শ্রম-জাতীয় প্রবৃদ্ধি বনাম রামভজন কৈরী by আলতাফ পারভেজ

স্বল্প মজুরিই প্রধান সমস্যা নয়। বাগিচা এলাকায় হাজার হাজার শ্রমিক ভুগছে স্বাস্থ্য সমস্যায়। হবিগঞ্জের মাধবপুরে দেখেছি ৫টি বাগান, ৪০ হাজার শ্রমিক। চিকিৎসক আছেন একজন, তাও চুক্তিভিত্তিক, স্বল্পকালীন। চা বাগিচার মালিকরা কোথায় চিকিৎসা নেন?


ওই মালিক ও শ্রমিকের আয় যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করে প্রবৃদ্ধির যে হিসাব হচ্ছে তা প্রতারণাপূর্ণ



দেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এ মুহূর্তে মনোযোগ-আকর্ষণী বিতর্ক চলছে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে। বিতণ্ডার বিষয়, কেউ বলছেন প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ; কেউবা বলছেন ৫.৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির খণ্ডাংশগুলো নিয়েই মতবিরোধ। বাজেটের আগে এ বিতর্কের শুরু; জের বইছে এখনও। যে দেশে এখনও ৪০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র, সংখ্যার হিসাবে যা ছয় কোটিরও বেশি, সেখানে প্রবৃদ্ধির খণ্ডাংশ নিয়ে বিতর্ক কতটা জরুরি? বরং কাদের শ্রম শোষণ করে কাদের প্রবৃদ্ধি ঘটছে সেটাই কি জনগণকে জানানো জরুরি নয়?
বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির এরূপ হিসাব যে কতটা অপ্রাসঙ্গিক এবং বিভ্রান্তিকর তার নজির হিসেবে চা শিল্পের কথা বলা যায়। দেশের সবচেয়ে 'হার্ডকোর পুওর'দের একাংশ চা শ্রমিক। সে কারণেই তাদের উদাহরণ দেওয়া। চা পুরনো শিল্প খাত। জিডিপির এক ভাগ হিস্যা চা খাতের। গার্মেন্টের উত্থানের আগে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে চা-ই ছিল নিশ্চিত এক উৎস। চা শ্রমঘন শিল্প। শ্রমিক হিসেবে প্রায় দেড় লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এ খাতে। এদের ওপর নির্ভরশীলসহ চা-নির্ভর জনগোষ্ঠী আছে চার-পাঁচ লাখের মতো।
১৯৯১ পরবর্তী এক দশকে দেখা যায়, এ খাতের উৎপাদনে ২৫ ভাগ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রবৃদ্ধির এ হার ভারত, শ্রীলংকা, চীন প্রভৃতি দেশের চেয়েও বেশি। প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক শক্তি হয়েও চা শ্রমিকরা তার কতটা হিস্যা পেয়েছে?
১৮৫৪ সালে যাত্রা থেকে এ শিল্পে প্রবৃদ্ধি হয়ে চলেছে। সস্তায় সরকারের দেওয়া খাসজমি এবং শ্রমিকদের প্রাণশক্তি নিংড়ে নেওয়া শ্রম_ এ ছাড়া এ শিল্পের বিকাশে আরও কোনো উদ্ভাবনী কর্তৃত্ব নেই তথাকথিত উদ্যোক্তাদের। খাসজমি দেওয়ার বিনিময়ে সরকার বৈদেশিক মুদ্রা পেলেও গত দেড়শ' বছরে এ শিল্পের লাগাতার প্রবৃদ্ধির কোনো ছোঁয়া শ্রমিকদের জীবনযাত্রায় লাগেনি।
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধি নিয়ে দেশের সর্বত্র এখন হাহাকার, আহাজারি। এ রকম এক অবস্থায়ও চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। এ টাকায় চলে একটি পুরো পরিবার। ঢাকায় বসে আমাদের অর্থনৈতিক থিঙ্কট্যাঙ্করা কখনও কি ভাবেন, ৪৮ টাকায় দিনযাপনের নারকীয়তার কথা?
এরূপ কম মজুরি স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকের উৎপাদনশীলতাও কমিয়ে দেয়। যে কারণে দেখা যায়, বাংলাদেশে একজন পাতা তোলা শ্রমিক দৈনিক গড়ে মাত্র ২০ কেজি পাতা তুলতে পারে। কর্মপরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত পরিবেশ ভালো হলে তারা গড়ে অনায়াসে ২৫ কেজি পাতা তুলতে পারত। এতে উৎপাদন খরচ অনেক কমে যেত। যেসব শ্রমিক পাতা তোলে, তারা স্রেফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ৩০-৪০ বছরের শ্রমিক জীবন কাটিয়ে দেয়। ৮ বাই ৮ বর্গফুটের একটি জীর্ণশীর্ণ ঘরে শ্রমিক পরিবারগুলো থাকছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। পায়খানা খোলা আকাশের নিচে, পানি কুয়ায়। হ্যাঁ, অবসরভাতাও পায় বটে তারা। সপ্তাহে ৪৫ টাকা। দৈনিক হিসাবে যা দাঁড়ায় সাড়ে ছয় টাকা!
স্বল্প মজুরিই প্রধান সমস্যা নয়। বাগিচা এলাকায় হাজার হাজার শ্রমিক ভুগছে স্বাস্থ্য সমস্যায়। হবিগঞ্জের মাধবপুরে দেখেছি ৫টি বাগান, ৪০ হাজার শ্রমিক। চিকিৎসক আছেন একজন, তাও চুক্তিভিত্তিক, স্বল্পকালীন। চা বাগিচার মালিকরা কোথায় চিকিৎসা নেন? ওই মালিক ও শ্রমিকের আয় যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করে প্রবৃদ্ধির যে হিসাব হচ্ছে তা প্রতারণাপূর্ণ। এ অর্থনীতি এক ধরনের পাপাচার। যে পাপাচার থেকে কেবল বিদ্রোহেরই জন্ম হয়। কিন্তু আমার বন্ধু রামভজন কৈরী বিদ্রোহী নয়। অহিংস, নিয়মতান্ত্রিক পথেই তার সংগ্রাম ও আস্থা।
এ শিল্পের দেড় শতাধিক বাগিচাই কমবেশি শোষণ-বঞ্চনার জীবন্ত কিংবদন্তি। কিন্তু সেখানে 'কর্মই ধর্ম' মন্ত্রে শ্রমিকদের বুঁদ করে রাখা আছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে পুরনো ও সংগঠিত শ্রমিক ইউনিয়ন চা খাতেই আছে। তারাই এ খাতের একমাত্র স্বীকৃত 'বার্গেইনিং এজেন্ট'। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছর এ ইউনিয়নে কোনো নির্বাচন হয়নি। ইউনিয়নটিকে মালিকরাই নিয়ন্ত্রণ করত। চা বাগান নিয়ে রিপোর্ট করে বিখ্যাত সাংবাদিক ড্যান জোন্স এ ইউনিয়নকে বলেছিলেন, 'কোম্পানি ইউনিয়ন।' যে ইউনিয়ন কখনও আন্দোলন করে না ।
একই সঙ্গে মালিক এবং মালিক নিয়ন্ত্রিত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা দুরূহ। সেই দুরূহ কাজটিই গত দশকে সফলভাবে করেছিল রামভজন কৈরীরা। ২০০৮ সালে তারা চা শ্রমিক ইউনিয়নকে বাধ্য করে নির্বাচন দিতে এবং সেই নির্বাচনে নতুন শ্রমিক নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় সব বাগিচায়। তরুণ রামভজন হন কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। কৈরীদের নেতৃত্বে চা বাগিচার নতুন প্রজন্ম নিয়মতান্ত্রিক পথেই শ্রমিক নামধারী দুষ্টচক্রটি ভেঙে ফেলে। পাহাড়ের মতো জেঁঁকে বসা শ্রমিক নেতৃত্ব নামক বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলার এ যজ্ঞে ঢাকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক নেতাদেরও সমর্থন ছিল না। সে ছিল আরেক বিস্ময়।
তবে রামভজনদের সফলতা ছিল সাময়িক। মালিকদের নীরব কারসাজি আর রাজনীতির প্রকাশ্য মদদে পুরনো স্বার্থবাদী চক্রটি পুলিশের সহায়তায় তালা ভেঙে সিবিএ কার্যালয় দখল করে নেয় ২০০৯ সালের নভেম্বরে। সেই থেকে প্রায় দেড়শ' বাগানের নির্বাচিত নেতৃত্ব পেয়েও রামভজনরা শ্রীমঙ্গলের লেবার হাউস থেকে বিতাড়িত। সিবিএ দখলকারীরা পুলিশ পাহারায় 'শ্রমিক নেতৃত্ব' সেজে কোম্পানির পাশে। জনপ্রতিনিধি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বাগান মালিকদের সমিতি, মিডিয়া সবাই এ দৃশ্যের দর্শক। কিন্তু কিছু বলছে না। কারণ রামভজনদের আবির্ভাব হলেই শোষণের পুরনো ব্যাকরণ ভেঙে পড়বে। সেখানে প্রবৃদ্ধির হিস্যা চাইবে শ্রমিকরা।
চা বাগান শ্রমিক ইউনিয়নে অহিংস পথে পরিবর্তন সাধনের এ প্রচেষ্টা একটি বার্তাই দেয়, এ পথে হবে না। ষাটের দশকে দার্জিলিংয়ে এ কথাই বলেছিলেন চারু মজুমদার। কিন্তু রামভজনরা মাওবাদী হয়নি। তারা এখনও ধৈর্য ধরতে চায়; আরও সংগঠিত হতে চায়; আরও। সীমান্তপারের চা বাগিচাগুলোতে ষাটের দশকের ফলাফল জানে রামভজন। আজকের ছত্রিশগড় কিংবা নেপালের অভিজ্ঞতাও নজরে আছে। কিন্তু পরিবর্তনের চিরায়ত পথে হাঁটতে চায়। মাঝে মধ্যে হতাশ হয়। আবার আশায় বুক বাঁধে। নিম্নবর্গের ঐক্য ও সংহতি শান্তিপূর্ণ পথেই বিজয় এনে দেবে_ এমনটিই বিশ্বাস।
কিন্তু বাংলাদেশ কি জানে পঞ্চাশ ভাগের বেশি চা শ্রমিক জীবনে এখনও থানা সদরও দেখেননি। এই শ্রমিকদের মূলধারার বাঙালিরা সামাজিকভাবে আবার 'অস্পৃশ্য' জ্ঞান করে! বাগানে যেসব শিশু ভাগ্যক্রমে পঞ্চম শ্রেণী পাস করে ফেলে, পরিবারের অসামর্থ্যের কারণে অনেকেই তারা উচ্চ শ্রেণীতে ভর্তি না হয়ে আবার ওই পঞ্চম শ্রেণীতে এসেই পড়ে। যুগের পর যুগ একই ভূমিতে বাস করেও ওই ভূমির মালিক নয় শ্রমিক পরিবারগুলো। ৮৫ ভাগ শ্রমিক সেখানে বাগানে ছিটানো কীটনাশকের প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে ডায়রিয়া ও চর্মরোগে আক্রান্ত। দাঁড়িয়ে কাজ করেন বলে অনেকের পায়ের পাতায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সারল্যভরা উত্তর, 'মাটি খেয়ে ফেলেছে।' আসলে কেন্দ্রীয় ঢাকার প্রবৃদ্ধি তাদের শ্রম খেয়ে ফেলেছে। আর সেই শ্রম থেকে জন্ম নিচ্ছে 'মধ্য আয়ের বাংলাদেশ'।
চা বাগিচার উপরোক্ত আদিম শোষণের মাঝে বড় হয়েও যারা অহিংস ধারায় অবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন তারা আসলে একটি বিশ্বাস নিয়ে লড়ছে। যে লড়াইয়ের খবর রাখে না বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞান। কিন্তু এ উদাসীনতা থেকেই জন্ম নিতে পারে রক্তাক্ত শ্রেণী সংগ্রামের। তখন হয়তো পুরো গণমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়বে বিদেশি ষড়যন্ত্র অনুসন্ধানে। যেমনটি ঘটে গার্মেন্ট শ্রমিকদের সংগ্রাম অভ্যুত্থানে রূপ নিলে।

আলতাফ পারভেজ : লেখক, গবেষক
altafparvez@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.