শেষ পর্যন্ত লটারি!

‘লটারি’ অত্যন্ত পরিচিত একটি শব্দ। এর মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য যেমন অর্থ সংগ্রহ করা হয়, তেমনি আকর্ষণীয় পুরস্কার প্রদান করে লটারির টিকেট ক্রেতাকে সন্তুষ্ট করারও ব্যবস্থা থাকে। এর মধ্যে হারজিতেরও একটি ব্যাপার রয়েছে।


এতদিন পর্যন্ত এই ব্যবস্থাটি মোটামুটি জনসেবা ও সমাজকল্যাণের গণ্ডিতেই সীমিত ছিল রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচপূর্ণ, জগতে প্রবেশের সুযোগ তার হয়নি। কিন্তু বেচারা লটারি এখন জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠছে এক সাবেক উপদেষ্টার অভিনব এক প্রস্তাবনার কারণে। এই সাবেক উপদেষ্টা সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকে লটারির মাধ্যমে আগামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত করার প্রস্তাব রেখেছেন। প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের ক্ষেত্রে ১০ অথবা ৫ বছর আগে অবসর গ্রহণ করা প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের একটি তালিকা প্রণয়ন করে সেখান থেকে ১৫ জনের নাম সংবলিত একটি ছোট তালিকা তৈরি করতে হবে এবং তার মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করতে হবে।
ফর্মুলাটি দৃশ্যত জলবৎ তরলং প্রকৃতির মনে হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। প্রথমত, সুপ্রীমকোর্টের রায়ে এতদিন চলে আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে গেছে, বলবত হয়েছে সংবিধানে সন্নিবেশিত নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে নিয়তিনির্ভর একটি ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের ভাগ্যনির্ধারকের ভূমিকায় কেন আনা হবে? তাছাড়া, এই লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তিও যে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হবেন, তারও কী কোনো নিশ্চয়তা আছে? এ কথা সত্যি, আজকের প্রাগ্রসর বিশ্বে যাঁরা সরকার পরিচালনার জন্য প্রধান ব্যক্তি নির্বাচনে লটারির প্রস্তাব করেন, তাঁরা একদিকে আমাদের রাজনীতির চরম দৈন্যদশাকে যেমন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চান, তেমনি, রাজনীতিবিদদের অসহিষ্ণু ও পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের যে সংস্কৃতি পল্লবিত, তার প্রতিও ইঙ্গিত করতে চান। কিন্তু রাজনীতিতে যত অসহিষ্ণুতা আর নেতিবাচক বিষয় থাকুক না কেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশ কিন্তু চালান রাজনীতিবিদরাই। সুতরাং সেই রাজনীতির গ-ি ছেড়ে ভাগ্যনির্ভর বায়বীয় ফর্মুলা ছুড়ে দিয়ে সস্তা বাহবা কুড়াবার চেষ্টা দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক হতে পারে কিনা সেটাও বিবেচ্য। আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং সব দলের অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হোক, এটা সবার প্রত্যাশা। কিন্তু কেউ যদি ‘সালিশ মানি কিন্তু তালগাছটা আমার’ এই মনোভাবের বশবর্তী হয়ে আপোসহীন থাকেন; আইন-আদালত কিংবা সংবিধানকে থোড়াই কেয়ার করেন তাহলে কিভাবে সমস্যার সমাধান আশা করা যায়? পরিস্থিতি যখন এমন, তখন লটারির এই টোটকা ফর্মুলা দিয়ে সমস্যা সমাধানের মধ্যে সদিচ্ছা ও সুবিবেচনার পরিচয় আছে কি?
সংবিধানের আওতায় সকল সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। তবে অসাংবিধানিক পথে হাঁটতে গেলে গণতন্ত্র ও সুস্থ রাজনীতি যে কতটা ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হতে পারে তার দৃষ্টান্ত দেশবাসী ইতোপূর্বে দেখেছে। তাই বিরোধীদল সরকারী দল সকলকেই সাংবিধানিক পথেই সমাধান খুঁজতে হবে। এমতাবস্থায় সরকার ও বিরোধী দলের সবাইকে দায়িত্বশীল ও সহিষ্ণু ভূমিকা পালন করতে হবে গণতন্ত্রের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে এবং তাদের নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেও।

No comments

Powered by Blogger.