মিসর-গাজা অবরোধের নেপথ্যে by ইউরি আভনেরি
উদ্ভট, খাপছাড়া কিছু একটা ঘটছে মিসরে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আসার জন্য গোটা দুনিয়া থেকে এক হাজার ৪০০ মানবাধিকারকর্মী জড়ো হয়েছিল মিসরে। গত বছর ইসরায়েলের ‘কাস্ট লিড’ নামক সামরিক আগ্রাসনের বর্ষপূর্তিতে তারা চেয়েছিল গাজার অহিংস সমাবেশে যোগ দিতে।
ইসরায়েলের অব্যাহত অবরোধে গাজার ১৫ লাখ অধিবাসীর বিপন্নতার প্রতিবাদ করতে চেয়েছিল তারা। এ উপলক্ষে আরও অনেক দেশে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। ইসরায়েলের রাজধানী তেলআবিবেও বিরাট প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। ইসরায়েলের আরব নাগরিকেরাও গাজা সীমান্তে আয়োজন করে সংহতি সভা।
প্রতিবাদীরা মিসরে হাজির হয়ে দেখল, তাদের জন্য বিরাট এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। মিসর সরকার তাদের গাজা সফর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যারা লুকিয়ে যাত্রীবাসগুলোতে করে গাজা সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, খুঁজে খুঁজে তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়মিত গাজামুখী কর্মীদের খুঁজে বেড়ায়।
বিক্ষুব্ধ কর্মীরা তখন যার যার দেশের দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেয়। ফরাসিরা ফরাসি দূতাবাসের সামনে তাঁবু গেড়ে বসে, মার্কিনরা তাদের দূতাবাসের সামনে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করার দাবি জানায়। সত্তরোর্ধ্ব কয়েকজন প্রতিবাদী শুরু করেন অনশন ধর্মঘট। পুরোটা সময় তাদের ঘিরে রাখে মিসরীয় দাঙ্গা পুলিশ আর গরম পানি ছিটানোর গাড়ি। বিক্ষোভকারীরা মিসরের ‘স্বাধীনতা’ (তাহরির) চত্বরে জমায়েত হলে পুলিশ তাদের সেখানেও হেনস্তা করে। অবশেষে মিসরীয় কায়দার একটি সমাধান আসে প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে। মাত্র ১০০ বিক্ষোভকারীকে গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়, বাকিরা রয়ে যায় মিসরে।
এসব যখন চলছে, তখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কায়রো সফর করছিলেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে তাঁকে বিরাট সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক নেতানিয়াহুর সঙ্গে আগেও বৈঠকে বসেছেন, কিন্তু কায়রোয় কখনোই নয়। এবারে তাঁকে খোদ কায়রোয় আমন্ত্রণ করার অর্থ হলো—মিসর-ইসরায়েলের সম্পর্ক আগের থেকে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
নেতানিয়াহুকে খুশি করার জন্য মোবারক কয়েক শ ইসরায়েলিকে মিসরে এনে এক ইহুদি ধর্মপুরুষের কবরে প্রার্থনার সুযোগ দেন। ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল এই, ফিলিস্তিনের বন্ধুদের গাজায় ঢুকতে দেওয়া হলো না, কিন্তু ইসরায়েলিদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসে দেওয়া হলো অভ্যর্থনা।
অনেকেই অবাক হবেন যে অবরোধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে বিশ্বের ‘বৃহত্তম কারাগার’ বানিয়ে রাখায় মিসরের অবদানও কম নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় যেকোনো দ্রব্য থেকে শুরু করে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ পর্যন্ত কিছুই এই অবরোধের বাইরে নয়। চূড়ান্ত মানবিক পরিস্থিতি ছাড়া কেউই গাজা থেকে ইসরায়েলে বা পশ্চিম তীরে অথবা অন্য কোথাও যেতে পারে না।
অথচ ইসরায়েলিরা কেবল উপত্যকাটির তিন দিক নিয়ন্ত্রণ করে। দক্ষিণ দিকটি নিয়ন্ত্রণ করে মিসর স্বয়ং। সুতরাং মিসরের হাত না থাকলে এই দিক দিয়েই গাজাবাসীরা বাকি দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারত। কিন্তু তাতে করে ইসরায়েলি অবরোধ অকার্যকর হয়ে যেত। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, মিসরের মাধ্যমেই ইসরায়েলি অবরোধ অটুট হয়েছে।
মিসর মনে করে, তারাই আরব দুনিয়ার নেতা। মিসরেই আরবের সবচেয়ে বেশির ভাগ লোকের বাস এবং দেশটিও আরব জগতের কেন্দ্রে অবস্থিত। ৫০ বছর আগে মিসরীয় নেতা গামাল আবদেল নাসের ছিলেন সমগ্র আরবের বীর—বিশেষত ফিলিস্তিনিদের। তাহলে কী করে সেই মিসর তাদের ১৫ লাখ গাজাবাসী ভাই-বোনকে ইসরায়েলের কাছে চূড়ান্ত পর্যুদস্ত হওয়ায় হাত লাগাচ্ছে?
তবে পরিহাসের বিষয় হলো, প্রকাশ্য সীমান্ত বন্ধ করে রাখলেও মিসর সীমান্তের তলার অজস্র সুড়ঙ্গের বিষয়ে মিসর এত দিন চোখ বুজে ছিল। ওই সব সুড়ঙ্গ দিয়েই গাজায় খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ যায়, তবে অতি চড়ামূল্যে। লাভটা হয় মিসরীয় ব্যবসায়ীদের। সেটাও বন্ধ করার জন্য মিসর এখন সীমান্তের পুরোটাজুড়ে লোহার দেয়াল তুলতে যাচ্ছে। ৮০ বছর আগে ইহুদিবাদী ভ্লাদিমির জে-য়েভ যখন আরবদের বিরুদ্ধে লোহার দেয়াল তোলার কথা বলেছিলেন, তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি, এক দিন আরবেরাই ইসরায়েলের হয়ে সেটা করে দেবে।
কিন্তু মিসর কেন সেটা করছে?
সমালোচকেরা বলেন, মিসর প্রতিবছর ইসরায়েলের সৌজন্যে প্রায় দুই শ কোটি ডলারের মার্কিন ভর্তুকি পেয়ে থাকে। এটিই মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তির বকশিশ। মার্কিন কংগ্রেসের ইসরায়েলপন্থী লবি যেকোনো মুহূর্তে এটা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
অন্যদের বিশ্বাস, মোবারক হামাসের ভয়ে ভীত। হামাসের যাত্রা হয়েছিল মিসরের প্রধান বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা হিসেবে। মিসর-সৌদি-জর্ডান-পশ্চিম তীর চক্রের বিপরীতে রয়েছে সিরিয়া-গাজা-ইরান-লেবানন অক্ষ। অনেকেই মনে করেন, পশ্চিম তীরের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাসকে দুর্বল করার জন্যই গাজায় অবরোধ জারি রাখার পক্ষে।
মোবারক হামাস নিয়ে ক্ষিপ্ত। কারণ, তারা তাঁর কথায় নাচে না। মিসরীয় নেতারা চায়, ফিলিস্তিনিরা তাদের হুকুম তামিল করুক। নাসের ও আনোয়ার সাদাত পিএলওর ওপর খ্যাপা ছিলেন। কী সাহস এই নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিটির, তারা তাদের বড় ‘নসিহত’ মানে না?
মিসরীয় অবরোধের কারণে ১৫ লাখ গাজাবাসীর জীবন ধ্বংসের মুখে এবং এদের বেশির ভাগই হামাস সদস্য নয়। এবং এটা করা হচ্ছে প্রকাশ্যে, সোয়া শ কোটি মুসলমানের চোখের সামনে। মিসরের এই নীতি খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু কেন হোসনি মোবারক এটা করছেন? সত্যিকার উত্তর সম্ভবত এই যে তাঁর আসলেই কোনো উপায় নেই।
ধনী-গরিব-নির্বিশেষে প্রতিটি মিসরীয় তাদের জাতি নিয়ে খুবই গর্বিত। প্রতিটি মিসরীয় মনে করে, ছয় থেকে আট হাজার বছরের ইতিহাস পিরামিডের শীর্ষ থেকে তাদের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবতা তাদের বিরুদ্ধে। সৌদি আরবের প্রভাব তাদের থেকে বেশি, খুদে দুবাই বিরাট ধনী হয়ে গেছে, ইরানের আঞ্চলিক ক্ষমতাও অনেক ওপরে। অতীতে মিসর বাইরের সাফল্য দেখিয়ে ভেতরের দুর্বলতা ঢেকেছে। পশ্চিমা বিশ্ব মিসরকে আরবের নেতা মনে করে। মিসরের সুখ কেবল এতটুকুই।
মিসরের বর্তমান দুরবস্থার জন্যই তাদের আমেরিকার কথায় চলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর আমেরিকার নির্দেশ মানে প্রকারান্তরে ইসরায়েলেরই নির্দেশ। এ জন্যই মিসরও শামিল হয়েছে ইসরায়েলের অবরোধে।
হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে মিসরীয়রা কেবল দুই কি তিনবার বিদ্রোহ করেছে। কিংবদন্তিতুল্য এই ধৈর্যের খারাপ দিকও রয়েছে। মানুষ যখন তার দাবি ভুলে যায়, তখন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রগতিও থমকে যায়। তাই মনে হয়, মিসরীয় জনগণ যেকোনো কিছু মানতে রাজি। প্রাচীন বা বর্তমান কোনো ফেরাউনকে খুব কমই জনপ্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে। হয়তো এমন দিন আসবে, যেদিন তাদের গর্বকে ছাপিয়ে যাবে তাদের হতাশা।
একজন ইসরায়েলি হিসেবে আমি ইসরায়েলের অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি। আমি যদি মিসরীয় হতাম, তাহলে মিসরীয় অবরোধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতাম। আর এই পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে আমি দাঁড়াতাম এই দুইয়েরই বিরুদ্ধে।
প্যালেস্টাইন ক্রনিকল থেকে ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলের সাবেক সাংসদ, শান্তিবাদী সংগঠক ও লেখক।
প্রতিবাদীরা মিসরে হাজির হয়ে দেখল, তাদের জন্য বিরাট এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। মিসর সরকার তাদের গাজা সফর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। যারা লুকিয়ে যাত্রীবাসগুলোতে করে গাজা সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করে, খুঁজে খুঁজে তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। মিসরীয় নিরাপত্তা বাহিনী নিয়মিত গাজামুখী কর্মীদের খুঁজে বেড়ায়।
বিক্ষুব্ধ কর্মীরা তখন যার যার দেশের দূতাবাসের সামনে অবস্থান নেয়। ফরাসিরা ফরাসি দূতাবাসের সামনে তাঁবু গেড়ে বসে, মার্কিনরা তাদের দূতাবাসের সামনে গিয়ে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করার দাবি জানায়। সত্তরোর্ধ্ব কয়েকজন প্রতিবাদী শুরু করেন অনশন ধর্মঘট। পুরোটা সময় তাদের ঘিরে রাখে মিসরীয় দাঙ্গা পুলিশ আর গরম পানি ছিটানোর গাড়ি। বিক্ষোভকারীরা মিসরের ‘স্বাধীনতা’ (তাহরির) চত্বরে জমায়েত হলে পুলিশ তাদের সেখানেও হেনস্তা করে। অবশেষে মিসরীয় কায়দার একটি সমাধান আসে প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে। মাত্র ১০০ বিক্ষোভকারীকে গাজায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়, বাকিরা রয়ে যায় মিসরে।
এসব যখন চলছে, তখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কায়রো সফর করছিলেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে তাঁকে বিরাট সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক নেতানিয়াহুর সঙ্গে আগেও বৈঠকে বসেছেন, কিন্তু কায়রোয় কখনোই নয়। এবারে তাঁকে খোদ কায়রোয় আমন্ত্রণ করার অর্থ হলো—মিসর-ইসরায়েলের সম্পর্ক আগের থেকে অনেক ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
নেতানিয়াহুকে খুশি করার জন্য মোবারক কয়েক শ ইসরায়েলিকে মিসরে এনে এক ইহুদি ধর্মপুরুষের কবরে প্রার্থনার সুযোগ দেন। ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল এই, ফিলিস্তিনের বন্ধুদের গাজায় ঢুকতে দেওয়া হলো না, কিন্তু ইসরায়েলিদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসে দেওয়া হলো অভ্যর্থনা।
অনেকেই অবাক হবেন যে অবরোধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে বিশ্বের ‘বৃহত্তম কারাগার’ বানিয়ে রাখায় মিসরের অবদানও কম নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় যেকোনো দ্রব্য থেকে শুরু করে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ পর্যন্ত কিছুই এই অবরোধের বাইরে নয়। চূড়ান্ত মানবিক পরিস্থিতি ছাড়া কেউই গাজা থেকে ইসরায়েলে বা পশ্চিম তীরে অথবা অন্য কোথাও যেতে পারে না।
অথচ ইসরায়েলিরা কেবল উপত্যকাটির তিন দিক নিয়ন্ত্রণ করে। দক্ষিণ দিকটি নিয়ন্ত্রণ করে মিসর স্বয়ং। সুতরাং মিসরের হাত না থাকলে এই দিক দিয়েই গাজাবাসীরা বাকি দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারত। কিন্তু তাতে করে ইসরায়েলি অবরোধ অকার্যকর হয়ে যেত। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, মিসরের মাধ্যমেই ইসরায়েলি অবরোধ অটুট হয়েছে।
মিসর মনে করে, তারাই আরব দুনিয়ার নেতা। মিসরেই আরবের সবচেয়ে বেশির ভাগ লোকের বাস এবং দেশটিও আরব জগতের কেন্দ্রে অবস্থিত। ৫০ বছর আগে মিসরীয় নেতা গামাল আবদেল নাসের ছিলেন সমগ্র আরবের বীর—বিশেষত ফিলিস্তিনিদের। তাহলে কী করে সেই মিসর তাদের ১৫ লাখ গাজাবাসী ভাই-বোনকে ইসরায়েলের কাছে চূড়ান্ত পর্যুদস্ত হওয়ায় হাত লাগাচ্ছে?
তবে পরিহাসের বিষয় হলো, প্রকাশ্য সীমান্ত বন্ধ করে রাখলেও মিসর সীমান্তের তলার অজস্র সুড়ঙ্গের বিষয়ে মিসর এত দিন চোখ বুজে ছিল। ওই সব সুড়ঙ্গ দিয়েই গাজায় খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ যায়, তবে অতি চড়ামূল্যে। লাভটা হয় মিসরীয় ব্যবসায়ীদের। সেটাও বন্ধ করার জন্য মিসর এখন সীমান্তের পুরোটাজুড়ে লোহার দেয়াল তুলতে যাচ্ছে। ৮০ বছর আগে ইহুদিবাদী ভ্লাদিমির জে-য়েভ যখন আরবদের বিরুদ্ধে লোহার দেয়াল তোলার কথা বলেছিলেন, তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি, এক দিন আরবেরাই ইসরায়েলের হয়ে সেটা করে দেবে।
কিন্তু মিসর কেন সেটা করছে?
সমালোচকেরা বলেন, মিসর প্রতিবছর ইসরায়েলের সৌজন্যে প্রায় দুই শ কোটি ডলারের মার্কিন ভর্তুকি পেয়ে থাকে। এটিই মিসর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তির বকশিশ। মার্কিন কংগ্রেসের ইসরায়েলপন্থী লবি যেকোনো মুহূর্তে এটা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
অন্যদের বিশ্বাস, মোবারক হামাসের ভয়ে ভীত। হামাসের যাত্রা হয়েছিল মিসরের প্রধান বিরোধী দল মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তিনি শাখা হিসেবে। মিসর-সৌদি-জর্ডান-পশ্চিম তীর চক্রের বিপরীতে রয়েছে সিরিয়া-গাজা-ইরান-লেবানন অক্ষ। অনেকেই মনে করেন, পশ্চিম তীরের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাসকে দুর্বল করার জন্যই গাজায় অবরোধ জারি রাখার পক্ষে।
মোবারক হামাস নিয়ে ক্ষিপ্ত। কারণ, তারা তাঁর কথায় নাচে না। মিসরীয় নেতারা চায়, ফিলিস্তিনিরা তাদের হুকুম তামিল করুক। নাসের ও আনোয়ার সাদাত পিএলওর ওপর খ্যাপা ছিলেন। কী সাহস এই নিপীড়িত ক্ষুদ্র জাতিটির, তারা তাদের বড় ‘নসিহত’ মানে না?
মিসরীয় অবরোধের কারণে ১৫ লাখ গাজাবাসীর জীবন ধ্বংসের মুখে এবং এদের বেশির ভাগই হামাস সদস্য নয়। এবং এটা করা হচ্ছে প্রকাশ্যে, সোয়া শ কোটি মুসলমানের চোখের সামনে। মিসরের এই নীতি খুবই বিপজ্জনক। কিন্তু কেন হোসনি মোবারক এটা করছেন? সত্যিকার উত্তর সম্ভবত এই যে তাঁর আসলেই কোনো উপায় নেই।
ধনী-গরিব-নির্বিশেষে প্রতিটি মিসরীয় তাদের জাতি নিয়ে খুবই গর্বিত। প্রতিটি মিসরীয় মনে করে, ছয় থেকে আট হাজার বছরের ইতিহাস পিরামিডের শীর্ষ থেকে তাদের দিকে চেয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবতা তাদের বিরুদ্ধে। সৌদি আরবের প্রভাব তাদের থেকে বেশি, খুদে দুবাই বিরাট ধনী হয়ে গেছে, ইরানের আঞ্চলিক ক্ষমতাও অনেক ওপরে। অতীতে মিসর বাইরের সাফল্য দেখিয়ে ভেতরের দুর্বলতা ঢেকেছে। পশ্চিমা বিশ্ব মিসরকে আরবের নেতা মনে করে। মিসরের সুখ কেবল এতটুকুই।
মিসরের বর্তমান দুরবস্থার জন্যই তাদের আমেরিকার কথায় চলা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আর আমেরিকার নির্দেশ মানে প্রকারান্তরে ইসরায়েলেরই নির্দেশ। এ জন্যই মিসরও শামিল হয়েছে ইসরায়েলের অবরোধে।
হাজার হাজার বছরের ইতিহাসে মিসরীয়রা কেবল দুই কি তিনবার বিদ্রোহ করেছে। কিংবদন্তিতুল্য এই ধৈর্যের খারাপ দিকও রয়েছে। মানুষ যখন তার দাবি ভুলে যায়, তখন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রগতিও থমকে যায়। তাই মনে হয়, মিসরীয় জনগণ যেকোনো কিছু মানতে রাজি। প্রাচীন বা বর্তমান কোনো ফেরাউনকে খুব কমই জনপ্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে। হয়তো এমন দিন আসবে, যেদিন তাদের গর্বকে ছাপিয়ে যাবে তাদের হতাশা।
একজন ইসরায়েলি হিসেবে আমি ইসরায়েলের অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আসছি। আমি যদি মিসরীয় হতাম, তাহলে মিসরীয় অবরোধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতাম। আর এই পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে আমি দাঁড়াতাম এই দুইয়েরই বিরুদ্ধে।
প্যালেস্টাইন ক্রনিকল থেকে ভাষান্তর ফারুক ওয়াসিফ
ইউরি আভনেরি: ইসরায়েলের সাবেক সাংসদ, শান্তিবাদী সংগঠক ও লেখক।
No comments