উৎপাদন দ্বিগুণ হলেও চাহিদা বেড়েছে দশ গুণ- চা শিল্পে সঙ্কট ২ by রহিম শেখ
ব্রিটিশদের হাত ধরে এ দেশে চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে চা শ্রমিকদের ভাগ্যের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বাড়েনি খুব একটা। বহু হিসেব-নিকেশের পর বছর কয়েক আগে সামান্য মজুরি বাড়ে চা শ্রমিকদের। বাড়তি আয় করতে হলে অধিক হারে চা পাতা তুলতে হয় শ্রমিকদের।
কিন্তু সেই চায়ের উৎপাদন কম হওয়ার অজুহাতে ন্যূনতম মজুরি দিতেও কষ্ট হয় বাগান মালিকদের। বাগান মালিকদের ভাষ্য, চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চায়ের উৎপাদন বাড়ছে না। সামনের দিনগুলোতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।
জানা গেছে, দেশে গত দু’দশকে চা উৎপাদন দ্বিগুণ হলেও চাহিদা বেড়েছে ১০ গুণ। চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উৎপাদন না বাড়ায় উল্টো আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে দেশ। অথচ এক সময় চা দেশের অন্যতম প্রধান রফতানি খাত ছিল। এদিকে চাহিদা মিটিয়ে রফতানি বাড়াতে চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ১২ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ চা বোর্ড। চা উৎপাদন তেমন না বাড়ার কারণ হিসেবে বৈরী আবহাওয়া ও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবকেই দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব কারণে চলতি বছর ৬০ মিলিয়ন কেজির চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণও আশঙ্কায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
চা বোর্ড সূত্র জানায়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ চায়ের চাহিদা বেড়েছে ৯ দশমিক ৯৪ ভাগ। আর উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ১৪ ভাগ। দেশীয় বাজারে চায়ের দাম বেশি হওয়ায় গত বছর ইস্পাহানী, আবুল খায়ের গ্রুপ ও এইচআরসিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি চা আমদানি করেছে। সূত্র মতে, বিগত সময়ের চেয়ে চায়ের উৎপাদন বাড়াতে পরিকল্পিতভাবে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বান্দরবান এলাকায় ‘স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন চিটাগং হিলট্রেক্স’ নামে ১০০ একর জমিতে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের উদ্যোগ নেয়া হলেও তাতে সফলতা আসেনি।
কেন চা উৎপাদনে খরা সে বিষয়টি বেরিয়ে এসেছে চা বিজ্ঞানীদের কথায়। চা বিজ্ঞানীদের মতে, চা উৎপাদনের অনুকূল আবহাওয়া বলতে বুঝায় ইউনিফর্ম বৃষ্টিপাত, রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ এবং ভাল নাইট টেমপারেচার। এ বছর চা মৌসুম শুরু হওয়ার প্রথমেই ছিল খরা। ছিল না কোন বৃষ্টিপাত। অতিরিক্ত খরার ফলে অনেক বাগানের চা গাছ জ্বলে যায়। এতে চায়ের উৎপাদন মৌসুম শুরু হতে এ বছর শুরুতেই দেরি হয়। তারপর একসময় শুরু হয় বৃষ্টিপাত। বৃষ্টিপাতের ফলে চা গাছে অল্প সময়েই নতুন পাতা গজাতে শুরু করে। খুশি হন চা বাগানের মালিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও চা বাগানের শ্রমিকরা। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে শুরু হয়ে যায় অনিয়মিত অতি বৃষ্টি ও শিলা বৃষ্টি। চা বাগান এলাকায় প্রতিদিনই ১০০-১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ায় চা উৎপাদনে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার লাভ করে।
চা বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিরিক্ত অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের ফলে অধিকাংশ সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে। ফলে প্রয়োজনীয় সূর্যালোক থেকে চা গাছ বঞ্চিত হচ্ছে। পর্যাপ্ত সূর্যালোক না থাকায় চা গাছের পাতা নিয়ম অনুযায়ী অঙ্কুরিত হচ্ছে না এবং পাতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এর ফলে পাকিং সাইকেল বিঘিœত হচ্ছে। পাকিং সাইকেল বিঘিœত হওয়া এবং বৃষ্টির দিনে চা পাতা পাকিং বন্ধ রাখায় চা শ্রমিকরা সাপ্তাহিক হাজিরা কম পাচ্ছেন। আবহাওয়ার এই প্রতিকুল অবস্থার কারণে চা শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এছাড়া অতি বৃষ্টি, অনিয়মিত বৃষ্টি, শিলা বৃষ্টি এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যালোক না থাকায় চা বাগানে প্রচুর পরিমাণে পোকামাকড়ের আক্রমণ তথা রেড স্পাইডার, হেলো প্যালটিস এর আক্রমণ এবং পর্যাপ্ত সূর্যালোক না থাকায় পাঙ্গাস জাতীয় রোগ যা ‘ব্ল্যাক রট’ নামে পরিচিত তার প্রাদুর্ভাব প্রচ-ভাবে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে চা গাছকে রক্ষা করার জন্য কেমিক্যাল ইনসেকটিসাইডস্ ¯েপ্র করা হয়। কিন্তু দিনের বেলা কেমিক্যাল ¯েপ্র করার পর ঐ দিন সন্ধ্যায়ই প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ায় তা ধুয়ে যাচ্ছে। ফলে আশানুরূপ কোন কাজ হচ্ছে না।
বিশ্লেণে দেখা গেছে, চা বাগানে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এন পি কে মিক্সার (মেনিওর) সার বাগানে ছিটিয়ে দেয়ার পর মাটি ঐ সার শোষণ (এবজরব) করতে ন্যূনপক্ষে ৭২ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে চা বাগানে এন পি কে মিক্সার (মেনিওর) সার ছিটানোর পর ঐ রাতেই বৃষ্টি হওয়ায় তা ধুয়ে চলে যাচ্ছে। ফলে চা বাগানে সারের (মেনিওর) কোন প্রভাব থাকছে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অক্টোবর মাসের পর বৃষ্টিপাত না হলে চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা ৬০ মিলিয়ন কেজি তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তবে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৫৮ মিলিয়ন কেজিতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে বলে মনে করছেন চা বিজ্ঞানীরা।
চা বোর্ডের হিসাব মতে, বর্তমানে দেশে ১৬৪টি চা বাগান ও ১১৬টি ফ্যাক্টরি রয়েছে। নার্সারি ছাড়া চা বাগানের আয়তন ৫৪ হাজার ১০৬ দশমিক ২৪ হেক্টর এবং নার্সারির আয়তন ১ হাজার ৩৭ দশমিক ৮৩ হেক্টর। এ ছাড়া দেশের অকৃষি এলাকার মধ্যে পতিত জমির আয়তন ৪ হাজার ৩১৯ দশমিক ৩০ হেক্টর। এক দশক আগেও দেশে উৎপাদিত চায়ের ৮০ শতাংশ রফতানি হতো। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদিত চায়ের ৯৬ শতাংশ দেশেই ব্যবহার হচ্ছে। চায়ের ব্যবহার অনেক বেড়ে যাওয়ায় বেশি পরিমাণে চা আমদানি করা হচ্ছে।
১২ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা : চাহিদা মেটাতে ২০১০ সালেই ইন্দোনেশিয়া থেকে ২ মিলিয়ন কেজি চা আমদানি করা হয়েছিল। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় গত বছরও বিপুল পরিমাণে চা আমদানি করা হয়েছে দেশে। এদিকে দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি বাড়লেও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে চায়ের রফতানি। এরই ধারাবাহিকতায় চা সঙ্কটের কথা বিবেচনায় রেখে ২০১২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সম্প্রতি একটি কৌশলগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে চা বোর্ড। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হলে ২০২৩ সাল নাগাদ ১০০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন সম্ভব হবে। এ পরিকল্পনায় ১০টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে ১০৬টি বাগানের ৬ হাজার ৪৪০ হেক্টর খালি জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণ করার কথা রয়েছে।
No comments