অফিসে 'কেউকেটা'দের ভিড়

অনিয়মই যেখানে নিয়ম', 'বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ', 'পাইক-পেয়াদার খবরদারি' ইত্যাদি বাক্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতায় অনেকেরই বিদ্যমান চিত্রের নেতিবাচক প্রভাব খেদোক্তিতে প্রকাশ পায়। ২৩ এপ্রিল কালের কণ্ঠের 'ওরা কেউ না তবু অফিসের বস' শিরোনামের প্রতিবেদনেও এসবেরই প্রতিফলন ঘটেছে; যা সমাজ, দেশ, নাগরিক মহলের জন্য অকল্যাণকর বার্তাবহ।


দেশের বেশির ভাগ অফিসে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা এবং অপকর্মের হোতা, দালাল, প্রতারক, স্বেচ্ছাচারী-ক্ষমতাবানদের যে চিত্র সাধারণভাবে দৃষ্টিগোচর হয়, তা জনকল্যাণকামী প্রশাসন কিংবা সেবাব্যবস্থার জন্য বড় বেশি বৈরী। ভূমি অফিস, কাস্টম হাউস, থানা, বিআরটিএ প্রভৃতি অফিসের বিদ্যমান চিত্রের যে বাস্তব প্রতিফলন ওই প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে, তা দীর্ঘদিনের অপক্রিয়ার বর্তমান পুষ্ট ফল_এমনটি দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়। ফলে সাধারণ মানুষের অন্তহীন ভোগান্তি আর অধিকারবঞ্চিত থাকার যেমন সাক্ষ্য মেলে, তেমনি রাষ্ট্রের বিবর্ণ চিত্রও ফুটে ওঠে।
অফিসের কেউ না তবু তারাই অফিসের 'কেউকেটা'_এই যে অলিখিত ধারা দিনের পর দিন চলে আসছে, এর বিরূপ প্রভাব ক্রমেই বহুমুখী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তারা অন্যায়-অনৈতিক কাণ্ডকীর্তি চালিয়ে একদিকে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে, অন্যদিকে যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তারা সব হীনস্বার্থ চরিতার্থে উন্মাদনা চালাচ্ছে, তা নিয়ম-শৃঙ্খলার স্তম্ভকে ধসিয়ে দিচ্ছে। দুর্নীতির বিষবৃক্ষ পল্লবিত হচ্ছে এবং অনিয়মই অলিখিতভাবে নিয়মে পরিণত হচ্ছে। এ অপধারা একটি সমাজ, রাষ্ট্র ও নাগরিক মহলের জন্য অভিশাপসম। কালের কণ্ঠের ওই প্রতিবেদনে পৃথকভাবে সেই চিত্রই উপস্থাপিত হয়েছে। একেকটি অফিসে অসাধু ক্ষমতাবানদের যে উন্মাদনা চলছে, তা সরকারের নীতিনির্ধারকদের অজানা থাকার কথা নয়। যেসব অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, 'অফিসের কেউ না দের' পরিকল্পনামাফিক 'কেউকেটা' হওয়ার পথটা সুগম করে দিচ্ছে তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে। ওদের চিহ্নিত করা নিশ্চয়ই কঠিন কোনো কাজ নয়। আমরা মনে করি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা আর জনসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বৃহৎ জনস্বার্থেই কালবিলম্ব না করে 'কেউকেটা'দের মূলোৎপাটন করা জরুরি।
যেকোনো অফিসের কার্যক্রম চলবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে, নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে_এটিই খুব স্বাভাবিক বিষয়। এ দেশে দুর্নীতি যে বড় ধরনের ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে, তা শুধু এর ব্যত্যয় ঘটার কারণেই। প্রায় প্রতিটি সরকারই দুর্নীতির মূলোচ্ছেদের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় আসছে বটে; কিন্তু বিদ্যমান চিত্র এখনো এর বিপরীত পরিস্থিতিই তুলে ধরছে। অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে সর্বাগ্রে। প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী জনগণের সেবক। জনগণের কাছে তাঁরা অবশ্যই দায়বদ্ধ। এসব কথা যাঁরা ভুলে গেছেন, তাঁদের তা মনে করিয়ে দেওয়া, তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের কর্তব্য। 'কেউকেটা'দের দাপট যাতে চির নির্মূল হয়, সে ব্যবস্থা সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। 'উমেদার', 'ফালতু', 'গ্যাটিস', 'রাইটার'_এসব পরিচয়ে পরিচিত হয়ে যাচ্ছেতাই করার কারোরই কোনো অবকাশ নেই।

No comments

Powered by Blogger.