দম্ভ অহংকারে বিধ্বস্ত সভ্যতা by এলাহী নেওয়াজ খান
অনেক দিন পর লিখছি। লিখতে বসে বিষয়বস্তু নির্বাচন করতে গিয়ে বেশ ধাঁধায় পড়ে গেলাম। আসলে সংঘাত বিক্ষুব্ধ বিশ্বে চটজলদি একটি বিষয় নির্বাচন কঠিন কাজ। অসংখ্য ঘটনাবলী। ছায়াছবির মতো একের পর এক দৃশ্য। এ জন্য কিছুটা চিন্তার প্রয়োজন হলো।
হঠাৎ চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো অপার এক দৃশ্য। দেখতে পেলাম কত সভ্যতা, কত উন্নত জনপদ ও কত শক্তিশালী শাসক ও তাদের কীর্তি কিভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভাবনার দুয়ারটা খুলে গেল। ইতিহাসের পাতা মূর্ত হয়ে উঠলো।
আসলে ইতিহাসের পাতা ঘাটলে সেসব ধ্বংসের কাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে আঙুল দিয়ে বলে দেয় যে, একগুঁয়েপনা, দম্ভ ও অহংকার অন্ধ হয়ে ক্ষমতার এমন কল্পলোক তৈরি করো না যেখানে তোমরা পৌঁছাতে পারবে না। যেমন করে নমরুদ আসমান ও জমিনের একক শক্তি মহান আল্লাহতালার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে আকাশের দিকে তীর ছুড়েছিল। সে তার সীমিত চিন্তা দিয়ে অসীমের মালিককে কল্পনা করেছিল আকাশে তার তীর পৌঁছানোর সীমা পর্যন্ত। সে জানতোই না যে, একক শক্তি অতি ক্ষুদ্র একটি ল্যাংড়া মশা দিয়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারেন।
মোদ্দা কথা অতীতের সকল সভ্যতার ধ্বংস হয়েছে মূলত একগুঁয়েপনা, দম্ভ ও অহংকারের কারণে। এটা কেবলমাত্র দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠা কোনো সভ্যতা, বা কোনো একজন শাসকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমন কি যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেও। যেমন হুনাইনের যুদ্ধে মুসলমান সৈনিকরা সংখ্যাধিক্যের বড়াই করেছিল। ফলে সে যুদ্ধে মুসলমান বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ পবিত্র কোরআনে এভাবে উল্লেখ হয়েছে: নিশ্চয় মহান আল্লাহ অনেক স্থানে তোমাদের সাহায্য করেছেন এবং হুনাইন যুদ্ধের দিন তোমরা তোমাদের জনসংখ্যার আধিক্যে প্রফুল্ল হয়েছিলে, তবে তা তোমাদের কোনো উপকারেই আসেনি এবং জমিন প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তোমরা শত্রুদের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। (সূরা তওবা: ২৫)
সুতরাং কোনো ইসলামী আন্দোলনকারীরা যদি বৃহৎ দল, অনেক কর্মী, বিশাল সম্পদের কথা ভেবে অহংকারী হয়; তাহলে তাদের ক্ষেত্রেও হুনাইন যুদ্ধের মতো পরিণতি হতে বাধ্য।
আসলে সৃষ্ট কোনো বস্তুরই নিজস্ব কোনো ক্ষমতা বা গুণ নেই। মহান একক সত্ত্বা যাকে যতটুকু ক্ষমতা দেন সে ততটুকু ক্ষমতাবান হয়। যে বস্তুর মধ্যে তিনি যতটুকু গুণ দেন সেই গুণে সেটি গুণাণ্বিত হয়। মহান পবিত্র সত্ত্বা নমরুদ ও ফেরাউনকে প্রভুত ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আর তা তাদের ক্ষমতার ধারণাকে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল যে, তারা সেই ক্ষমতা প্রদানকারী মহানেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। পরিণতি ছিল সম্পূর্ণ ধ্বংস। অন্যদিকে সেই মহান সত্ত্বা, আগুণের মধ্যে যে গুণ দিয়েছেন, তা হচ্ছে, তার দাহ্য করার ক্ষমতা। কিন্তু নমরুদ যখন হযরত ইব্রাহীম আ.-কে প্রজ্বলিত আগুনে নিক্ষেপ করে; তখন সে আগুন মহানের নির্দেশে নবীর আ. জন্য শান্তিদায়ক গুণে পরিণত হয়ে যায়।
এই ক্ষমতা ও গুণ কোনো বস্তুর ইচ্ছাধীন নয়। এটা সেই মহান পবিত্র সত্ত্বা কর্তৃক প্রদত্ত। অর্থাৎ তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে রাজত্ব দেন, ক্ষমতা দেন আবার তা কেড়ে নেন। অস্থায়ী এই দুনিয়াতে প্রদত্ত সকলেরই ক্ষমতা সীমিত সময়ের জন্য। কখন এবং কিভাবে সে ক্ষমতার অবসান হবে, তা ক্ষমতাপ্রাপ্তদের বোধের অন্তরালে থাকে। যখন সে ক্ষমতা বিনাশের নির্দেশ মহান সত্ত্বার তরফ থেকে আসে; তখন তা আসে অভাবিত উপায়ে। বজ্রপাতের মতো। অহংকারীর কারুন এবং তার সম্পদ গ্রাস করেছিল মাটি। আর বর্তমান যুগে অহংকারী সম্পদশালীও ধ্বংস্ব হয় জীবনে নেমে আসা আকস্মিক দুর্বিপাকে কিম্বা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আর সম্পদ সঞ্চয়ের কোনো সীমা নেই। কারণ মহান একক সত্ত্বা যাকে সম্পদ দেন তাকে প্রচুর দেন। বিশ্বের কোনো শক্তি ঠেকাতে পারে না। আর এই প্রাপ্তি তাকে সীমাহীন আশার দিকে নিয়ে যায়; যা তার জীবনে কখনোই পুরণ হবার নয়। আকস্মাৎ মৃত্যু তার স্বপ্নের সৌধকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যে, সে কোনো অবস্থাতেই দুনিয়া ছেড়ে যেতে চায় না। কিন্তু তার কোনো সম্পদ কিম্বা গর্বিত সন্তানরা তার চলে যাওয়াকে আটকাতে পারে না। কার্যত তার অর্জিত সকল সম্পদের বোঝা নিয়েই সে কারুনের মতোই মাটিতে গ্রাস হয়।
যদি কেউ মহান সত্ত্বার প্রদত্ত ক্ষমতাকে নিজের অর্জিত কিম্বা জনগণ বা কর্মী-সমর্থক দ্বারা প্রাপ্ত বলে মনে করেন, তবে সে মূলত ফানুসের তৈরি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। সে সিংহাসন দেখতে বিস্ময়কর; কিন্তু নিমিষে বাতাসে মিলিয়ে যায়। আসলে শাসকরা বিবেকহীন নেতা-কর্মীদের আনুগত্য এমনভাবে পেতে থাকে, যা তাকে তার স্রষ্টার আনুগত্য ভুলিয়ে দেয়। ফলে অহংকার তাকে আজাজিল কিম্বা দাজ্জালের পর্যায়ে নিয়ে যায়। আজাজিল যেমন আগুনের তৈরি বলে অহংকার করে আদম আ.-কে সিজদা করার মহানের নির্দেশ অমান্য করেছিল। তেমনি দাজ্জাল মহান সত্ত্বা প্রদত্ত ক্ষমতা বলে এতটা দিশেহারা হয়ে পড়বে যে, সে একহাতে বেহেস্ত এবং অপর হাতে দোজখ নিয়ে মানুষকে বলবে, আমার কথা যে শুনবে সে বেহেস্ত যাবে, আর যে আমার কথা অমান্য করবে সে দোজখে যাবে। মূলত হবে উল্টোটা। অর্থাৎ যে দাজ্জালের কথা শুনবে সে যাবে দোজখে; আর যে অমান্য করবে সে যাবে বেহেস্তে। বর্তমান যুগেও দাজ্জালের মতো আচরণ দৃশ্যমান। ক্ষমতাশালীরা তাদের অন্যায় কাজের সমর্থকদের নানাভাবে পুরস্কৃত করে। আর সমর্থকরা পুরস্কার পেতে পেতে আরো প্রাপ্তির লোভে আনুগত্যের মাত্রা এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়; যা শেষ পর্যন্ত পুরস্কারদাতাকে ‘দেবতার’ আসনে বসিয়ে দেয়। তারা অনেকটা দাজ্জালের অনুসারীদের মতো। দিকবিদিক ধ্বংসকারী এমন ক্ষমতাবান দাজ্জাল মাত্র একটা শরাঘাতেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
আর শাসকরা যে ক্ষমা নিয়ে দম্ভ করেনব, তার সীমা কতদূর পর্যন্ত। কোনো দাম্ভিক ক্ষতাবান শাসক, বড়জোর তার শত্রু একজন মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে, কিম্বা জেলে আটকিয়ে জুলুম নির্যাতন করতে পারে। অথবা পারে নানাভাবে হয়রানি করতে। এর বেশি আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। অথচ সে যখন আল্লাহ প্রদত্ত ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়বে; তখন সুবিধাভোগী পুজারীদের কাউকেই সে পাশে পাবে না। অতীত তার সাক্ষী।
পরিশেষে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের পরিণতি সম্পর্কে এখানে উল্লেখ করতে চাই। অনেকের জানা আছে যে, মক্কা বিজয়ের পর রাসূল পাক সা. মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে রোম, মিশর, ইয়েমেন ও পারস্যসহ বিভিন্ন দেশের শাসকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি পাঠান। এদের মধ্যে পারস্য সম্রাট খসরু ছিল বেপরোয়া ও অহংকারী। তার ঔদ্ধত্য সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে অহংকারের এতটা অন্ধ ছিল যে, রাসূল সা. চিঠি ছিড়ে টুকরো করে ফেলেন। তার এই ঔদ্ধত্য সম্পর্কে ইরানের প্রসিদ্ধ কবি হাকিম নিযামী তার এ কবিতায় উল্লেখ করেন- অহংকারী যে, নেই তার অন্তঃদৃষ্টি। আত্মম্ভরিতায় তার নেই কোনো গুণ ও নিপুনতা। কবিতার আরেক জায়গায় তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন, পত্রখানা সে ছিঁড়ে করলো টুকরো টুকরো, আসলে পত্র নয়; বরং নিজেকেই ছিঁড়ে করল টুকরো টুকরো।
মহানবী সা. সম্রাট খসরুর ঔদ্ধত্যের কথা শুনে বললেন, হে আল্লাহ! তার রাজত্বকে টুকরো টুকরো করে দিন। বেয়াকুফ খসরু ক্ষমতার মদমত্ত হয়ে তার অধীনস্ত ইয়েমেনের শাসনকর্তাকে নির্দেশ দেন মহানবী সা.-কে গ্রেফতার করার জন্য। নির্দেশ পেয়ে ইয়েমেন শাসনকর্তা জান দু’জন সেনাপতি পাঠান রাসূল সা.-কে গ্রেফতার করার জন্য। তারা রাসূলের সা. সঙ্গে সাক্ষাত করে ইয়েমেনের শাসনকর্তার গ্রেফতারের নির্দেশ সম্বলিত চিঠি হস্তান্তর করেন। মহানবী তাদের বললেন, আজকে আপনারা যান। আগামীকাল আপনাদের আমার মত জানাবো।
ওইদিনই মহানবী সা. ওহি মারফত জানতে পারলেন যে, খসরু পারভেজ নিহত হয়েছে। পরদিন ওরা দু’জন রাসূলের সা. কাছে উপস্থিত হলে তিনি বললেন, ‘আমার পালনকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, খসরু পারভেজকে তার পুত্র শিরাজই হত্যা করেছে এবং সে নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেছে।
পরবর্তীতে ইয়েমেন ও পারস্য মুসলিম শক্তির কাছে পদানত হয়।
বর্তমান যুগেও রাসূলের সা. বহু উম্মত আছেন যাদের কথা আল্লাহ শোনেন। আর সীমা লংঘনকারীকে তো আল্লাহই নিজেই পছন্দ করেন না। তাই সে মহান সত্ত্বা আল্লাহ-তালা বলেছেন, ‘অহংকার তথা অহমিকা আমার চাদর এবং মহত্ব আমার পায়জামা। যে লোক এ দু’টি বিষয়ে আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে, আমি তাকে ধ্বংস করে দেব’। আল্লাহপাক আরো বলেছেন, ‘জমিনে যারা অন্যায়ভাবে গর্ব করে, আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী থেকে সরিয়ে দেব’।
এলাহী নেওয়াজ খান: সাংবাদিক
আসলে ইতিহাসের পাতা ঘাটলে সেসব ধ্বংসের কাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে আঙুল দিয়ে বলে দেয় যে, একগুঁয়েপনা, দম্ভ ও অহংকার অন্ধ হয়ে ক্ষমতার এমন কল্পলোক তৈরি করো না যেখানে তোমরা পৌঁছাতে পারবে না। যেমন করে নমরুদ আসমান ও জমিনের একক শক্তি মহান আল্লাহতালার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে আকাশের দিকে তীর ছুড়েছিল। সে তার সীমিত চিন্তা দিয়ে অসীমের মালিককে কল্পনা করেছিল আকাশে তার তীর পৌঁছানোর সীমা পর্যন্ত। সে জানতোই না যে, একক শক্তি অতি ক্ষুদ্র একটি ল্যাংড়া মশা দিয়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারেন।
মোদ্দা কথা অতীতের সকল সভ্যতার ধ্বংস হয়েছে মূলত একগুঁয়েপনা, দম্ভ ও অহংকারের কারণে। এটা কেবলমাত্র দীর্ঘকাল ধরে গড়ে উঠা কোনো সভ্যতা, বা কোনো একজন শাসকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমন কি যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ক্ষেত্রেও। যেমন হুনাইনের যুদ্ধে মুসলমান সৈনিকরা সংখ্যাধিক্যের বড়াই করেছিল। ফলে সে যুদ্ধে মুসলমান বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এ পবিত্র কোরআনে এভাবে উল্লেখ হয়েছে: নিশ্চয় মহান আল্লাহ অনেক স্থানে তোমাদের সাহায্য করেছেন এবং হুনাইন যুদ্ধের দিন তোমরা তোমাদের জনসংখ্যার আধিক্যে প্রফুল্ল হয়েছিলে, তবে তা তোমাদের কোনো উপকারেই আসেনি এবং জমিন প্রশস্ত হওয়া সত্ত্বেও তোমাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং তোমরা শত্রুদের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। (সূরা তওবা: ২৫)
সুতরাং কোনো ইসলামী আন্দোলনকারীরা যদি বৃহৎ দল, অনেক কর্মী, বিশাল সম্পদের কথা ভেবে অহংকারী হয়; তাহলে তাদের ক্ষেত্রেও হুনাইন যুদ্ধের মতো পরিণতি হতে বাধ্য।
আসলে সৃষ্ট কোনো বস্তুরই নিজস্ব কোনো ক্ষমতা বা গুণ নেই। মহান একক সত্ত্বা যাকে যতটুকু ক্ষমতা দেন সে ততটুকু ক্ষমতাবান হয়। যে বস্তুর মধ্যে তিনি যতটুকু গুণ দেন সেই গুণে সেটি গুণাণ্বিত হয়। মহান পবিত্র সত্ত্বা নমরুদ ও ফেরাউনকে প্রভুত ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আর তা তাদের ক্ষমতার ধারণাকে এতদূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল যে, তারা সেই ক্ষমতা প্রদানকারী মহানেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। পরিণতি ছিল সম্পূর্ণ ধ্বংস। অন্যদিকে সেই মহান সত্ত্বা, আগুণের মধ্যে যে গুণ দিয়েছেন, তা হচ্ছে, তার দাহ্য করার ক্ষমতা। কিন্তু নমরুদ যখন হযরত ইব্রাহীম আ.-কে প্রজ্বলিত আগুনে নিক্ষেপ করে; তখন সে আগুন মহানের নির্দেশে নবীর আ. জন্য শান্তিদায়ক গুণে পরিণত হয়ে যায়।
এই ক্ষমতা ও গুণ কোনো বস্তুর ইচ্ছাধীন নয়। এটা সেই মহান পবিত্র সত্ত্বা কর্তৃক প্রদত্ত। অর্থাৎ তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে রাজত্ব দেন, ক্ষমতা দেন আবার তা কেড়ে নেন। অস্থায়ী এই দুনিয়াতে প্রদত্ত সকলেরই ক্ষমতা সীমিত সময়ের জন্য। কখন এবং কিভাবে সে ক্ষমতার অবসান হবে, তা ক্ষমতাপ্রাপ্তদের বোধের অন্তরালে থাকে। যখন সে ক্ষমতা বিনাশের নির্দেশ মহান সত্ত্বার তরফ থেকে আসে; তখন তা আসে অভাবিত উপায়ে। বজ্রপাতের মতো। অহংকারীর কারুন এবং তার সম্পদ গ্রাস করেছিল মাটি। আর বর্তমান যুগে অহংকারী সম্পদশালীও ধ্বংস্ব হয় জীবনে নেমে আসা আকস্মিক দুর্বিপাকে কিম্বা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। আর সম্পদ সঞ্চয়ের কোনো সীমা নেই। কারণ মহান একক সত্ত্বা যাকে সম্পদ দেন তাকে প্রচুর দেন। বিশ্বের কোনো শক্তি ঠেকাতে পারে না। আর এই প্রাপ্তি তাকে সীমাহীন আশার দিকে নিয়ে যায়; যা তার জীবনে কখনোই পুরণ হবার নয়। আকস্মাৎ মৃত্যু তার স্বপ্নের সৌধকে এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যে, সে কোনো অবস্থাতেই দুনিয়া ছেড়ে যেতে চায় না। কিন্তু তার কোনো সম্পদ কিম্বা গর্বিত সন্তানরা তার চলে যাওয়াকে আটকাতে পারে না। কার্যত তার অর্জিত সকল সম্পদের বোঝা নিয়েই সে কারুনের মতোই মাটিতে গ্রাস হয়।
যদি কেউ মহান সত্ত্বার প্রদত্ত ক্ষমতাকে নিজের অর্জিত কিম্বা জনগণ বা কর্মী-সমর্থক দ্বারা প্রাপ্ত বলে মনে করেন, তবে সে মূলত ফানুসের তৈরি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আছে। সে সিংহাসন দেখতে বিস্ময়কর; কিন্তু নিমিষে বাতাসে মিলিয়ে যায়। আসলে শাসকরা বিবেকহীন নেতা-কর্মীদের আনুগত্য এমনভাবে পেতে থাকে, যা তাকে তার স্রষ্টার আনুগত্য ভুলিয়ে দেয়। ফলে অহংকার তাকে আজাজিল কিম্বা দাজ্জালের পর্যায়ে নিয়ে যায়। আজাজিল যেমন আগুনের তৈরি বলে অহংকার করে আদম আ.-কে সিজদা করার মহানের নির্দেশ অমান্য করেছিল। তেমনি দাজ্জাল মহান সত্ত্বা প্রদত্ত ক্ষমতা বলে এতটা দিশেহারা হয়ে পড়বে যে, সে একহাতে বেহেস্ত এবং অপর হাতে দোজখ নিয়ে মানুষকে বলবে, আমার কথা যে শুনবে সে বেহেস্ত যাবে, আর যে আমার কথা অমান্য করবে সে দোজখে যাবে। মূলত হবে উল্টোটা। অর্থাৎ যে দাজ্জালের কথা শুনবে সে যাবে দোজখে; আর যে অমান্য করবে সে যাবে বেহেস্তে। বর্তমান যুগেও দাজ্জালের মতো আচরণ দৃশ্যমান। ক্ষমতাশালীরা তাদের অন্যায় কাজের সমর্থকদের নানাভাবে পুরস্কৃত করে। আর সমর্থকরা পুরস্কার পেতে পেতে আরো প্রাপ্তির লোভে আনুগত্যের মাত্রা এমন পর্যায়ে নিয়ে যায়; যা শেষ পর্যন্ত পুরস্কারদাতাকে ‘দেবতার’ আসনে বসিয়ে দেয়। তারা অনেকটা দাজ্জালের অনুসারীদের মতো। দিকবিদিক ধ্বংসকারী এমন ক্ষমতাবান দাজ্জাল মাত্র একটা শরাঘাতেই ধ্বংস হয়ে যাবে।
আর শাসকরা যে ক্ষমা নিয়ে দম্ভ করেনব, তার সীমা কতদূর পর্যন্ত। কোনো দাম্ভিক ক্ষতাবান শাসক, বড়জোর তার শত্রু একজন মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে, কিম্বা জেলে আটকিয়ে জুলুম নির্যাতন করতে পারে। অথবা পারে নানাভাবে হয়রানি করতে। এর বেশি আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। অথচ সে যখন আল্লাহ প্রদত্ত ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়বে; তখন সুবিধাভোগী পুজারীদের কাউকেই সে পাশে পাবে না। অতীত তার সাক্ষী।
পরিশেষে পারস্য সম্রাট খসরু পারভেজের পরিণতি সম্পর্কে এখানে উল্লেখ করতে চাই। অনেকের জানা আছে যে, মক্কা বিজয়ের পর রাসূল পাক সা. মদিনায় প্রত্যাবর্তন করে রোম, মিশর, ইয়েমেন ও পারস্যসহ বিভিন্ন দেশের শাসকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত সম্বলিত চিঠি পাঠান। এদের মধ্যে পারস্য সম্রাট খসরু ছিল বেপরোয়া ও অহংকারী। তার ঔদ্ধত্য সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে অহংকারের এতটা অন্ধ ছিল যে, রাসূল সা. চিঠি ছিড়ে টুকরো করে ফেলেন। তার এই ঔদ্ধত্য সম্পর্কে ইরানের প্রসিদ্ধ কবি হাকিম নিযামী তার এ কবিতায় উল্লেখ করেন- অহংকারী যে, নেই তার অন্তঃদৃষ্টি। আত্মম্ভরিতায় তার নেই কোনো গুণ ও নিপুনতা। কবিতার আরেক জায়গায় তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন, পত্রখানা সে ছিঁড়ে করলো টুকরো টুকরো, আসলে পত্র নয়; বরং নিজেকেই ছিঁড়ে করল টুকরো টুকরো।
মহানবী সা. সম্রাট খসরুর ঔদ্ধত্যের কথা শুনে বললেন, হে আল্লাহ! তার রাজত্বকে টুকরো টুকরো করে দিন। বেয়াকুফ খসরু ক্ষমতার মদমত্ত হয়ে তার অধীনস্ত ইয়েমেনের শাসনকর্তাকে নির্দেশ দেন মহানবী সা.-কে গ্রেফতার করার জন্য। নির্দেশ পেয়ে ইয়েমেন শাসনকর্তা জান দু’জন সেনাপতি পাঠান রাসূল সা.-কে গ্রেফতার করার জন্য। তারা রাসূলের সা. সঙ্গে সাক্ষাত করে ইয়েমেনের শাসনকর্তার গ্রেফতারের নির্দেশ সম্বলিত চিঠি হস্তান্তর করেন। মহানবী তাদের বললেন, আজকে আপনারা যান। আগামীকাল আপনাদের আমার মত জানাবো।
ওইদিনই মহানবী সা. ওহি মারফত জানতে পারলেন যে, খসরু পারভেজ নিহত হয়েছে। পরদিন ওরা দু’জন রাসূলের সা. কাছে উপস্থিত হলে তিনি বললেন, ‘আমার পালনকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, খসরু পারভেজকে তার পুত্র শিরাজই হত্যা করেছে এবং সে নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেছে।
পরবর্তীতে ইয়েমেন ও পারস্য মুসলিম শক্তির কাছে পদানত হয়।
বর্তমান যুগেও রাসূলের সা. বহু উম্মত আছেন যাদের কথা আল্লাহ শোনেন। আর সীমা লংঘনকারীকে তো আল্লাহই নিজেই পছন্দ করেন না। তাই সে মহান সত্ত্বা আল্লাহ-তালা বলেছেন, ‘অহংকার তথা অহমিকা আমার চাদর এবং মহত্ব আমার পায়জামা। যে লোক এ দু’টি বিষয়ে আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে, আমি তাকে ধ্বংস করে দেব’। আল্লাহপাক আরো বলেছেন, ‘জমিনে যারা অন্যায়ভাবে গর্ব করে, আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী থেকে সরিয়ে দেব’।
এলাহী নেওয়াজ খান: সাংবাদিক
No comments