নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-সততার এই মূল্য? by বিশ্বজিত্ চৌধুরী

রাজনীতি ও রাজনীতিকদের কথায় কথায় তুলোধোনা করি আমরা। নিশ্চয় যুক্তিসংগত কারণও আছে এর। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। শুধু মোটা দাগে বলা চলে, সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় দুর্দশার দায় যে এই নেশা ও পেশার ব্যক্তিদের ওপর অনেকটাই বর্তায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।


কিন্তু এই প্রচলিত ধারণার বাইরে অবস্থান করেন এমন রাজনীতিক ও রাজনীতি যে আমাদের সমাজে এখনো আছে, সে কথা কি ভুলতে বসেছি আমরা? তাঁদের ত্যাগ ও অবদানের কতটা প্রতিদান দেয় এই দেশ? জানি, ব্যতিক্রম কখনোই নিয়ম নয়, কিন্তু এই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম যদি প্রকৃত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়; তাহলে দেশপ্রেম, সততা ও সদিচ্ছার মতো শব্দগুলো একসময় অভিধানের বাইরে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ কথাগুলো বলা হলো একটা আবেগ থেকে। একজন সত্ ও ত্যাগী রাজনীতিকের জীবন ও পরিণতি এই আবেগের উত্স।
রাজনীতিক হিসেবে মোহাম্মদ ইউসুফ সফল, না ব্যর্থ—এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারছি না। মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, নিজের চেতনা ও কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা এবং সর্বোপরি জনসমর্থন আদায় করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করা যদি রাজনীতিকের জীবনের সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই সফল।
মোহাম্মদ ইউসুফ ১৯৯১ সালে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ তথ্য তাঁর কৃতিত্ব বর্ণনার জন্য যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে উল্লেখ করতে হবে, তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী ফজলুল কাদের চৌধুরীর পরিবারের একজন সদস্য, ইতিপূর্বে যাঁরা ছিলেন প্রায় অপরাজেয়।
এর আগে অনেক মুক্তিযোদ্ধার কথা আমরা শুনেছি, যাঁরা পেটের দায়ে রিকশা চালিয়েছেন, অভুক্ত-অর্ধভুক্ত থেকেছেন, যথার্থ চিকিত্সার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরেছেন। কিন্তু একজন নির্বাচিত সাংসদ এ রকম দুরবস্থায় পড়তে পারেন, সে রকম শুনিনি কখনো। ক্ষমতার এত কাছাকাছি থাকলে দারিদ্র্য দূরে সরে যাবে—এটাই তো ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মোহাম্মদ ইউসুফ তার ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম বলেই হয়তো তাঁর জীবনের পরিণতি করুণ।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে এক কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন মোহাম্মদ ইউসুফ। স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর রাঙ্গুনিয়া কলেজে ভর্তি হন। তখন থেকেই বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। একাধিকবার কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে রাঙ্গুনিয়ার গরিব কৃষকদের জমি নিলাম-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে সামরিক আইনের বিচারে কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন তিনি। এই মামলার শিরোনাম ছিল ‘রাষ্ট্র বনাম মোহাম্মদ ইউসুফ ও অন্যান্য’। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামেও বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এ দেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অগ্রজ সহকর্মী প্রয়াত চৌধুরী হারুনর রশিদের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের হেফাজত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে এসে রাঙ্গুনিয়া কলেজে সহযোদ্ধাদের কাছে বিলি করেছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে রাঙ্গুনিয়া কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে নিজের আর্থিক নিরাপত্তা ও উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছেড়ে শ্রমিক রাজনীতি করার জন্য তিনি যোগ দিয়েছিলেন কর্ণফুলী পাটকলে। এ সময় আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতির সঙ্গে। বেশ কয়েকবার পাটকল সিবিএর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
রাঙ্গুনিয়ায় একসময় কাদের চৌধুরী পরিবারের দাপট এতটাই ছিল যে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দলগুলোর ছিল প্রার্থী-সংকট। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাই আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছিল তত্কালীন কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ ইউসুফকে। তখনকার আটদলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে ইউসুফ প্রথমবারের মতো পরাজিত করেন কাদের চৌধুরী পরিবারের প্রার্থীকে। তখনকার এনডিপির প্রার্থী (বর্তমান বিএনপির নেতা) গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী তাঁর কাছে হেরেছিলেন আট হাজার ভোটের ব্যবধানে। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর এলাকায় বহুধাবিভক্ত দলটিকে একটি সাংগঠনিক ভিত্তিও দিয়েছিলেন। তাঁর সম্পর্কে পত্রিকান্তরে এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেছেন, সাংসদ হয়ে যেখানে অনেকে কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, গুলশান-বনানীতে বাড়ি করেছেন, সেখানে মোহাম্মদ ইউসুফ যে নিজের জন্য শহর বা গ্রামে একখণ্ড জমি কিনতে পারলেন না, তাতেই তো প্রমাণিত হয়, কী অসম্ভব সততার পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি।
একসময় যে ছোট ভাইয়ের জন্য একটি চাকরির তদবির করতে রাজি হননি, আজ তাঁরই অভাবের সংসারে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন চিরকুমার মোহাম্মদ ইউসুফ।
প্রায় বিনা চিকিত্সায় ধুঁকে ধুঁকে মরছেন তিনি। শরীরের ডান পাশ সম্পূর্ণ অবশ। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। কথা বলেন প্রায় অবোধ্য ভাষায়। কয়েক মাস আগে মাইল্ড স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি করানো হয়েছিল তাঁকে। ২৮ দিন চিকিত্সার পর ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু অর্থাভাবে উন্নত চিকিত্সা করানো সম্ভব হয়নি। ছোট ভাই সেকান্দরও দরিদ্র। প্রতিদিন প্রায় ৪০০ টাকার ওষুধের ব্যয় বহন করা তাঁর পক্ষে দুঃসাধ্য। অর্থাভাবে ইউসুফের মোবাইল ফোনটিও বিক্রি করতে হয়েছে। সেকান্দর বলেছেন, ‘জানি, মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হবে তাঁর। কিন্তু তাতে লাভটা কী? বরং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিকিত্সার ব্যবস্থা করলে এই মানুষটির শেষ জীবনটা এত দুর্বিষহ হতো না।’
বর্তমান সাংসদদের জন্য বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করা হবে, না দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সংযোজন করা গাড়ি দেওয়া হবে—এই নিয়ে যখন সরকার গলদঘর্ম, তখন মোহাম্মদ ইউসুফের মতো একজন সাবেক সাংসদ বিনা চিকিত্সায় মারা যাবেন, এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য আর কী হতে পারে?
সত্ রাজনীতিক এখনকার সমাজে এক বিরল প্রজাতি। পরিচর্যার অভাবে বিরল প্রজাতির মানুষ যেখানে বিলুপ্ত, সেখানে সত্ মানুষের খোঁজে আমাদের অরণ্যে রোদন অর্থহীন।
সত্ রাজনীতিকদের পরিণতি যদি হয় এমনই করুণ, কোন মুখে অসত্-দুর্নীতিবাজদের সমালোচনা করব আমরা?
বিশ্বজিত্ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.