ভিন্নমত-তারল্য সংকট, সুদের হার এবং বিনিয়োগ প্রসঙ্গ by আবু আহমেদ
ব্যাংকগুলোতে প্রচণ্ড তারল্য সংকট চলছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে। তারা প্রতিযোগিতামূলকভাবে ব্যাংক আমানত ও ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু সুদের হার বাড়িয়েও আমানত সংগ্রহ করার একটা সীমা আছে। অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ যদি মন্থর থাকে তাহলে শুধু সুদের হার বাড়ালে সামগ্রিক আমানত বাড়তে পারে না।
এমতাবস্থায় জিরো-সাম গেইমের (তবৎড়-ংঁস মধসব) নিয়ম মেনে আমানত এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে গিয়ে জমা হবে। এতে সুদের হার কমবে না, বরং সুদের হারের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় থাকবে। অর্থনীতিতে গত চার-পাঁচ মাসে এত তারল্য সংকটের উদ্ভব হলো কেন? এ প্রশ্নের জবাব বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসৃত মুদ্রানীতির মধ্যে খুঁজতে হবে। কোনো অর্থনীতিতে দুই কারণে তারল্য সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এক. যে ব্যাংক রিজার্ভ মুদ্রা ছাড়ে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি বিভিন্ন হাতিয়ার ব্যবহার করে বাজার থেকে মুদ্রা তুলে নেয়।
বাজার থেকে মুদ্রা তুলে নেওয়ার নীতিকে অর্থনীতি শাস্ত্রে সংকোচনশীল মুদ্রানীতি বলে। এটা বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ কারণেই অনুসরণ করে, যখন মনে করে অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বেশি হয়ে গেছে এবং অতিরিক্ত মুদ্রা বা তার ফলে অতিরিক্ত তারল্য অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এমন একটি নীতি অনুসরণ করছে কি না সেটা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করব। অক্টোবর-নভেম্বর মাসের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্যাশ রিজার্ভ অনুপাত বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে আগের চাইতে বেশি অর্থ জমা রাখতে হয়েছে। এই বাড়তি জমা হিসাব করলে কয়েক হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। অন্যদিকে মোট রিজার্ভ ধারণ বা এসএলআরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আগের চাইতে বেশি সরকারি ট্রেজারি বিলস ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে। ১ শতাংশ এসএলআর এবং আধা শতাংশ সিআরআর বাড়ালে অর্থনীতি থেকে কত অতিরিক্ত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে জমা হয়েছে, সেটাও হিসাব কষে বের করা দুরূহ বিষয় নয়।
এই দুই অনুপাত পরিবর্তনের ফলে যদি অর্থনীতি থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে যায়, তাহলে প্রকৃত অর্থে অর্থনীতিতে এর কমপক্ষে তিনগুণ অর্থের অর্থাৎ ১৫ হাজার কোটি টাকার তারল্য প্রবাহ কমে যাবে। এই হিসাবগুলো আমার স্মৃতি থেকে লেখা এবং মোটা দাগের ভিত্তিতে হিসাব। এসএলআর এবং সিআরআর বাড়ানো হলে আমাদের অর্থনীতিতে কত হাজার কোটি টাকার শর্টফল পড়েছে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ অবশ্যই জানে। বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহের ক্ষেত্রে হঠাৎ এই উল্টো নীতি নিতে গেল কেন_সে প্রশ্ন ইতিমধ্যে আমরা কয়েকবার তুলেছি। একটা কারণ থাকতে পারে, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কয়েক মাস আগে এসে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, অর্থনীতিতে ক্রেডিট ফ্লো তথা ঋণের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সেটা করতে হবে সুদের হার বাড়িয়ে।
তাদের যুক্তি হলো, সুদের হার বাড়লে অর্থের চাহিদা কমে যাবে এবং অর্থের চাহিদা কমলে মূল্যস্ফীতি ঘটবে না। এসব যুক্তি অবশ্য ক্লাসিক্যাল মাইক্রো অর্থনীতিতে বেশ ভালোভাবেই দেওয়া আছে। আইএমএফ সেই বাজারমুখী সনাতনী যুক্তিগুলো তাদের দরিদ্র সদস্য দেশগুলোতে সাহায্যের শর্ত হিসেবে চাপ দিতে থাকে। তাদের একটি কথা_ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি ঘটবে। সুতরাং পণ্যমূল্য কম চাও তো অর্থের প্রবাহের লাগাম টেনে ধরো। সংকোচন মুদ্রানীতির অন্য হাতিয়ার হলো, যেসব ট্রেজারি বিলস বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে, সেগুলো পুনঃক্রয়ের ক্ষেত্রেও সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া।
ব্যাংকগুলো যখন বেশি সুদে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তাদের এসএলআর হিসাবে রক্ষিত সরকারি ট্রেজারি বিলসগুলো বেশি সুদে গছাতে পারে তখন অর্থনীতিতে তারা যে সুদ আমানতকারীদের দেবে তা অবশ্যই বেড়ে যাবে। তাই বলছিলাম, সুদের হারের ঊর্ধ্বগতি বর্তমান অনুসৃত মুদ্রানীতিরই ফল। কিন্তু আমরা বরাবর বাংলাদশ ব্যাংকের এই মুদ্রানীতির বিরোধিতা করে আসছি। এই মুদ্রানীতি হলো বিনিয়োগবিরোধী এবং সংগত কারণেই আমাদের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধিরও বিরোধী। আর এ কারণেই অনেক উঠতি অর্থনীতি আইএমএফের নির্দেশিত মুদ্রানীতি থেকে সরে এসে স্বাধীন মুদ্রানীতি অনুসরণ করে। আজকে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রদেয় ঋণের ওপর সুদের হার অনেক বেড়ে গেছে। এই বৃদ্ধি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত-পাকিস্তান থেকে অনেক বেশি। ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে যে বিনিয়োগ হবে, সে বিনিয়োগের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে এবং অর্থনীতিতে তখন প্রকৃত অর্থেই মূল্যস্ফীতির চাপ বজায় থাকবে। সেই ধরনের মূল্যস্ফীতিকে পড়ংঃ-ঢ়ঁংয রহভষধঃরড়হ বা উৎপাদনে এর আধিক্যজনিত মূল্যস্ফীতি বলে।
অন্যদিকে আমাদের অর্থনীতিতে আজ যে বাড়তি মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভব করা হচ্ছে, এর উৎস আমাদের ব্যক্তি খাতে বর্ধিত ঋণপ্রবাহ নয়, বরং এর উৎস বিদেশ, যেখান থেকে আমরা খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করি। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে ক্রেডিট ফ্লোর লাগাম টেনে ধরলে কি মূল্যস্ফীতি কমে যাবে? তাতে আমদানি কমে যেতে পারে। কিন্তু তার অর্থ তো হবে পণ্যের দুষ্প্রাপ্যতা, সেই অবস্থা তো হবে আরো খারাপ। যাহোক, দ্বিতীয় যে কারণে অর্থনীতিতে তারল্য সংকট ও সুদের হার বাড়তে পারে তা হলো, আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু সে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়া অর্থনীতির জন্য ভালো। ওই অবস্থায় বর্ধিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাল রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অর্থনীতিতে বর্ধিত মুদ্রার জোগান দিতে হবে। নইলে অর্থনীতিকে পেছনে টেনে ধরার নামান্তর হবে। অন্য যে কারণে তারল্য সংকট সৃষ্টি হতে পারে সেটা হলো, দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা নষ্ট হওয়া। আস্থা নষ্ট হলে লোকে নগদ অর্থ ধারণ করে বেশি। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকিং খাতে কম অর্থের প্রাপ্তি ঘটবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments