সরল গরল-ইতিমনি খুন ও আগাম জামিন by মিজানুর রহমান খান

নীলফামারীর জলঢাকা পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী ইতিমনি (১৪) বাসায় একা ছিল। গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। এর দায়ে এককভাবে অভিযুক্ত হয় ২৫ বছরের কথিত বখাটে প্রতিবেশী যুবক মাহামুদার রহমান।


হাইকোর্ট থেকে তিনি আগাম জামিন নিয়েছিলেন। এখন পলাতক। নিম্ন আদালতে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি।
আগাম জামিন হাইকোর্টের একটি অসাধারণ এখতিয়ার। বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় আদালতের এটা অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কথা। হাইকোর্টের কোনো কোনো বেঞ্চ অবশ্য অনেক সময় প্রায় গণহারেও আগাম জামিন প্রদানের নজির স্থাপন করছেন, যা গভীর উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার বিষয়।
ধর্ষণ ও খুনের দায়ে অভিযুক্ত মাহামুদার অতি ভাগ্যবান। গৃহবধূ ধর্ষণ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এবং অন্য বহু মামলায় অভিযুক্ত জলঢাকা পৌরসভার বর্তমান মেয়রের কথিত মদদে পুলিশ তাঁকে না ধরায় জলঢাকা ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। আর তখনই গণজামিন দিয়ে বিতর্কিত বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান ও বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ওই অভিযুক্ত মাহামুদারকে নয় সপ্তাহ মেয়াদে আগাম জামিন দেন। দিনটি ছিল ২৮ অক্টোবর। ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার ২৮ দিন পরে মাহামুদার এদিন হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁর আগাম জামিন জোটে। এজাহারে নাম উঠতেই মাহামুদার পলাতক হন। পুলিশ তখন বলেছে, আমরা তাঁকে খুঁজি, পাই না। আগাম জামিন লাভের পরে জলঢাকা পুলিশের অকাট্য যুক্তি: ‘ওকে ছুঁতে হাইকোর্টের মানা।’ চলতি জানুয়ারির গোড়ায় তাঁর জামিনের মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু তিনি এখন পলাতক। হাইকোর্টের ওই বেঞ্চসংশ্লিষ্ট ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) কাজী এম ইজারুল হক সাগর গতকাল প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘সব মামলায় নির্দেশনা প্রদান যে অসংগত, তা আমি বহুবার আদালতকে বলেছি। এ ক্ষেত্রেও নির্দেশনা দেওয়া ঠিক হয়নি।’ হাইকোর্টের আদেশে বিচারিক হাকিমের উদ্দেশে প্রধানত দুই ধরনের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন হাইকোর্ট। প্রথমত, নির্দিষ্ট সময় আগাম জামিন ভোগের পর তাঁকে বিচারিক হাকিমের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এ সময় বিচারিক আদালত তাঁর নিয়মিত জামিনের দরখাস্ত মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করবেন কি না, তা বিবেচনায় স্বাধীন থাকেন। দ্বিতীয়ত, নিম্ন আদালতের হাত-পা বেঁধে দেওয়া। বলে দেওয়া হয়, নিয়মিত জামিনের জন্য দরখাস্ত করলে আদালত তা মঞ্জুর করবেন। আলোচ্য ক্ষেত্রে দেখলাম, শ্যাল দিয়ে বাক্যটি লেখা অর্থাত্ বিচারিক হাকিম তাঁকে নিয়মিত জামিন দেবেন। হাইকোর্টের আদেশের এ রকম ব্যাখ্যা করেন ইতিমনি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা নাগরিক আন্দোলনের নেতারাও।
চাঞ্চল্যকর এই মামলা গত বছরের ১ অক্টোবর ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অজামিনযোগ্য ৯(২) ধারার আওতায় নীলফামারীর জলঢাকা থানায় দায়ের হয়। মামলার আইও জলঢাকা থানার সদ্য বদলি হওয়া ওসি মো. আরমান হোসেন। এজাহারে তাঁর লেখা, ‘আমি ১ অক্টোবর সকাল সোয়া দশটায় মহিলা কনস্টেবল রহিমা খাতুন ও উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহফুজা সুলতানার সহায়তায় লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করি। ইতিমনির ডান কান থেকে রক্ত বের হয়। তাঁর থুতনিতে, দুই কানের নিচে গলায়, বাম স্তনের নিচে, ঊরুতে রক্তাক্ত জখম দেখা যায়। আমরা তাঁর যৌনাঙ্গে বীর্য দেখি, আঘাতের চিহ্ন ছিল, যা গোলাপি রং ধারণ করেছিল, এ কথা ওসি সাহেব ঠিকই সুরতহাল রিপোর্টে লিখেছেন। কিন্তু ময়নাতদন্ত রিপোর্টে তা আসেনি। আমরা খুব অবাক হই।’ মাহফুজা টেলিফোনে আমাকে বলেন। ওসি মাহামুদার কর্তৃক ধর্ষণপূর্বক হত্যাকাণ্ড ঘটল কি না, তা তদন্ত করে সুস্পষ্ট মতামতসহ প্রেরণের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন।
পুলিশ অভিযুক্তকে আটক না করায় এলাকার মানুষ বিক্ষোভ দেখায়। ৮ অক্টোবরে মানববন্ধন হলো। ৪ নভেম্বর হরতালে অচল হলো জলঢাকা। নারীনেত্রী আফরোজা রোজির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ছাত্র-জনতা সংগ্রাম কমিটি। সমাজ দেখল একমাত্র অভিযুক্ত ধর্ষক হাইকোর্টের জোরে ঘুরে বেড়ায়। এটা সত্য যে, অভিযুক্ত হলেই কাউকে অপরাধী বলা যায় না। মাহামুদারকেও আমরা আপাতত নিরীহ ধরে নিতে পারি। কিন্তু পুলিশ একমাত্র অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি। হাইকোর্টের আগাম জামিনকে পুলিশ কার্যত অপব্যাখ্যা করেছে। তারা রিমান্ডের বাইরে আসামির সঙ্গে কথা বলা আদৌ দরকারি মনে করেনি। অনেক সময় পূর্বশত্রুতা, হয়রানি, রেষারেষির কারণ থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মাহামুদারের সঙ্গে ইতির পরিবারের কোনো ধরনের বৈরিতা ছিল না।
ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ইতিমনির মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে ১ অক্টোবর ২০০৯ ডা. দিলীপ কুমার রায় পাঁচটি জখমের বর্ণনা দেন। ‘ইতিমনির মাথার সামনের দিকে ও নাকের পাশে রক্ত জমা ছিল। তার থুতনির নিচে ও ঘাড়ের বাম পাশের উপরের দিকে জমাট রক্ত ছিল। এবং ডান বুকের উপরের দিকেও রক্ত জমা ও একই সঙ্গে জমাটবাঁধা রক্তও দেখা যায়। এসব জখমের কারণে তাঁর রক্তক্ষরণ ঘটে এবং শকে মারা যায়। এটা স্পষ্ট যে তাকে খুন করা হয়েছে।’ এতে ধর্ষণের আলামত বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু অভিজ্ঞ চিকিত্সকেরা বলেন, যৌনাঙ্গের সোয়াব টেস্টে অনেক সময় বীর্যের আলামত নাও মিলতে পারে। কিন্তু তাতে ধর্ষণজনিত খুন যে হয়নি, তা প্রমাণিত হয় না। ময়নাতদন্তে স্পষ্ট যে, ইতিমনি আত্মরক্ষায় সচেষ্ট ছিল। তবে তাকে ধর্ষণের অকাট্য প্রমাণ হাজির করেছে মহাখালীর রাসায়নিক বিভাগের রিপোর্ট (নং ৪৮৩৯)।
তার পরনে ছিল গোলাপি রঙের পায়জামা, এমব্রয়ডারি করে ফুল তোলা। সিআইডির রাসায়নিক পরীক্ষক মো. কায়ছার রহমান গত ২৭ ডিসেম্বর নীলফামারীর বিচারিক হাকিমকে জানিয়েছেন, ওই পায়জামার দাগযুক্ত স্থানে ‘মানুষের বীর্য’ পাওয়া গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে এখন রয়েছে ডিএনএ পরীক্ষাগার। সারা বিশ্বে ধর্ষণজনিত অপরাধীদের শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা সবচেয়ে কার্যকর উপায়। অভিযুক্ত ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা করলেই সত্য বেরোবে। নিয়মানুযায়ী আগামী ছয় মাস পর এই পায়জামাটি ধ্বংস করা হবে। তাই তার আগেই অভিযুক্ত ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষা জরুরি। এই ল্যাবরেটরির একজন জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে ইঙ্গিত দেন যে, ‘অনেক সময় মহাখালীর পরীক্ষাগারে এমনভাবে আলামত পরীক্ষা করা হয় যা পরে আমাদের ল্যাবরেটরির কাজে নাও লাগতে পারে।’
এ নিয়ে কথা হলো নীলফামারীর পুলিশ সুপার গোলাম রসুলের সঙ্গে। বললেন, ‘আসামির ডিএনএ পরীক্ষা করাতে আদালতের অনুমতি লাগবে। কিন্তু আসামি কোথায়? আগাম জামিনের শেষ দিনে আদালতে ফোর্স মোতায়েন করেছিলাম। কিন্তু আসামি আসেননি।’ অভিযোগপত্র না দেওয়ার বিষয়ে পুলিশ সুপার বলেন, একমাত্র সাক্ষী নিহত ইতিমনির বাবা। তিনিই মাহামুদারকে ঘর থেকে বের হতে দেখেন। অন্যরা এই বিবরণ তাঁর বরাতেই দিচ্ছেন। তাই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
২৩৫৫৭/২০০৯ ফৌজদারি বিবিধ মামলায় হাইকোর্টের ওই বিচারকদ্বয়ের আদেশ সত্যি অবাক করা। তাঁরা লিখেছেন, ‘মাহামুদারের আইনজীবী কেন আমাদের অসাধারণ এখতিয়ারের আওতায় আগাম জামিনলাভের যোগ্য, তার উল্লেখযোগ্য কারণ দেখাতে পারেননি।’ হাইকোর্ট তদুপরি কারণ না দেখিয়ে আগাম জামিন দেন। এখানেও ফাঁক আছে। আদেশে আগাম জামিন দেওয়া হয়নি। অভিযুক্ত ধর্ষককে টানা দুই মাস এক সপ্তাহ সময় দেন তাঁর বাড়ির দরোজার আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য। আইনবহির্ভূত হাইকোর্টের পরিভাষায়, এর নাম নির্দেশনা। এবং এও বলে দেন যে, অভিযুক্ত যদি জামিন চান তাহলে নিম্ন আদালত তাঁকে নিয়মিত জামিন দেবেন। জামিন আদেশে দেখি, ডিএজি সাগরের নাম। কিন্তু আদেশে রাষ্ট্রের বক্তব্য নেই। ডিএজি এটা জেনে লেখকের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করেন। উল্লেখ্য, ওই বেঞ্চ গত মাসে সাজাভোগরত ডাকাবুকোদের গণজামিন দিলে বিতর্ক হয়। তারা এও বলেছিলেন, তাঁরা ধর্ষণ মামলার আসামিদের জামিন দেননি। প্রধান বিচারপতি ১০ জানুয়ারি ওই বেঞ্চ ভেঙে দেন। এ ঘটনায় গতকালের সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন ছিল সরব। এটা হয়তো একটা তাত্ক্ষণিক প্রতিকার। কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ সামনে। শুনেছি, প্রধান বিচারপতি ওই বেঞ্চের দেওয়া অস্বাভাবিক জামিনসংক্রান্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুই সদস্যের একটি কমিটি করেছেন। তবে বিচক্ষণ ও সত্ হিসেবে সুপরিচিত এক বিচারপতি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে কমিটির প্রধান হতে রাজি না হওয়ার কথা জেনে দুঃখ পেলাম। অবশ্য গতকাল যিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন তিনিও অভিজ্ঞ। ওই বেঞ্চের জামিনপ্রলয়ে বেঞ্চ কর্মকর্তাদের তুলনামূলক দায় তুচ্ছ। আমরা অপেক্ষায় থাকব সীমাহীন বিচারিক বাড়াবাড়ির জবাবদিহিতা দেখার জন্য। মাহামুদারের আগাম জামিন প্রমাণ করে যে, জামিনপ্রলয় কেবল ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বরে ঘটেনি। ওই বেঞ্চ প্রায় টানা তিন মাস ধরে জামিনসংক্রান্ত আদেশ দিয়েছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে দেখা করে ইতিমনির ভাই শরিফুল কান্নায় ভেঙে পড়েন। সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা। জানালেন, হাইকোর্টের দোহাই দিয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া থেকেও বিরত আছে পুলিশ। অন্যদিকে আসামিপক্ষ মামলা তুলে নিতে তাঁদের হুমকি দিয়ে চলেছে। ৭ নভেম্বর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লেখা এক আবেদন থেকে দেখা যায়, ধর্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সই করেছেন সংসদের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় শাখার শীর্ষ নেতারা। তার পরও কাঁদেন ইতিমনির বাবা ইয়াকুব। তাঁকে হত্যার হুমকি এসেছে। নীলফামারীবাসী বেদনায় নীল। তাদের আশঙ্কা, তারা আদৌ বিচার পাবে না! অ্যাটর্নি জেনারেল দুঃখ প্রকাশ করেন। প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেবেন। দ্রুত ডিএনএ পরীক্ষা তাঁরও কাম্য।
সবমিলিয়ে ইতিমনিকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা এক মস্ত পরিহাস। অভিযুক্ত মাহামুদার এখন থেকে একটা দীর্ঘ সময় পলাতক থাকতে পারেন। তখন হয়তো ওই ‘মানুষের বীর্য’ যে মাহামুদারের, তা প্রমাণ করা সম্ভব হবে না। আলামত নষ্ট হবে। ইতিমনির জন্য আন্দোলনকারীরা ইতিকে ভুলে যাবেন। কারণ, তত দিনে হয়তো আরও ইতিমনি তৈরি হবে। ‘আইন মান্যকারী’ পলাতক মাহামুদার বীরদর্পে হাইকোর্টে মিথ্যা মামলা কোয়াশ বা বাতিলের জন্য আসবেন। পুনরায় ‘আত্মসমর্পণ’ করবেন। হাইকোর্টের কোনো বেঞ্চ হয়তো উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণহীন ‘হয়রানিমূলক’ অভিযোগ থেকে তাঁকে বেকসুর খালাস দেবেন! কে জানে তত দিনে মাহামুদার হয়তো আমাদের জনপ্রিয় নেতা হবেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.