ইতিউতি-হারিয়ে যাওয়া ট্রেন by আতাউস সামাদ
ট্রেন নিয়ে একটা ছড়া আর একটা গান মনে পড়ছে। ছড়াটা বাচ্চাদের, ইংরেজি ভাষায়। ইউ টিউবে পাওয়া। ছড়ার দুটি পঙ্ক্তি হলো- This train is going to the city, this train This train is going to the city where the lights are all so perelty. ('এই ট্রেন চলেছে শহরে, এই ট্রেন/
ট্রেনটা চলেছে নগরে যেখানে বাতিগুলো কী যে সুন্দর।')
দুর্বল অনুবাদটি অক্ষম এই লেখকের। নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন।
গান যেটা মনে পড়ছে তা বাংলা পপ গানের প্রবর্তক বিখ্যাত গায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খান গেয়েছিলেন। সেটির প্রথম দুটি পঙক্তি : 'রেল লাইনের বস্তিতে ছেলেটা কাল জন্মেছিল/ছেলেটা মরে গেছে, মা তার কাঁদছে।'
গানের লাইন দুটি স্মৃতি থেকে লিখেছি। তাই এই উদ্ধৃতিতে ভুল থাকতে পারে। সে জন্যও মাফ চেয়ে নিচ্ছি। এই দুটি ছড়া আর গানে আমাদের দেশের স্বপ্ন আর বাস্তবতায় যে বিরোধ তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
আসলেও ট্রেন আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আজ যাঁরা আমার বয়সী তাঁদের মধ্যে এমন হয়তো খুব কমই আছেন যাঁদের মনে ট্রেন নিয়ে ছেলেবেলার কোনো মধুর অথবা রোমাঞ্চকর ঘটনার ছবি ধরা নেই। আমাদের সেই সময়ে টেলিভিশন ছিল না, DVD ছিল না, ইন্টারনেট, You Tube আর ফেসবুক তো নয়ই। বিদেশি কমিকসের বইতে কিছু কার্টুন কাহিনী দেখতাম। সেগুলোর বেশির ভাগই আবার সাদাকালো। দৈনিক পত্রিকাও এত ছিল না। যা ছিল সেগুলো ছয় পৃষ্ঠার। তাতে এখনকার মতো সবার জন্য বিনোদন থাকত না। তাই আনন্দ-শিহরণ-রোমাঞ্চ এসব পাওয়ার জন্য প্রধান অবলম্বন ছিল প্রকৃতি- খোলা আকাশ, বিশাল মাঠ, গাছপালা, পাখি, নদী, বিল এসব। এর মধ্যে মানুষের পাতা লোহার জোড়া রেললাইন আর ঝমঝম আওয়াজ তুলে ছুটে চলা ট্রেন আলাদা মাত্রা যোগ করত। রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে রেলের ওপর দাঁড়িয়ে সামনে দৃষ্টি মেলে দেখতাম লাইন দুটি দিগন্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। দিনের পর দিন রেললাইন আর দিগন্ত রেখার মাখামাখি দেখেছি আর ভেবেছি কিভাবে এটা হয়। এই প্রশ্নের সমাধান করতে পারিনি। তাই বলে বিস্ময় উপভোগ করা বন্ধ হয়নি। আমারও না, সমবয়সীদেরও না।
তবে রেললাইন শুধু দেখেই যে আনন্দ তা নয়, শোনারও একটা বিষয় ছিল। লাইনের ধারে গেলে কখনো না কখনো রেলের পাতে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করেছি ট্রেন আসার শব্দ পাওয়া যায় কি না। আমাদের মতোই অন্যরাও করেছে। আপনিও বাদ যাননি, নয় কি! আবার ট্রেন আসতে দেখলে দৌড়ে কিছু দূরে সরে গিয়েছি। সেখান থেকে শোনার চেষ্টা করেছি ট্রেন কী বলে। আবারও অবাক হয়েছি এই দেখে যে ট্রেন যখন সামনে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তখন তার ভাষা যেন বদলে যাচ্ছে। আবার দেখার চেষ্টা করেছি ট্রেনের জানালা দিয়ে কোনো কিশোর আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কি না। গাড়িতে চেনা কেউ আছে কি না।
অবশ্য সবচেয়ে মজার ছিল বোধ করি রেললাইন ধরে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। আমার আজও মনে পড়ে, রাজশাহী স্টেশন থেকে রেললাইন ধরে একা হাঁটতে হাঁটতে এক বিশাল আখক্ষেতের কাছে এসে পড়লে কৌতূহলের বশে তার ভেতর ঢুকে পড়েছিলাম। একটু পরই উপলব্ধি করলাম যে ক্ষেতের ভেতরে পথ হারিয়েছি। লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চিৎকার করব কি না ভাবছি, এমন সময় মনে হলো আখগুলোর ফাঁক দিয়ে একটু দূরে একটা লম্বা উঁচু ঢিপি দেখা যাচ্ছে। ওটার দিকে এগিয়ে বুঝলাম যে ওটাই রেললাইন। এবার বুকের ধুকপুকানি কমল।
আমাদের ছোটবেলায় খুব বেশি বাস ছিল না, আর নদীতে অল্প কটা স্টিমার ছাড়া সবই দাঁড়টানা পালতোলা ধীর গতির নৌকা, তাই দূরে যাতায়াতের জন্য ট্রেনই ব্যবহার করতেন বেশির ভাগ মানুষ। আমার ছোটবেলার বেশ কিছু সময় কেটেছে পদ্মা নদীর পশ্চিমে হুগলি, কলকাতা, জলপাইগুড়ি আর রাজশাহীতে। তাই ব্রডগেজ ট্রেনের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। ওগুলোর দৈত্যের মতো স্টিম ইঞ্জিনগুলোর কালো রং, বাষ্প ছাড়ার সময় ভয়ংকর আওয়াজ আর এর পেটে কয়লার গনগনে আগুন দেখে খুব ভয় পেতাম। ওপার থেকে এপারে কিশোরগঞ্জের কাছে দেশেরবাড়িতে আসার সময় দেখলাম গাড়িগুলো ছোট হয়ে গেল। মজাই লাগল। তবে একবার দার্জিলিং যাওয়ার সময় শিলিগুড়িতে আরো ছোট আকারের ট্রেন দেখে মনেই হয়নি যে এটা দূরে কোথাও যাবে। সেই ট্রেনেই পাহাড়ি পথে দার্জিলিং পৌঁছলাম। মনে পড়ছে ওই ছোট ট্রেনটার সামনে ও পেছনে দুটি ইঞ্জিন ছিল। পাহাড়ি পথে ট্রেনই যে নিরাপদ তা বুঝেছি একবার শিলং থেকে তামাবিল পর্যন্ত খোলা জিপে চড়ে আসতে বাধ্য হয়ে।
আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গেও ট্রেনের সম্পর্ক আছে একধরনের। যেমন, আমি যখন প্রথমবার একা ট্রেনে যাতায়াত করলাম তখন ভাবলাম যে 'এবার বড় হয়েছি'। আর সেই যাত্রা তো যেই-সেই ব্যাপার ছিল না। সিলেট থেকে লাতু যেতে হবে, মাঝখানে কুলাউড়া জংশনে ট্রেন বদলাতে হবে। তখনো আমি স্কুলে পড়ি। সেই সময় নিজে নিজের দায়িত্ব নিয়ে চলেছি। জীবনের সে এক মাইলফলক আর কী। সেই ক্ষণটি উদ্যাপন করার জন্য কুলাউড়া স্টেশনের রেস্তরাঁয় ঢুকে এক পট চায়ের অর্ডার দিলাম। বেয়ারা আমার হুকুম তামিল করলেন দেখে মনে মনে পুলকিত হলাম।
তবে আরো আছে ট্রেনের মাহাত্ম্য। তা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট। যেমন, আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম একটা ট্রেন ছিল, যার নাম ছিল গ্রিন অ্যারো। এটা টানত ডিজেলচালিত ইঞ্জিন আর কামরাগুলো ছিল লোহার। ১৯৬৪ সালে সেনাশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাবার জন্য ফাতিমা জিন্নাহ এই ট্রেনে ভ্রমণ করেন। তাঁর সঙ্গে অন্যদের মধ্যে ছিলেন আইয়ুব খানের পক্ষ ত্যাগকারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর জেনারেল আজম খান। ট্রেনটা যখন ঢাকা স্টেশন ত্যাগ করার জন্য নড়ে উঠল, তখন জেনারেল আজম খান অপেক্ষমাণ জনতা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলে উঠলেন, 'দ্য ট্রেন অব ডেমোক্রেসি হ্যাজ স্টার্টেড'। গণতন্ত্রের রেলগাড়ি চলতে শুরু করেছে। পরদিনের পত্রিকায় আমরা ওই 'গ্রিন অ্যারো'র নাম দিয়েছিলাম 'ডেমোক্রেসি ট্রেন'। পথে স্টেশনে স্টেশনে এত জনসমাগম হয়েছিল যে ওই ট্রেনটা সেদিন সন্ধ্যার বদলে পরদিন দুপুরে চট্টগ্রাম পৌঁছেছিল। আমরা ভাবলাম, গণতন্ত্র ফিরে এলো বলে। তবে তা হয়নি। মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে পরোক্ষ ভোটের পাতানো নির্বাচনে আইয়ুব খানই প্রেসিডেন্ট হলেন। সম্মিলিত বিরোধী জোটের প্রার্থী ফাতিমা জিন্নাহ হেরে গেলেন।
সেই সময় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কিছুদিন ট্রেন চলত ঘড়ির কাঁটা ধরে। তাই কোনো হরতাল ডাকা হলে যদি হরতালকারীরা ট্রেন আটকে দিতে পারত তাহলে সেই ঘটনা বড় খবর হিসেবে দেখা হতো। ওই ঘটনা উল্লেখ করে বলা হতো, কড়া হরতাল হয়েছে। আর কোনো কারণে কোথাও বিক্ষোভকারীরা ট্রেনলাইন উপড়ে ফেললে সেটা হতো মহা উত্তেজনার ব্যাপার। ট্রেনে আগুন দেওয়ার কথা তো ভাবাই হতো না। একইভাবে ট্রেন দুর্ঘটনা হলে মনে হতো বজ্রপাত হয়েছে। আবার এর বিপরীত ভাবনাও ভেবেছি আমরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যদি রেল সেতু বা সেনাবাহী কোনো ট্রেন উড়িয়ে দিয়েছেন, সে ঘটনা আমাদের কাছে বিরাট বিজয় বলে মনে হতো। হানাদার পাকিস্তানিরাও ঘাবড়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের সময় একবার দেখেছি পাকিস্তানিদের রসদবাহী একটা ট্রেনে ইঞ্জিনের সামনে লাগানো হয়েছে কয়েকটি খালি ওয়াগন এবং বালুর বস্তা বোঝাই একটা খোলা ট্রলি। পাকিস্তানিদের মতলব ছিল, রেললাইনে যদি মুক্তিযোদ্ধারা মাইন পেতে থাকেন তবে সেটা সামনের খালি ওয়াগনের তলায় ফাটবে, এতে হয়তো ইঞ্জিনটা বেঁচে যাবে। এদিক থেকে দেখলে রেল যোগাযোগ আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়।
বিবিসির বিখ্যাত সাংবাদিক এবং বাংলাদেশে অনেকের বন্ধু মার্ক টালি ট্রেনে চড়তে এবং ট্রেন দেখতে খুব ভালোবাসেন। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনে করে সেতুটি পার হন। আমন্ত্রিত সাংবাদিক হিসেবে মার্ক টালিও ওই ট্রেনে ছিলেন। যমুনা সেতু পারাপারের প্রথম ট্রেনে উঠতে পেরে খুবই উল্লসিত হয়েছিলেন তিনি। একবার মার্ক টালি বিবিসির জন্য একটা রেডিও ডকুমেন্টারি করার সময় সেই কাজে তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। মার্ক টালি প্রায় জোর করেই ট্রেনে করে চট্টগ্রাম গেলেন। রেললাইনের দুই পাশে গ্রামগুলোর সবুজ বৃক্ষরাজি আর পানিতে অর্ধেক ডোবা ধানক্ষেত দেখতে দেখতে মার্ক টালি বললেন, 'বাংলাদেশের এই সবুজের মতো সুন্দর সবুজ আমি আর কোথাও দেখিনি এবং ট্রেন থেকে ছাড়া আর কোনোভাবে এই সবুজ, আকাশের মেঘ, আকাশ আর পানি মিশে যাওয়া দেখতে পারা যায় না। অন্য যেকোনো বাহন থেকে দেখলে এর কিছু না কিছু বাদ পড়বেই। তা ছাড়া এত রকম মানুষই বা একসঙ্গে কিভাবে পাওয়া যাবে।'
পরে আরেকবার ঢাকায় এসে বাংলাদেশের ট্রেনের দুরবস্থা দেখে মার্ক টালি খুব ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছিলেন। আমরা একটা লেভেল ক্রসিংয়ে আমার গাড়িতে বসেছিলাম। ট্রেন আসছে দেখে মার্ক গাড়ি থেকে নেমে ক্রসিংয়ের গেটের কাছে ছুটে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, 'এই ট্রেনটা কী কেউ ধোয় না, এটা এত ময়লা, এত হতশ্রী।' পরে আরো কয়েকটা ট্রেন দেখে তিনি হতাশ হয়ে বলেছিলেন, 'তোমাদের প্রশাসক আর রাজনৈতিক নেতারা অযোগ্য না হয় অসভ্য (আনকালচার্ড)। উনারা ট্রেনের যত্ন নেন না। উনারা কি বোঝেন যে একটা দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে সেই দেশের সভ্যতা, কৃষ্টি, উন্নয়নের মান বোঝা যায়?' মার্ক টালি খুব গর্ব করে বলতেন, তাঁর নানা বাংলাদেশের আখাউড়ায় বসবাস করে পাটের ব্যবসা করতেন। আর নানার বাড়িতে বেড়াতে এলে তিনি ট্রেন দেখে বহু সময় কাটাতেন। স্যার মার্ক তাঁর বৃদ্ধ বয়সে বাংলাদেশের ট্রেন দেখলে কী বলবেন তা কল্পনা করা কঠিন নয়।
তবে আজকে আমি ট্রেন নিয়ে পড়েছি, কারণ আমি ও আমার মতো অনেকেই এই ভেবে শঙ্কিত যে বাংলাদেশের ট্রেন কি উঠে যাবে? তা হয়তো হবে না, কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে বাংলাদেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই তো জাতীয় সংসদে বলেছেন যে জনবলের অভাবে ৫৮টি রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে প্রায় রোজই অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে লোকজন ট্রেনে কাটা পড়তে দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রী বললেন যে রেল বিভাগ থেকে লোকজনকে অবসরে যেতে দেওয়া যাচ্ছে না কারণ তাঁদের কাজে হাল ধরার মতো লোক নেই। তিনি এও বলেছেন যে ট্রেনের অনেক চালকই এখন এত বৃদ্ধ যে এখন চোখে ভালো করে দেখতে পান না। তবু এঁরা কষ্ট করে ট্রেন চালাচ্ছেন। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে যখন এক নারী ট্রেনচালক একটি গাড়ির দায়িত্ব নিলেন তখন আমরা ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইঞ্জিন, বগি ও ওয়াগনের অবস্থাও খুব খারাপ। গত সোমবার ঝিনাইদহে কপোতাক্ষ এঙ্প্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। প্রাণে বাঁচার জন্য ইঞ্জিন থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়ে চালক আহত হয়েছেন। এর আগে চট্টগ্রামের কাছে একটা চলন্ত ট্রেনের বগির একটা চাকা খুলে গিয়ে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। নাটবল্টু ক্ষয় হয়ে ঢিলা হয়ে যাওয়ায় চাকাটা খুলে গিয়েছিল বলে প্রাথমিক খবরে বলা হয়। বহু জায়গায় যত্নের অভাবে রেললাইনের মাটি দুর্বল হয়ে গেছে। পাথর নেই বলে লাইন দুর্বল হয়ে গেছে। আমার দেশ পত্রিকায় বলা হয়েছে, লাইনের পুরনো পাত আর পুরনো গাড়ির চাকা ঘষায় ঘষায় ক্ষয় হয়ে যাওয়াও ট্রেন পড়ে যাওয়ার একটা কারণ। সত্যি কথা বলতে কি, চলার সময় ট্রেনের কোচগুলো যে প্রচণ্ডভাবে দোলে আর কর্কশ আওয়াজ করে তাতে যাত্রীরা ভয়ই পান। অথচ ট্রেন বাংলাদেশে সত্যিকারের গণবাহন। সাধারণ মানুষের চলাফেরার অবলম্বন। আর তা এতটাই যে কামরায় তিল ধারণের জায়গা না থাকায় ট্রেনের ছাদে ওঠার জন্য মানুষ মই ভাড়া করে। কুষ্টিয়ায় দেখেছি গরিব মানুষ ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের জানালার সঙ্গে তাঁদের সাইকেল বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে করে। এ দেশে আসলে রেল যোগাযোগ আরো বিস্তৃত করা এবং আরো বেশি ট্রেনের ব্যবস্থা করা দরকার। বর্তমান সরকার নানা অতিকায় প্রকল্পের পেছনে না ছুটে রেলের উন্নয়নের পেছনে অগ্রাধিকার দিয়ে বিনিয়োগ করলে ভালো করত। এর আগের যেসব সরকার রেল ব্যবস্থাকে অবহেলা করেছে তারাও পাপ করেছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
দুর্বল অনুবাদটি অক্ষম এই লেখকের। নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন।
গান যেটা মনে পড়ছে তা বাংলা পপ গানের প্রবর্তক বিখ্যাত গায়ক ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খান গেয়েছিলেন। সেটির প্রথম দুটি পঙক্তি : 'রেল লাইনের বস্তিতে ছেলেটা কাল জন্মেছিল/ছেলেটা মরে গেছে, মা তার কাঁদছে।'
গানের লাইন দুটি স্মৃতি থেকে লিখেছি। তাই এই উদ্ধৃতিতে ভুল থাকতে পারে। সে জন্যও মাফ চেয়ে নিচ্ছি। এই দুটি ছড়া আর গানে আমাদের দেশের স্বপ্ন আর বাস্তবতায় যে বিরোধ তা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
আসলেও ট্রেন আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। আজ যাঁরা আমার বয়সী তাঁদের মধ্যে এমন হয়তো খুব কমই আছেন যাঁদের মনে ট্রেন নিয়ে ছেলেবেলার কোনো মধুর অথবা রোমাঞ্চকর ঘটনার ছবি ধরা নেই। আমাদের সেই সময়ে টেলিভিশন ছিল না, DVD ছিল না, ইন্টারনেট, You Tube আর ফেসবুক তো নয়ই। বিদেশি কমিকসের বইতে কিছু কার্টুন কাহিনী দেখতাম। সেগুলোর বেশির ভাগই আবার সাদাকালো। দৈনিক পত্রিকাও এত ছিল না। যা ছিল সেগুলো ছয় পৃষ্ঠার। তাতে এখনকার মতো সবার জন্য বিনোদন থাকত না। তাই আনন্দ-শিহরণ-রোমাঞ্চ এসব পাওয়ার জন্য প্রধান অবলম্বন ছিল প্রকৃতি- খোলা আকাশ, বিশাল মাঠ, গাছপালা, পাখি, নদী, বিল এসব। এর মধ্যে মানুষের পাতা লোহার জোড়া রেললাইন আর ঝমঝম আওয়াজ তুলে ছুটে চলা ট্রেন আলাদা মাত্রা যোগ করত। রেলস্টেশন থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় গিয়ে রেলের ওপর দাঁড়িয়ে সামনে দৃষ্টি মেলে দেখতাম লাইন দুটি দিগন্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। দিনের পর দিন রেললাইন আর দিগন্ত রেখার মাখামাখি দেখেছি আর ভেবেছি কিভাবে এটা হয়। এই প্রশ্নের সমাধান করতে পারিনি। তাই বলে বিস্ময় উপভোগ করা বন্ধ হয়নি। আমারও না, সমবয়সীদেরও না।
তবে রেললাইন শুধু দেখেই যে আনন্দ তা নয়, শোনারও একটা বিষয় ছিল। লাইনের ধারে গেলে কখনো না কখনো রেলের পাতে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করেছি ট্রেন আসার শব্দ পাওয়া যায় কি না। আমাদের মতোই অন্যরাও করেছে। আপনিও বাদ যাননি, নয় কি! আবার ট্রেন আসতে দেখলে দৌড়ে কিছু দূরে সরে গিয়েছি। সেখান থেকে শোনার চেষ্টা করেছি ট্রেন কী বলে। আবারও অবাক হয়েছি এই দেখে যে ট্রেন যখন সামনে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তখন তার ভাষা যেন বদলে যাচ্ছে। আবার দেখার চেষ্টা করেছি ট্রেনের জানালা দিয়ে কোনো কিশোর আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কি না। গাড়িতে চেনা কেউ আছে কি না।
অবশ্য সবচেয়ে মজার ছিল বোধ করি রেললাইন ধরে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা। আমার আজও মনে পড়ে, রাজশাহী স্টেশন থেকে রেললাইন ধরে একা হাঁটতে হাঁটতে এক বিশাল আখক্ষেতের কাছে এসে পড়লে কৌতূহলের বশে তার ভেতর ঢুকে পড়েছিলাম। একটু পরই উপলব্ধি করলাম যে ক্ষেতের ভেতরে পথ হারিয়েছি। লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য চিৎকার করব কি না ভাবছি, এমন সময় মনে হলো আখগুলোর ফাঁক দিয়ে একটু দূরে একটা লম্বা উঁচু ঢিপি দেখা যাচ্ছে। ওটার দিকে এগিয়ে বুঝলাম যে ওটাই রেললাইন। এবার বুকের ধুকপুকানি কমল।
আমাদের ছোটবেলায় খুব বেশি বাস ছিল না, আর নদীতে অল্প কটা স্টিমার ছাড়া সবই দাঁড়টানা পালতোলা ধীর গতির নৌকা, তাই দূরে যাতায়াতের জন্য ট্রেনই ব্যবহার করতেন বেশির ভাগ মানুষ। আমার ছোটবেলার বেশ কিছু সময় কেটেছে পদ্মা নদীর পশ্চিমে হুগলি, কলকাতা, জলপাইগুড়ি আর রাজশাহীতে। তাই ব্রডগেজ ট্রেনের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতো। ওগুলোর দৈত্যের মতো স্টিম ইঞ্জিনগুলোর কালো রং, বাষ্প ছাড়ার সময় ভয়ংকর আওয়াজ আর এর পেটে কয়লার গনগনে আগুন দেখে খুব ভয় পেতাম। ওপার থেকে এপারে কিশোরগঞ্জের কাছে দেশেরবাড়িতে আসার সময় দেখলাম গাড়িগুলো ছোট হয়ে গেল। মজাই লাগল। তবে একবার দার্জিলিং যাওয়ার সময় শিলিগুড়িতে আরো ছোট আকারের ট্রেন দেখে মনেই হয়নি যে এটা দূরে কোথাও যাবে। সেই ট্রেনেই পাহাড়ি পথে দার্জিলিং পৌঁছলাম। মনে পড়ছে ওই ছোট ট্রেনটার সামনে ও পেছনে দুটি ইঞ্জিন ছিল। পাহাড়ি পথে ট্রেনই যে নিরাপদ তা বুঝেছি একবার শিলং থেকে তামাবিল পর্যন্ত খোলা জিপে চড়ে আসতে বাধ্য হয়ে।
আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গেও ট্রেনের সম্পর্ক আছে একধরনের। যেমন, আমি যখন প্রথমবার একা ট্রেনে যাতায়াত করলাম তখন ভাবলাম যে 'এবার বড় হয়েছি'। আর সেই যাত্রা তো যেই-সেই ব্যাপার ছিল না। সিলেট থেকে লাতু যেতে হবে, মাঝখানে কুলাউড়া জংশনে ট্রেন বদলাতে হবে। তখনো আমি স্কুলে পড়ি। সেই সময় নিজে নিজের দায়িত্ব নিয়ে চলেছি। জীবনের সে এক মাইলফলক আর কী। সেই ক্ষণটি উদ্যাপন করার জন্য কুলাউড়া স্টেশনের রেস্তরাঁয় ঢুকে এক পট চায়ের অর্ডার দিলাম। বেয়ারা আমার হুকুম তামিল করলেন দেখে মনে মনে পুলকিত হলাম।
তবে আরো আছে ট্রেনের মাহাত্ম্য। তা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট। যেমন, আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম একটা ট্রেন ছিল, যার নাম ছিল গ্রিন অ্যারো। এটা টানত ডিজেলচালিত ইঞ্জিন আর কামরাগুলো ছিল লোহার। ১৯৬৪ সালে সেনাশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালাবার জন্য ফাতিমা জিন্নাহ এই ট্রেনে ভ্রমণ করেন। তাঁর সঙ্গে অন্যদের মধ্যে ছিলেন আইয়ুব খানের পক্ষ ত্যাগকারী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর জেনারেল আজম খান। ট্রেনটা যখন ঢাকা স্টেশন ত্যাগ করার জন্য নড়ে উঠল, তখন জেনারেল আজম খান অপেক্ষমাণ জনতা ও সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলে উঠলেন, 'দ্য ট্রেন অব ডেমোক্রেসি হ্যাজ স্টার্টেড'। গণতন্ত্রের রেলগাড়ি চলতে শুরু করেছে। পরদিনের পত্রিকায় আমরা ওই 'গ্রিন অ্যারো'র নাম দিয়েছিলাম 'ডেমোক্রেসি ট্রেন'। পথে স্টেশনে স্টেশনে এত জনসমাগম হয়েছিল যে ওই ট্রেনটা সেদিন সন্ধ্যার বদলে পরদিন দুপুরে চট্টগ্রাম পৌঁছেছিল। আমরা ভাবলাম, গণতন্ত্র ফিরে এলো বলে। তবে তা হয়নি। মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে পরোক্ষ ভোটের পাতানো নির্বাচনে আইয়ুব খানই প্রেসিডেন্ট হলেন। সম্মিলিত বিরোধী জোটের প্রার্থী ফাতিমা জিন্নাহ হেরে গেলেন।
সেই সময় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কিছুদিন ট্রেন চলত ঘড়ির কাঁটা ধরে। তাই কোনো হরতাল ডাকা হলে যদি হরতালকারীরা ট্রেন আটকে দিতে পারত তাহলে সেই ঘটনা বড় খবর হিসেবে দেখা হতো। ওই ঘটনা উল্লেখ করে বলা হতো, কড়া হরতাল হয়েছে। আর কোনো কারণে কোথাও বিক্ষোভকারীরা ট্রেনলাইন উপড়ে ফেললে সেটা হতো মহা উত্তেজনার ব্যাপার। ট্রেনে আগুন দেওয়ার কথা তো ভাবাই হতো না। একইভাবে ট্রেন দুর্ঘটনা হলে মনে হতো বজ্রপাত হয়েছে। আবার এর বিপরীত ভাবনাও ভেবেছি আমরা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা যদি রেল সেতু বা সেনাবাহী কোনো ট্রেন উড়িয়ে দিয়েছেন, সে ঘটনা আমাদের কাছে বিরাট বিজয় বলে মনে হতো। হানাদার পাকিস্তানিরাও ঘাবড়ে যেত। মুক্তিযুদ্ধের সময় একবার দেখেছি পাকিস্তানিদের রসদবাহী একটা ট্রেনে ইঞ্জিনের সামনে লাগানো হয়েছে কয়েকটি খালি ওয়াগন এবং বালুর বস্তা বোঝাই একটা খোলা ট্রলি। পাকিস্তানিদের মতলব ছিল, রেললাইনে যদি মুক্তিযোদ্ধারা মাইন পেতে থাকেন তবে সেটা সামনের খালি ওয়াগনের তলায় ফাটবে, এতে হয়তো ইঞ্জিনটা বেঁচে যাবে। এদিক থেকে দেখলে রেল যোগাযোগ আমাদের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়।
বিবিসির বিখ্যাত সাংবাদিক এবং বাংলাদেশে অনেকের বন্ধু মার্ক টালি ট্রেনে চড়তে এবং ট্রেন দেখতে খুব ভালোবাসেন। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্রেনে করে সেতুটি পার হন। আমন্ত্রিত সাংবাদিক হিসেবে মার্ক টালিও ওই ট্রেনে ছিলেন। যমুনা সেতু পারাপারের প্রথম ট্রেনে উঠতে পেরে খুবই উল্লসিত হয়েছিলেন তিনি। একবার মার্ক টালি বিবিসির জন্য একটা রেডিও ডকুমেন্টারি করার সময় সেই কাজে তাঁর সঙ্গে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম। মার্ক টালি প্রায় জোর করেই ট্রেনে করে চট্টগ্রাম গেলেন। রেললাইনের দুই পাশে গ্রামগুলোর সবুজ বৃক্ষরাজি আর পানিতে অর্ধেক ডোবা ধানক্ষেত দেখতে দেখতে মার্ক টালি বললেন, 'বাংলাদেশের এই সবুজের মতো সুন্দর সবুজ আমি আর কোথাও দেখিনি এবং ট্রেন থেকে ছাড়া আর কোনোভাবে এই সবুজ, আকাশের মেঘ, আকাশ আর পানি মিশে যাওয়া দেখতে পারা যায় না। অন্য যেকোনো বাহন থেকে দেখলে এর কিছু না কিছু বাদ পড়বেই। তা ছাড়া এত রকম মানুষই বা একসঙ্গে কিভাবে পাওয়া যাবে।'
পরে আরেকবার ঢাকায় এসে বাংলাদেশের ট্রেনের দুরবস্থা দেখে মার্ক টালি খুব ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছিলেন। আমরা একটা লেভেল ক্রসিংয়ে আমার গাড়িতে বসেছিলাম। ট্রেন আসছে দেখে মার্ক গাড়ি থেকে নেমে ক্রসিংয়ের গেটের কাছে ছুটে গেলেন। ফিরে এসে বললেন, 'এই ট্রেনটা কী কেউ ধোয় না, এটা এত ময়লা, এত হতশ্রী।' পরে আরো কয়েকটা ট্রেন দেখে তিনি হতাশ হয়ে বলেছিলেন, 'তোমাদের প্রশাসক আর রাজনৈতিক নেতারা অযোগ্য না হয় অসভ্য (আনকালচার্ড)। উনারা ট্রেনের যত্ন নেন না। উনারা কি বোঝেন যে একটা দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা দেখে সেই দেশের সভ্যতা, কৃষ্টি, উন্নয়নের মান বোঝা যায়?' মার্ক টালি খুব গর্ব করে বলতেন, তাঁর নানা বাংলাদেশের আখাউড়ায় বসবাস করে পাটের ব্যবসা করতেন। আর নানার বাড়িতে বেড়াতে এলে তিনি ট্রেন দেখে বহু সময় কাটাতেন। স্যার মার্ক তাঁর বৃদ্ধ বয়সে বাংলাদেশের ট্রেন দেখলে কী বলবেন তা কল্পনা করা কঠিন নয়।
তবে আজকে আমি ট্রেন নিয়ে পড়েছি, কারণ আমি ও আমার মতো অনেকেই এই ভেবে শঙ্কিত যে বাংলাদেশের ট্রেন কি উঠে যাবে? তা হয়তো হবে না, কিন্তু এ কথা তো ঠিক যে বাংলাদেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই তো জাতীয় সংসদে বলেছেন যে জনবলের অভাবে ৫৮টি রেলস্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে প্রায় রোজই অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে লোকজন ট্রেনে কাটা পড়তে দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রী বললেন যে রেল বিভাগ থেকে লোকজনকে অবসরে যেতে দেওয়া যাচ্ছে না কারণ তাঁদের কাজে হাল ধরার মতো লোক নেই। তিনি এও বলেছেন যে ট্রেনের অনেক চালকই এখন এত বৃদ্ধ যে এখন চোখে ভালো করে দেখতে পান না। তবু এঁরা কষ্ট করে ট্রেন চালাচ্ছেন। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে যখন এক নারী ট্রেনচালক একটি গাড়ির দায়িত্ব নিলেন তখন আমরা ভেবেছিলাম যে বাংলাদেশে একটা বিপ্লব ঘটে গেছে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ইঞ্জিন, বগি ও ওয়াগনের অবস্থাও খুব খারাপ। গত সোমবার ঝিনাইদহে কপোতাক্ষ এঙ্প্রেস ট্রেনের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। প্রাণে বাঁচার জন্য ইঞ্জিন থেকে বাইরে লাফিয়ে পড়ে চালক আহত হয়েছেন। এর আগে চট্টগ্রামের কাছে একটা চলন্ত ট্রেনের বগির একটা চাকা খুলে গিয়ে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। নাটবল্টু ক্ষয় হয়ে ঢিলা হয়ে যাওয়ায় চাকাটা খুলে গিয়েছিল বলে প্রাথমিক খবরে বলা হয়। বহু জায়গায় যত্নের অভাবে রেললাইনের মাটি দুর্বল হয়ে গেছে। পাথর নেই বলে লাইন দুর্বল হয়ে গেছে। আমার দেশ পত্রিকায় বলা হয়েছে, লাইনের পুরনো পাত আর পুরনো গাড়ির চাকা ঘষায় ঘষায় ক্ষয় হয়ে যাওয়াও ট্রেন পড়ে যাওয়ার একটা কারণ। সত্যি কথা বলতে কি, চলার সময় ট্রেনের কোচগুলো যে প্রচণ্ডভাবে দোলে আর কর্কশ আওয়াজ করে তাতে যাত্রীরা ভয়ই পান। অথচ ট্রেন বাংলাদেশে সত্যিকারের গণবাহন। সাধারণ মানুষের চলাফেরার অবলম্বন। আর তা এতটাই যে কামরায় তিল ধারণের জায়গা না থাকায় ট্রেনের ছাদে ওঠার জন্য মানুষ মই ভাড়া করে। কুষ্টিয়ায় দেখেছি গরিব মানুষ ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের জানালার সঙ্গে তাঁদের সাইকেল বেঁধে নিয়ে যাচ্ছেন সঙ্গে করে। এ দেশে আসলে রেল যোগাযোগ আরো বিস্তৃত করা এবং আরো বেশি ট্রেনের ব্যবস্থা করা দরকার। বর্তমান সরকার নানা অতিকায় প্রকল্পের পেছনে না ছুটে রেলের উন্নয়নের পেছনে অগ্রাধিকার দিয়ে বিনিয়োগ করলে ভালো করত। এর আগের যেসব সরকার রেল ব্যবস্থাকে অবহেলা করেছে তারাও পাপ করেছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
No comments