রাজনীতিতে মননশীলতার পরাজয় by এ কে এম শাহনাওয়াজ

আমাদের রাজনীতিকরা_বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতার রাজনীতির মাঠে ঘোরাফেরা করেন, তাঁরা দিন দিন কেমন যেন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছেন। নিজেদের রাজনীতির অচলায়তনের বাইরে যে সুস্থ সাধারণ মানুষের একটি জগৎ আছে এবং ভোটের আগে তাদের কাছে ফিরতে হয়, তা যেন একেবারেই ভুলে যাচ্ছেন।


রাজনীতির মাঠে তাঁদের ভাষা ও শব্দচয়ন এতটাই অমার্জিত হয়ে পড়ছে যে সচেতন মানুষ তাঁদের প্রজন্মে বেড়ে ওঠার অঙ্গনে নষ্ট পরিবেশ দেখে আতঙ্কিত হচ্ছেন। রাজনীতির এ মহানায়করা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকতে পছন্দ করেন। গণতন্ত্রের বুলি মুখে নিয়ে গণতন্ত্রের হন্তারক হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে পাকা করেন। গণতন্ত্রের একটি প্রধান লক্ষণ পরমতসহিষ্ণু হওয়া। তা আমাদের রাজনীতির নায়কদের কাছে অচেনা হয়ে গেছে। তাঁদের ভাষা আর ভাষণ শুনলে মনে হয়, নিজেদের গণ্ডির বাইরে দেশের তাবৎ মানুষ মূর্খ। যার যার বিরোধী পক্ষকে উদ্দেশ্য করে অভব্য শব্দচয়ন না করলে এবং খিস্তি না শোনালে যেন স্বস্তি নেই। তাই দেশের মানুষ কে কী ভাবল তা নিয়ে এঁরা মোটেই ভাবিত নন। চোখে ঠুলি পরা গোঁয়ার ষাঁড়ের মতো কেবল ছুটতে থাকেন। টেলিভিশনে দর্শকের কান-চোখ এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে দুই বড় দলের নেতা-নেত্রীদের গৎ বাঁধা মেধাবী শব্দচয়ন শুনতে এবং বডি ল্যাংগুয়েজ দেখতে। বিরামহীনভাবে একই ভাষায় একে অন্যকে বকাঝকা আর সমালোচনা করেই যাচ্ছেন। শ্রোতা বিব্রত হলেও রাজনীতির কর্ণধাররা অক্লান্তভাবে ভাঙা রেকর্ড বাজাতে কিছুমাত্র ক্লান্ত হচ্ছেন না।
অভ্যস্ত গিনিপিগ আমাদের বিস্মিত হওয়ার কথা নয়, তবুও চমকে গেলাম প্রকাশ্য সভায় রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা বিএনপি নেতাদের মননশীলতাবিহীন শব্দচয়ন শুনে। আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর পুলিশ-র‌্যাবপ্রধানরা যা-ই বলুন না কেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রম অবনতি দেখে দেশবাসী আতঙ্কিত। তাই প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় ভয়ার্ত চোখেই দৃষ্টি বোলাতে হয়। বড় সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক দল আশ্রিত হওয়াটা এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। সরকারি দলে থাকলে সন্ত্রাসীর আস্ফালন বেশি থাকে। সন্ত্রাসে সাফল্যের হারও থাকে বেশি। বিরোধী দলে থাকলে নখ শানাতে থাকে, যাতে মওকা পেলে প্রথম থাবাটি মারা যায়। তার পরও মাঝেমধ্যে ভাবতে ইচ্ছে করে জঙ্গি মৌলবাদীদের মতো অতটা বখে যায়নি আমাদের বড় দলের নেতারা।
এমন প্রাক ধারণা নিয়ে গত ২১ এপ্রিল কয়েকটি পত্রিকার পাতায় চোখ বোলাচ্ছিলাম। জনকণ্ঠের একটি হেডিংয়ে চোখ আটকে গেল। লেখা 'জিব কেটে নেব, সচিবালয় তছনছ করব।' এটুকুতেই থেমে গেলাম এবং একটা ভুল করে ফেললাম। ৪ এপ্রিলের আমিনী তাণ্ডবটা বোধ হয় তখনো মাথা থেকে সরেনি। সরকারের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা আমিনীর মতো মানুষকেও দাপুটে রাজনীতিক বানিয়ে দিল! এই হেডিংটি দেখে মনে হলো, আমিনীদের লেটেস্ট কোনো জঙ্গি হুমকি বোধ হয়। একটু পরই ভুল ভাঙল। খবরটি পড়ে বিস্মিত হওয়া উচিত নয়, তবুও বিস্মিত হলাম।
সংবাদ পরিবেশন যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এই সন্ত্রাসী শব্দের প্রবক্তা বিএনপির দুই বড় নেতা। জিব কেটে নেওয়ার জন্য ছুরি শানাচ্ছেন সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক এবং সচিবালয় তছনছ করে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করতে স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী। আর এসব চায়ের টেবিলে বসা কোনো বেফাঁস কথোপকথন নয়, ২০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত একটি প্রকাশ্য সমাবেশে দাঁড়িয়ে দেওয়া ঘোষণা। এখানেই শেষ নয়, রিপোর্টটি পড়তে গিয়ে দেখলাম, 'বাবু যত বলে পারিষদ দলেবলে তার শতগুণ' ধরনের ধারায় সমাবেশের সভাপতি ব্যক্তিপূজার আজ্ঞাবহ রাজনীতির মানসপুত্রের মতো করে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীদের বলে দিলেন জিয়া পরিবারের কারো প্রতি কটূক্তি করলে মামলা নয়, তারা যেন হামলা করে। অর্থাৎ আমাদের এই দায়িত্বশীল বড় দলের নেতারা যাঁরা অনেক দিন সরকারে ছিলেন, রাজনীতি সহায় থাকলে আবারও কোনো এক শুভ সকালে সরকার গঠন করবেন, তাঁরা জানিয়ে দিলেন দলটি আইনের শাসন মানে না, পেশিশক্তি প্রয়োগ করেই পথ হাঁটবে।
জিব কাটা থেকে হামলা পর্যন্ত এমন সন্ত্রাসী শব্দ প্রয়োগের হেতু নিয়ে ভাবছিলাম। একটা যোগসূত্র অবশ্য পাওয়া গেল। রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ যেমন রক্তের সন্ধানেই উচাটন করে, তেমনি রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে সুবিধার রস আকণ্ঠ পান করা দলটি দীর্ঘদিন পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। তাই এদের উদ্ভ্রান্ত দশা শুরু থেকেই লক্ষ করেছিল মানুষ। নিয়মের নয়, আবদারের দুটো আসন সংসদের সামনের সারিতে না পাওয়ার বালখিল্য আচরণের ছুতানাতায় সংসদ বর্জনের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভেতরকার অস্থিরতার প্রকাশ শুরু করে দেয় তখন। আওয়ামী লীগের অপরিপক্ব শাসনের দুর্বলতা বারবার ইস্যু এনে দিতে থাকে বিএনপিকে। কিন্তু নিকট-অতীতে সরকারে থাকা বিএনপি নেতাদের দুর্নীতি আর অপশাসনে বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষের আস্থায় ফিরতে পারেনি বলে আওয়ামী লীগের শাসন দুর্বলতা থেকে খুব বেশি ফসল ঘরে তুলতে পারছে না বিএনপি। তাই রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য মহাবিষ্ট বিএনপি নেতারা এখন যেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ফলে নিয়মতান্ত্রিক পথে হাঁটতে পারছে না বলে মাঝেমধ্যেই কথায়-আচরণে স্বদন্ত বেরিয়ে পড়ছে। মেঠো বক্তৃতা দিতে গিয়ে শব্দচয়ন ও ভাবভঙ্গিতে সব ধরনের মননশীলতা হারিয়ে ফেলছেন।
আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমুর হঠাৎ কেন মনে হলো, রাজনীতির মাঠ গরম করতে হবে তা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। মুক্তিযুদ্ধে জেড ফোর্সের স্বীকৃত অধিনায়ক জিয়াউর রহমান সম্মুখযুদ্ধ করেননি_এমন তত্ত্বকথা প্রচার করার দায়িত্ব নিজে নিয়ে কতটা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিলেন সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ১০ টাকা কেজি চাল প্রসঙ্গে দুই দলের প্রধান নেতা-নেত্রীদের ভাঙা রেকর্ড প্রায় প্রতিদিন শুনে শুনে এমনিতেই সাধারণ মানুষ ক্লান্ত। এর মধ্যে আবার এমন উটকো আর অপ্রয়োজনীয় সংলাপ! তাই ভবিষ্যতে জনাব আমুদের মতো এমন বেফাঁস কথা বললে ফারুক সাহেবদের মতো 'বিদগ্ধ' রাজনীতিকরা রাজনৈতিক পরিশীলিত শব্দে ধরাশায়ী নয়, চকচকে ছোরা হাতে জিব কাটতে উদ্যত হবেনই। বিএনপির মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার মজা এই দলের নেতারা বেশি বুঝেছেন। তাই ক্ষমতাহীন তাঁরা থাকতে চাননি। সে কারণে সব পরিকল্পনা পাকা করেছিলেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাজানো পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেয়। এ কারণে ওই সরকারের ওপর বিএনপি বেশি খেপা। এর মধ্যে আওয়ামী সরকারের দুর্বল যাত্রাপথ দেখে হালে পানি পেয়েছে বিএনপি। তাই গণতান্ত্রিক ধারাকে দুর্বল করে দিয়ে অসময়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনের আওয়াজ তুলছে।
রাজনীতি দিয়ে রাজনীতি মোকাবিলা করার মেধা ও ধৈর্য দুটোই বোধ হয় হারিয়ে ফেলেছেন আমাদের রাজনীতির ধারক-বাহকরা। যে অপকর্মের দায়ে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করেছে মানুষ, তাতে তাদের সহজে কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর কথা নয়। কিন্তু মহাজোট বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালকরা হাতে পাওয়া আনুকূল্যকে ব্যবহার করতে পারছেন না। বরঞ্চ নিজেদের শিক্ষানবিস শাসনে সব ক্ষেত্রে বিএনপির মতো একই লঙ্কাকাণ্ড করে বিএনপির কলঙ্কিত শরীরে সাদা কাপড়ের আস্তরণ তুলে দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষের স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার পথ করে দিচ্ছেন। বারবার ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত মানুষ আবার তুলনায় 'মন্দের ভালো' খোঁজায় দৃষ্টি ফেরাতে পারে। কিন্তু তর সইছে না বিএনপি নেতাদের।
আজ বিএনপির যদি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো পরামর্শক থাকেন এবং তাঁদের কথা ধারণ করার ইচ্ছে যদি দলটির প্রধান নেতা-নেত্রীর থাকে, তবে ভাবতে হবে তেলতেলে বাঁশ বেয়ে যতটুকু উঠতে পেরেছে তাকেই পুঁজি করে ধীরেসুস্থে আরেকটু উঠবে_নাকি মেঠো রাজনীতির অমননশীল শব্দচয়নের বাঁদরামিতে লাফাতে গিয়ে ধপাস ধরণীতল হবে।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.