রাজাপাকসের বাংলাদেশ সফর by তারেক শামসুর রেহমান
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ সফর শেষ হয়েছে বুধবার। তাঁর ওই সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা ও যোগাযোগ উন্নয়নের পাঁচটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব চুক্তির মধ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ও শ্রীলঙ্কার রপ্তানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সহযোগিতাবিষয়ক
সমঝোতা স্মারক, দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতি বিনিময়বিষয়ক সমঝোতা স্মারক, শ্রীলঙ্কার টারশিয়ারি ও ভোকেশনাল এডুকেশন কমিশনের সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতাবিষয়ক সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ মৎস্য ও গবাদি পশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও শ্রীলঙ্কার মৎস্য ও অ্যাকুয়াটিক সম্পদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সহযোগিতা চুক্তি এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক) ও শ্রীলঙ্কা কৃষি গবেষণা নীতিবিষয়ক কাউন্সিলের মধ্যে সমঝোতা স্মারক। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কা হামবানটোটায় যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে (যা চীনের আর্থিক সহযোগিতায় নির্মিত), তা বাংলাদেশকে ব্যবহারেরও অনুমতি দিয়েছে।
শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের পুরনো বন্ধু। যে কয়টি দেশ প্রথম দিকে (১৯৭২) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, শ্রীলঙ্কা তার মধ্যে অন্যতম। তবে ইতিহাস বলে, ওই অঞ্চলটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, শ্রীলঙ্কার আদি রাজা ভিজয়ার (ঠরলধুধ) পূর্বপুরুষ ছিলেন এ অঞ্চলের মানুষ। একসময় বাংলাদেশের বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ এবং পশ্চিম বাংলার একটি অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল ভাঙ্গা সাম্রাজ্য (ভাঙ্গা বা বাঙ্গা) বা ঠধহমধ করহমফড়স (ইধহমধ)। রাজা ভিজয়ার আদি পুরুষের জন্ম এই ভাঙ্গা সাম্রাজ্যে। একসময় এই অঞ্চল ও শ্রীলঙ্কা ব্রিটেনের কলোনি ছিল। ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটির পরিচিতি ছিল সিলোন হিসেবে। শুধু ব্রিটিশরাই ওই দেশটি দখল করেনি, পর্তুগিজরাও এসেছিল ১৫০৫ সালের দিকে। গ্রিকরাও এসেছিল। তারা এর নামকরণ করেছিল ঞধঢ়ৎড়নধহব। আরব বণিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে এসে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছিল। তারা শ্রীলঙ্কায়ও এসেছিল। তারা শ্রীলঙ্কার নামকরণ করেছিল ঝবৎবহফরন। পর্তুগিজরা এ অঞ্চলটির নামকরণ করেছিল ঈবরষধড়, যা ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ঈবুষড়হ। অর্থাৎ ব্রিটিশরা পর্তুগিজদের দেওয়া নামই রেখে দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের তথা বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পর্কের আরেকটি কারণ বৌদ্ধ ধর্ম। মহারাজা অশোকের পুত্র ভিসু মাহিন্দা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য এ অঞ্চল, অর্থাৎ আজকের শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। ওই সময়কার এক রাজা দেভানাম (উবাধহধস) বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেই থেকে শুরু। শ্রীলঙ্কার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে যোগসূত্র থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্ক যে খুব উন্নত, তা বলা যাবে না। প্রায় ৩৮ বছর আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও মাত্র ২০০৮ সালে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে বাংলাদেশ যেখানে রপ্তানি করেছিল ১৪ কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকার পণ্য, সেখানে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার টাকায়। এর চেয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি রপ্তানি করে তাইওয়ান, থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুরে। আমরা যদি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমদানির পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে দেখব, যেখানে ২০০০-২০০১ সালে আমদানি হয়েছে ৪৩ কোটি ১০ লাখ টাকার পণ্য, সেখানে ২০০৬-২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ কোটি ১১ লাখ টাকায়। এর চেয়েও অনেক বেশি পণ্য আমরা আমদানি করি থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুর থেকে। সুতরাং বাণিজ্য বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশ তার পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের চামড়াজাত দ্রব্য, মেলামাইন ও প্লাস্টিক সামগ্রী, নিটওয়্যার, সাবান ও সিরামিক সামগ্রীর চাহিদা রয়েছে শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কা যদি শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়, তাহলে বাংলাদেশি পণ্যের একটি বড় বাজার হতে পারে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশি তৈরি পোশাক, চামড়া এবং ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারে। আশার কথা, রাজাপাকসের সফরের সময় এসব বিষয়ে আলোচনায় এসেছে এবং তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।
দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কায় জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল। সংখ্যালঘু তামিলরা ১৯৮৪-৮৫ সালের পর থেকে স্বাধীন একটি তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছিল, যার নেতৃত্বে ছিল তামিল টাইগাররা। তারা একটি দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল, যদিও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তারা বিতর্কিত ছিল। ১৯৮৫ সালের পর থেকে কোনো সরকারই তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। ২০০৯ সালের মে মাসে তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এর আগে তিনি তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ওই যুদ্ধে টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরন নিহত হন। টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াটা প্রয়োজন ছিল। কেননা গৃহযুদ্ধের কারণে সব ধরনের উন্নয়ন সেখানে বন্ধ হয়েছিল। এমনকি একসময় শ্রীলঙ্কা পোশাকশিল্পের নেতৃত্বে ছিল। তারা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করেছিল এ খাতে। পোশাকশিল্পের অনেক বিশেষজ্ঞ শ্রীলঙ্কার নাগরিক এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। এখন যুদ্ধের পর সেখানে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। সেখানে বিনিয়োগ বেড়েছে। বাংলাদেশ এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। যৌথ উদ্যোগে সেখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা সম্ভব। বলতে দ্বিধা নেই, সমসাময়িক শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে রাজাপাকসের জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কিংবা তামিল যুদ্ধের নায়ক জেনারেল ফনসেকার সঙ্গে বিরোধ তাঁকে কিছুটা বিতর্কিত করলেও টাইগারদের পরাজিত করায় সাধারণ সিংহলিজদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ২০০৫ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি দ্বিতীয়বারও বিজয়ী হন। ছয় বছর পর পর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। ইতিমধ্যে সেখানে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এবং রাজাপাকসের জন্য তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের পথ প্রশ্বস্ত হয়েছে। রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টির নেতা। এই দলটি দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গাও ছিলেন এই দলের নেতা। রাজাপাকসে দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশে তাঁর এই সফর যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান এক ও অভিন্ন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিক সহযোগিতা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে দুই দেশের অবস্থান এক। দুটি দেশই চায়, আঞ্চলিক সহযোগিতা আরো শক্তিশালী হোক।
দারিদ্র্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সমস্যা। দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালের কলম্বো সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশন ১৯৯২ সালে তাদের খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিল। পরবর্তীকালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সার্ক সম্মেলনে ওই ঘোষণা অনুমোদিত হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়ার ৭৪ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। আর তাদের মধ্যে ৮২ শতাংশই দরিদ্র। এই দারিদ্র্য শ্রীলঙ্কায় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাংলাদেশেও। দেশ দুটি এখন দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে যেতে পারে।
শ্রীলঙ্কা একটি ছোট্ট দেশ, বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যে অর্জন, তা বিশ্বমানের। শুধু ক্রিকেট নিয়েই যে শ্রীলঙ্কা বিশ্ব জয় করেছে তা নয়, শ্রীলঙ্কা একটি শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কার গ্র্যাজুয়েটরা আজ অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সর্বত্র বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। দেশটির শিক্ষার হার প্রায় ৮৮ শতাংশ। শিশুমৃত্যুর হার তারা কমিয়ে এনেছে। উচ্চশিক্ষায় তারা একটা মান অনুসরণ করে আসছে। ঢালাওভাবে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেনি। একটি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেবিকাগোষ্ঠী (নার্স) রয়েছে শ্রীলঙ্কায়, যাদের যথেষ্ট চাহিদা আছে বিদেশে। উচ্চশিক্ষার মডেলও আমরা গ্রহণ করতে পারি শ্রীলঙ্কা থেকে।
রাজাপাকসের বাংলাদেশ সফর শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এল। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এসব যৌথ উদ্যোগে অনেক কিছু করতে পারে। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক এখন শুধু সার্ককেই শক্তিশালী করবে না, বরং একটি সন্ত্রাসমুক্ত দক্ষিণ এশিয়া এবং সমৃদ্ধিশালী দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে বড় অবদান রাখবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের পুরনো বন্ধু। যে কয়টি দেশ প্রথম দিকে (১৯৭২) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, শ্রীলঙ্কা তার মধ্যে অন্যতম। তবে ইতিহাস বলে, ওই অঞ্চলটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক হাজার বছরের পুরনো। ইতিহাস থেকে জানা যায়, শ্রীলঙ্কার আদি রাজা ভিজয়ার (ঠরলধুধ) পূর্বপুরুষ ছিলেন এ অঞ্চলের মানুষ। একসময় বাংলাদেশের বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জ এবং পশ্চিম বাংলার একটি অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল ভাঙ্গা সাম্রাজ্য (ভাঙ্গা বা বাঙ্গা) বা ঠধহমধ করহমফড়স (ইধহমধ)। রাজা ভিজয়ার আদি পুরুষের জন্ম এই ভাঙ্গা সাম্রাজ্যে। একসময় এই অঞ্চল ও শ্রীলঙ্কা ব্রিটেনের কলোনি ছিল। ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটির পরিচিতি ছিল সিলোন হিসেবে। শুধু ব্রিটিশরাই ওই দেশটি দখল করেনি, পর্তুগিজরাও এসেছিল ১৫০৫ সালের দিকে। গ্রিকরাও এসেছিল। তারা এর নামকরণ করেছিল ঞধঢ়ৎড়নধহব। আরব বণিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে এসে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটিয়েছিল। তারা শ্রীলঙ্কায়ও এসেছিল। তারা শ্রীলঙ্কার নামকরণ করেছিল ঝবৎবহফরন। পর্তুগিজরা এ অঞ্চলটির নামকরণ করেছিল ঈবরষধড়, যা ইংরেজিতে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ঈবুষড়হ। অর্থাৎ ব্রিটিশরা পর্তুগিজদের দেওয়া নামই রেখে দিয়েছিল। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের তথা বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পর্কের আরেকটি কারণ বৌদ্ধ ধর্ম। মহারাজা অশোকের পুত্র ভিসু মাহিন্দা বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য এ অঞ্চল, অর্থাৎ আজকের শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন। ওই সময়কার এক রাজা দেভানাম (উবাধহধস) বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেই থেকে শুরু। শ্রীলঙ্কার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে যোগসূত্র থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সম্পর্ক যে খুব উন্নত, তা বলা যাবে না। প্রায় ৩৮ বছর আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও মাত্র ২০০৮ সালে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল শুরু হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যও খুব আশাব্যঞ্জক নয়। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে বাংলাদেশ যেখানে রপ্তানি করেছিল ১৪ কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার টাকার পণ্য, সেখানে ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০ কোটি ৩৭ লাখ ২৪ হাজার টাকায়। এর চেয়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি রপ্তানি করে তাইওয়ান, থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুরে। আমরা যদি শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমদানির পরিসংখ্যান দেখি, তাহলে দেখব, যেখানে ২০০০-২০০১ সালে আমদানি হয়েছে ৪৩ কোটি ১০ লাখ টাকার পণ্য, সেখানে ২০০৬-২০০৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৩ কোটি ১১ লাখ টাকায়। এর চেয়েও অনেক বেশি পণ্য আমরা আমদানি করি থাইল্যান্ড কিংবা সিঙ্গাপুর থেকে। সুতরাং বাণিজ্য বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশ তার পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাইতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের চামড়াজাত দ্রব্য, মেলামাইন ও প্লাস্টিক সামগ্রী, নিটওয়্যার, সাবান ও সিরামিক সামগ্রীর চাহিদা রয়েছে শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কা যদি শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়, তাহলে বাংলাদেশি পণ্যের একটি বড় বাজার হতে পারে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশি তৈরি পোশাক, চামড়া এবং ওষুধ শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারে। আশার কথা, রাজাপাকসের সফরের সময় এসব বিষয়ে আলোচনায় এসেছে এবং তিনি ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।
দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কায় জাতিগত দ্বন্দ্ব ছিল। সংখ্যালঘু তামিলরা ১৯৮৪-৮৫ সালের পর থেকে স্বাধীন একটি তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছিল, যার নেতৃত্বে ছিল তামিল টাইগাররা। তারা একটি দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল, যদিও তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য তারা বিতর্কিত ছিল। ১৯৮৫ সালের পর থেকে কোনো সরকারই তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। ২০০৯ সালের মে মাসে তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এর আগে তিনি তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ওই যুদ্ধে টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরন নিহত হন। টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়াটা প্রয়োজন ছিল। কেননা গৃহযুদ্ধের কারণে সব ধরনের উন্নয়ন সেখানে বন্ধ হয়েছিল। এমনকি একসময় শ্রীলঙ্কা পোশাকশিল্পের নেতৃত্বে ছিল। তারা দক্ষ জনশক্তি তৈরি করেছিল এ খাতে। পোশাকশিল্পের অনেক বিশেষজ্ঞ শ্রীলঙ্কার নাগরিক এসে বাংলাদেশের বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। এখন যুদ্ধের পর সেখানে এক ধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। সেখানে বিনিয়োগ বেড়েছে। বাংলাদেশ এই সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। যৌথ উদ্যোগে সেখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা সম্ভব। বলতে দ্বিধা নেই, সমসাময়িক শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে রাজাপাকসের জনপ্রিয়তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কিংবা তামিল যুদ্ধের নায়ক জেনারেল ফনসেকার সঙ্গে বিরোধ তাঁকে কিছুটা বিতর্কিত করলেও টাইগারদের পরাজিত করায় সাধারণ সিংহলিজদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ২০০৫ সালে তিনি প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি দ্বিতীয়বারও বিজয়ী হন। ছয় বছর পর পর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। ইতিমধ্যে সেখানে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এবং রাজাপাকসের জন্য তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্টের পথ প্রশ্বস্ত হয়েছে। রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টির নেতা। এই দলটি দীর্ঘদিন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গাও ছিলেন এই দলের নেতা। রাজাপাকসে দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও বাংলাদেশে তাঁর এই সফর যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বরং বেশ কিছু ইস্যুতে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান এক ও অভিন্ন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিক সহযোগিতা ইত্যাদি নানা ইস্যুতে দুই দেশের অবস্থান এক। দুটি দেশই চায়, আঞ্চলিক সহযোগিতা আরো শক্তিশালী হোক।
দারিদ্র্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সমস্যা। দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালের কলম্বো সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিশন ১৯৯২ সালে তাদের খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছিল। পরবর্তীকালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সপ্তম সার্ক সম্মেলনে ওই ঘোষণা অনুমোদিত হয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ এশিয়ার ৭৪ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করে। আর তাদের মধ্যে ৮২ শতাংশই দরিদ্র। এই দারিদ্র্য শ্রীলঙ্কায় যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বাংলাদেশেও। দেশ দুটি এখন দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করে যেতে পারে।
শ্রীলঙ্কা একটি ছোট্ট দেশ, বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের যে অর্জন, তা বিশ্বমানের। শুধু ক্রিকেট নিয়েই যে শ্রীলঙ্কা বিশ্ব জয় করেছে তা নয়, শ্রীলঙ্কা একটি শিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলেছে। শ্রীলঙ্কার গ্র্যাজুয়েটরা আজ অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সর্বত্র বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। দেশটির শিক্ষার হার প্রায় ৮৮ শতাংশ। শিশুমৃত্যুর হার তারা কমিয়ে এনেছে। উচ্চশিক্ষায় তারা একটা মান অনুসরণ করে আসছে। ঢালাওভাবে তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেনি। একটি দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেবিকাগোষ্ঠী (নার্স) রয়েছে শ্রীলঙ্কায়, যাদের যথেষ্ট চাহিদা আছে বিদেশে। উচ্চশিক্ষার মডেলও আমরা গ্রহণ করতে পারি শ্রীলঙ্কা থেকে।
রাজাপাকসের বাংলাদেশ সফর শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এল। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এসব যৌথ উদ্যোগে অনেক কিছু করতে পারে। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ক এখন শুধু সার্ককেই শক্তিশালী করবে না, বরং একটি সন্ত্রাসমুক্ত দক্ষিণ এশিয়া এবং সমৃদ্ধিশালী দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে বড় অবদান রাখবে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments