শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন- চা বেচে বিদ্যালয় by গাজীউল হক
বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন! হাঁটেন লাঠিতে ভর দিয়ে। বিদ্যালয়ের বারান্দা ধরে এগোচ্ছেন। বাঁ হাতে চায়ের পেয়ালা। চকিতে নজর বুলিয়ে ঢুকে পড়েন একটি শ্রেণীকক্ষে। তাঁকে দেখে শিক্ষক খানিকটা অপ্রস্তুত; চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান তিনি। ইতস্তত করে বলেন, ‘আপনি আবার কষ্ট করে...।’
জবাবে মানুষটি স্মিত হাসেন। টেবিলের ওপর পেয়ালা নামিয়ে রাখতে রাখতে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেন, ‘পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?’ ছেলেমেয়েরা সমস্বরে বলে, ‘ভালো হচ্ছে দাদু।’ ঠোঁটের ওপর ঝুলে থাকা হাসিটা এবার ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখে। হূষ্টচিত্তে শ্রেণীকক্ষ থেকে বের হন।
বয়স তাঁর ৮২। পেশায় দোকানদার, চা বেচে দিন চলে। আরও একটি পরিচয় আছে তাঁর। তিনি এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। নাম আবদুল খালেক। কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নলুয়া চাঁদপুর গ্রামে বাড়ি। সেই গ্রামেই বছর ১৫ আগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন নলুয়া চাঁদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা তাঁকে দাদু বলে ডাকে। অনেকের কাছে এটি ‘দাদুর স্কুল’ নামে পরিচিত।
মনঃপীড়া থেকে স্কুল প্রতিষ্ঠা: কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক লাগোয়া নলুয়া চাঁদপুর গ্রাম। ১৯৩০ সালে সেই গ্রামে আবদুল খালেকের জন্ম। ১৯৪২ সালে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার বিজয়পুর উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। পারিবারিক টানাপোড়েনের কারণে পড়াটা আর এগোয়নি। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানা জিনিস বেচতেন। একসময় চা বিক্রি শুরু করেন আবদুল খালেক। সেই পাকিস্তান আমলের কথা। মহাসড়কের পাশে একটি দোকানঘর তোলেন। সেই দোকানে চা খেতে ভিড় জমাত অনেকে। নিম্নমাধ্যমিকের গণ্ডি পার না হলেও আবদুল খালেক কথা বলেন শুদ্ধ উচ্চারণে। এ নিয়ে গ্রামের অনেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত। শিক্ষিত তরুণদের নাম বিকৃত করে ডাকত তারা। বিষয়টি তাঁকে মনঃপীড়া দিত ভীষণ। তিনি ভাবতেন, শিক্ষিত না হলে গ্রামের মানুষজন সভ্যভব্য হবে না। কিন্তু এলাকায় তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নেই। ছেলেমেয়েরা পড়বে কোথায়! সেই থেকে একটি বিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন তাঁর মনে।
আবদুল খালেকের সেই স্বপ্ন বাস্তবে এসে ধরা দেয় বহু বছর পর। মুক্তিযুদ্ধের আগে সড়কের পাশে ৫২ শতাংশ জমি সাত হাজার টাকায় কিনেছিলেন। চা বেচার টাকাতেই কিনেছিলেন জমিটুকু। ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে নিজের শেষ সম্বল সেই জমিটুকুই বিদ্যালয়কে দান করে দেন।
আবদুল খালেক বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখলাম এলাকায় শিক্ষিতের হার বাড়ছে না। বহু লোক নিরক্ষর। যাঁরা শিক্ষিত তাঁদের সম্মান নেই। ওই ভাবনা থেকেই মনে করলাম, এমন কাজ করতে হবে—যাতে মরলেও মানুষ স্মরণ করে।’
তাঁকে দেখে এগিয়ে এলেন অনেকে: গ্রামের অনেকেই তাঁর স্বপ্নের কথা জানতেন। একটি বিদ্যালয় করার তাগিদ গ্রামের সচেতন মানুষজনও অনুভব করতেন। কিন্তু সে জন্য অনেক জমির প্রয়োজন। সে জমি কেনার টাকা মিলবে কোত্থেকে! এ প্রশ্নেই আটকে ছিল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। সে উদ্যোগের পালে হাওয়া দিতে এগিয়ে এলেন আবদুল খালেক। দান করলেন সড়কের পাশের জমিটুকু। তাঁর মহানুভবতা দেখে এগিয়ে এলেন আরও অনেকে। কেউ টিন দেন, কেউ বাঁশ-কাঠ, কেউ বা দেন টাকা। গ্রামের মানুষের সহায়তায় দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে যায় প্রায় ৬০ ফুট টিনের ঘরটি। সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লেখা হয় আবদুল খালেকের নাম।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ বলেন, ‘এখন স্কুলে সাড়ে ৮৬ শতক জমি আছে। এর মধ্যে আবদুল খালেক ৫২ শতক দিয়েছেন। বাকি সাড়ে ৩৪ শতক এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে কিনেছেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হলে কমপক্ষে ৭৫ শতক জমির প্রয়োজন। তাই আবদুল খালেকের উদ্যোগকে টেনে নিয়ে গেছেন গ্রামবাসী।’ এলাকাবাসী জানায়, তারা সহযোগিতা করেছে ঠিকই। কিন্তু বাতি জ্বালিয়েছেন আবদুল খালেকই।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘তিনি যে ওই জায়গা বিদ্যালয়ের নামে লিখে দেবেন, ভাবতেই পারিনি। আমাকে জায়গাটি দেখিয়ে একদিন বলেছিলেন, “এখানে হাইস্কুল হবে। আপনি হবেন এর প্রথম সভাপতি।” এত বড় ত্যাগ আমাদের সমাজে এ পর্যায়ের মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।’
পেলেন স্কুল, হারালেন অর্ধাঙ্গিনী: সকিনা আক্তার ও আবদুল খালেক দম্পতির ঘরে ছেলেমেয়ে ছিল না। শুরুতে জমিদানের কথা শুনে স্ত্রী আবদুল খালেককে ‘পাগল’ ঠাওরেছিলেন। ১৯৯৯ সালের ৫ অক্টোবর বিদ্যালয় দেখতে যান সকিনা। বাড়ি ফেরার পথে বিদ্যালয়ের সামনে এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। সেদিন জিপ গাড়িটি চাঁদপুরের দিকে যাচ্ছিল। সকিনার শাড়ির আঁচল গাড়ির পেছনে আটকে যায়। গাড়িটি তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় শাহরাস্তির নাওড়া-বানিয়াচং এলাকা পর্যন্ত। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে। এরপর থেকে আবদুল খালেক একাই আছেন। বিদ্যালয়ের পাশেই তাঁর চায়ের দোকান। দোকানে থাকেন সারা দিন, রাতে সেখানেই ঘুম। কিছু বিস্কুট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী রাখেন দোকানে। এগুলো বেচে দিনে শ তিনেক টাকা পান। তা দিয়েই চলে যায় তাঁর।
বিদ্যালয়ের ঠিকুজি: ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি ৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে নলুয়া চাঁদপুর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এমপিওভুক্ত হয় ২০০৪ সালে। বর্তমানে এখানে পাঁচজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন। আছেন খণ্ডকালীন আরও পাঁচজন শিক্ষক। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে ২০৫ জন। এ বছর থেকে নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি উচ্চবিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে।
বিদ্যালয়টি থেকে ২০১০ সালে ৩৮ জন শিক্ষার্থী জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করে শতভাগ। গত বছর ৪২ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ৩৯ জন। সহশিক্ষণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিদ্যালয়ে নিয়মিত সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
আবদুল খালেক বলেন, ‘নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকা অবস্থায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা যখন বিদায় নিত, তখন হাউমাউ করে কাঁদতাম। এখন উচ্চবিদ্যালয় হওয়ায় বেশ ভালো লাগছে।’
দরদি মানুষটির আক্ষেপ: কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের উত্তরে বিদ্যালয়টি অবস্থিত। টিনের লম্বা ঘরটিতে চারটি শ্রেণীকক্ষ। এ ঘরের পশ্চিমে আছে তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি আধপাকা ভবন। এর একটিতে শিক্ষকেরা বসেন, বাকি দুটি শ্রেণীকক্ষ। কিন্তু কোনো কক্ষেই বৈদ্যুতিক পাখা নেই।
‘বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎই নেই, পাখা দিয়ে কী হবে! প্রচণ্ড গরমে শিক্ষার্থীরা হাঁসফাঁস করে। মাত্র দুটি খুঁটি বসালেই বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। অথচ এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।’ আক্ষেপ ঝরে আবদুল খালেকের কণ্ঠে। তিনি বিদ্যালয়ে দলাদলি পছন্দ করেন না। তাঁর স্বপ্নের বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়ে রাজনীতি রয়েছে।
যা-ই ঘটুক, রোজ দুবার বিদ্যালয়ে যান, সবার খোঁজখবর নেন। নিজে চা বানিয়ে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের বিনা পয়সায় চা খাওয়ান। সম্প্রতি বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের চা খাওয়ানোর ওই দৃশ্য দেখা যায়। অবশ্য এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। আগের মতো রোজ চা-বিস্কুট নিয়ে যেতে পারেন না। আবদুল খালেকের কথায়, ‘চা পানে ক্লান্তি দূর হয়, পাঠদানেও আগ্রহের সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের সতেজ রাখার জন্য চা খাওয়াই।’
সবাই যা বলেন: বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রহিমা আক্তার ও মাহফুজুর রহমান বলে, দাদু লাঠিতে ভর দিয়ে প্রতিদিন স্কুলে আসেন। আমাদের ক্লাস নিয়মিত হয় কি না জিজ্ঞেস করেন।
নলুয়া চাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্যাহ বলেন, ‘এখনো আবদুল খালেক দুই বেলা বিদ্যালয়ে এসে আমাদের কার্যক্রম তদারক করেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ আমাদের উজ্জ্বীবিত করে।’
বিদ্যালয় এলাকার ইউপি সদস্য ও লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুর রশিদ বলেন, ‘তিনি আমাদের এলাকার দানবীর। রাস্তার পাশের দামি জমিটাই তিনি বিদ্যালয়ের জন্য দান করেছেন।’
বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কবির উদ্দীন বলেন, ‘আবদুল খালেকের এমন উদ্যোগ সমাজ ও রাষ্ট্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। চা বিক্রি করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ত্যাগী মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তিনি ওই এলাকার বাতিঘর।’
আবদুল খালেক চা বানান, আর শিক্ষার্থীদের হই-হুল্লোড় দেখেন। এসব দেখে তাঁর প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফলাফল দেখে চোখ বুজতে চান সাদা মনের এই মানুষটি।
বয়স তাঁর ৮২। পেশায় দোকানদার, চা বেচে দিন চলে। আরও একটি পরিচয় আছে তাঁর। তিনি এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। নাম আবদুল খালেক। কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার নলুয়া চাঁদপুর গ্রামে বাড়ি। সেই গ্রামেই বছর ১৫ আগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন নলুয়া চাঁদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা তাঁকে দাদু বলে ডাকে। অনেকের কাছে এটি ‘দাদুর স্কুল’ নামে পরিচিত।
মনঃপীড়া থেকে স্কুল প্রতিষ্ঠা: কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক লাগোয়া নলুয়া চাঁদপুর গ্রাম। ১৯৩০ সালে সেই গ্রামে আবদুল খালেকের জন্ম। ১৯৪২ সালে চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার বিজয়পুর উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন তিনি। পারিবারিক টানাপোড়েনের কারণে পড়াটা আর এগোয়নি। মানুষের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নানা জিনিস বেচতেন। একসময় চা বিক্রি শুরু করেন আবদুল খালেক। সেই পাকিস্তান আমলের কথা। মহাসড়কের পাশে একটি দোকানঘর তোলেন। সেই দোকানে চা খেতে ভিড় জমাত অনেকে। নিম্নমাধ্যমিকের গণ্ডি পার না হলেও আবদুল খালেক কথা বলেন শুদ্ধ উচ্চারণে। এ নিয়ে গ্রামের অনেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত। শিক্ষিত তরুণদের নাম বিকৃত করে ডাকত তারা। বিষয়টি তাঁকে মনঃপীড়া দিত ভীষণ। তিনি ভাবতেন, শিক্ষিত না হলে গ্রামের মানুষজন সভ্যভব্য হবে না। কিন্তু এলাকায় তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নেই। ছেলেমেয়েরা পড়বে কোথায়! সেই থেকে একটি বিদ্যালয় গড়ার স্বপ্ন তাঁর মনে।
আবদুল খালেকের সেই স্বপ্ন বাস্তবে এসে ধরা দেয় বহু বছর পর। মুক্তিযুদ্ধের আগে সড়কের পাশে ৫২ শতাংশ জমি সাত হাজার টাকায় কিনেছিলেন। চা বেচার টাকাতেই কিনেছিলেন জমিটুকু। ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে নিজের শেষ সম্বল সেই জমিটুকুই বিদ্যালয়কে দান করে দেন।
আবদুল খালেক বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখলাম এলাকায় শিক্ষিতের হার বাড়ছে না। বহু লোক নিরক্ষর। যাঁরা শিক্ষিত তাঁদের সম্মান নেই। ওই ভাবনা থেকেই মনে করলাম, এমন কাজ করতে হবে—যাতে মরলেও মানুষ স্মরণ করে।’
তাঁকে দেখে এগিয়ে এলেন অনেকে: গ্রামের অনেকেই তাঁর স্বপ্নের কথা জানতেন। একটি বিদ্যালয় করার তাগিদ গ্রামের সচেতন মানুষজনও অনুভব করতেন। কিন্তু সে জন্য অনেক জমির প্রয়োজন। সে জমি কেনার টাকা মিলবে কোত্থেকে! এ প্রশ্নেই আটকে ছিল বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ। সে উদ্যোগের পালে হাওয়া দিতে এগিয়ে এলেন আবদুল খালেক। দান করলেন সড়কের পাশের জমিটুকু। তাঁর মহানুভবতা দেখে এগিয়ে এলেন আরও অনেকে। কেউ টিন দেন, কেউ বাঁশ-কাঠ, কেউ বা দেন টাকা। গ্রামের মানুষের সহায়তায় দেখতে দেখতে দাঁড়িয়ে যায় প্রায় ৬০ ফুট টিনের ঘরটি। সাইনবোর্ডে প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে লেখা হয় আবদুল খালেকের নাম।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্লাহ বলেন, ‘এখন স্কুলে সাড়ে ৮৬ শতক জমি আছে। এর মধ্যে আবদুল খালেক ৫২ শতক দিয়েছেন। বাকি সাড়ে ৩৪ শতক এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে কিনেছেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হলে কমপক্ষে ৭৫ শতক জমির প্রয়োজন। তাই আবদুল খালেকের উদ্যোগকে টেনে নিয়ে গেছেন গ্রামবাসী।’ এলাকাবাসী জানায়, তারা সহযোগিতা করেছে ঠিকই। কিন্তু বাতি জ্বালিয়েছেন আবদুল খালেকই।
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘তিনি যে ওই জায়গা বিদ্যালয়ের নামে লিখে দেবেন, ভাবতেই পারিনি। আমাকে জায়গাটি দেখিয়ে একদিন বলেছিলেন, “এখানে হাইস্কুল হবে। আপনি হবেন এর প্রথম সভাপতি।” এত বড় ত্যাগ আমাদের সমাজে এ পর্যায়ের মানুষের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না।’
পেলেন স্কুল, হারালেন অর্ধাঙ্গিনী: সকিনা আক্তার ও আবদুল খালেক দম্পতির ঘরে ছেলেমেয়ে ছিল না। শুরুতে জমিদানের কথা শুনে স্ত্রী আবদুল খালেককে ‘পাগল’ ঠাওরেছিলেন। ১৯৯৯ সালের ৫ অক্টোবর বিদ্যালয় দেখতে যান সকিনা। বাড়ি ফেরার পথে বিদ্যালয়ের সামনে এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। সেদিন জিপ গাড়িটি চাঁদপুরের দিকে যাচ্ছিল। সকিনার শাড়ির আঁচল গাড়ির পেছনে আটকে যায়। গাড়িটি তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় শাহরাস্তির নাওড়া-বানিয়াচং এলাকা পর্যন্ত। পরে স্থানীয় লোকজন তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে। এরপর থেকে আবদুল খালেক একাই আছেন। বিদ্যালয়ের পাশেই তাঁর চায়ের দোকান। দোকানে থাকেন সারা দিন, রাতে সেখানেই ঘুম। কিছু বিস্কুট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী রাখেন দোকানে। এগুলো বেচে দিনে শ তিনেক টাকা পান। তা দিয়েই চলে যায় তাঁর।
বিদ্যালয়ের ঠিকুজি: ১৯৯৭ সালের ১ জানুয়ারি ৭০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে নলুয়া চাঁদপুর নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এমপিওভুক্ত হয় ২০০৪ সালে। বর্তমানে এখানে পাঁচজন এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন। আছেন খণ্ডকালীন আরও পাঁচজন শিক্ষক। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থী আছে ২০৫ জন। এ বছর থেকে নবম-দশম শ্রেণীর শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি উচ্চবিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে।
বিদ্যালয়টি থেকে ২০১০ সালে ৩৮ জন শিক্ষার্থী জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করে শতভাগ। গত বছর ৪২ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ৩৯ জন। সহশিক্ষণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে বিদ্যালয়ে নিয়মিত সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
আবদুল খালেক বলেন, ‘নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকা অবস্থায় অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা যখন বিদায় নিত, তখন হাউমাউ করে কাঁদতাম। এখন উচ্চবিদ্যালয় হওয়ায় বেশ ভালো লাগছে।’
দরদি মানুষটির আক্ষেপ: কুমিল্লা-চাঁদপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের উত্তরে বিদ্যালয়টি অবস্থিত। টিনের লম্বা ঘরটিতে চারটি শ্রেণীকক্ষ। এ ঘরের পশ্চিমে আছে তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি আধপাকা ভবন। এর একটিতে শিক্ষকেরা বসেন, বাকি দুটি শ্রেণীকক্ষ। কিন্তু কোনো কক্ষেই বৈদ্যুতিক পাখা নেই।
‘বিদ্যালয়ে বিদ্যুৎই নেই, পাখা দিয়ে কী হবে! প্রচণ্ড গরমে শিক্ষার্থীরা হাঁসফাঁস করে। মাত্র দুটি খুঁটি বসালেই বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। অথচ এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।’ আক্ষেপ ঝরে আবদুল খালেকের কণ্ঠে। তিনি বিদ্যালয়ে দলাদলি পছন্দ করেন না। তাঁর স্বপ্নের বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়ে রাজনীতি রয়েছে।
যা-ই ঘটুক, রোজ দুবার বিদ্যালয়ে যান, সবার খোঁজখবর নেন। নিজে চা বানিয়ে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের বিনা পয়সায় চা খাওয়ান। সম্প্রতি বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকদের চা খাওয়ানোর ওই দৃশ্য দেখা যায়। অবশ্য এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। আগের মতো রোজ চা-বিস্কুট নিয়ে যেতে পারেন না। আবদুল খালেকের কথায়, ‘চা পানে ক্লান্তি দূর হয়, পাঠদানেও আগ্রহের সৃষ্টি হয়। শিক্ষকদের সতেজ রাখার জন্য চা খাওয়াই।’
সবাই যা বলেন: বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী রহিমা আক্তার ও মাহফুজুর রহমান বলে, দাদু লাঠিতে ভর দিয়ে প্রতিদিন স্কুলে আসেন। আমাদের ক্লাস নিয়মিত হয় কি না জিজ্ঞেস করেন।
নলুয়া চাঁদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সফিউল্যাহ বলেন, ‘এখনো আবদুল খালেক দুই বেলা বিদ্যালয়ে এসে আমাদের কার্যক্রম তদারক করেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ আমাদের উজ্জ্বীবিত করে।’
বিদ্যালয় এলাকার ইউপি সদস্য ও লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবদুর রশিদ বলেন, ‘তিনি আমাদের এলাকার দানবীর। রাস্তার পাশের দামি জমিটাই তিনি বিদ্যালয়ের জন্য দান করেছেন।’
বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কবির উদ্দীন বলেন, ‘আবদুল খালেকের এমন উদ্যোগ সমাজ ও রাষ্ট্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। চা বিক্রি করে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা ত্যাগী মানুষের পক্ষেই সম্ভব। তিনি ওই এলাকার বাতিঘর।’
আবদুল খালেক চা বানান, আর শিক্ষার্থীদের হই-হুল্লোড় দেখেন। এসব দেখে তাঁর প্রাণ জুড়িয়ে যায়। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। বিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ফলাফল দেখে চোখ বুজতে চান সাদা মনের এই মানুষটি।
No comments