একটি মৃত্যু, দুটি রিপোর্ট by সজল জাহিদ
দুটি রিপোর্ট তৈরি। এখন ছাপার অপেক্ষা। যে কোনো দিন সমকালের ভালো জায়গা নিয়ে ছাপার কথা। সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আগেভাগে কথা বলে তৈরি করা রিপোর্ট দুটিতে জিয়া আহমেদের গুরুত্বপূর্ণ কমেন্ট রয়েছে। আরও কয়েকটির পরিকল্পনাও তৈরি। কেবল রিপোর্টের কাঠামোতে ফেলা বাকি।
সেখানেও তার মন্তব্যই গুরুত্ব পাওয়ার কথা; কিন্তু জিয়া আহমেদ নেই।
ক্যালেন্ডারে সোমবার শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনিই 'খবর'। অথচ বহুবার বড় বড় খবরের উৎস হয়েছেন মানুষটি। ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই জেনেও যাই। ঘুম ভাঙানো মোবাইলের ও-প্রান্তের কণ্ঠ মৃত্যুর খবরটা যখন দিল, অস্বীকার করছি না, না ছাপা ওই দুটি রিপোর্টের কথা বিদ্যুৎগতিতে মাথায় ঝিলিক দিয়েছে। তাহলে দুটি রিপোর্টের মৃত্যুও কি হলো? আরও যেটি মাথায় এলো, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও তরতাজা মানুষটি টেলিফোনে তার উচ্ছ্বাস, উদ্বেগ অনেক কিছুই বলেছেন। বলেছেন, একদিন পরের টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তিনি কী বলবেন? কীভাবে বলবেন, সেটিও। আজ সংসদীয় কমিটির সেই বৈঠক! তবে লিখতে লিখতেই জেনেছি, বৈঠক স্থগিত হয়েছে।
যে কয়জন রিপোর্টারের সঙ্গে জিয়া আহমেদের সবচেয়ে বেশি মতদ্বৈধতা হয়েছে, বিবাদ হয়েছে; নিঃসন্দেহে তাদের একেবারে শীর্ষে আমি। দিনের পর দিন তিনি আমাকে, সমকালকে এড়িয়ে গেছেন। 'খোঁচা ছাড়া তুমি কোনো প্রশ্ন করতে পার না?' এমন কথা তিনি অনেকবার শুনিয়েছেন। ভালো রিপোর্টের জন্য ডেকে শুভেচ্ছা জানাতেও কি ভুল করেছেন? না। রিপোর্ট তার বিপক্ষে গেছে; লাল কালিতে প্রধান শিরোনামে ছাপা হয়েছে, তারপরও সকলের সামনে জড়িয়ে ধরেছেন। বলেছেন, 'এই শেষ। আর এগিয়ো না।' তার এমন সরল আত্মসমর্পণের সাক্ষী অনেকেই আছেন। রিপোর্টার হিসেবে, এই হচ্ছে আমার চোখে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জিয়া আহমেদ। নামের আগে যার মেজর জেনারেলও লেখা হয়। কিন্তু তাতে তার কোনো অহমিকা দেখিনি। সাংবাদিকের ছেলে হওয়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে হৃদ্যতাও ছিল ঢের। যার শুরু '৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকার সময়ে। সৈনিকের পোশাক থেকে জিয়া আহমেদ শেলী নামে গান-কবিতাও বেরিয়েছে।
স্বীকার করছি, তিন বছরের মেয়াদ শেষে গত ফেব্রুয়ারিতে যখন আরও এক বছরের দায়িত্ব পান তখন খুশি হতে পারিনি। তখনও তিনি আমার ফোন ধরেন না। এড়িয়ে চলেন। সংবাদ সম্মেলনেও পারতপক্ষে আমার প্রশ্নের উত্তরও দেন না। কিন্তু সবার আগে সমকালে যখন খবরটা ছাপা হয়, ফোন করতে ভোলেননি।
রোববার রাতেও যখন কথা বলি তখন নিজের বিয়েবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আত্মীয়স্বজন নিয়ে খাচ্ছেন। অনুষ্ঠানটা নিয়ে তার মধ্যে মৃদু লজ্জাও ছিল। কথার একটি বিষয় ছিল, গত ছয় মাসে কতগুলো মোবাইল সিম বন্ধ হয়েছে? 'সংখ্যাটি তার জানা নেই' জানিয়ে, সকালে ফোন দিতে বললেন। সকালেই তো তিনি সকল নেটওয়ার্কের বাইরে।
আবার গতকাল দুপুরে যখন সাদামাটা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে তার শবদেহের চলে যাওয়া দেখছি মনে হয়েছে, এই মৃত্যু তো সাড়ে নয় কোটি মোবাইল গ্রাহকের জন্যও দুঃখের। যারা অপেক্ষায় রয়েছেন দশ সেকেন্ডের পালস উপভোগের তাদের জন্য এটি বেশি কষ্টের। মোবাইল ব্যবহারকারী মাত্রই জানেন, দশ সেকেন্ডের পালস নিয়ে 'যুদ্ধে' নেমেছিলেন তিনি। এরপর এক সেকেন্ডের পালসের পরিকল্পনাও মাথায় রেখেছিলেন।
একটুখানি তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায়ও যারা আছেন তাদের সবারই জানা, মোবাইল ফোনের স্পেকট্রাম পুনর্বিন্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী সহজে করেছেন। একটি সিদ্ধান্তে সরকারের হাতে আসে ১৮শ' ব্যান্ডের ১৫ দশমিক ৬ মেগাহার্ডস স্পেকট্রাম। বাজারমূল্যে যা দুই হাজার কোটি টাকার সমান। নানা জটিলতার পরও চার মোবাইল অপারেটরের দ্বিতীয় প্রজন্মের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে। তৈরি করেছেন তৃতীয় প্রজন্মের নীতিমালাও। গ্রামের কৃষক আর শহরের রিকশাচালক এই দুই শ্রেণীকে সবচেয়ে সহজে মোবাইল প্রযুক্তির কাছে আনতে চেয়েছেন তিনি। বিটিআরসির মাধ্যমে কোনো সরকারি সংস্থাকে প্রথম ফেসবুকের মাধ্যমে জনগণের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব থেকেও তো তাকে বঞ্চিত করা যাবে না।
মোবাইল অপারেটররা হয়তো তার অনেক সিদ্ধান্তে খুশি হননি। কিন্তু সরকারের কোষাগারে টাকা আসছে, এই খবর অনেক সাধারণকেও দিয়েছে অসাধারণ আনন্দ। এই আনন্দ, বেদনা হয়ে গতকাল গড়িয়ে পড়ার দুঃখও কাল দেখেছি অনেকের চোখে।
সজল জাহিদ :সাংবাদিক
No comments