হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় ৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন- বিচার শুরুর নির্দেশ আদালতের

ভিন্নধর্মী খ্যাতিমান লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় ৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সোমবার ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় অভিযোগ


গঠন করেন। এর আগে গত ১৪ মে ৫ আসামির বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলায় সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করায় হত্যাচেষ্টা মামলাটি হত্যা মামলায় পরিণত হয়। গত বছরের ২২ মে হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করেন দেলওয়ার হোসেন সাঈদী।
সোমবার আদালতে দেয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাক্ষ্য প্রমাণ, চিকিৎসা প্রতিবেদন, জার্মানি থেকে পাঠানো মৃত্যু সনদ, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ও শবদেহ পরীক্ষার (অটোপসি) প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, হামলার শিকার হওয়ার পর হুমায়ুন আজাদ হাইপারটেনশন রোগে আক্রান্ত হন। আসামিদের আক্রমণের কারণেই এই লেখকের মৃত্যু হয়।
হত্যা মামলায় মিজানুর রহমান মিনহাজ ওরফে শফিক ওরফে শাওন ওরফে হামিম ওরফে হাসিম, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহীদ, নূর মোহাম্মদ শামীম ওরফে জেএম মবিন ওরফে সাবু, সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে সজীব ওরফে তাওহিদ ও হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব ওরফে রাসেলকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। আসামিরা জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা। পরবর্তীতে আসামিরা শিবির থেকে জেএমবিতে যোগ দেয়।
মামলার অভিযোগ গঠনকালে মামলার বাকি ৪ আসামিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দিলে আসামিরা নিজেদের নির্দোষ বলে দাবি করে। একইসঙ্গে আসামিরা আদালতে নিজেদের পক্ষে নিজেরাই শুনানি করে। তদন্তে হুমায়ুন আজাদ হত্যাকা-ে দোষ প্রমাণিত না হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির কারাবন্দী দেলওয়ার হোসেন সাঈদীকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের ২০ নবেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় হুমায়ুন আজাদের লেখা উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ প্রকাশিত হয়। উপন্যাসে মৌলবাদীদের আসল চেহারা প্রকাশ পেয়ে যায়। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলা থেকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে বাসায় ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়।
হামলাকারীরা হুমায়ুন আজাদকে এলোপাতাড়িভাবে ছুরিকাঘাত করে। হুমায়ুন আজাদের চিৎকারে লোকজন জমে গেলে কিলিং স্কোয়াডের সদস্যরা বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। সেখানে তাঁকে ২২ দিন চিকিৎসা দেয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ব্যাঙ্ককে পাঠানো হয়। সেখানে ৪৮ দিন চিকিৎসাধীন রাখা হয়। সর্বশেষ ওই বছরই তাঁকে পাঠানো হয় জার্মানির মিউনিখে। ওই বছরের ১২ আগস্ট মিউনিখেই তিনি মারা যান।
হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার ঘটনায় তাঁর ছোট ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের জবানবন্দী গ্রহণ করেন। জবানবন্দীতে হুমায়ুন আজাদ তাঁর উপরে হামলার পেছনে জামায়াত, শিবির তথা মৌলবাদীদের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন। জবানবন্দীতে তিনি আরও দাবি করেন, তাঁকে মানসিকভাবে ঘায়েল করতে নানাভাবে চেষ্টা চালানো হয়েছে। তাঁর পেছনে ছাত্রশিবিরের বেশকিছু ছাত্রকে লেলিয়ে দেয়া হয়। এ ছাত্ররা তাঁর চলাফেরার সময় কাছাকাছি গিয়ে তাঁকে পাগল, মাথা খারাপ, অসভ্য, উন্মাদ বলে টিপ্পনি কাটত। এভাবে মাসখানেক তাঁকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। এমন মানসিক নির্যাতনে প্রায়ই তিনি টিচার্স লাউঞ্জ থেকে আগে আগে রিক্সাযোগে বাসায় ফিরতেন। বিনা কাজে বাইরে যেতেন না। এরপর তাঁকে টেলিফোনে অব্যাহতভাবে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। জবানবন্দীতে এবং সাংবাদিকদের কাছে হামলার নেপথ্য জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ।
মামলা তদন্তের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১৭ এপ্রিল জেএমবির আত্মঘাতী জঙ্গী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা মিজানুর রহমান শাওনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে শাওন সিএমএম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। জবানবন্দীতে শাওন জানান, রাজধানীর সবুজবাগের ঝিলপাড়ের বাসায় জেএমবির শুরা কমিটির সভায় হুমায়ুন আজাদকে হত্যার চূড়ান্ত পরিকল্পনা হয়। সভায় ফাঁসিতে মৃত্যু কার্যকর হওয়া শীর্ষ জঙ্গী নেতা শায়খ রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ জেএমবির শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই উপস্থিত ছিলেন। হত্যার জন্য জেএমবির সামরিক শাখার কমান্ডার আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে শহীদ ওরফে ভাগ্নে শহীদ (প্রসঙ্গত, জেএমবির গ্রেফতারকৃত আমির সাইদুর রহমানের স্ত্রী জেএমবির অর্থ শাখার গ্রেফতারকৃত কর্ণধার খেজুর কনে কামরুন্নাহার হিমুর বোন জামাই শহীদ), মিজানুর রহমান শাওন, আব্দুল আউয়াল (ফাঁসিতে মৃত্যু) ও শামীমসহ কয়েকজনকে নিয়ে একটি বিশেষ স্কোয়াড গঠন করা হয়। ওই স্কোয়াডটিই অধ্যাপক আজাদের ওপর হামলা চালায়।

No comments

Powered by Blogger.