সাদাকালো-মহাসংকটের মুখে নাসেরের দেশ মিসর by আহমদ রফিক
সত্যিই নাসেরের দেশ মিসর আজ মহা রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। মিসরকে রাজতন্ত্রের মধ্যযুগীয় শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেন গামাল আবদুন নাসের। রাজা ফারুককে দেশ ছাড়তে হয়। গোটা মধ্যপ্রাচ্যের চোখে মধ্যমণি হয়ে ওঠে গণতন্ত্রী মিসর। এরপর ইরাকেও রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। স্লোগান ওঠে- 'নাসের আমাদের ভাই।'
কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাবও উঠেছিল, যদিও নানা কারণে তা কার্যকর হয়নি। হয়তো 'বাথ পার্টি'র অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এর নেপথ্য কারণ। সমাজবাদী 'বাথ পার্টি' শাসিত ইরাক, সিরিয়াও এককাট্টা হতে পারেনি, যদিও একসময় বিদেশনীতির ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করেছে।
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কল্যাণে সেই ইরাক শেষ। আর কত দিন তার রক্তক্ষরণ চলবে- কেউ জানে না। একই পরাশক্তির নেপথ্য টানে সিরিয়া এখন মহাদুর্যোগের সাগর পাড়ি দিচ্ছে। আর কয় দিন টিকে থাকবে, বলা কঠিন। তাদের মূল অপরাধ একটাই- সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের। ইতিমধ্যে একই পথের যাত্রী গাদ্দাফির লিবিয়া খতম।
আর মিসর? নাসেরের মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাতের শাসনে মিসরীয় রাজনীতির পার্শ্বপরিবর্তন। আসোয়ান বাঁধ নির্মাণ বোধ হয় তার উৎস সূত্র। প্রেসিডেন্ট সাদাতের আমল থেকে মিসরীয় রাজনীতি হয়ে ওঠে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদনির্ভর। তৈরি হতে থাকে ধর্মীয় রাজনীতির ভিত- সবাইকে অবাক করে দিয়ে। আনোয়ার সাদাত হত্যাকাণ্ডের পেছনে ইসলামী জঙ্গিদের তৎপরতার কথা তখনই সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল।
এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়া এবং দীর্ঘকাল শাসন, যা হয়ে ওঠে স্বৈরশাসনের নামান্তর। এর প্রতিক্রিয়া জনমনে দেখা দিতে বাধ্য। বিশেষ করে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার ও অপশাসনের মুখে। সর্বোপরি মার্কিননির্ভরতা, বেয়াড়া ইসরায়েলের সঙ্গে সখ্য। নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তি 'মুসলিম ব্রাদারহুড'। কিন্তু ওটা সঠিক পদ্ধতি ছিল না। জনসন্তোষ তৈরিতে দরকার ছিল সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু তা হয়নি বলে ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি নীরবে গোকুলে বেড়েছে। একপর্যায়ে ঘটে জনবিস্ফোরণ। তিউনিসিয়ার বাতাস বয়ে আনে মিসরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনপ্রতিবাদের ঝড়বাদল, যদিও নাম 'আরব বসন্ত'। আর সেই বাসন্তী বাতাসের টানে হোসনি মুবারকের পতন। কারাবন্দি মুবারককে এখন যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করতে হবে। বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ মুবারক কত দিন থাকবেন দণ্ডভোগ করতে- সেটাই বড় কথা।
আফ্রো-এশিয়ায় সংগ্রামে মুক্ত দেশগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্য, দুর্নীতি, ক্ষমতার লোভ ও অপব্যবহার। সেই প্রেক্ষাপটে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসন বা গণতন্ত্রের লেবেল এঁটে স্বৈরশাসনের অনাচার। এর ফলে প্রায়ই রক্ষণশীল বা ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান। উত্থান অপশাসনের প্রতিক্রিয়া। যেমন আমরা দেখেছি আলজেরিয়ায়। সেখানে একটি আত্মত্যাগী বিপ্লবের ফসল নষ্ট করে দেয় রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভ ও সামরিক শাসন। বুমেদিনের দুষু্ব পরিকল্পনার জেরে জেরবার কথিত গণতন্ত্রী আলজেরিয়া। সেখানেও জোর করে ঢাকনিচাপা দেওয়া হয়েছিল ইসলামী রাজনীতি-প্রভাবিত অসন্তোষ।
দীর্ঘ সামরিক শাসন বা স্বৈরশাসনে গণতান্ত্রিক শক্তির সাংগঠনিক ভিত তৈরি হতে পারে না সমাজে বা রাষ্ট্রযন্ত্রে তথা শাসনব্যবস্থায়। এ সহজ সত্য কোনো শাসকই বুঝতে চান না। চান না বলে নিজ হাতে গণতন্ত্রবিরোধী ধ্বংসের বীজ রোপণ করেন। পরিণামে ঘটে বিস্ফোরণ। ঘটে নির্বাচনে পরাজয়। মিসরেও তা-ই ঘটেছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো গণতন্ত্রী দলের নেতাকে পাওয়া যায়নি প্রার্থী হিসেবে। দুঃশাসনের এমন স্টিমরোলার চালিয়ে দেশ শাসন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। সেনাবাহিনীর সমর্থনে দীর্ঘ সময় ধরে।
তাঁর পতনের পর দেখা গেল, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ সাংগঠনিক শক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। তাই মুবারক শাসনের প্রতিনিধি আহমেদ শফিক (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসির প্রতিদ্বন্দ্বী। যে শাসনব্যবস্থাকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে, তার সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কেউ ভোট দেয়? না, দেয়নি।
তবু হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এর অর্থ, মানুষ ধর্মীয় জঙ্গি পার্টির প্রার্থীকে ভোট দিতে চাননি। যাঁরা দিয়েছেন নিতান্ত নিরুপায় হয়ে, বিকল্প কেউ নেই বলে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটা ছোট্ট খবর; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এক ভোটারের প্রতিক্রিয়া- মুরসিকে তো ভোট দিতে চাই না; কিন্তু ওই দুর্নীতিবাজদের প্রতিনিধিকে কিভাবে ভোট দিই। অর্থাৎ নেগেটিভ তথা নেতিবাচক ভোটে জিতেছেন ধর্মীয় রক্ষণশীল রাজনৈতিক পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা।
এখন মোহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট। বহু দিনের প্রতীক্ষিত বিজয়। সেনাবাহিনী মহা সমস্যায়। নাসেরের উত্তরাধিকার বহনকারী সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই আর আগের অবস্থায় নেই। তবু দেখা যাচ্ছে, তারা রক্ষণশীলদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বড় একটা রাজি নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের দাবি, না মেনেই বা উপায় কী? মিসরীয় বসন্ত এখন বর্ষার দুর্যোগে পরিণত।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃত গণতন্ত্র এখন বিপদের মুখে। সেনাবাহিনী কয় দিনই বা তত্ত্বাবধানের নামে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে? ইসলামবাদী প্রেসিডেন্ট যদি ইসলামী ধারার শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান প্রণয়ন করতে চান, তাহলে কী হবে? অন্যদিকে কী করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা? কী ভাবছে ইসরায়েল। ইসলামী জঙ্গি শাসন মেনে নেবে, নাকি সেনাশাসনের পক্ষে দাঁড়াবে? এখানেই যত গেরো। নাসের কি তাঁর কবরে পাশ ফিরবেন? সংশ্লিষ্টদের এখন পথ বেছে নিতে হবে। কারণ আর যা-ই হোক, মিসরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের দেশকে তো আর মুঠোর বাইরে রাখা যায় না। আসোয়ানকে কেন্দ্র করে যে কর্তৃত্ব হাতে এসেছে, তা হারানো সম্ভব নয়। কাজেই কূটসংঘাত না আপস- কোন পথ বেছে নেয় ওয়াশিংটন-ইসরায়েল শক্তিকেন্দ্র, সেটাই দেখার বিষয়। আপসই যদি হয়, সেটাই বা কী ধরনের হবে? সংবিধান রচনা করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে। মার্কিন লবি বলে কোনো কথা নয়, স্থানীয় গণতন্ত্রীদের জন্য এখন এক উভয় সংকট। ধর্মীয় রক্ষণশীলতায় পেছন হাঁটা, না অনাকাঙ্ক্ষিত সেনাশাসনের লেজ ধরে চলা। হোসনি মুবারকের অপশাসন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার কারণেই বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব। এ অবস্থায় ব্রাদারহুড এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন 'ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি'র ক্যাডার ও সমর্থক জনতা তাহ্রির স্কয়ারে আবারও প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করেছে। চলছে রাতভর বিক্ষোভ আর স্লোগান। 'নির্বাচন মেনে নাও, ক্ষমতা ফিরিয়ে দাও' গোছের স্লোগান। সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত- এটা আরেক বড় সমস্যা। তা ছাড়া ব্রাদারহুড কি সত্যি স্বাধীনতা, মুক্তি ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী? বলা কঠিন। সত্যি বলতে কী, জনসাধারণের পক্ষেও সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কাকে সমর্থন জোগাবে। আপাতত সমর্থনযোগ্য কেউ নেই শীর্ষস্থানে।
তবে একটি কথা সত্য যে এসব ক্ষেত্রে মানুষ জনস্বার্থের দিকটাই বড় করে দেখে, রাজনৈতিক আদর্শের ভালো-মন্দ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। আদর্শবাদী ব্যক্তি বা দলের জন্য এভাবে উঠে আসে সমস্যা। দেশ আদর্শ শাসনের ক্ষেত্রে বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায় কয়েক দশক। এমন উদাহরণ তো বিশ্বে কম নেই। প্রায়ই দেখা যায়, এ জাতীয় রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার মেলে না; বরং পরিস্থিতি মন্দ থেকে মন্দতর পর্যায়ের দিকে মোড় নেয়।
এখন কী করবে সেনাবাহিনী- সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু কিছুকাল আগেও তুরস্কে দেখা গিয়েছিল অনুরূপ সমস্যা। কামাল পাশার ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার বহন করা সামরিক বাহিনীকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। মিসর নাসেরের সেনাবাহিনীর এখন তেমনই আত্মিক সংকট, বলা চলে আদর্শিক সংকট। কারণ তাহ্রির স্কয়ার এখন সামরিক বাহিনীর গৃহীত পদক্ষেপও উপেক্ষা করতে চাইছে। সে ক্ষেত্রে কোনো অর্বাচীন পদক্ষেপে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিতে পারে। আর তাতে ব্রাদারহুড ও জাস্টিস পার্টির জয়লাভের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মিসরীয় সামরিক বাহিনী কি তেমন ঝুঁকি নিতে চাইবে? তবে সেনা দপ্তর যে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তেমন আলামতও অস্পষ্ট নয়। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে ব্রাদারহুড নেতাদের সঙ্গে সমঝোতামূলক আলোচনার পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।
আলোচনার মূল লক্ষ্য মিসরের শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করা। সেনাবাহিনীর পক্ষে এটা আদর্শিক দায় বলে সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন। এ ক্ষেত্রে ইসলামী ব্রাদারহুড নমনীয় না হলে সংঘাত অনিবার্য। আর সে সংঘাতে কে জয়ী হবে- সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। লক্ষ করার মতো বিষয় যে এমন এক রাজনৈতিক সংকটের মুখেও ওয়াশিংটন-ইসরায়েলের মুখে রা নেই। কেন? তারা কি স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে পারছে না! মিসরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাই এখন বড় হয়ে থাকছে। সময় দ্রুতই এর সমাধান সবাইকে জানিয়ে দেবে। তবে মনে রাখা দরকার, তাহ্রির স্কয়ারে মুবারক শাহির পতনের মূল প্রতিবাদী সমাবেশ গড়ে ক্ষুব্ধ তারুণ্য, গণতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি, পরে ইসলামপন্থীরা যোগ দিয়ে জয় ছিনিয়ে নেয় কূটকৌশলে। ঠিক যেমন দেখা গিয়েছিল বাদশাহ-খেদা আন্দোলনে, ইরানে। মিসর কি নেতার অভাবে সেই পথ ধরবে?
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের কল্যাণে সেই ইরাক শেষ। আর কত দিন তার রক্তক্ষরণ চলবে- কেউ জানে না। একই পরাশক্তির নেপথ্য টানে সিরিয়া এখন মহাদুর্যোগের সাগর পাড়ি দিচ্ছে। আর কয় দিন টিকে থাকবে, বলা কঠিন। তাদের মূল অপরাধ একটাই- সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের। ইতিমধ্যে একই পথের যাত্রী গাদ্দাফির লিবিয়া খতম।
আর মিসর? নাসেরের মৃত্যুর পর আনোয়ার সাদাতের শাসনে মিসরীয় রাজনীতির পার্শ্বপরিবর্তন। আসোয়ান বাঁধ নির্মাণ বোধ হয় তার উৎস সূত্র। প্রেসিডেন্ট সাদাতের আমল থেকে মিসরীয় রাজনীতি হয়ে ওঠে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদনির্ভর। তৈরি হতে থাকে ধর্মীয় রাজনীতির ভিত- সবাইকে অবাক করে দিয়ে। আনোয়ার সাদাত হত্যাকাণ্ডের পেছনে ইসলামী জঙ্গিদের তৎপরতার কথা তখনই সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছিল।
এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়া এবং দীর্ঘকাল শাসন, যা হয়ে ওঠে স্বৈরশাসনের নামান্তর। এর প্রতিক্রিয়া জনমনে দেখা দিতে বাধ্য। বিশেষ করে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার ও অপশাসনের মুখে। সর্বোপরি মার্কিননির্ভরতা, বেয়াড়া ইসরায়েলের সঙ্গে সখ্য। নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক শক্তি 'মুসলিম ব্রাদারহুড'। কিন্তু ওটা সঠিক পদ্ধতি ছিল না। জনসন্তোষ তৈরিতে দরকার ছিল সুশাসন, দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা; কিন্তু তা হয়নি বলে ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তি নীরবে গোকুলে বেড়েছে। একপর্যায়ে ঘটে জনবিস্ফোরণ। তিউনিসিয়ার বাতাস বয়ে আনে মিসরে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনপ্রতিবাদের ঝড়বাদল, যদিও নাম 'আরব বসন্ত'। আর সেই বাসন্তী বাতাসের টানে হোসনি মুবারকের পতন। কারাবন্দি মুবারককে এখন যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করতে হবে। বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ মুবারক কত দিন থাকবেন দণ্ডভোগ করতে- সেটাই বড় কথা।
আফ্রো-এশিয়ায় সংগ্রামে মুক্ত দেশগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে শাসনতান্ত্রিক নৈরাজ্য, দুর্নীতি, ক্ষমতার লোভ ও অপব্যবহার। সেই প্রেক্ষাপটে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসন বা গণতন্ত্রের লেবেল এঁটে স্বৈরশাসনের অনাচার। এর ফলে প্রায়ই রক্ষণশীল বা ধর্মীয় রাজনীতির উত্থান। উত্থান অপশাসনের প্রতিক্রিয়া। যেমন আমরা দেখেছি আলজেরিয়ায়। সেখানে একটি আত্মত্যাগী বিপ্লবের ফসল নষ্ট করে দেয় রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভ ও সামরিক শাসন। বুমেদিনের দুষু্ব পরিকল্পনার জেরে জেরবার কথিত গণতন্ত্রী আলজেরিয়া। সেখানেও জোর করে ঢাকনিচাপা দেওয়া হয়েছিল ইসলামী রাজনীতি-প্রভাবিত অসন্তোষ।
দীর্ঘ সামরিক শাসন বা স্বৈরশাসনে গণতান্ত্রিক শক্তির সাংগঠনিক ভিত তৈরি হতে পারে না সমাজে বা রাষ্ট্রযন্ত্রে তথা শাসনব্যবস্থায়। এ সহজ সত্য কোনো শাসকই বুঝতে চান না। চান না বলে নিজ হাতে গণতন্ত্রবিরোধী ধ্বংসের বীজ রোপণ করেন। পরিণামে ঘটে বিস্ফোরণ। ঘটে নির্বাচনে পরাজয়। মিসরেও তা-ই ঘটেছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো গণতন্ত্রী দলের নেতাকে পাওয়া যায়নি প্রার্থী হিসেবে। দুঃশাসনের এমন স্টিমরোলার চালিয়ে দেশ শাসন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক। সেনাবাহিনীর সমর্থনে দীর্ঘ সময় ধরে।
তাঁর পতনের পর দেখা গেল, গণতান্ত্রিক রাজনীতির সুস্থ সাংগঠনিক শক্তি প্রায় নেই বললেই চলে। তাই মুবারক শাসনের প্রতিনিধি আহমেদ শফিক (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসির প্রতিদ্বন্দ্বী। যে শাসনব্যবস্থাকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে, তার সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে কেউ ভোট দেয়? না, দেয়নি।
তবু হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এর অর্থ, মানুষ ধর্মীয় জঙ্গি পার্টির প্রার্থীকে ভোট দিতে চাননি। যাঁরা দিয়েছেন নিতান্ত নিরুপায় হয়ে, বিকল্প কেউ নেই বলে দিয়েছেন। এর মধ্যে একটা ছোট্ট খবর; কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এক ভোটারের প্রতিক্রিয়া- মুরসিকে তো ভোট দিতে চাই না; কিন্তু ওই দুর্নীতিবাজদের প্রতিনিধিকে কিভাবে ভোট দিই। অর্থাৎ নেগেটিভ তথা নেতিবাচক ভোটে জিতেছেন ধর্মীয় রক্ষণশীল রাজনৈতিক পার্টি মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা।
এখন মোহাম্মদ মুরসি মিসরের প্রেসিডেন্ট। বহু দিনের প্রতীক্ষিত বিজয়। সেনাবাহিনী মহা সমস্যায়। নাসেরের উত্তরাধিকার বহনকারী সেনাবাহিনী নিশ্চয়ই আর আগের অবস্থায় নেই। তবু দেখা যাচ্ছে, তারা রক্ষণশীলদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বড় একটা রাজি নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের দাবি, না মেনেই বা উপায় কী? মিসরীয় বসন্ত এখন বর্ষার দুর্যোগে পরিণত।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃত গণতন্ত্র এখন বিপদের মুখে। সেনাবাহিনী কয় দিনই বা তত্ত্বাবধানের নামে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে? ইসলামবাদী প্রেসিডেন্ট যদি ইসলামী ধারার শাসনতন্ত্র তথা সংবিধান প্রণয়ন করতে চান, তাহলে কী হবে? অন্যদিকে কী করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা? কী ভাবছে ইসরায়েল। ইসলামী জঙ্গি শাসন মেনে নেবে, নাকি সেনাশাসনের পক্ষে দাঁড়াবে? এখানেই যত গেরো। নাসের কি তাঁর কবরে পাশ ফিরবেন? সংশ্লিষ্টদের এখন পথ বেছে নিতে হবে। কারণ আর যা-ই হোক, মিসরের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের দেশকে তো আর মুঠোর বাইরে রাখা যায় না। আসোয়ানকে কেন্দ্র করে যে কর্তৃত্ব হাতে এসেছে, তা হারানো সম্ভব নয়। কাজেই কূটসংঘাত না আপস- কোন পথ বেছে নেয় ওয়াশিংটন-ইসরায়েল শক্তিকেন্দ্র, সেটাই দেখার বিষয়। আপসই যদি হয়, সেটাই বা কী ধরনের হবে? সংবিধান রচনা করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে। মার্কিন লবি বলে কোনো কথা নয়, স্থানীয় গণতন্ত্রীদের জন্য এখন এক উভয় সংকট। ধর্মীয় রক্ষণশীলতায় পেছন হাঁটা, না অনাকাঙ্ক্ষিত সেনাশাসনের লেজ ধরে চলা। হোসনি মুবারকের অপশাসন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে দেওয়ার কারণেই বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব। এ অবস্থায় ব্রাদারহুড এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন 'ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি'র ক্যাডার ও সমর্থক জনতা তাহ্রির স্কয়ারে আবারও প্রতিবাদী সমাবেশের আয়োজন করেছে। চলছে রাতভর বিক্ষোভ আর স্লোগান। 'নির্বাচন মেনে নাও, ক্ষমতা ফিরিয়ে দাও' গোছের স্লোগান। সাধারণ মানুষও বিভ্রান্ত- এটা আরেক বড় সমস্যা। তা ছাড়া ব্রাদারহুড কি সত্যি স্বাধীনতা, মুক্তি ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী? বলা কঠিন। সত্যি বলতে কী, জনসাধারণের পক্ষেও সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কাকে সমর্থন জোগাবে। আপাতত সমর্থনযোগ্য কেউ নেই শীর্ষস্থানে।
তবে একটি কথা সত্য যে এসব ক্ষেত্রে মানুষ জনস্বার্থের দিকটাই বড় করে দেখে, রাজনৈতিক আদর্শের ভালো-মন্দ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। আদর্শবাদী ব্যক্তি বা দলের জন্য এভাবে উঠে আসে সমস্যা। দেশ আদর্শ শাসনের ক্ষেত্রে বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যায় কয়েক দশক। এমন উদাহরণ তো বিশ্বে কম নেই। প্রায়ই দেখা যায়, এ জাতীয় রাজনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার মেলে না; বরং পরিস্থিতি মন্দ থেকে মন্দতর পর্যায়ের দিকে মোড় নেয়।
এখন কী করবে সেনাবাহিনী- সেটাই দেখার বিষয়। কিন্তু কিছুকাল আগেও তুরস্কে দেখা গিয়েছিল অনুরূপ সমস্যা। কামাল পাশার ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার বহন করা সামরিক বাহিনীকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। মিসর নাসেরের সেনাবাহিনীর এখন তেমনই আত্মিক সংকট, বলা চলে আদর্শিক সংকট। কারণ তাহ্রির স্কয়ার এখন সামরিক বাহিনীর গৃহীত পদক্ষেপও উপেক্ষা করতে চাইছে। সে ক্ষেত্রে কোনো অর্বাচীন পদক্ষেপে গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নিতে পারে। আর তাতে ব্রাদারহুড ও জাস্টিস পার্টির জয়লাভের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মিসরীয় সামরিক বাহিনী কি তেমন ঝুঁকি নিতে চাইবে? তবে সেনা দপ্তর যে তাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তেমন আলামতও অস্পষ্ট নয়। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে ব্রাদারহুড নেতাদের সঙ্গে সমঝোতামূলক আলোচনার পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে।
আলোচনার মূল লক্ষ্য মিসরের শাসনব্যবস্থার গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করা। সেনাবাহিনীর পক্ষে এটা আদর্শিক দায় বলে সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন। এ ক্ষেত্রে ইসলামী ব্রাদারহুড নমনীয় না হলে সংঘাত অনিবার্য। আর সে সংঘাতে কে জয়ী হবে- সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। লক্ষ করার মতো বিষয় যে এমন এক রাজনৈতিক সংকটের মুখেও ওয়াশিংটন-ইসরায়েলের মুখে রা নেই। কেন? তারা কি স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে পারছে না! মিসরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাই এখন বড় হয়ে থাকছে। সময় দ্রুতই এর সমাধান সবাইকে জানিয়ে দেবে। তবে মনে রাখা দরকার, তাহ্রির স্কয়ারে মুবারক শাহির পতনের মূল প্রতিবাদী সমাবেশ গড়ে ক্ষুব্ধ তারুণ্য, গণতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি, পরে ইসলামপন্থীরা যোগ দিয়ে জয় ছিনিয়ে নেয় কূটকৌশলে। ঠিক যেমন দেখা গিয়েছিল বাদশাহ-খেদা আন্দোলনে, ইরানে। মিসর কি নেতার অভাবে সেই পথ ধরবে?
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক
No comments