বনসম্পদ-আমরা কী করছি আর আসলে কী করা উচিত by খসরু চৌধুরী

কোপেনহেগেন সম্মেলন আপাত ব্যর্থ হলেও পৃথিবীর সম্যক জলবায়ু নিয়ে এই সম্মেলন সারা পৃথিবীতে একটা সাড়া ফেলেছে। দেশগুলো এটাও জানতে পেরেছে, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় বাংলাদেশে আমরা কী করছি!


একটি দেশের জলবায়ু, বিশেষ করে উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণের অন্যতম নিয়ামক শক্তি হচ্ছে সে দেশের বনভূমি। বর্তমান অবস্থায় বন বিভাগের ভাষ্য অনুযায়ী দেশের মোট আয়তনের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে। বাস্তব অবস্থা অন্য রকম। বন বিভাগের দখলে সম্ভবত ৫ শতাংশ এলাকার বেশি নেই। আর বড় গাছের ছায়া রয়েছে, এমন এলাকা ৩ শতাংশের বেশি হবে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে একজন বাংলাদেশি হলেন পৃথিবীর সেই হতভাগ্য ব্যক্তিটি, যাঁর বনভাগ্যে পড়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে কম বন এলাকা।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপই যে বনভূমি কমে যাওয়ার মূল কারণ, এটা সবাই জানেন। কিন্তু বর্তমানে যে দ্রুততায় বনভূমি শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাতে শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দোষারোপ করা যায় না। গত তিন মাসের পত্রপত্রিকা নাড়াচাড়া করলেই সবার চোখে পড়বে, এ বছর শুকনো মৌসুমের শুরু থেকেই আমাদের মিশ্র বৃষ্টিপাতের পাহাড়ি জঙ্গলগুলোর গাছপালা দেদার কাটা হচ্ছে। এ সময়টায় বৃষ্টি না হওয়ায় পাহাড় থেকে গাছ কাটা যেমন সহজ, তেমনি গাছ বহনের ট্রাক ও বনের কাঁচা রাস্তাগুলো ব্যবহার করা যায় স্বচ্ছন্দে। গাছ কাটা হচ্ছে মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের, চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের, ফাঁসিয়াখালী অভয়ারণ্যের, কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের, কক্সবাজারের মেদা কাচাপিয়া জাতীয় উদ্যানের, টেকনাফ গেম রিজার্ভের। সাজেক উপত্যকা, পাবলাখালীর দুর্গমতার জন্য সেখানে কী হচ্ছে, তার খবর খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে পাবলাখালীতে সীমান্ত-লাগোয়া কিছু এলাকা ছাড়া বন তেমন একটা নেই। পত্রপত্রিকার তদন্তে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গাছ কাটার হোতারা হচ্ছেন স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও বন বিভাগের মাঠপর্যায়ের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। এই রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা দলমতনির্বিশেষে কাজটি করে থাকেন।
আমরা যদি আমাদের তলানিতে ঠেকে যাওয়া বনসম্পদ রক্ষা করতে চাই, তাহলে আমাদের প্রয়োজন শক্তিশালী কার্যকর একটি বন বিভাগ। আমাদের বন এলাকা এবং বনের ওপর চাপের তুলনায় বন বিভাগের জনবল, অস্ত্রবল, পরিবহন নিদারুণভাবে কম। সরকারি অর্থ বরাদ্দও খুবই কম। মাঠপর্যায়ের কর্মচারীরা সমাজবিচ্ছিন্ন, জনবিচ্ছিন্নভাবে জীবন যাপন করেন। তাঁদের প্রস্তুত থাকতে হয় দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা। স্নানাহার অনিশ্চিত, চিকিত্সা সুদূরপরাহত। তাঁদের পারিবারিক জীবন বলতে কিছু নেই। স্বাস্থ্যকর বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব কর্মচারীর ছেলেমেয়েদের শিক্ষারও কোনো ব্যবস্থা নেই। এলাকাগুলো জনবিরল হওয়ায় প্রতিটি এলাকায়ই রয়েছে সশস্ত্র ডাকাতের দল। সন্ত্রাসী দলগুলো তাদের প্রশিক্ষণ শিবির হিসেবে বনের এলাকাগুলো বেছে নেয়। শুধু সুন্দরবন এলাকার সমস্যার দিকে তাকালেই সারা দেশের অবস্থার একটি চিত্র পাওয়া যেতে পারে।
জল ও স্থল মিলিয়ে বাংলাদেশে সুন্দরবনের মোট এলাকা রয়েছে ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এ এলাকার দেখাশোনা করার জন্য বন বিভাগের জনবল রয়েছে মাত্র এক হাজার ১০০ জন। এ এলাকার বনজ সম্পদের ওপর প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে জড়িত দক্ষিণ বাংলার প্রায় তিন কোটি মানুষ। বন বিভাগের টহল ফাঁড়িগুলোতে কোনো যান্ত্রিক যানবাহন নেই। স্টেশন অফিসগুলোতে যেসব নৌযান আছে, সেগুলো অধিকাংশই নষ্ট। সুন্দরবনে নেওয়া নানা প্রকল্পের পরিত্যক্ত নৌযান এগুলো। খুবই দুর্বলভাবে নির্মিত এগুলো। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও জ্বালানি তেলের জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই।
পুরো সুন্দরবন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে ৩০ থেকে ৪০টি ছোট-বড় ডাকাত দল। ডাকাত দলের ভয়ে বন বিভাগ দুর্গম এলাকার প্রায় ১০টি টহল ফাঁড়িতে অস্ত্র রাখা বন্ধ করে দিয়েছে। কোনো কোনো টহল ফাঁড়ি ডাকাত দল বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করে। অস্ত্রবল, লোকবল, যানবাহনবলে বলীয়ান এসব ডাকাত দলের বিরুদ্ধে ক্যাম্পগুলোর চার-পাঁচজন বনকর্মীর পক্ষে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব তো হয়ই না, উপরন্তু তাদের আশ্রয়দাতা হতে বাধ্য হতে হয়। ২০০৫ সালে সামান্য কিছু চায়নিজ রাইফেল দেওয়া ছাড়া বন বিভাগ বনকর্মীদের কোনো সাহায্যই করতে পারেনি। অথচ ডাকাত দল ব্যবহার করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার সন্ত্রাসী দলগুলোর আধুনিক অস্ত্রপাতি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, সুন্দরবনের বনচারী ব্যবসায়ীরা বন বিভাগকে যে রাজস্ব দেন, ডাকাতদের দিতে হয় তার চেয়ে বেশি। সুন্দরবনের কর্মচারীরা খাদ্য হিসেবে শুধু গোনের সময় জেলেদের কাছ থেকে মাছ পান। তরিতরকারিও জেলেরাই আনেন। বাকি সময়টা শুধু আলু দিয়েই ভাত খেতে হয়। সকালে বন কর্মচারীরা টহলে বের হলে বন ফাঁঁড়িগুলো অরক্ষিত থাকে। জেলে-বাওয়ালি আশপাশে থাকলে বন অফিসের পাশে রাত কাটান। না থাকলে নিরালা, নিঝুম অন্ধকার। পানীয় জল বলতে তাঁরা পান বন অফিসের লাগোয়া একটি ছোট পুকুরের আধা-লোনা জল। জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ভেসে গেলে সেই জলও পানের উপযুক্ত থাকে না। ক্যাম্পগুলোর কক্ষগুলো জরাজীর্ণ। এগুলো সংস্কারের জন্য সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। তাঁদের চলাচলের জন্য রয়েছে খুবই ছোট নড়বড়ে একটি হাতে-বাওয়া ডিঙি। কাঠচোর, মাছচোর, হরিণচোরদের ধরতে পারলেও তাঁদের বিপদ। এই চোরদের কোর্টে চালান করার যানবাহনও তাঁদের নেই। কোর্টে চালান দিতে পারলেও আরেক বিপদ। তখন তাঁদের সাক্ষ্য দিতে যেতে হয় কোর্টে। তাঁদের যাতায়াত, খাই-খরচারও কোনো বরাদ্দ নেই। বেতন-ভাতাও সামান্য। অধিকাংশ কর্মচারী জলবাহিত রোগে ভোগেন। তাঁদের ট্রেনিংয়ের মানও নিচু। স্বভাবতই তাঁদের নৈতিকতার অবস্থাও শোচনীয়।
এ অবস্থায় নড়বড়ে একদল মানুষের কাছ থেকে আমরা কী করে আশা করব, তাঁরা লোভের বশবর্তী হবেন না। যে বিপুল প্রতিকূল প্রতিবন্ধকতা তাঁদের সামনে, সেখানে কী করে আশা করব যে তাঁরা উচ্চ নৈতিকতার আদর্শ স্থাপন করবেন।
বন বিশেষজ্ঞদের মতে, সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনার জন্য অন্তত তিন হাজার বনকর্মী দরকার। সেই সঙ্গে তাঁদের স্বাভাবিক আবাসন, যোগাযোগ, অস্ত্রায়ন উন্নত করা দরকার। সেই সঙ্গে দরকার উন্নত ট্রেনিং। সুন্দরবন-সংলগ্ন অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা—নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিডিআর, পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে বন বিভাগের সহজ সমন্বয় দরকার।
ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে যখন ঠগিদের মারাত্মক উত্পাত শুরু হয়েছিল, ব্রিটিশ সরকার তখন ঠগি দমনের জন্য সেনাবাহিনীর মেজর হেনরি স্লিম্যানকে একটি বাহিনী দিয়ে নিযুক্ত করেছিল। স্লিম্যান এই মারাত্মক বাহিনী দমন করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
ঢাকা শহরে বসে সুন্দরবনে ডাকাতের অত্যাচার বোঝা যায় না। বুঝতে হলে সুন্দরবনে যেতে হবে। তখন সহজেই অনুমেয় হবে, এখানেও স্লিম্যানের বাহিনীর মতো একটি বাহিনীর কিছুকাল কাজ করা দরকার।
দেশের শুকনো এলাকার বনাঞ্চলগুলোয় বন বিভাগের অবস্থা সুন্দরবনের চেয়ে উন্নত নয়। এ অবস্থায় বন রক্ষা করতে হলে একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কমিটির মাধ্যমে আমাদের বনগুলোর সম্যক অবস্থা জানতে হবে। কমিটির সুপারিশে বন বিভাগ পুনর্বিন্যাস করতে হবে। বন বিভাগের মেরুদণ্ড সোজা করার জন্য সরকারের আর্থিক বরাদ্দ অনেক বাড়াতে হবে। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো ক্ষেত্রে বন উজাড় ধরা পড়ে গেলে দু-একজন কর্মকর্তা ও কতিপয় কর্মচারীর শাস্তি দেওয়া হয়েছে কালেভদ্রে। বর্তমানের অসুস্থ এই বন বিভাগ তার চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা রাখে না। এতে বন ব্যবস্থাপনার কোনো লাভ হয়নি।
সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী বন উজাড়ের বিষয়ে অবগত হয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। বন উজাড়ের অপকর্মের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির জন্য জাতীয় সংসদে বিল পেশ করার কথা ভাবছেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই উদ্যোগ অবশ্যই ধন্যবাদার্হ। কিন্তু বন বিভাগকে শক্তিশালী করা না হলে তাদের কাছে কৈফিয়ত পাওয়ার কোনো নৈতিক অধিকার আমাদের থাকে না। এ বিষয়টিরও সুরাহা হওয়া দরকার।
খসরু চৌধুরী: বন বিশেষজ্ঞ।

No comments

Powered by Blogger.