়িংগামের মতো টেনে মৌলবাদ দৃঢ় করার ক্ষেত্রে তারা কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের পক্ষেই গ্রহণ করা সম্ভব।
হাইকোর্টের নির্দেশে জনাব শাহাবুদ্দীন সংখ্যালঘু অত্যাচারের যে রিপোর্ট পেশ করেছিলেন, সরকার সে ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাকুক, রিপোর্টটিও প্রকাশিত হয়নি। এমন কী ১/১১-তে যারা যুক্ত ছিল [বা এর বিরুদ্ধে নিশ্চুপ ছিল], তাদের প্রশাসনে রেখেছে, মন্ত্রিসভায়ও। এই নিয়ে আলোচনা তুললে আলোচনাকারীকে সঙ্গে সঙ্গে সরকারবিরোধী বিএনপির পক্ষের লোক বলে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এভাবে, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য যারা ছিলেন শেখ হাসিনার সমর্থক, তারা সরে যাচ্ছেন। আলবদরদের মতো এ পক্ষের কমিটমেন্ট তেমন দৃঢ় নয়। সে কারণেই দেখা যায় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী সচিবের স্টাফের সংখ্যা কুড়ির বেশি। অথচ মানবতাবিরোধী অপরাধে দুটি ট্রাইব্যুনালে ১৩ জন স্টাফ নিয়োগ মন্ত্রীরা মনে করছেন মাত্রাতিরিক্ত। এ নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছে তাদের বলা হচ্ছে এ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। এই ধারণাহীনরা ৪০ বছর এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। আর মন্ত্রীরা? আমি ফিরিস্তি আর বাড়াব না। আমি একটি বিষয় বুঝতে অক্ষম, ক্ষমতায় গেলে ক্ষমতাবানদের চেহারাটা, এজেন্ডা বদলে যায় কেন?
সবশেষে আমরা অভিনন্দন জানাই এ সরকারকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও বলি, মন্ত্রীদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য যদি যথাসময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হয় এবং এ কারণে যদি আওয়ামী লীগ পরাজয় বরণ করে তা’হলে তারা বুদ্ধিজীবীদের, পেশাদারদের [যারা অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশ্বাসী] নির্মূল করে দেবে। তাদের যুক্তি খুব পরিষ্কার, আগে খুন তারপর দেখা যাক কী হয়। ১৯৭১ সালে আলবদরদের হাতে যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা তো ফিরে আসেননি। আলবদররা শুধু বেঁচেই রইল না, ফিরেও এল। এখন মাত্র কয়েকজনের বিচার হচ্ছে। মাঝারি পর্যায়ের আলবদরদের ব্যাপারে কোন চিন্তাভাবনা করা হয়নি। মাঠ পর্যায়ে যারা আছে তাদের কথা বাদই দিলাম। এসব আলবদর এখন অস্ত্র শানাচ্ছে, আমাদের যে কোন একটি ভুলের জন্য অপেক্ষা করছে মাত্র।
কয়েক দিন পর পর আলী আহসান মুজাহিদের ভি চিহ্ন দেখিয়ে হাসি বা হাত নেড়ে গোলাম আযমের মৃদু হাসি কি দেখেননি?
লে. জে. জিয়াউর রহমান, লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া শহীদের যে অবমাননা করেছিলেন এবং এখনও করছেন, সেখানে শেখ হাসিনা শহীদদের প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আলবদর এখন ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করছে। নিজেকে ও পরিবার-পরিজনকে বাঁচাতে চাইলে এখনই ঠিক করুন আলবদরদের আবার ক্ষমতায় আনবেন, নাকি যারা এখন খুনি আলবদরদের বিচার করছে তাদের সমর্থন করবেন।
No comments