পার্বত্য চট্টগ্রাম-জরিপ আগে না মালিকানা আগে by এ এম এম শওকত আলী
ভূমি অধিকারসহ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আশির দশকের পর থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি অশান্ত পরিবেশ প্রায় স্থায়ী রূপ লাভ করে। ১৯৯৭ সালে ‘শান্তিচুক্তি’র মাধ্যমে এ অশান্ত পরিবেশ অনেকাংশে শান্ত হলেও সম্পূর্ণ হয়নি। কিছুদিন আগে খাগড়াছড়ি জেলায় আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এর মূল উৎস ভূমির মালিকানা।
শান্তিচুক্তিটি আদিবাসীদের কিছু গোষ্ঠী বা সংগঠন মেনে নেয়নি। এটাও আরেকটা সমস্যা। যে অংশ মেনে নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল তারাও এখন হতাশ ও ক্ষুব্ধ। ভূমির মালিকানা সমস্যাই একটি মৌলিক সমস্যা। এ সমস্যার সমাধানেই শান্তিচুক্তিতে এ সংক্রান্ত কিছু ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট ধারায় ভূমিবিরোধের নিষ্পত্তির দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশনকে। কমিশন গঠনের জন্য ১৯৯৯ সালে একটি আইনও প্রণীত হয়। এ কমিশনের মূল দায়িত্ব ছিল আদিবাসী ও বসবাসরত বাঙালিদের ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি করা।
চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, কমিশন ভূমি জরিপের মাধ্যমে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করবে। একই সঙ্গে ভূমির মালিকানার দলিল বা রেকর্ড চূড়ান্ত করবে। এ কথা সত্য যে ভূমি জরিপের পরেই মালিকানার রেকর্ড চূড়ান্ত করা হয়। এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। জরিপ কার্যের বিভিন্ন ধাপে জরিপকর্মীরা জমি কার দখলে আছে, অন্য কোনো দাবিদার আছে কি না এসব বিষয় পরীক্ষা করে। এ জন্য শুনানির মাধ্যমে আপত্তি গ্রহণ ও নিষ্পত্তিরও বিধান রয়েছে।
ভূমি জরিপ-প্রক্রিয়া বাংলাদেশ ভূমি জরিপ আইন, বিধি ও ম্যানুয়াল অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আইনটি ব্রিটিশ আমলের। এর মধ্যে কিছু পরিবর্তনও হয়েছে, যা খুব সামান্য। ভূমি জরিপ-প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার পর ভূমির মালিকানা রেকর্ড ছাপানো হয়। এটাই হলো মালিকানার ভিত্তি। তবে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি এ বিষয়ে আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। এখানে প্রশ্নটি হলো, বাংলাদেশ ভূমি জরিপ আইন ও বিধি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আইনসিদ্ধভাবে প্রযোজ্য কি না। এ বিষয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে।
কারণ, জন্মলগ্ন থেকেই এ অঞ্চল সাধারণ শাসনবহির্ভূত অঞ্চল হিসেবে আইনে স্বীকৃত। শাসনকার্য পরিচালিত হতো পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ একটি আইনের মাধ্যমে। এর শিরোনাম হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ (রেগুলেশন ১, ১৯০০)। এর আওতায় একই সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি প্রণীত হয়। এ বিধির প্রায় বেশির ভাগই ভূমিসংক্রান্ত।
এ আইনে এ কথাও বলা ছিল যে সরকার প্রয়োজনবোধে অন্য কোনো আইনও তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট আইন এ অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য করতে পারে। ১৯০০ সাল থেকে এ তফসিলে বহু আইন স্থান পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ভূমি জরিপ আইনের কোনো উল্লেখ তফসিলে স্থান পায়নি। পার্বত্যচুক্তির ভূমিসংক্রান্ত ধারায় এটা একটা বড় দুর্বলতা, যার নিরসন হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় জরিপ করা হলেও ভূমির যে মালিকানা রেকর্ড প্রণীত হবে তা আইনের দৃষ্টিতে হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
১৯০০ সালের শাসনবিধিতে এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভূমিসংক্রান্ত বিষয়ে স্বীকৃতি ছিল। বিধিমালায় ভূমিসংক্রান্ত কিছু মালিকানা বা অন্য কোনো স্বত্ব নিবন্ধন আইনের আওতায় নিবন্ধন করার বিধানও ছিল। বিধিমালায় স্বীকৃত সনাতন আইনের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ১. বসবাসরত যেকোনো আদিবাসী বাসগৃহের জন্য শহরাঞ্চলের বাইরে ০.৩০ একর জমি গ্রামপ্রধানকে অবহিত করে ব্যবহার করতে পারবে। ২. বিধিমালা অনুযায়ী, অন্য কোনো দলিল নিবন্ধন না করা হলেও তা সংশ্লিষ্ট আদালতে অগ্রাহ্য করা হবে না।
২০০৯ সালে সম্পাদিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, আদিবাসী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালিদের জমি নিবন্ধন করার হার ৪২ শতাংশ এবং আদিবাসীদের ৩০ শতাংশ। গোত্রভেদে আদিবাসীদের মধ্যেও এ সংখ্যার তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো গোত্রের কোনো কাগজপত্রও নেই। অর্পিত দায়িত্ব পালনে কমিশন এ বিষয়ে দৃষ্টি দিলে ভালো হয়। সাম্প্রতিককালের অনেক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯৪৭ সালে বাঙালিদের সংখ্যা মোট আদিবাসীর ১০ শতাংশ ছিল। ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫০ শতাংশ। তথ্যটি এ বছর এপ্রিলে চট্টগ্রামের স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত হাইকোর্টের একটি রায়ে পাওয়া যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি কমিশন নিয়ে বিতর্ক, মালিকানা চূড়ান্ত করার জন্য প্রথমে ভূমি জরিপ করা হবে, না পরে। যত দূর মনে হয়, এ বিষয়ে শান্তিচুক্তিতে কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। ভূমি কমিশন ভূমি জরিপ করেই বিরোধের নিষ্পত্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর বিরোধিতা করছে শান্তিচুক্তির সমর্থনকারী আদিবাসী গোষ্ঠী। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন গোত্রের রাজারাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এর ফলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি-প্রক্রিয়া জটিল হয়ে উঠেছে। প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে পাহাড়িদের আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্য হওয়া উচিত।
সাধারণভাবে এ অভিমত সম্পর্কে দ্বিমত প্রকাশ করা যায় না। তবে যদি দেখা যায় যে, পরামর্শ করে কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি তাহলে কী হবে? কমিশন কি একতরফাভাবে জরিপ আগে করবে? অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ ধরনের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। আশির দশকে এ ধরনের চেষ্টা করার জন্য কিছু সরকারি জরিপকর্মীকে একটি সংগঠন অপহরণ করেছিল। এর ফলে সরকার এ পথে আর এগোয়নি। তবে আশার কথা এই যে, পার্বত্যচুক্তিতে বিষয়টি স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৯-পরবর্তী সময়ে কোনো সম্প্রদায়ের ভূমিসংক্রান্ত দখলের প্রকৃত অবস্থান জরিপের (আইনি অর্থে নয়) মাধ্যমে চিহ্নিত করা উচিত। বিশেষ করে এ বিষয়ে স্থানীয় হেডম্যান যথেষ্ট তথ্য দিতে সক্ষম হবেন। প্রয়োজনবোধে সাক্ষ্য-প্রমাণও গ্রহণ করা যায়। এটা করতে হবে শুনানির মাধ্যমে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালায় ভূমিসংক্রান্ত একটি বিধিতে অনিবাসীদের জন্য বন্দোবস্তকৃত খাসজমির উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা নিষিদ্ধ। তবে উত্তরাধিকারসংক্রান্ত মালিকানা জেলা প্রশাসক ক্ষেত্রভেদে দিতে ক্ষমতাবান। এ ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়ে অনিবাসীদের জন্য সমতানীতি (PrincipleÊof equity) অনুসরণের বিধানও রয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি সংকীর্ণ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের একমত হওয়া। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বসবাসরত আদিবাসী ও বাঙালিদের একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি। এ দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়িত্ব তখনই হবে, যখন দলমত-নির্বিশেষে সবাই শান্তি স্থাপনে সক্রিয় সহযোগিতা করবে। বর্তমানে এ পরিস্থিতি নেই। আদিবাসীরা যেমন বিভক্ত, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এ মতবিরোধ অনেকাংশে চাপা কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্য।
বাংলাদেশে সমতল ভূমির জন্য ভূমি জরিপ আর পার্বত্য চট্টগ্রামে উদূ্ভত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সমার্থক নয়। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জরিপ পরবর্তী পর্যায়ে হলেও কোনো ক্ষতি হবে না। স্থানীয়ভাবে পরিদর্শন করে ভূমি আগ্রাসনের এলাকা চিহ্নিত করাকে অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া সমীচীন হবে। এ ক্ষেত্রে অভীষ্ট লক্ষ্য হবে দখলচ্যুত আদিবাসীদের নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন। বিষয়টি কী প্রক্রিয়ায় হবে তা নির্ধারণের জন্য আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদসহ সংক্ষুব্ধ আদিবাসীদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করেই গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি সম্ভব। দখলদার বাঙালিদেরও শুনানির সুযোগ দিতে হবে। কারণ দুই পক্ষের শুনানি ছাড়া নিষ্পত্তি আইনসিদ্ধ হবে না। ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনের প্রয়োজন অনুভূত হলে তাও করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন দিকনির্দেশনার, যা পরে সংশোধনের ভিত্তি হতে পারে।
সংবাদে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজা প্রথমে ভূমি জরিপ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন। সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনাই হয়নি। সংসদে প্রধান বিরোধী দলের অব্যাহত অনুপস্থিতির ফলে এ বিষয়ে আদৌ কোনো আলোচনা হবে কি না তা প্রায় অনিশ্চিত। সময়ই সব সমস্যার সমাধান করে দেবে—এমন প্রবাদ বাক্যে অনেকে বিশ্বাসী হতে পারেন। তবে এর বিপরীতও হতে পারে। তা হলো, দীর্ঘ কালক্ষেপণে সমস্যা সরকারের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। অতীত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভূমি কমিশনের কাজের অগ্রগতি বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কমিশন গঠন করা হয়েছিল ২০০১ সালে। বর্তমানে কমিশন অবশ্য সাম্প্রতিককালে গঠিত হয়েছে। প্রায় নয় বছর পরও অবস্থা তথৈবচ। যে দিকনির্দেশনার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, তা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারে। বিকল্প হিসেবে ভূমি কমিশন স্ব-উদ্যোগে একই কাজ করতে পারে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, কমিশন ভূমি জরিপের মাধ্যমে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করবে। একই সঙ্গে ভূমির মালিকানার দলিল বা রেকর্ড চূড়ান্ত করবে। এ কথা সত্য যে ভূমি জরিপের পরেই মালিকানার রেকর্ড চূড়ান্ত করা হয়। এ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। জরিপ কার্যের বিভিন্ন ধাপে জরিপকর্মীরা জমি কার দখলে আছে, অন্য কোনো দাবিদার আছে কি না এসব বিষয় পরীক্ষা করে। এ জন্য শুনানির মাধ্যমে আপত্তি গ্রহণ ও নিষ্পত্তিরও বিধান রয়েছে।
ভূমি জরিপ-প্রক্রিয়া বাংলাদেশ ভূমি জরিপ আইন, বিধি ও ম্যানুয়াল অনুযায়ী পরিচালিত হয়। আইনটি ব্রিটিশ আমলের। এর মধ্যে কিছু পরিবর্তনও হয়েছে, যা খুব সামান্য। ভূমি জরিপ-প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার পর ভূমির মালিকানা রেকর্ড ছাপানো হয়। এটাই হলো মালিকানার ভিত্তি। তবে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি এ বিষয়ে আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। এখানে প্রশ্নটি হলো, বাংলাদেশ ভূমি জরিপ আইন ও বিধি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আইনসিদ্ধভাবে প্রযোজ্য কি না। এ বিষয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে।
কারণ, জন্মলগ্ন থেকেই এ অঞ্চল সাধারণ শাসনবহির্ভূত অঞ্চল হিসেবে আইনে স্বীকৃত। শাসনকার্য পরিচালিত হতো পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য বিশেষ একটি আইনের মাধ্যমে। এর শিরোনাম হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০ (রেগুলেশন ১, ১৯০০)। এর আওতায় একই সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি প্রণীত হয়। এ বিধির প্রায় বেশির ভাগই ভূমিসংক্রান্ত।
এ আইনে এ কথাও বলা ছিল যে সরকার প্রয়োজনবোধে অন্য কোনো আইনও তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট আইন এ অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য করতে পারে। ১৯০০ সাল থেকে এ তফসিলে বহু আইন স্থান পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ভূমি জরিপ আইনের কোনো উল্লেখ তফসিলে স্থান পায়নি। পার্বত্যচুক্তির ভূমিসংক্রান্ত ধারায় এটা একটা বড় দুর্বলতা, যার নিরসন হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় জরিপ করা হলেও ভূমির যে মালিকানা রেকর্ড প্রণীত হবে তা আইনের দৃষ্টিতে হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
১৯০০ সালের শাসনবিধিতে এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভূমিসংক্রান্ত বিষয়ে স্বীকৃতি ছিল। বিধিমালায় ভূমিসংক্রান্ত কিছু মালিকানা বা অন্য কোনো স্বত্ব নিবন্ধন আইনের আওতায় নিবন্ধন করার বিধানও ছিল। বিধিমালায় স্বীকৃত সনাতন আইনের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে দুটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। ১. বসবাসরত যেকোনো আদিবাসী বাসগৃহের জন্য শহরাঞ্চলের বাইরে ০.৩০ একর জমি গ্রামপ্রধানকে অবহিত করে ব্যবহার করতে পারবে। ২. বিধিমালা অনুযায়ী, অন্য কোনো দলিল নিবন্ধন না করা হলেও তা সংশ্লিষ্ট আদালতে অগ্রাহ্য করা হবে না।
২০০৯ সালে সম্পাদিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, আদিবাসী ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালিদের জমি নিবন্ধন করার হার ৪২ শতাংশ এবং আদিবাসীদের ৩০ শতাংশ। গোত্রভেদে আদিবাসীদের মধ্যেও এ সংখ্যার তারতম্য রয়েছে। কোনো কোনো গোত্রের কোনো কাগজপত্রও নেই। অর্পিত দায়িত্ব পালনে কমিশন এ বিষয়ে দৃষ্টি দিলে ভালো হয়। সাম্প্রতিককালের অনেক প্রবন্ধে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৯৪৭ সালে বাঙালিদের সংখ্যা মোট আদিবাসীর ১০ শতাংশ ছিল। ১৯৯১ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫০ শতাংশ। তথ্যটি এ বছর এপ্রিলে চট্টগ্রামের স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত হাইকোর্টের একটি রায়ে পাওয়া যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি কমিশন নিয়ে বিতর্ক, মালিকানা চূড়ান্ত করার জন্য প্রথমে ভূমি জরিপ করা হবে, না পরে। যত দূর মনে হয়, এ বিষয়ে শান্তিচুক্তিতে কোনো স্পষ্ট রূপরেখা নেই। ভূমি কমিশন ভূমি জরিপ করেই বিরোধের নিষ্পত্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এর বিরোধিতা করছে শান্তিচুক্তির সমর্থনকারী আদিবাসী গোষ্ঠী। পত্রিকান্তরে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন গোত্রের রাজারাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এর ফলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি-প্রক্রিয়া জটিল হয়ে উঠেছে। প্রকাশিত একটি সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে পাহাড়িদের আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে পরামর্শ করে যাচাই-বাছাই ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্য হওয়া উচিত।
সাধারণভাবে এ অভিমত সম্পর্কে দ্বিমত প্রকাশ করা যায় না। তবে যদি দেখা যায় যে, পরামর্শ করে কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি তাহলে কী হবে? কমিশন কি একতরফাভাবে জরিপ আগে করবে? অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ ধরনের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। আশির দশকে এ ধরনের চেষ্টা করার জন্য কিছু সরকারি জরিপকর্মীকে একটি সংগঠন অপহরণ করেছিল। এর ফলে সরকার এ পথে আর এগোয়নি। তবে আশার কথা এই যে, পার্বত্যচুক্তিতে বিষয়টি স্বীকৃত। এ ক্ষেত্রে ১৯৭৯-পরবর্তী সময়ে কোনো সম্প্রদায়ের ভূমিসংক্রান্ত দখলের প্রকৃত অবস্থান জরিপের (আইনি অর্থে নয়) মাধ্যমে চিহ্নিত করা উচিত। বিশেষ করে এ বিষয়ে স্থানীয় হেডম্যান যথেষ্ট তথ্য দিতে সক্ষম হবেন। প্রয়োজনবোধে সাক্ষ্য-প্রমাণও গ্রহণ করা যায়। এটা করতে হবে শুনানির মাধ্যমে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালায় ভূমিসংক্রান্ত একটি বিধিতে অনিবাসীদের জন্য বন্দোবস্তকৃত খাসজমির উত্তরাধিকার সূত্রে মালিকানা নিষিদ্ধ। তবে উত্তরাধিকারসংক্রান্ত মালিকানা জেলা প্রশাসক ক্ষেত্রভেদে দিতে ক্ষমতাবান। এ ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়ে অনিবাসীদের জন্য সমতানীতি (PrincipleÊof equity) অনুসরণের বিধানও রয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতি সংকীর্ণ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাধান করা যাবে না। এ জন্য প্রয়োজন সব রাজনৈতিক দলের একমত হওয়া। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বসবাসরত আদিবাসী ও বাঙালিদের একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টিভঙ্গি। এ দৃষ্টিভঙ্গির স্থায়িত্ব তখনই হবে, যখন দলমত-নির্বিশেষে সবাই শান্তি স্থাপনে সক্রিয় সহযোগিতা করবে। বর্তমানে এ পরিস্থিতি নেই। আদিবাসীরা যেমন বিভক্ত, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ বিষয় নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। এ মতবিরোধ অনেকাংশে চাপা কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্য।
বাংলাদেশে সমতল ভূমির জন্য ভূমি জরিপ আর পার্বত্য চট্টগ্রামে উদূ্ভত ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি সমার্থক নয়। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি জরিপ পরবর্তী পর্যায়ে হলেও কোনো ক্ষতি হবে না। স্থানীয়ভাবে পরিদর্শন করে ভূমি আগ্রাসনের এলাকা চিহ্নিত করাকে অধিকতর প্রাধান্য দেওয়া সমীচীন হবে। এ ক্ষেত্রে অভীষ্ট লক্ষ্য হবে দখলচ্যুত আদিবাসীদের নিজ ভূমিতে পুনর্বাসন। বিষয়টি কী প্রক্রিয়ায় হবে তা নির্ধারণের জন্য আঞ্চলিক পরিষদ, পার্বত্য জেলা পরিষদসহ সংক্ষুব্ধ আদিবাসীদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করেই গ্রহণযোগ্য নিষ্পত্তি সম্ভব। দখলদার বাঙালিদেরও শুনানির সুযোগ দিতে হবে। কারণ দুই পক্ষের শুনানি ছাড়া নিষ্পত্তি আইনসিদ্ধ হবে না। ভূমি কমিশন আইনের সংশোধনের প্রয়োজন অনুভূত হলে তাও করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন দিকনির্দেশনার, যা পরে সংশোধনের ভিত্তি হতে পারে।
সংবাদে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন রাজা প্রথমে ভূমি জরিপ করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন। সরকারি নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনাই হয়নি। সংসদে প্রধান বিরোধী দলের অব্যাহত অনুপস্থিতির ফলে এ বিষয়ে আদৌ কোনো আলোচনা হবে কি না তা প্রায় অনিশ্চিত। সময়ই সব সমস্যার সমাধান করে দেবে—এমন প্রবাদ বাক্যে অনেকে বিশ্বাসী হতে পারেন। তবে এর বিপরীতও হতে পারে। তা হলো, দীর্ঘ কালক্ষেপণে সমস্যা সরকারের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। অতীত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভূমি কমিশনের কাজের অগ্রগতি বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ কমিশন গঠন করা হয়েছিল ২০০১ সালে। বর্তমানে কমিশন অবশ্য সাম্প্রতিককালে গঠিত হয়েছে। প্রায় নয় বছর পরও অবস্থা তথৈবচ। যে দিকনির্দেশনার বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, তা সম্পন্ন করার লক্ষ্যে একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এ কমিটি আঞ্চলিক পরিষদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে পারে। বিকল্প হিসেবে ভূমি কমিশন স্ব-উদ্যোগে একই কাজ করতে পারে।
এ এম এম শওকত আলী: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা; সাবেক সচিব।
No comments