চারদিক- হংসছানার জলকেলি by বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী
শরতের নীল আকাশে মেঘের জটলা। কোথাও হালকা, কোথাও বা গাঢ়। ধোঁয়াটে বর্ণের কুণ্ডলী পাকানো মেঘমালা পশ্চিমের আকাশে স্থির হয়ে আছে। তেল পোড়ানো আগুনের ফুলকির মতো। হাইল হাওরের নীলাভ জলরাশির বুকে আসমানের এই গুমোট রূপের প্রতিবিম্ব।
হালকা বাতাসের দাপটে হাওর কিছুটা অশান্ত। ছোট ছোট ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ডিঙি নৌকার পেটে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশ্চিম ভাড়াউড়া ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে গেছে। শাখামুড়া ছড়ার (খাল) ভাটিতে খালের দুই পাশে হাইল হাওরের বিস্তৃত প্লাবনভূমি। খালের দুই পাশে কয়েকটি মাছের খামার। প্রায় আধা কিলোমিটার খাল পেরিয়ে আমাদের নৌকাটি হাইল হাওরের বিলে এসে পড়েছে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। মাথার ওপর সূর্য। ভাদ্রের তালপাকা গরম। তেতে উঠেছে হাওরের বিশাল জলরাশি। মৃদুমন্দ বাতাসেও নেই প্রশান্তির ছোঁয়া। হাওরের ভাপ ছড়ানো জল ছুঁয়ে আসা বাতাস অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর পরও যেতে হবে আমাদের।
নৌকার মাঝি শাহাবউদ্দিন। মধ্যবয়সী মানুষ। একসময় গান ধরলেন। গলায় সুর নেই। এর পরও গেয়ে চললেন আপনমনে,
‘জাইল্যায় জাল বায় পলো-জালে
ছাইক্কা তুলে পানি খালে আর বিলে
জাইল্যায় জাল বায়
কোন পন্থে যাইবায় গো জাইল্যা...।’
বৈঠার ছন্দময় তালে আমাদের নৌকা স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যাচ্ছে। হাইল হাওরের বিভিন্ন অংশে শত শত নৌকায় জেলেরা পলো-জালে মাছ ধরছেন। অবৈধ কারেন্ট জালের ছড়াছড়িও কম নয়। জালে খুব একটা মাছ ধরা পড়ছে না। মলা, বইচা, টেংরা, পুঁটি, গুলাইয়া। বড়জোর রুই, বাউশ, ঘনিয়ার বাগড়া।
বিয়ালার টেক পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই বাইক্কা বিল। এটি হাইল হাওরের স্থায়ী অভয়াশ্রম। বছরের এ সময়টাতে বিলটি নতুন করে সাজে। গোলাপি রঙের চোখজুড়ানো জলপদ্ম ফোটে এ বিলে। হাওরের সব অঞ্চলেই এ সময় জলপদ্ম ফোটার কথা। এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছি, কোথাও হাওরের এ রূপ চোখে পড়েনি—যেমনটি দেখেছি বাইক্কা বিলে। হাইল হাওরের অন্য বিলগুলোতে সারা বছর মাছ মারা হয়। তাই লতাগুল্মজাতীয় এই গাছের অস্তিত্ব বাইক্কা বিল ছাড়া অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মাছ ধরার অত্যাচারে জলপদ্ম বিলীন হয়ে গেছে, এটি জানালেন নৌকার মাঝি শাহাবউদ্দিন। ১০ বছর ধরে তিনি হাইল হাওরকে খুব কাছ থেকে দেখছেন। বছরের প্রায় নয় মাসই তিনি হাওরে থাকেন। নৌকায় রান্না, খাওয়া, ঘুমানো—সবই।
দুই পাশে হাজার হাজার প্রস্ফুটিত জলপদ্মের মিষ্টি হাসি। বাতাসের দোলায় একে অন্যের শরীরে লুটোপুটি খাচ্ছে। এরই মাঝখান দিয়ে সরু নৌপথ ধরে বাতাসের দোলায় দোল খেয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম বাইক্কা বিলের পর্যটন টাওয়ারে। হাওরের ভাসান জলে টাওয়ারে যাওয়ার হেঁটে চলার পথ ডুবে আছে। নৌকাটি টাওয়ারের সিঁড়িতে ভেড়ালেন মাঝি।
এই বিলে সম্প্রতি বালিহাঁস ডিমে তা দিয়ে ছানা ফুটিয়েছে। বাইক্কা বিলের পর্যটন টাওয়ারে উঠে অপেক্ষা করছিলাম মিরাশ মিয়ার। তিনি বড়গাঙ্গিনা সম্পদ সহব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। স্থানীয় মৎস্যজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। সংগঠনটি বাইক্কা বিল অভয়াশ্রমের দেখভাল করে।
মিরাশ মিয়া বিলের অন্য অংশে ছিলেন। দূর থেকে টাওয়ারে দেখতে পেয়ে একটা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে তিনি চলে এলেন। নিয়ে গেলেন হিজল-করচের বনে। যেখানে বালিহাঁসের প্রজননের জন্য কাঠের কৃত্রিম বাসা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল।
কাঠের একটি বাক্স খুলে তিনি দেখালেন, মুক্তোর মতো সাদা রঙের ডিমের ওপর ছয়টি ছানা। সাদা-কালো রঙে মাখামাখি সদ্য ফোটা ছানাগুলো লুটোপুটি খাচ্ছে। আরেকটি ছানা ভেতর থেকে ডিম ফুটো করে খানিকটা ঠোঁট বের করেছে। খোলস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কী প্রাণান্ত চেষ্টা! একটু দূরে বিলের ভাসান জলে সাঁতার কাটছে আরও পাঁচটি ছানা। মিরাশ জানালেন, এই ছানাগুলো অন্য একটি বাক্সে ছিল। বাক্স থেকে নিজেরাই ঝাঁপ দিয়ে পানিতে পড়েছে।
বাইক্কা বিলে ২০০৫ সাল থেকে এ রকম কাঠের বাক্সে বালিহাঁসের প্রজননের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বছরই বেশি সফলতা এসেছে। ২১টি বাক্সের মধ্যে আটটিতে ৬২টি বালিহাঁসের ডিম পাওয়া যায়। ডিম থেকে ছানা ফুটেছে ৩৯টি।
বাইক্কা বিলে বালিহাঁসের কৃত্রিম প্রজননের খবরটি দেশের পাখিপ্রেমীদের আন্দোলিত করেছে। ইংরেজি কটন পিগমি গুস (Nettapus Coromandelianus) নামের এই হাঁসের প্রজননে উচ্ছ্বসিত পাখিবিশেষজ্ঞ শরীফ খান ঘটনাটি জানার পর থেকে ফোনে এ সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন।
শরীফ খান জানান, বুনোহাঁসের এই প্রজাতি দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে ছোট বুনোহাঁসের এই প্রজাতিটি হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, জলাশয়ের কাছাকাছি পুরোনো নারকেল, তাল, খেজুরগাছের খোঁড়লে বাসা বাঁধে। জলাশয়ের পাশে পুরোনো এসব গাছ না থাকায় এদের প্রজনন হচ্ছে না। বাজপাখি, ইঁদুর, বনবিড়াল, চিল এদের প্রধান শত্রু। মানুষ তো আছেই। এসব শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেলেই কেবল এরা হাইল হাওরের স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে।
বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী
শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার পশ্চিম ভাড়াউড়া ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে গেছে। শাখামুড়া ছড়ার (খাল) ভাটিতে খালের দুই পাশে হাইল হাওরের বিস্তৃত প্লাবনভূমি। খালের দুই পাশে কয়েকটি মাছের খামার। প্রায় আধা কিলোমিটার খাল পেরিয়ে আমাদের নৌকাটি হাইল হাওরের বিলে এসে পড়েছে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। মাথার ওপর সূর্য। ভাদ্রের তালপাকা গরম। তেতে উঠেছে হাওরের বিশাল জলরাশি। মৃদুমন্দ বাতাসেও নেই প্রশান্তির ছোঁয়া। হাওরের ভাপ ছড়ানো জল ছুঁয়ে আসা বাতাস অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর পরও যেতে হবে আমাদের।
নৌকার মাঝি শাহাবউদ্দিন। মধ্যবয়সী মানুষ। একসময় গান ধরলেন। গলায় সুর নেই। এর পরও গেয়ে চললেন আপনমনে,
‘জাইল্যায় জাল বায় পলো-জালে
ছাইক্কা তুলে পানি খালে আর বিলে
জাইল্যায় জাল বায়
কোন পন্থে যাইবায় গো জাইল্যা...।’
বৈঠার ছন্দময় তালে আমাদের নৌকা স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে যাচ্ছে। হাইল হাওরের বিভিন্ন অংশে শত শত নৌকায় জেলেরা পলো-জালে মাছ ধরছেন। অবৈধ কারেন্ট জালের ছড়াছড়িও কম নয়। জালে খুব একটা মাছ ধরা পড়ছে না। মলা, বইচা, টেংরা, পুঁটি, গুলাইয়া। বড়জোর রুই, বাউশ, ঘনিয়ার বাগড়া।
বিয়ালার টেক পেরিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলেই বাইক্কা বিল। এটি হাইল হাওরের স্থায়ী অভয়াশ্রম। বছরের এ সময়টাতে বিলটি নতুন করে সাজে। গোলাপি রঙের চোখজুড়ানো জলপদ্ম ফোটে এ বিলে। হাওরের সব অঞ্চলেই এ সময় জলপদ্ম ফোটার কথা। এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছি, কোথাও হাওরের এ রূপ চোখে পড়েনি—যেমনটি দেখেছি বাইক্কা বিলে। হাইল হাওরের অন্য বিলগুলোতে সারা বছর মাছ মারা হয়। তাই লতাগুল্মজাতীয় এই গাছের অস্তিত্ব বাইক্কা বিল ছাড়া অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মাছ ধরার অত্যাচারে জলপদ্ম বিলীন হয়ে গেছে, এটি জানালেন নৌকার মাঝি শাহাবউদ্দিন। ১০ বছর ধরে তিনি হাইল হাওরকে খুব কাছ থেকে দেখছেন। বছরের প্রায় নয় মাসই তিনি হাওরে থাকেন। নৌকায় রান্না, খাওয়া, ঘুমানো—সবই।
দুই পাশে হাজার হাজার প্রস্ফুটিত জলপদ্মের মিষ্টি হাসি। বাতাসের দোলায় একে অন্যের শরীরে লুটোপুটি খাচ্ছে। এরই মাঝখান দিয়ে সরু নৌপথ ধরে বাতাসের দোলায় দোল খেয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম বাইক্কা বিলের পর্যটন টাওয়ারে। হাওরের ভাসান জলে টাওয়ারে যাওয়ার হেঁটে চলার পথ ডুবে আছে। নৌকাটি টাওয়ারের সিঁড়িতে ভেড়ালেন মাঝি।
এই বিলে সম্প্রতি বালিহাঁস ডিমে তা দিয়ে ছানা ফুটিয়েছে। বাইক্কা বিলের পর্যটন টাওয়ারে উঠে অপেক্ষা করছিলাম মিরাশ মিয়ার। তিনি বড়গাঙ্গিনা সম্পদ সহব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। স্থানীয় মৎস্যজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে সংগঠনটি গড়ে উঠেছে। সংগঠনটি বাইক্কা বিল অভয়াশ্রমের দেখভাল করে।
মিরাশ মিয়া বিলের অন্য অংশে ছিলেন। দূর থেকে টাওয়ারে দেখতে পেয়ে একটা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে তিনি চলে এলেন। নিয়ে গেলেন হিজল-করচের বনে। যেখানে বালিহাঁসের প্রজননের জন্য কাঠের কৃত্রিম বাসা তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল।
কাঠের একটি বাক্স খুলে তিনি দেখালেন, মুক্তোর মতো সাদা রঙের ডিমের ওপর ছয়টি ছানা। সাদা-কালো রঙে মাখামাখি সদ্য ফোটা ছানাগুলো লুটোপুটি খাচ্ছে। আরেকটি ছানা ভেতর থেকে ডিম ফুটো করে খানিকটা ঠোঁট বের করেছে। খোলস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কী প্রাণান্ত চেষ্টা! একটু দূরে বিলের ভাসান জলে সাঁতার কাটছে আরও পাঁচটি ছানা। মিরাশ জানালেন, এই ছানাগুলো অন্য একটি বাক্সে ছিল। বাক্স থেকে নিজেরাই ঝাঁপ দিয়ে পানিতে পড়েছে।
বাইক্কা বিলে ২০০৫ সাল থেকে এ রকম কাঠের বাক্সে বালিহাঁসের প্রজননের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বছরই বেশি সফলতা এসেছে। ২১টি বাক্সের মধ্যে আটটিতে ৬২টি বালিহাঁসের ডিম পাওয়া যায়। ডিম থেকে ছানা ফুটেছে ৩৯টি।
বাইক্কা বিলে বালিহাঁসের কৃত্রিম প্রজননের খবরটি দেশের পাখিপ্রেমীদের আন্দোলিত করেছে। ইংরেজি কটন পিগমি গুস (Nettapus Coromandelianus) নামের এই হাঁসের প্রজননে উচ্ছ্বসিত পাখিবিশেষজ্ঞ শরীফ খান ঘটনাটি জানার পর থেকে ফোনে এ সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছেন।
শরীফ খান জানান, বুনোহাঁসের এই প্রজাতি দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে ছোট বুনোহাঁসের এই প্রজাতিটি হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিল, জলাশয়ের কাছাকাছি পুরোনো নারকেল, তাল, খেজুরগাছের খোঁড়লে বাসা বাঁধে। জলাশয়ের পাশে পুরোনো এসব গাছ না থাকায় এদের প্রজনন হচ্ছে না। বাজপাখি, ইঁদুর, বনবিড়াল, চিল এদের প্রধান শত্রু। মানুষ তো আছেই। এসব শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেলেই কেবল এরা হাইল হাওরের স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে।
বিশ্বজ্যোতি চৌধুরী
শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
No comments