বাঘা তেঁতুল-পিতৃভিটায় পেয়ারাদা প্রণাম পেলেন by সৈয়দ আবুল মকসুদ
অনেক সময় লেখার বিষয় পাওয়া যায় তো তার একটা জুতসই শিরোনাম পাওয়া যায় না, কারও সাহায্য নিতে হয়। আমার এ লেখাটির শিরোনাম আমি পেয়ে গেছি কলকাতার একটি প্রধান বাংলা দৈনিক থেকে। আমাদের সাবেক সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গত মাসে গিয়েছিলেন তাঁর জন্মভূমি জলপাইগুড়ি বেড়াতে।
তাঁর সেই সফরের পাঁচ কলামব্যাপী শিরোনাম প্রায় এ রকম: পৈতৃক ভিটায় এসে পেয়ারাদা প্রণাম পেলেন।
কবিতায় অনুপ্রাণ থাকলে ভালো, জীবনে অনুপ্রাণ থাকলে তা আরও ভালো। পেয়ারা থেকে প্রেসিডেন্টে প্রমোশন পাওয়া সবার ভাগ্যে জোটে না। আবার জীবনের পড়ন্তবেলায় পেয়ারাদায় প্রত্যাবর্তন, সেটাও কম কপালের কথা নয়। আমাদের কাছে তিনি সামরিক শাসক অথবা রাষ্ট্রপতি অথবা একটি বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান, কিন্তু তাঁর জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গে, তিনি তাঁর নাতির বয়সী সাংবাদিকের কাছে পেয়ারাদা। তাই সেখানে তাঁরা শিরোনাম দেন ‘ঘরের ছেলে পেয়ারাদাকে প্রণাম’ অথবা ‘পৈতৃক ভিটায় এলেন পেয়ারাদা’ প্রভৃতি। তাঁরা লিখেছেন, ৬ ডিসেম্বর ‘দুপুরে দিনহাটায় তাঁর পৈতৃক ভিটেতে এলেন। পুলিশি বেষ্টনীর মধ্যে শত শত মানুষের অভিনন্দন গ্রহণ করেন ঘরের ছেলে পেয়ারাদা। তখন বাড়ির টানে পেয়ারাদাকে দেখতে কৌতূহলী অপেক্ষমাণ জনতা। সকলেই উদগ্রীব। তারপর বাড়ির উঠোনে তৈরি মঞ্চে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সকলকে [সকলের] শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন এরশাদ।’ [দৈনিক স্টেটসম্যান]
আরও লেখা হয়েছে, ‘পড়ন্ত বেলায় ঘরের ছেলে...এসে পৌঁছলেন দিনহাটায়। বিলাসবহুল বিশেষ গাড়িতে...চ্যাংরাবান্দা সীমান্ত দিয়ে দিনহাটায় এসে পৌঁছান তিনি।...পুরোনো বাসস্ট্যান্ডের নিকট ফুলদিঘির পাড়ের পৈতৃক ভিটেতে আসেন।...এরই মধ্যে জনতার বাঁধভাঙা উল্লাস আছড়ে পড়ে পেয়ারাদাকে দেখার জন্য।...তিনি হাত নাড়িয়ে তাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন পর পৈতৃক ভিটেতে এসে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তবে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেন।’
আমরা তো জানি, জীবনে অগণিতবার তিনি ‘আবেগাপ্লুত’ হয়েছেন এবং তারপরই ‘নিজেকে সামলে’ নিয়েছেন। সেদিন সাংবাদিকদের সঙ্গেও তিনি কথা বলেন ‘আবেগঘন কণ্ঠে’। এতকাল পরে হঠাত্ এখন ‘পূর্বপুরুষের ভিটার টানে’ কেন তিনি পশ্চিমবঙ্গে? সংবাদপত্র লিখেছে, ‘শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে তিনি খুবই আশাবাদী। একপক্ষ কালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদের পৈতৃক ভিটায় আগমনকে অনেকেই তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করেন।’ [দৈনিক স্টেটসম্যান]
পৈতৃক বাড়ির উঠানের মঞ্চে তিনি দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। ৩৪টি গোলাপফুল ও নলেন গুড়ের সন্দেশ দিয়ে স্বাগত জানানো হয় পেয়ারাদাকে। তিনি বলেন, ‘ভালোবাসা পেতে ও ভালোবাসা দিতেই তাঁর এই পৈতৃক ভিটায় আসা।...মঞ্চের সামনে বসা উপস্থিত জনতা বাংলাদেশ হয়ে দিনহাটা-কলকাতা রেলপথ চালুর দাবি জানান দিনহাটার পেয়ারাদার কাছে।’
যে পেয়ারাদাকে তারা কোনো দিন স্বপ্নেও দেখেনি, তাঁকে চোখের সামনে দেখে হুঁশ ছিল না জনতার। তাই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে নয়, রেলপথের দাবি জানান তাঁরা ঘরের ছেলে পেয়ারাদার কাছে।
সেদিন ওখানে উপস্থিত হন পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মন্ত্রী কমল গুহের ছেলে উদয়নবাবু। কমলবাবু ছিলেন এরশাদের স্কুল-সহপাঠী। উদয়নবাবু ‘বাবার বন্ধুকে ফুলের স্তবক ও বই দিয়ে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি রীতিমতো পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন।’ এরশাদ সাহেবের জীবনের একটি নতুন তথ্য সেদিন জানা গেল। দিনহাটায় না গেলে আমরা কোনো দিনই জানতাম না আমাদের এই শাসনকর্তার দীক্ষাগুরু কে? কমল গুহ ছিলেন একজন আদর্শবান রাজনীতিক। জনতাকে সাক্ষী রেখে এরশাদ তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘স্কুলে ওর কাছেই আমার রাজনীতির দীক্ষা।’
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেরও আগে হিটলারের সময় কমলবাবু তাঁর শিষ্যকে এমন দীক্ষাই দিয়ে যান, যার প্রয়োগ শুরু হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। তিনি দীক্ষা দেন যে রোববার থেকে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারে নিয়ে এসো। এবং শুক্রবারে টিপু সুলতান রোডের মসজিদে মুসল্লিদের সামনে এক কথা, তার পরদিন ভারতের হাইকমিশনারকে বলবে আরেক কথা। গুহ মহাশয় আরও শিখিয়েছিলেন যে আটরশি গিয়ে এক কথা বলো, পরদিন শিল্পকলা একাডেমিতে নৃত্যশিল্পীদের বলো বিপরীত কথা। কমলবাবু কী দীক্ষাই দিলেন যে তা প্রয়োগের ফলে দেলোয়ার-দীপালি সাহা, তাজুল ইসলাম-ডাক্তার মিলনসহ প্রাণ গেল কত মানুষের।
গুহ মহাশয় কি দীক্ষাই দিলেন যে যে খালেদা জিয়া তাঁকে জেলে পাঠালেন, তাঁরই পাশে গিয়ে চেয়ারে বসে বললেন, ‘এ মুহূর্তটিরই অপেক্ষায় ছিলাম এত দিন।’ তার অল্প সময় পরেই শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে বললেন, ‘বেগম জিয়ার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ কমলবাবুই হয়তো দীক্ষা দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতির ঘাতকদের প্রমোশন দিয়ে বড় পদে বসিও।
দিনহাটায় গিয়ে ৭০ বছর পর দীক্ষাগুরুকে তাঁর যতই মনে পড়ুক, আমাদের মনে পড়ে চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের কথা। তাই মনে মনে বলি, কামরুল ভাই, টিএসসির সড়কদ্বীপে বসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে কী সাংঘাতিক ছবিটিই না এঁকেছিলেন? অব্যর্থ ছবির বিষয়বস্তু।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
কবিতায় অনুপ্রাণ থাকলে ভালো, জীবনে অনুপ্রাণ থাকলে তা আরও ভালো। পেয়ারা থেকে প্রেসিডেন্টে প্রমোশন পাওয়া সবার ভাগ্যে জোটে না। আবার জীবনের পড়ন্তবেলায় পেয়ারাদায় প্রত্যাবর্তন, সেটাও কম কপালের কথা নয়। আমাদের কাছে তিনি সামরিক শাসক অথবা রাষ্ট্রপতি অথবা একটি বড় রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান, কিন্তু তাঁর জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গে, তিনি তাঁর নাতির বয়সী সাংবাদিকের কাছে পেয়ারাদা। তাই সেখানে তাঁরা শিরোনাম দেন ‘ঘরের ছেলে পেয়ারাদাকে প্রণাম’ অথবা ‘পৈতৃক ভিটায় এলেন পেয়ারাদা’ প্রভৃতি। তাঁরা লিখেছেন, ৬ ডিসেম্বর ‘দুপুরে দিনহাটায় তাঁর পৈতৃক ভিটেতে এলেন। পুলিশি বেষ্টনীর মধ্যে শত শত মানুষের অভিনন্দন গ্রহণ করেন ঘরের ছেলে পেয়ারাদা। তখন বাড়ির টানে পেয়ারাদাকে দেখতে কৌতূহলী অপেক্ষমাণ জনতা। সকলেই উদগ্রীব। তারপর বাড়ির উঠোনে তৈরি মঞ্চে দাঁড়িয়ে উপস্থিত সকলকে [সকলের] শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন এরশাদ।’ [দৈনিক স্টেটসম্যান]
আরও লেখা হয়েছে, ‘পড়ন্ত বেলায় ঘরের ছেলে...এসে পৌঁছলেন দিনহাটায়। বিলাসবহুল বিশেষ গাড়িতে...চ্যাংরাবান্দা সীমান্ত দিয়ে দিনহাটায় এসে পৌঁছান তিনি।...পুরোনো বাসস্ট্যান্ডের নিকট ফুলদিঘির পাড়ের পৈতৃক ভিটেতে আসেন।...এরই মধ্যে জনতার বাঁধভাঙা উল্লাস আছড়ে পড়ে পেয়ারাদাকে দেখার জন্য।...তিনি হাত নাড়িয়ে তাদের শুভেচ্ছা গ্রহণ করেন। দীর্ঘদিন পর পৈতৃক ভিটেতে এসে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তবে ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেন।’
আমরা তো জানি, জীবনে অগণিতবার তিনি ‘আবেগাপ্লুত’ হয়েছেন এবং তারপরই ‘নিজেকে সামলে’ নিয়েছেন। সেদিন সাংবাদিকদের সঙ্গেও তিনি কথা বলেন ‘আবেগঘন কণ্ঠে’। এতকাল পরে হঠাত্ এখন ‘পূর্বপুরুষের ভিটার টানে’ কেন তিনি পশ্চিমবঙ্গে? সংবাদপত্র লিখেছে, ‘শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে তিনি খুবই আশাবাদী। একপক্ষ কালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদের পৈতৃক ভিটায় আগমনকে অনেকেই তাত্পর্যপূর্ণ বলে মনে করেন।’ [দৈনিক স্টেটসম্যান]
পৈতৃক বাড়ির উঠানের মঞ্চে তিনি দাঁড়িয়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। ৩৪টি গোলাপফুল ও নলেন গুড়ের সন্দেশ দিয়ে স্বাগত জানানো হয় পেয়ারাদাকে। তিনি বলেন, ‘ভালোবাসা পেতে ও ভালোবাসা দিতেই তাঁর এই পৈতৃক ভিটায় আসা।...মঞ্চের সামনে বসা উপস্থিত জনতা বাংলাদেশ হয়ে দিনহাটা-কলকাতা রেলপথ চালুর দাবি জানান দিনহাটার পেয়ারাদার কাছে।’
যে পেয়ারাদাকে তারা কোনো দিন স্বপ্নেও দেখেনি, তাঁকে চোখের সামনে দেখে হুঁশ ছিল না জনতার। তাই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে নয়, রেলপথের দাবি জানান তাঁরা ঘরের ছেলে পেয়ারাদার কাছে।
সেদিন ওখানে উপস্থিত হন পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত মন্ত্রী কমল গুহের ছেলে উদয়নবাবু। কমলবাবু ছিলেন এরশাদের স্কুল-সহপাঠী। উদয়নবাবু ‘বাবার বন্ধুকে ফুলের স্তবক ও বই দিয়ে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি রীতিমতো পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন।’ এরশাদ সাহেবের জীবনের একটি নতুন তথ্য সেদিন জানা গেল। দিনহাটায় না গেলে আমরা কোনো দিনই জানতাম না আমাদের এই শাসনকর্তার দীক্ষাগুরু কে? কমল গুহ ছিলেন একজন আদর্শবান রাজনীতিক। জনতাকে সাক্ষী রেখে এরশাদ তাঁর ছেলেকে বললেন, ‘স্কুলে ওর কাছেই আমার রাজনীতির দীক্ষা।’
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেরও আগে হিটলারের সময় কমলবাবু তাঁর শিষ্যকে এমন দীক্ষাই দিয়ে যান, যার প্রয়োগ শুরু হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। তিনি দীক্ষা দেন যে রোববার থেকে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারে নিয়ে এসো। এবং শুক্রবারে টিপু সুলতান রোডের মসজিদে মুসল্লিদের সামনে এক কথা, তার পরদিন ভারতের হাইকমিশনারকে বলবে আরেক কথা। গুহ মহাশয় আরও শিখিয়েছিলেন যে আটরশি গিয়ে এক কথা বলো, পরদিন শিল্পকলা একাডেমিতে নৃত্যশিল্পীদের বলো বিপরীত কথা। কমলবাবু কী দীক্ষাই দিলেন যে তা প্রয়োগের ফলে দেলোয়ার-দীপালি সাহা, তাজুল ইসলাম-ডাক্তার মিলনসহ প্রাণ গেল কত মানুষের।
গুহ মহাশয় কি দীক্ষাই দিলেন যে যে খালেদা জিয়া তাঁকে জেলে পাঠালেন, তাঁরই পাশে গিয়ে চেয়ারে বসে বললেন, ‘এ মুহূর্তটিরই অপেক্ষায় ছিলাম এত দিন।’ তার অল্প সময় পরেই শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে বললেন, ‘বেগম জিয়ার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’ কমলবাবুই হয়তো দীক্ষা দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতির ঘাতকদের প্রমোশন দিয়ে বড় পদে বসিও।
দিনহাটায় গিয়ে ৭০ বছর পর দীক্ষাগুরুকে তাঁর যতই মনে পড়ুক, আমাদের মনে পড়ে চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের কথা। তাই মনে মনে বলি, কামরুল ভাই, টিএসসির সড়কদ্বীপে বসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে কী সাংঘাতিক ছবিটিই না এঁকেছিলেন? অব্যর্থ ছবির বিষয়বস্তু।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments