মাদক নিয়ে কৌতূহলও নয়... by জিনিয়া আফরিন
“আর কথা বলো না তো, যাও সামনে থেকে, বিরক্ত লাগছে আমার” কপাল কুচকে নীলা তার মাকে ‘কথা গুলো বলল। মা তাকে পড়াশোনার কথা বললেই নীলার খুব রাগ হয়। নীলা যতটা শক্ত ও রাগী প্রকৃতির মেয়ে ঠিক ততটা নরমও। এভাবে মায়ের সাথে কথা বলে তার মনটাও খারাপ হয়ে গেল।
একটু পর মায়ের কাছে গিয়ে বলল, “সরি আম্মু! তুমি জানো না পড়াশোনার কথা বার বার বললে আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছা চলে যায়?
“হুম, জানি, এখান থেকে যাও এখন আমার মেজাজ খারাপ। ”
“রাগ করে থেকো না আম্মু। সরি বলেছি তো, আর এরকম করবো না। মাফ করে দাও, প্লিজ।”
নীলা ও তার মায়ের ঠিক এরকম আহ্লাদের সম্পর্ক। তার মা জেন তার বান্ধবী, সে সব কিছুই বলে মাকে, তাই তার মাও তাকে বিশ্বাস করে।
নীলা একটু আজব প্রকৃতির মেয়ে, না জানা জিনিসগুলো জানার ইচ্ছা তার অনেক আগে থেকে। বলা যেতে পারে যে সে যে কোন বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে ব্যাপারগুলো বুঝতে বেশ পছন্দ করে।
একদিন টিভিতে একটি অনুষ্ঠানে মাদকাসক্তি নিয়ে কথা হচ্ছিল। নীলা, তার মা ও বাবা বসে একই সাথে অনুষ্ঠানটি দেখল। হঠাৎ নীলার মনে আজব এক প্রশ্ন আসল। সে মনে মনে চিন্তা করল, “আসলে মাদকাসক্তি ব্যাপারটা কি ? কেন করে মানুষ? কিভাবে করে?
এই প্রশ্নগুলোই যে তার জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে, পিছিয়ে দিতে পারে এটা সে জানত না। আর এ না জানা থেকেই শুরু হলো নীলার পরিবর্তন।
নীলা মাদকাশক্তি নিয়ে রিসার্চ করতে শুরু করল। ইন্টারনেট, বন্ধু বান্ধব থেকে যতটা সম্ভব জানতে থাকল।
কিন্তু মাদকাসক্ত হলে কি হয় এটা ছিল তার কাছে অজানা। তাই এই অজানাকে জানার ইচ্ছায় নীলা একদিন বাসায় ফিরল। কিছু ড্রাগস্ নিয়ে, মা জানলে ভয় পেয়ে যেতে পারে। তাই মাকে এসব কথা বলল না। ড্রাগস্গুলো কিনে রেখে দিল। কিন্তু সেটা নেবে কি নেবে না তা নিয়ে সে কিছুটা কনফিউসড ছিল।
কিন্তু মায়ের মন একমাত্র সন্তান নীলার ব্যাপারে সারা দিতে একটুও দেরি করল না। নীলা ড্রাগস্গুলো যেখানে লুকিয়ে রেখেছিল তার মা সেখান থেকে সেগুলো সরিয়ে ফেলে।
ঠিক তার পরদিন নীলা জিনিসগুলো জায়গায় না দেখে তার মেজাজ প্রচ- খারাপ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে তার মা ছাড়া এ কাজটি আর কারও হতে পারে না।
নীলা মাকে গিয়ে বলে, “যেসব জিনিস আমার ড্রয়ার থেকে নিয়ে এসেছে, তার ব্যাপারে কি একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করেছ ? ”
“মা, তুমি কেন ড্রাগস নিচ্ছ? কি সমস্যা তোমার, মামুনী? আমাকে বল ?”
“নীলা মায়ের এ কথা শুনে আরও রাগান্বিত হয়ে যায়। সে তার মাকে ড্রাগস্গুলো ফেরত দিতে বলে। তার মাও না পেরে সন্তানকে ড্রাগস্গুলো হাতে তুলে দেয়।
এরপরও নীলা ড্রাগস্গুলো নেয়নি। কিন্তু সেই দিনের পর থেকে নীলার প্রতি বাবা মায়ের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হতে থাকে। নীলা রাত জেগে বই পড়লে, গান শুনলে তারা সন্দেহ প্রবণভাবে তাকে দেখে। আর সেই সাথে নীলাও তার বাবা-মায়ের আচরণের এ পরিবর্তন দেখতে পায়। এতে তার মনে ভীষণ কষ্ট লাগে। আর তাছাড়া ১৭-১৮ বছরের মেয়েরা একটু বেশি ইমোশনাল হয়।
তাই রাগ, জেদ ও কষ্টের বশে নীলা ড্রাগস্গুলো নিতে শুরু করে। কিন্তু কোন কিছু লুকায় না। প্রকাশ্যে মা-বাবাকে বলে বলেই সে এ কাজগুলো শুরু করে। তার মাকে সে বলে, “আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না, একবারের জন্য?”
মায়ের চোখ লাল হয়ে, মা কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। নীলা বলে, “তোমরা যে ব্যাপারটিকে বিশ্বাস করছ, আমি সেটাকেই সত্যি করছি, চিন্তা করো না, মা” আরও বলে, ১৮ বছর ধরে বিশ্বাস করে এ ২-৩ দিনে এত অবিশ্বাস করে ফেললে?
কোনো প্রশ্নের উত্তরই মা দিতে পারে না। শুধু কাঁদে, আর সে কান্নায় নীলার বুকে অসম্ভব কষ্ট হয়। সেও কাঁদে কিন্তু লুকিয়ে।
নীলা এখন হাসপাতালে, তার বাবা তাকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করে দিয়েছে। সেখানে বন্দী জীবনে নীলা খুঁজে পায় না মায়ের মমতার ছোঁয়া, আদর, মায়ের হাতের ভাত খায়িয়ে দেয়া আর বিশ্বাসের সে দৃষ্টিভঙ্গি।
সে শুধু জানালার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে হয়তবা কোন একদিন তার মা তার হাত ধরে, বিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে, আর বন্দী করে রাখবে না তার জানার ইচ্ছাকে, বিশ্বাস করবে তার সন্তানের ওপর, বিশ্বাস করবে তার নীলা কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে শেখেনি তার মায়ের কাছ থেকে।
No comments