ধর নির্ভয় গান-দেবে আর নেবে মেলাবে, মিলিবে by আলী যাকের
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পারস্পরিক সম্মান, সহযোগিতা ও সমঝোতা কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন স্বচ্ছ মনমানসিকতা নিয়ে দুই ব্যক্তি কিংবা দুই দেশ একে অন্যের প্রতি সত্যিকারের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। ইন্দিরা গান্ধী ওই রকম মনমানসিকতা নিয়েই সমূহ বিপদ সামনে জেনেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতি।
অথচ আমরা ভারতবিদ্বেষী কথা বলাকে আমাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি অবলীলায়। সেই সঙ্গে ধর্মের জিগির তুলতেও আমরা দ্বিধা করি না
সম্প্রতি ভারতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী এবং সে দেশের ক্ষমতাসীন জোটের নেত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি মূলত এসেছিলেন ঢাকায় অনুষ্ঠিত অটিজম সম্পর্কিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের উদ্বোধন করতে। ওই উদ্বোধনের পর বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননাও তিনি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছেন যেসব ভিন দেশি নাগরিক, তাদের সবাইকে বিশেষ সম্মাননা প্রদর্শন করা হবে। ইন্দিরা গান্ধীকে সেই সম্মাননার প্রথম প্রাপক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এ নির্বাচন যে সব দিক থেকেই সবচেয়ে উপযোগী ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সম্মাননা প্রদানের দিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর গৃহীত নানা তথ্যচিত্র সমন্বয়ে নির্মিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন দেখানো হয়। এ ছাড়া তার বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রস্তাব এবং দলিল-দস্তাবেজে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার আপসহীন, ঋজু নেতৃত্ব এবং বিচক্ষণ অবস্থান সম্বন্ধে আমরা সবাই সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেতৃত্বে বিভিন্ন পশ্চিমা পরাশক্তি এবং আমাদের অতি নিকটের চীন দেশ পাকিস্তানের পক্ষে যেমন উলঙ্গভাবে অবস্থান নিয়েছিল, তখনকার ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো দুর্বল দেশ এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ত। কেবল তা-ই নয়, ওইসব পরাশক্তির হুমকি-ধমকির কাছে পরাজয় স্বীকার না করাই ছিল আশ্চর্যজনক এক বিষয়। প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী ওইসব বাধাবিপত্তিকে নানাভাবে তুচ্ছ করে এগিয়ে এসেছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, সত্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে। তার একটি বচন আমার এখনও স্পষ্ট কানে বাজে। তাকে যখন মার্কিন সরকার এই বলে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিল যে, তিনি কেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য ভারতের সীমানা খুলে দিয়েছিলেন এবং এখানকার সাধারণ মানুষকে সে সীমানা অতিক্রম করে ভারতের ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়েছিলেন? তখন তার উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, 'আমার পাশের ঘরে যখন আগুন লাগবে, মানুষের আর্তচিৎকার আমি শুনব, তাদের আবেদনকে তুচ্ছ করে আমি কি আমার ঘরের দরজা বন্ধ রাখতে পারি? এটা নিতান্তই মানবিক যে, আমার পাশের দেশের মানুষ যখন আক্রান্ত হয়, তখন তার আশ্রয়ে আমার দ্বার আমি খুলে দেব।'
সব রকম বিপদ-বাধাকে তুচ্ছ করে এ রকম একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ক'জন রাষ্ট্রনেতা আজ পর্যন্ত নিতে পেরেছেন, আমার জানা নেই। ইন্দিরা গান্ধী পেরেছিলেন। এবং এর পেছনে শক্তভাবে দাঁড়ানোর জন্য তিনি তার দেশের মানুষকে তৈরি করেছিলেন। তারা সবাই দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছিল পূর্ববঙ্গের লাঞ্ছিত, অবহেলিত, আক্রান্ত মানুষের পাশে ভাই হিসেবে দাঁড়াতে, বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিতে। এ কথা কী করে ভুলি যে, ওই সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে? সেসব সৈন্যের রক্ত রঞ্জিত করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিকে। মিলেমিশে গিয়েছিল বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যের রক্ত। কী করে ভুলি যে, স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্য ফিরে গিয়েছিল নিজ দেশে? বাংলাদেশের প্রয়োজনের চেয়ে এক দিনও বেশি অবস্থান না করে। কী করে ভুলব যে, ওই যুদ্ধের সময় এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে? ভুলি কী করে যে, ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বময় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে? চেষ্টা চালিয়েছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির এবং আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবল্পুব্দকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত করে আনার?
অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দানকারী চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয় আমাদের ভুলিয়ে দিতে যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অথবা এর নেতাদের কী ভূমিকা ছিল। নিতান্ত ক্ষুদ্র মনের অধিকারী না হলে এ কৃতঘ্নতা কোনো দেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে আমি মনে করি না। তবে এ বিষয়টি বোধ হয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কিংবা রাজনীতিতে হত্যা, ষড়যন্ত্র ও ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতাবদল ঘটিয়েছিল, তারা ছিল পাকিস্তানি পরাজিত শত্রুরই অনুচর। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ষড়যন্ত্র করে চলেছিল, কী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করা যায়। আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে, পাকিস্তানের বশ্যতা স্বীকার করে, আবার একটি আধা-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যেসব দেশ নিদ্বর্িধায় তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তাদের সঙ্গেও সম্পর্কচ্ছেদ করতে হয় বৈকি। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, আমাদের অতি নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির সূত্রপাত।
সেদিন অটিজম সম্পর্কিত সেমিনারের উদ্বোধনী বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, অর্থনীতি থেকে শুরু করে গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে এ মুহূর্তে। ইন্দিরা যেমন মহৎ হৃদয়ের মানুষ ছিলেন এবং যেমন স্পষ্টবাদী ছিলেন, তারই সানি্নধ্যে লালিত সোনিয়া গান্ধীর উচ্চারণে সেই মাহাত্ম্যই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ ক্ষুদ্রমনা আমরা এ মানসিকতার যথাযথ স্বীকৃতি দিতে সবসময়ই অপারগ।
সোনিয়া গান্ধী এক দিনে একাধিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার পর ফিরে গেছেন দিলি্লতে। তার এ সফর পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতি রাতে আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এবং পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নানা রকম আলোচনার অবতারণা করা হচ্ছে। আমার আজকের প্রসঙ্গ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর এ আলোচনা এবং মতবাদের একটা বিশ্লেষণের চেষ্টা, যা থেকে আমরা হয়তো সত্যের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হতে পারব। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এ বিষয়টি নিতান্ত জরুরি। ইতিহাসের পদযুগল প্রোথিত থাকতে হবে শক্তভাবে শক্ত মাটির ওপর। আমারই কোনো নাটকের একটি সংলাপ ছিল, 'চোরাবালির ওপর ইমারত গড়া যায় না।' অর্থাৎ মিথ্যার বেসাতি দিয়ে যদি ভিত্তি স্থাপন করার চেষ্টা করা হয়, সময়ে সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে বাধ্য। কিছু কথা স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন কোনো রকম ধোঁয়াশা না রেখেই।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে যে সন্দেহ এবং বৈষম্য আমরা লক্ষ্য করি, তার শুরু কবে থেকে? আমরা সবাই স্বীকার করব যে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধে ভারত কেবল আমাদের পাশেই এসে দাঁড়ায়নি, আমাদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা প্রদান করেছিল এবং তারও অধিক, তারা আমাদের কাঁধে কাঁধ রেখে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সে সময় ভারত সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এবং বঙ্গবল্পুব্দকে নৃসংশভাবে হত্যা করে এক স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা যখন বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে নেয়, তখনও ভারতের নেতৃত্বে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি এবং গণতন্ত্রের প্রতি, এ কথা আমরা সবাই জানি। তিনি বাংলাদেশের এ বিপর্যয়কে কোনোমতেই মেনে নিতে পারেননি। তবুও একজন সত্যিকারে গণতান্ত্রিক সহনশীলতাসম্পন্ন নেতা হিসেবে তিনি বাংলাদেশে সংঘটিত সব দুরাচারকে আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে কখনোই কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয় তখনই, যখন বাংলাদেশের সামরিক জান্তা পাকিস্তানি স্টাইলে ভারতকে বাংলাদেশের প্রথম এবং প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। এ কথা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে বলেছিল বাংলাদেশের তখনকার ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা এবং তাদের উত্তরসূরিরা এখনও সময় সময় তাদের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য ওই কথাই বলে বেড়ায়। যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সুর অনেকটা নরম হয়ে এসেছে। এক হাতে কখনও তালি বাজে না। আমার দেশসংলগ্ন একটি দেশ, যা আমাকে তিন দিক থেকে ঘিরে রয়েছে এবং আমার স্বাধীনতায় যার অবদান অনস্বীকার্য, তাকেই যদি আমি শত্রু হিসেবে গণ্য করি, তাহলে সে দেশটি কেন আমার প্রতি আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার গলা বাড়িয়ে দিয়ে মাথাটা হারাবে? অতএব, এটাই স্বাভাবিক যে, ইট ছুড়ে মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। এবং যেমন ইংরেজিতে বলা হয়, 'কাচের দুর্গে বাস করে কারও প্রতি ঢিল ছোড়া যায় না।' এ চিন্তাগুলো বোধ হয় আমাদের সামরিক শাসকদের মাথায় কোনোদিন ঢোকেনি। সমূহ বিপদ জেনেও এ কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না, যুক্তির কোনো কথাই কোনোদিন কি তাদের মাথায় ঢুকেছে? অতএব, যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ফলে গঙ্গার যে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি আমরা পাচ্ছিলাম, সেটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সে ব্যাপারেও ভারত নিস্পৃহ হয়ে পড়েছিল। সীমান্তে গোলযোগ নিরসনে ভারতের কোনো উদ্যোগই আমরা দেখতে পাইনি। ছিটমহলগুলো সম্বন্ধে ওই মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তাও শীতল প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপিত হয়। এ রকম আরও হাজারো নিদর্শন হাজির করা যায়, এ আলোচনা প্রসঙ্গে যা থেকে আমি বিরত থাকব স্থান সংকুলানের স্বার্থে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শুরু হয় দুটি মানুষের মধ্যে। একজন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি এ কথা মানি যে, দু'জন মানুষের মধ্যে ঠিক যেমন ভাবের আদান-প্রদান হতে পারে, হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলা যেতে পারে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুখ ও দুঃখকে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, অথবা তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে পারস্পরিক মতবিরোধ মিটিয়ে ফেলা যেতে পারে, একইভাবে দুটি রাষ্ট্রের ব্যাপারেও সম্পর্কের অগ্রগতি, কী অধঃগতি নির্ভর করে। তবে এটা সত্য যে, দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও অনেক রাষ্ট্রের স্বার্থ হয়তো ভাবনা-চিন্তা করে দেখার বিষয় আছে। কিন্তু সর্বাগ্রে যে দুটি রাষ্ট্রের প্রতিবেশী হিসেবে অবস্থান, সে দুটির ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সবচেয়ে প্রধান। আমরা জানি, পারস্পরিক বল্পুব্দত্বের মাধ্যমে অনেক কিছুই অর্জন করা যায়। আজকের বিশ্বের সবচেয়ে দাপুটে যে পরাশক্তি, সেই যুক্তরাষ্ট্রও তার একসময়ের সবচেয়ে বড় শত্রু চীনের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সম্পর্ককে মোটামুটি একটি সহনীয় জায়গায় নিয়ে এসেছে। হঠাৎ মনে পড়ল, সাম্যবাদী বিশ্বকে একসময়ের অতি জনপ্রিয় মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান 'শয়তান' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সে কথা ভাবলে এখন হাসি পায়।
যাকগে, উদারহণটি আমি এখানে টানলাম এ কারণে যে, পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে সব দেশকেই ছাড় দিতে হয়। ভারত আগ বাড়িয়ে আমাদের সবকিছু দিয়ে যাবে আর আমরা কেবলই বলতে থাকব যে, তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়, এভাবে তো সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব নয়? আজকালকার রাজনৈতিক আলোচনায়, কি গণমাধ্যমে, কি তার বাইরে, আমরা প্রথমেই শুরু করে দিই এ সন্দেহ দিয়ে যে, ভারত যা কিছু করুক, তার পেছনে নিশ্চয়ই একটি স্বার্থ কাজ করে। এসব আলোচকের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, স্বার্থ অবশ্যই কাজ করে। আপনি যখন বাংলাদেশের ধ্বজাবাহী হিসেবে নিজের বক্তব্য পেশ করেন, সেখানে আপনার স্বার্থ কাজ করে না? কেবল দুঃখ লাগে এ ভেবে যে, সেখানে দেশের চেয়ে বড় স্বার্থ হয়ে দাঁড়ায় একটি দল, কী সেই দলের নেতা। এবং তাদেরই মতবাদ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। আমরা বিরক্ত হয়ে টেলিভিশনের কান মুচড়ে বন্ধ করে অথবা যে পত্রিকায় ওই ধরনের একপেশে মন্তব্য ছাপা হয়, সে পত্রিকাটি জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিই। এ মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি মনে আসছে। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছো অপমান, অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান।' আমরা যদি কৃতঘ্ন হয়েই থাকি, তার মূল্য আমাদের দিতে হবে। তবে তা দেওয়া হয়ে গেছে বলেই আপাতত আমি ধরে নেব। এ কারণেই এ লেখাটি যখন লিখছি তখন হঠাৎ মনে হলো, সত্যি বিচিত্র এ দেশ। এই অতি সম্প্রতি সোনিয়া গান্ধী যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখন আমাদের দেশের যে দলটি সবচেয়ে বেশি ভারতবিদ্বেষী, তারা উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে দিয়েছিল। তিনি চলে যাওয়ার পরপরই তারাই আবার শুরু করে দিয়েছে সেই ভ্যান্তারা_ এটা দেখতে হবে, ওটা দেখতে হবে ইত্যাদি, প্রভৃতি। অথচ তারাও তো কয়েক দফায় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে সে সময় কখনও তো তারা তাদের পাকিস্তানপ্রেমিক/দোসরদের সঙ্গে আঁতাত করে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেনি? সাহস হয়নি! তাদের শাসনামলের প্রথম দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর না হয় যেন, সে কারণে আরবি উক্তিসংবলিত সব বিলবোর্ড ঢেকে দেওয়া হয়েছিল, সে কথা কি সবাই ভুলে গেছে? তাদের নেতাই এটি করেছিলেন। কেন? কারণ, যারা দুর্বল, তারা পেছনে অনেক কথাই বলতে পারে। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলার সাহস তাদের নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, জেলে চার নেতার হত্যা_ এসব দুষ্কৃতি যে মার্কিন-মধ্যপ্রাচ্য-চীন-পাকিস্তান আঁতাত এ দেশে ঘটিয়েছিল, যারা এ দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল একসময় রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যা করে, তারা ছিল সত্যিকার অর্থে দুর্বল।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পারস্পরিক সম্মান, সহযোগিতা ও সমঝোতা কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন স্বচ্ছ মনমানসিকতা নিয়ে দুই ব্যক্তি কিংবা দুই দেশ একে অন্যের প্রতি সত্যিকারের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। ইন্দিরা গান্ধী ওই রকম মনমানসিকতা নিয়েই সমূহ বিপদ সামনে জেনেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতি। অথচ আমরা ভারতবিদ্বেষী কথা বলাকে আমাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি অবলীলায়। সে সঙ্গে ধর্মের জিগির তুলতেও আমরা দ্বিধা করি না। একটি বিশেষ দল ক্ষমতায় এলে অর্ধেক দেশ ভারতের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে কিংবা মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি দেওয়া হবে_ এ ধরনের নিকৃষ্টমানের সস্তা স্লোগান যেসব নেতাকর্মীর মুখে উচ্চারিত হয়, তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় বাংলাদেশকে একটি সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যাওয়া। এই দ্বিপক্ষীয়, কি বহুপক্ষীয় সম্পর্ক কেবল তখনই বিশ্বাসযোগ্যতা পায়, যখন সব দেশ সম্পর্কের ব্যাপারে সৎ ও নির্বিবাদী হয়। আমি বল্পুব্দত্ব কামনা করব, সব ক্ষেত্রে সহযোগিতা কামনা করব এবং পারস্পরিক লেনদেনে সমতার কথা বলব, কিন্তু তার মধ্যে অস্বচ্ছতা থাকবে, অসত্য উচ্চারণ থাকবে_ এ বিষয়টি কারও পক্ষেই বোঝা দুষ্কর নয়। সুতরাং, আমার পাশের ঘরের প্রতিবেশী খুব সহজেই বুঝতে পারে আমার মনমানসিকতা এবং সেভাবেই আচরণ করে আমার সঙ্গে।
আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান যে ভুল বোঝাবুঝি এবং সমস্যাগুলো আছে, যার অধিকাংশের জন্ম বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীকালে, তার সত্বর অপসারণ এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য এবং উভয়ের মধ্যে একটি সম্মানজনক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই কেবল আমাদের পথ চলাকে মসৃণ ও নিষ্কণ্টক করে তুলতে পারে।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সম্প্রতি ভারতীয় কংগ্রেসের সভানেত্রী এবং সে দেশের ক্ষমতাসীন জোটের নেত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধীর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী ঢাকায় এসেছিলেন। তিনি মূলত এসেছিলেন ঢাকায় অনুষ্ঠিত অটিজম সম্পর্কিত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের উদ্বোধন করতে। ওই উদ্বোধনের পর বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে ইন্দিরা গান্ধীকে দেওয়া বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননাও তিনি গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ সরকার আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছেন যেসব ভিন দেশি নাগরিক, তাদের সবাইকে বিশেষ সম্মাননা প্রদর্শন করা হবে। ইন্দিরা গান্ধীকে সেই সম্মাননার প্রথম প্রাপক হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এ নির্বাচন যে সব দিক থেকেই সবচেয়ে উপযোগী ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সম্মাননা প্রদানের দিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ওপর গৃহীত নানা তথ্যচিত্র সমন্বয়ে নির্মিত একটি বিশেষ প্রতিবেদন দেখানো হয়। এ ছাড়া তার বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রস্তাব এবং দলিল-দস্তাবেজে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার আপসহীন, ঋজু নেতৃত্ব এবং বিচক্ষণ অবস্থান সম্বন্ধে আমরা সবাই সম্যক জ্ঞান লাভ করতে পারি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেতৃত্বে বিভিন্ন পশ্চিমা পরাশক্তি এবং আমাদের অতি নিকটের চীন দেশ পাকিস্তানের পক্ষে যেমন উলঙ্গভাবে অবস্থান নিয়েছিল, তখনকার ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের যে কোনো দুর্বল দেশ এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ত। কেবল তা-ই নয়, ওইসব পরাশক্তির হুমকি-ধমকির কাছে পরাজয় স্বীকার না করাই ছিল আশ্চর্যজনক এক বিষয়। প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী ওইসব বাধাবিপত্তিকে নানাভাবে তুচ্ছ করে এগিয়ে এসেছিলেন গণতন্ত্রের পক্ষে, অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে, সত্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে। তার একটি বচন আমার এখনও স্পষ্ট কানে বাজে। তাকে যখন মার্কিন সরকার এই বলে হেনস্তা করার চেষ্টা করেছিল যে, তিনি কেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য ভারতের সীমানা খুলে দিয়েছিলেন এবং এখানকার সাধারণ মানুষকে সে সীমানা অতিক্রম করে ভারতের ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়েছিলেন? তখন তার উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, 'আমার পাশের ঘরে যখন আগুন লাগবে, মানুষের আর্তচিৎকার আমি শুনব, তাদের আবেদনকে তুচ্ছ করে আমি কি আমার ঘরের দরজা বন্ধ রাখতে পারি? এটা নিতান্তই মানবিক যে, আমার পাশের দেশের মানুষ যখন আক্রান্ত হয়, তখন তার আশ্রয়ে আমার দ্বার আমি খুলে দেব।'
সব রকম বিপদ-বাধাকে তুচ্ছ করে এ রকম একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ক'জন রাষ্ট্রনেতা আজ পর্যন্ত নিতে পেরেছেন, আমার জানা নেই। ইন্দিরা গান্ধী পেরেছিলেন। এবং এর পেছনে শক্তভাবে দাঁড়ানোর জন্য তিনি তার দেশের মানুষকে তৈরি করেছিলেন। তারা সবাই দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছিল পূর্ববঙ্গের লাঞ্ছিত, অবহেলিত, আক্রান্ত মানুষের পাশে ভাই হিসেবে দাঁড়াতে, বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিতে। এ কথা কী করে ভুলি যে, ওই সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে? সেসব সৈন্যের রক্ত রঞ্জিত করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিকে। মিলেমিশে গিয়েছিল বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যের রক্ত। কী করে ভুলি যে, স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবল্পুব্দ শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্য ফিরে গিয়েছিল নিজ দেশে? বাংলাদেশের প্রয়োজনের চেয়ে এক দিনও বেশি অবস্থান না করে। কী করে ভুলব যে, ওই যুদ্ধের সময় এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল ভারতের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে? ভুলি কী করে যে, ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বময় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে? চেষ্টা চালিয়েছিলেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির এবং আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবল্পুব্দকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত করে আনার?
অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় নেতৃত্ব দানকারী চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয় আমাদের ভুলিয়ে দিতে যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অথবা এর নেতাদের কী ভূমিকা ছিল। নিতান্ত ক্ষুদ্র মনের অধিকারী না হলে এ কৃতঘ্নতা কোনো দেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে আমি মনে করি না। তবে এ বিষয়টি বোধ হয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, যারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে কিংবা রাজনীতিতে হত্যা, ষড়যন্ত্র ও ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতাবদল ঘটিয়েছিল, তারা ছিল পাকিস্তানি পরাজিত শত্রুরই অনুচর। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ষড়যন্ত্র করে চলেছিল, কী করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করা যায়। আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে, পাকিস্তানের বশ্যতা স্বীকার করে, আবার একটি আধা-উপনিবেশবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় যেসব দেশ নিদ্বর্িধায় তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, তাদের সঙ্গেও সম্পর্কচ্ছেদ করতে হয় বৈকি। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই, আমাদের অতি নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির সূত্রপাত।
সেদিন অটিজম সম্পর্কিত সেমিনারের উদ্বোধনী বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, অর্থনীতি থেকে শুরু করে গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে এ মুহূর্তে। ইন্দিরা যেমন মহৎ হৃদয়ের মানুষ ছিলেন এবং যেমন স্পষ্টবাদী ছিলেন, তারই সানি্নধ্যে লালিত সোনিয়া গান্ধীর উচ্চারণে সেই মাহাত্ম্যই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ ক্ষুদ্রমনা আমরা এ মানসিকতার যথাযথ স্বীকৃতি দিতে সবসময়ই অপারগ।
সোনিয়া গান্ধী এক দিনে একাধিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার পর ফিরে গেছেন দিলি্লতে। তার এ সফর পরবর্তী সময়ে প্রায় প্রতি রাতে আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এবং পত্রপত্রিকায় প্রতিদিন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে নানা রকম আলোচনার অবতারণা করা হচ্ছে। আমার আজকের প্রসঙ্গ ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর এ আলোচনা এবং মতবাদের একটা বিশ্লেষণের চেষ্টা, যা থেকে আমরা হয়তো সত্যের অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হতে পারব। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য এ বিষয়টি নিতান্ত জরুরি। ইতিহাসের পদযুগল প্রোথিত থাকতে হবে শক্তভাবে শক্ত মাটির ওপর। আমারই কোনো নাটকের একটি সংলাপ ছিল, 'চোরাবালির ওপর ইমারত গড়া যায় না।' অর্থাৎ মিথ্যার বেসাতি দিয়ে যদি ভিত্তি স্থাপন করার চেষ্টা করা হয়, সময়ে সেটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে বাধ্য। কিছু কথা স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন কোনো রকম ধোঁয়াশা না রেখেই।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে যে সন্দেহ এবং বৈষম্য আমরা লক্ষ্য করি, তার শুরু কবে থেকে? আমরা সবাই স্বীকার করব যে, ১৯৭১-এ পাকিস্তানের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধে ভারত কেবল আমাদের পাশেই এসে দাঁড়ায়নি, আমাদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা প্রদান করেছিল এবং তারও অধিক, তারা আমাদের কাঁধে কাঁধ রেখে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। সে সময় ভারত সরকারের নেতৃত্বে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এবং বঙ্গবল্পুব্দকে নৃসংশভাবে হত্যা করে এক স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা যখন বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করে নেয়, তখনও ভারতের নেতৃত্বে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতি এবং গণতন্ত্রের প্রতি, এ কথা আমরা সবাই জানি। তিনি বাংলাদেশের এ বিপর্যয়কে কোনোমতেই মেনে নিতে পারেননি। তবুও একজন সত্যিকারে গণতান্ত্রিক সহনশীলতাসম্পন্ন নেতা হিসেবে তিনি বাংলাদেশে সংঘটিত সব দুরাচারকে আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে কখনোই কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয় তখনই, যখন বাংলাদেশের সামরিক জান্তা পাকিস্তানি স্টাইলে ভারতকে বাংলাদেশের প্রথম এবং প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে। এ কথা অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে বলেছিল বাংলাদেশের তখনকার ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা এবং তাদের উত্তরসূরিরা এখনও সময় সময় তাদের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য ওই কথাই বলে বেড়ায়। যদিও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সুর অনেকটা নরম হয়ে এসেছে। এক হাতে কখনও তালি বাজে না। আমার দেশসংলগ্ন একটি দেশ, যা আমাকে তিন দিক থেকে ঘিরে রয়েছে এবং আমার স্বাধীনতায় যার অবদান অনস্বীকার্য, তাকেই যদি আমি শত্রু হিসেবে গণ্য করি, তাহলে সে দেশটি কেন আমার প্রতি আহ্লাদে আটখানা হয়ে তার গলা বাড়িয়ে দিয়ে মাথাটা হারাবে? অতএব, এটাই স্বাভাবিক যে, ইট ছুড়ে মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। এবং যেমন ইংরেজিতে বলা হয়, 'কাচের দুর্গে বাস করে কারও প্রতি ঢিল ছোড়া যায় না।' এ চিন্তাগুলো বোধ হয় আমাদের সামরিক শাসকদের মাথায় কোনোদিন ঢোকেনি। সমূহ বিপদ জেনেও এ কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারছি না, যুক্তির কোনো কথাই কোনোদিন কি তাদের মাথায় ঢুকেছে? অতএব, যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির ফলে গঙ্গার যে ৪৪ হাজার কিউসেক পানি আমরা পাচ্ছিলাম, সেটি প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, সে ব্যাপারেও ভারত নিস্পৃহ হয়ে পড়েছিল। সীমান্তে গোলযোগ নিরসনে ভারতের কোনো উদ্যোগই আমরা দেখতে পাইনি। ছিটমহলগুলো সম্বন্ধে ওই মুজিব-ইন্দিরা বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তাও শীতল প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপিত হয়। এ রকম আরও হাজারো নিদর্শন হাজির করা যায়, এ আলোচনা প্রসঙ্গে যা থেকে আমি বিরত থাকব স্থান সংকুলানের স্বার্থে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শুরু হয় দুটি মানুষের মধ্যে। একজন সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমি এ কথা মানি যে, দু'জন মানুষের মধ্যে ঠিক যেমন ভাবের আদান-প্রদান হতে পারে, হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলা যেতে পারে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুখ ও দুঃখকে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, অথবা তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে পারস্পরিক মতবিরোধ মিটিয়ে ফেলা যেতে পারে, একইভাবে দুটি রাষ্ট্রের ব্যাপারেও সম্পর্কের অগ্রগতি, কী অধঃগতি নির্ভর করে। তবে এটা সত্য যে, দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও অনেক রাষ্ট্রের স্বার্থ হয়তো ভাবনা-চিন্তা করে দেখার বিষয় আছে। কিন্তু সর্বাগ্রে যে দুটি রাষ্ট্রের প্রতিবেশী হিসেবে অবস্থান, সে দুটির ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সবচেয়ে প্রধান। আমরা জানি, পারস্পরিক বল্পুব্দত্বের মাধ্যমে অনেক কিছুই অর্জন করা যায়। আজকের বিশ্বের সবচেয়ে দাপুটে যে পরাশক্তি, সেই যুক্তরাষ্ট্রও তার একসময়ের সবচেয়ে বড় শত্রু চীনের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সম্পর্ককে মোটামুটি একটি সহনীয় জায়গায় নিয়ে এসেছে। হঠাৎ মনে পড়ল, সাম্যবাদী বিশ্বকে একসময়ের অতি জনপ্রিয় মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান 'শয়তান' বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সে কথা ভাবলে এখন হাসি পায়।
যাকগে, উদারহণটি আমি এখানে টানলাম এ কারণে যে, পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে সব দেশকেই ছাড় দিতে হয়। ভারত আগ বাড়িয়ে আমাদের সবকিছু দিয়ে যাবে আর আমরা কেবলই বলতে থাকব যে, তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়, এভাবে তো সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব নয়? আজকালকার রাজনৈতিক আলোচনায়, কি গণমাধ্যমে, কি তার বাইরে, আমরা প্রথমেই শুরু করে দিই এ সন্দেহ দিয়ে যে, ভারত যা কিছু করুক, তার পেছনে নিশ্চয়ই একটি স্বার্থ কাজ করে। এসব আলোচকের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, স্বার্থ অবশ্যই কাজ করে। আপনি যখন বাংলাদেশের ধ্বজাবাহী হিসেবে নিজের বক্তব্য পেশ করেন, সেখানে আপনার স্বার্থ কাজ করে না? কেবল দুঃখ লাগে এ ভেবে যে, সেখানে দেশের চেয়ে বড় স্বার্থ হয়ে দাঁড়ায় একটি দল, কী সেই দলের নেতা। এবং তাদেরই মতবাদ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। আমরা বিরক্ত হয়ে টেলিভিশনের কান মুচড়ে বন্ধ করে অথবা যে পত্রিকায় ওই ধরনের একপেশে মন্তব্য ছাপা হয়, সে পত্রিকাটি জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিই। এ মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের কলি মনে আসছে। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছো অপমান, অপমানে হতে হবে তাদের সবার সমান।' আমরা যদি কৃতঘ্ন হয়েই থাকি, তার মূল্য আমাদের দিতে হবে। তবে তা দেওয়া হয়ে গেছে বলেই আপাতত আমি ধরে নেব। এ কারণেই এ লেখাটি যখন লিখছি তখন হঠাৎ মনে হলো, সত্যি বিচিত্র এ দেশ। এই অতি সম্প্রতি সোনিয়া গান্ধী যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখন আমাদের দেশের যে দলটি সবচেয়ে বেশি ভারতবিদ্বেষী, তারা উভয় দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে দিয়েছিল। তিনি চলে যাওয়ার পরপরই তারাই আবার শুরু করে দিয়েছে সেই ভ্যান্তারা_ এটা দেখতে হবে, ওটা দেখতে হবে ইত্যাদি, প্রভৃতি। অথচ তারাও তো কয়েক দফায় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় থাকাকালে সে সময় কখনও তো তারা তাদের পাকিস্তানপ্রেমিক/দোসরদের সঙ্গে আঁতাত করে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেনি? সাহস হয়নি! তাদের শাসনামলের প্রথম দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর না হয় যেন, সে কারণে আরবি উক্তিসংবলিত সব বিলবোর্ড ঢেকে দেওয়া হয়েছিল, সে কথা কি সবাই ভুলে গেছে? তাদের নেতাই এটি করেছিলেন। কেন? কারণ, যারা দুর্বল, তারা পেছনে অনেক কথাই বলতে পারে। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলার সাহস তাদের নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, জেলে চার নেতার হত্যা_ এসব দুষ্কৃতি যে মার্কিন-মধ্যপ্রাচ্য-চীন-পাকিস্তান আঁতাত এ দেশে ঘটিয়েছিল, যারা এ দেশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল একসময় রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যা করে, তারা ছিল সত্যিকার অর্থে দুর্বল।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পারস্পরিক সম্মান, সহযোগিতা ও সমঝোতা কেবল তখনই সম্ভব হয়, যখন স্বচ্ছ মনমানসিকতা নিয়ে দুই ব্যক্তি কিংবা দুই দেশ একে অন্যের প্রতি সত্যিকারের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। ইন্দিরা গান্ধী ওই রকম মনমানসিকতা নিয়েই সমূহ বিপদ সামনে জেনেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রতি। অথচ আমরা ভারতবিদ্বেষী কথা বলাকে আমাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করি অবলীলায়। সে সঙ্গে ধর্মের জিগির তুলতেও আমরা দ্বিধা করি না। একটি বিশেষ দল ক্ষমতায় এলে অর্ধেক দেশ ভারতের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হবে কিংবা মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি দেওয়া হবে_ এ ধরনের নিকৃষ্টমানের সস্তা স্লোগান যেসব নেতাকর্মীর মুখে উচ্চারিত হয়, তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয় বাংলাদেশকে একটি সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যাওয়া। এই দ্বিপক্ষীয়, কি বহুপক্ষীয় সম্পর্ক কেবল তখনই বিশ্বাসযোগ্যতা পায়, যখন সব দেশ সম্পর্কের ব্যাপারে সৎ ও নির্বিবাদী হয়। আমি বল্পুব্দত্ব কামনা করব, সব ক্ষেত্রে সহযোগিতা কামনা করব এবং পারস্পরিক লেনদেনে সমতার কথা বলব, কিন্তু তার মধ্যে অস্বচ্ছতা থাকবে, অসত্য উচ্চারণ থাকবে_ এ বিষয়টি কারও পক্ষেই বোঝা দুষ্কর নয়। সুতরাং, আমার পাশের ঘরের প্রতিবেশী খুব সহজেই বুঝতে পারে আমার মনমানসিকতা এবং সেভাবেই আচরণ করে আমার সঙ্গে।
আমাদের দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান যে ভুল বোঝাবুঝি এবং সমস্যাগুলো আছে, যার অধিকাংশের জন্ম বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীকালে, তার সত্বর অপসারণ এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য এবং উভয়ের মধ্যে একটি সম্মানজনক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠাই কেবল আমাদের পথ চলাকে মসৃণ ও নিষ্কণ্টক করে তুলতে পারে।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments