তথ্যপ্রযুক্তি-রাজশাহী হতে পারে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি-নগর by মুনির হাসান

এবার রাজশাহী গিয়ে নতুন দৃশ্য দেখলাম। বিভিন্ন রাস্তা খোঁড়া হচ্ছে। কারণ রাজশাহীতে গ্যাস যাচ্ছে। রাজশাহীবাসীর জন্য নিঃসন্দেহে খুবই আনন্দের ঘটনা। আশা করা যায়, গ্যাস সংযোগের বিষয়টি রাজশাহীর এগিয়ে যাওয়ার একটি অনুপ্রেরণা হবে। রাজশাহী আমাদের দেশের শিক্ষা নগর।


একটি সরকারি সাধারণ এবং একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সেখানে এরই মধ্যে বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। মেডিকেল, পলিটেকনিক ছাড়াও রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজ। অনেকের হয়তো ধারণা নেই যে রাজশাহী নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজ এইচএসসি পর্যায়ে দেশের প্রথম পাঁচটি কলেজের একটি। গণিত অলিম্পিয়াডের আয়োজক হিসেবে আমরা দেখেছি, রাজশাহীর শিক্ষার্থীদের গাণিতিক দক্ষতাও অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভালো।
এ রকম একটি শহরে কেন জানি কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। না, ঠিক হলো না। একটা শিল্প গড়ে উঠেছে, মেসবাড়ি শিল্প। বিভিন্ন স্থানে অনেক মেসবাড়ি গড়ে উঠেছে। সে রকম একটি বাড়ি থেকে মাসে প্রায় আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত আয় হয় বলে শুনেছি। রাজশাহীর অনেক কর্মকাণ্ডই শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক।
তবে, রাজশাহী হতে পারে বাংলাদেশের আইটি নগর। তথ্যপ্রযুক্তিকে ঘিরে নতুন একটি যুগ সেখানে শুরু হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি বা জ্ঞানভিত্তিক একটি নগর গড়ে তোলার জন্য যা যা দরকার, তার সবই সেখানে আছে। রাজশাহী শহরটি ছিমছাম, জীবনযাত্রার ব্যয় কম, অধিবাসীরা আন্তরিক। তথ্যপ্রযুক্তির জন্য একটি শহরকে গড়ে তুলতে হলে দরকার প্রযুক্তিনির্ভর গ্র্যাজুয়েটদের সরবরাহ। রাজশাহীতে সেটি খুব ভালোভাবেই আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ও কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখানে খুব ভালো মানের আইটি গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে। এর বড় প্রমাণ হলো, দেশের আইটি সংস্থাগুলোতে রুয়েট ও রাবির গ্র্যাজুয়েটদের প্রাধান্য। দ্বিতীয়ত, দরকার মোটা পাইপের ইন্টারনেট। সম্ভবত রাজশাহী আমাদের সেই সৌভাগ্যবান শহরগুলোর একটি, যেখানে বিটিসিএলের মাধ্যমে সাবমেরিন কেবেলর সুবিধা পৌঁছেছে। শুধু তা-ই নয়, ইতিমধ্যে রাজশাহীতে পৌঁছে গেছে ফাইবার অ্যাট হোমের ফাইবারও। ফলে একটি প্রধান এবং একটি বিকল্প সংযোগও এখন সেখানে নেওয়া সম্ভব। যদিও শহরে এখনো সে রকম আইএসপি নেই, তবে ইচ্ছে করলে সেখানে আইএসপি-সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
আর বিদ্যুত্? হ্যাঁ। বিদ্যুত্ নিয়ে আমাদের অন্যান্য শহরের চেয়ে ভালো নেই রাজশাহীও। তবে, যদি রাজশাহী শহরের কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থাপনাকে ভিত্তি করে প্রথম আইটি পার্কটি গড়ে ওঠে, তাহলে সেখানে বিকল্প বিদ্যুতের ব্যবস্থা করাটা কঠিন হবে না। ভবিষ্যতে রাজশাহীর বিদ্যুত্ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হবে বলে আমার ধারণা। কারণ, বড়পুকুরিয়া আর রূপপুরে হাজার মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের কথা আমরা শুনেছি।
রাজশাহীসহ আমাদের আইটি পার্কগুলোর মূল লক্ষ্য হবে বিদেশের জন্য আইটি-সেবা বা সফটওয়্যার তৈরির কাজ করা। সেই সঙ্গে রাজশাহী হতে পারে দেশের আইটি কাঠামোর দ্বিতীয় নার্ভ সেন্টার। কেননা, ঢাকা ও রাজশাহীতে একই সঙ্গে ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা কম। ঢাকার ভূমিকম্পে রাজশাহীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও কম। এ কারণে দেশের বড় ডেটা সেন্টারগুলো তাদের দুর্যোগ-পুনরুদ্ধার কেন্দ্রগুলো (ডিজাস্টার রিকভারি সেন্টার) সেখানে গড়ে তুলতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক, বিমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সরকারি ডেটা সেন্টার, বহুজাতিক সংস্থা ছাড়া এ এমনকি অন্যান্য দেশের ডেটা সেন্টারের ব্যাকআপ সেটআপ সেখানে করার কথা ভাবা যায়। কলসেন্টার গড়ে তোলার কথাও ভাবা যেতে পারে। দেশে এখন বেশ কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের কাস্টমার কেয়ার সেন্টার গড়ে তুলেছে। এগুলোর বর্ধিত অংশ হতে পারে রাজশাহীতে। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সেখানে কর্মী সরবরাহের একটি ধারাবাহিক সুযোগ থাকবে।
বিনিয়োগকারীদের জন্য সবচেয়ে বড় দিক হলো, ঢাকা বা এর আশপাশের এ রকম সেন্টার গড়ে তুলতে যে খরচ হবে, তার চেয়ে অনেক কম খরচে সেখানে এসব কেন্দ্র গড়ে তোলা যাবে।
বর্তমান সরকার দেশে বেশ কিছু আইটি পার্ক, ভিলেজ গড়ে তোলার কথা ভাবছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন করে দালানকোঠা গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু রাজশাহী অন্তত দুটি সরকারি স্থাপনা রয়েছে, যেগুলো বর্তমানে পরিত্যক্ত। ফলে, ন্যূনতম খরচে এই স্থাপনা গড়ে তোলা যায়। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের উত্সাহ জোগানোর জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশন, রাজশাহী উন্নয়ন ব্যাংকসহ এমনতর প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আইটি কাজের আউটসোর্সিংয়ের জন্য রাজশাহীভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেছে নিতে পারে। তাহলে সেখানে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইটি কোম্পানিগুলো আগ্রহী হবে।
কেবল আউটসোর্সিং বা কলসেন্টার নয়। রাজশাহীতে বিভিন্ন আইটি প্রতিষ্ঠান তাদের গবেষণা ও উন্নয়নকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারে। ঢাকার চেয়ে অনেক আরামে সেখানে গবেষণা করা যাবে, এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। এসবই আইটি খাতে রাজশাহীর অপার সম্ভাবনার মাত্র কয়েকটি।
অল্প কিছুদিন ধরে রাজশাহীর কিছু তরুণ এই লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। এবার রাজশাহীতে গিয়ে আমি তাঁদের উদ্যম, আকাঙ্ক্ষা ও মনোবল দেখে এসেছি। তাঁদের কেউ কেউ ঢাকা থেকে রাজশাহীতে ফিরে গেছেন, কাজ করছেন বিদেশের জন্য। কেউ এসেছেন বিদেশ থেকে, ইচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের আইটি পেশাজীবী গড়ে তুলবেন। অনেকেই শিক্ষাজীবনেই আউটসোর্সিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন নিজের ছোট্ট প্রতিষ্ঠান। তাঁদের চোখে দিনবদলের স্বপ্ন।
রোমের মতো শহরও এক দিনে তৈরি হয়নি। রাজশাহী আইটি নগরও নিশ্চয়ই এক দিনে হবে না। তবে সবাই মিলে স্বপ্ন দেখলে সে স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না, সত্যি হয়ে যায়। কথাটা রাজশাহীবাসী যেমন জানে, তেমনি আমরাও জানি।
রাজশাহীর নতুন প্রজন্মের স্বপ্নযাত্রা সফল হোক।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।
munir.hasan@matholympiad.org.bd

No comments

Powered by Blogger.