রেলের এক হাজার কর্মী নিয়োগে ঘুষ-বাণিজ্য by একরামুল হক ও অনিকা ফারজানা
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ছয় বিভাগে এক হাজার ৬৯টি পদে নিয়োগে অবৈধ বাণিজ্য হয়েছে। রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নকারীরা এতে জড়িত। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
রেলের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের একটি হাইস্কুলের নয়জন এবং একটি কলেজের সাতজন শিক্ষক এই কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলে প্রমাণ পেয়েছে দুদকের তদন্ত দল। এই শিক্ষকেরা নিয়োগসংক্রান্ত মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষার খাতায়ও নম্বর বাড়িয়ে দিয়েছেন।
রেলওয়ে ও মন্ত্রণালয়ের আলাদা তদন্ত এবং সর্বশেষ দুদকের অনুসন্ধানে নিয়োগে দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও বিতর্কিত নিয়োগগুলো বাতিল হয়নি। নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মীরা চাকরি করে যাচ্ছেন।
তদন্তে ঘুষ-দুর্নীতির প্রমাণ মিললেও নিয়োগ বাতিল করা হচ্ছে না কেন, জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। মন্তব্যও করতে চাই না।’ তবে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. তাফাজ্জল হোসেন বলেন, নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের ব্যাপারে সরকার ও মন্ত্রণালয় থেকে এখনো কিছু বলা হয়নি। তাই তাঁরা চাকরি করছেন।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, রেলওয়ের কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত পদ, মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁদের সন্তানদের জন্য পদসহ মহিলা/অনগ্রসর জেলা/আনসার-ভিডিপি/উপজাতি/এতিম/প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন ধরনের কোটার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। শুধু ঘুষের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
২০১০ সালে এই নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হয়ে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চলে। দুদকের অনুসন্ধান চলাকালেও নিয়োগ দেওয়া হয় বলে রেল সূত্রে জানা যায়। ২৪টি শ্রেণীতে এক হাজার ১৭৭ পদের বিপরীতে এ পর্যন্ত এক হাজার ১১৭ জন নিয়োগ পেয়েছেন।
সাময়িক বরখাস্ত হওয়া রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) ইউসুফ আলী মৃধা ও রেল পুলিশের কমান্ড্যান্ট এনামুল হকসহ ৩৯ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গত সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা দেন অনুসন্ধান কর্মকর্তারা। দুদকের উপপরিচালক মো. আবু সাঈদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল এই অনুসন্ধান করে। দুদক শিগগিরই এ বিষয়ে মামলা করবে। পূর্বাঞ্চলের ২৫ কর্মকর্তাসহ ৫০ জনকে আসামি করা হতে পারে।
দুদকের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, কমিশনের বৈঠকে এ বিষয়ে মামলা করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নিয়োগ বাতিল হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে সরকার বা আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। দুদক বড়জোর সুপারিশ করতে পারে।
দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত বিভাগ সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, পূর্বাঞ্চল রেলের নিয়োগে দুর্নীতির প্রাথমিক প্রমাণ ও তদন্তের ওপর ভিত্তি করে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করা হবে। ইউসুফ আলী মৃধা ছাড়া অন্য যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হবে, তাঁরা হলেন নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও পূর্ব রেলওয়ের অতিরিক্ত যান্ত্রিক প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান এবং সদস্যসচিব ও জ্যেষ্ঠ ওয়েলফেয়ার কর্মকর্তা গোলাম কিবরিয়া।
অভিযোগ প্রসঙ্গে কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশ ও সুপারিশ মেনেই সবকিছু করেছি। সেগুলো রেলের মহাব্যবস্থাপক থেকে নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক হয়ে আমার কাছে এসেছে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সুপারিশ কি ফেলে দেওয়া যায়?’ চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে নিয়োগ পরীক্ষার নম্বরপত্র পরিবর্তনের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো টেব্যুলেশন শিট নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে যাইনি। গিয়েছি ব্যক্তিগত কাজে।’
চট্টগ্রাম থেকে দুদকের জব্দ করা নথিতে দেখা যায়, সুইপার থেকে শুরু করে লোকোমাস্টার পর্যন্ত বিভিন্ন পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের ঘুষ বিনিময় হয়েছে। ওই ঘুষের অর্থ ভাগ করে নিয়েছেন রেলের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষার খসড়া নম্বরপত্রে জালিয়াতির মাধ্যমে অসংখ্য অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীকে কৃতকার্য দেখানো হয়েছে। যেমন, ১২১৬ কোড নম্বরধারী ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদের জন্য লিখিত পরীক্ষায় মাত্র ২ নম্বর পেয়েছিলেন। কিন্তু নম্বর কেটে তাঁকে ২৫ নম্বর দিয়ে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। এই পদের ৩৫টির বেশি খাতায় কাটাছেঁড়া করে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
২৪টি শ্রেণীর নিয়োগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম পাওয়া গেছে ট্রেড এপ্রেন্টিস পদে। এই শ্রেণীর ৪০০ পদের বিপরীতে আবেদনকারী ছিলেন ৩৪ হাজার ৭৯১ জন। নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৩৬৯ জনকে। একইভাবে অনিয়ম করে নিয়োগ পেয়েছেন ১১২ জন চৌকিদার, ২৪৮ জন সুইপার, ১৪৩ জন ট্রলিম্যান, ১৫ জন সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর ও ১৮২ জন লোকোমাস্টার পদে। সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৯৫ জনের মধ্যে সাতজন মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেন। কিন্তু নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১১ জনকে। এই ১১ জনের ছয়জনই আবার মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। এ ছাড়া অনুসন্ধান প্রতিবেদনে কিছু রোল নম্বর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এঁরা পরীক্ষায় পাস না করেও নিয়োগ পেয়েছেন। আবার পরীক্ষায় পাস করার পরও ঘুষের টাকা দিতে না পারায় নিয়োগ পাননি—এমন ঘটনাও রয়েছে অনেক।
রেল সূত্রে জানা যায়, ২৪ শ্রেণীর মধ্যে শুধু ট্রেড অ্যাপ্রেন্টিস পদের জন্যই চার থেকে সাত লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
গত ৯ এপ্রিল মধ্যরাতে সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ওমর ফারুক বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে মন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছিলেন। এ সময় বিজিবির সদর দপ্তরে গাড়িটি আটক করা হলে পরদিন ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। টাকার পরিমাণ ৭০ লাখ বা তারও বেশি বলে জানা যায়। গাড়িতে ইউসুফ আলী মৃধা ও এনামুল হকও ছিলেন। এই টাকা পূর্বাঞ্চলের নিয়োগ-বাণিজ্যের অংশ বলে তখন অভিযোগ ওঠে।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ: জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি দুদক কয়েকজন কর্মকর্তার সম্পদের হিসাবও নিয়েছে। তাঁরা হলেন: পূর্বাঞ্চল রেলের নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক হাফিজুর রহমান চৌধুরী ও সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়া, রেল বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এস এম লিয়াকত আলী, মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার (চট্টগ্রাম সদর পূর্ব) এফ এম মহিউদ্দিন ও আইন কর্মকর্তা আমান উল্লাহ, বরখাস্ত হওয়া জিএম ইউসুফ আলী মৃধা ও তাঁর স্ত্রী, কমান্ড্যান্ট এনামুল হক ও তাঁর স্ত্রী।
আরও নিয়োগ: রেল সূত্র জানায়, ২৪ শ্রেণীর বাইরে আরও নিয়োগ দেওয়া হয় নিরাপত্তা প্রহরী পদে ৪০০, কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ কারখানার ১২০ খালাসি এবং ৪০ জন নিরীক্ষক ও সহকারী নিরীক্ষক। এ ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। তবে এখনো তা চিহ্নিত করা হয়নি। অনিয়ম তদন্তে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে রেলের ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তার সমন্বয়ে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।
এর কারণ জানতে চাইলে একটি তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী ছায়দুর রহমান বলেন, ‘আসলে আমাদের কমিটির বিভিন্ন জন বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছেন। এ জন্য প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে। আমরা তদন্ত শেষ করেছি। মুশকিলের বিষয় হলো, আমাদের এক বস্তার মতো ফটোকপি করতে হচ্ছে। কষ্ট হলেও কাজ তো করে যাব।’
এপ্রিলে নিয়োগ-বাণিজ্যের খবর প্রকাশের পর এ নিয়ে হইচইয়ের মুখে তিন শ্রেণীর এক হাজার ৫৭৩ জন নিয়োগের প্রক্রিয়াটি থেমে যায়। পরে মন্ত্রণালয় ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ায়। এদিকে মামলার কারণে থেমে গেছে আরও ১০টি শ্রেণীর ৬২৬ জনের নিয়োগ-প্রক্রিয়া।
No comments