রুপা সুব্রামানিয়া দেহেলজিয়া-মমতা ব্যানার্জির পশ্চিমবঙ্গ

ভারতীয় পদ্ধতির কমিউনিস্ট অর্থনীতির ধারক হিসেবে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গ কয়েক বছর ধরে ধীরলয়ে চলছিল। তাদের অধোগতিটা ছিল লক্ষণীয়। বিশেষ করে আর দুটো রাজ্যের চেয়ে এখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। আর এসবই সেখানে পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে।


মমতা ব্যানার্জির এ জনপ্রিয়তার পেছনে কোনো জাদুমন্ত্র কাজ করছে, যা নাকি তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের গভর্নমেন্ট হাউসে নিয়ে যেতে চায়। কোনো অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তাঁর রয়েছে, যা নাকি পশ্চিমবঙ্গের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে সচল করতে সক্ষম। ৩৪ বছর ধরে শাসনকারী কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্কসিস্ট) বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে, তারা অর্থনৈতিকভাবে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। আর এটাই হচ্ছে মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস জোটের সাফল্যের বড় মন্ত্র। জোটের অন্য দলটি হচ্ছে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। এই জোট যে ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি মাত্রা তৈরি করছে তা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। আজকে যেসব ভোটার বয়সে তরুণ তাদের পক্ষে নতুন কিছুই দেখার সুযোগ হয়নি। এই যে পরিবর্তন তাকে বার্লিনের দেয়াল ভাঙার সঙ্গে তুলনা না করা গেলেও তা যে বড় একটি পরিবর্তনের সূচনা করবে তা সন্দেহাতীত। যদিও মমতা ব্যানার্জি তাঁর অর্থনৈতিক দর্শন কী হবে তা স্পষ্টভাবে আমাদের সামনে বিস্তারিত বলেননি, তার পরও আমাদের অনুমান করতে কষ্ট হয় না, আসলে অর্থনৈতিক বিবেচনাটা কী হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা ২০০৯ সাল থেকে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কার্যক্রম বিবেচনায় আনতে পারি। তিনি যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন তা ভুলতে চাননি। যে কারণে তাঁর কার্যক্রমের বেশির ভাগই পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ চিন্তা করে পরিচালিত হয়েছে। তবে রেলমন্ত্রী হিসেবে তিনি সফল হয়েছেন_এমন কথা হলফ করে কেউ বলতে পারবে না। বরং বলা চলে, তিনি এ ক্ষেত্রে অশুভ সংকেতই দিয়েছেন। কারণ রেলওয়ে বড় একটি লোকসানি খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এ সময়। ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারি জেনারেল অমিত মিত্র রেলওয়ের এ লোকসানের জন্য বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিকে দায়ী করেছেন। রাজ্য সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে যাঁকে এখন থেকেই মনে করা হচ্ছে সেই অমিত মিত্র আরো কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন রেলওয়ের ভাড়া কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও। বছরের শুরুতে মমতা ব্যানার্জি প্রদত্ত রেলওয়ে বাজেটটি ছিল এমনভাবে তৈরি, যাতে মনে হয় এটি একটি নির্বাচনী বাজেট। বিরোধীদের মতে, ওই বাজেট উচ্চাভিলাষী এবং অবাস্তবও বটে। রেলওয়ের এই বিশাল লোকসান থেকে রেলওয়েকে সারিয়ে তুলতে হলে একটা পথ হচ্ছে যাত্রী ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া। তবে রেলওয়েতে ভ্রমণ করে সাধারণত ওইসব সাধারণ মানুষ যারা বিমান কিংবা মোটরকার ব্যবহার করতে পারে না। তবে যাত্রী ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারটি অত সহজ নয়। কারণ কিছু মানুষ এমন রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত, যারা সমালোচনা করার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দক্ষ। তারা কিন্তু ছেড়ে দেবে না কোনোটাই। রেলমন্ত্রী হিসেবে তিনি কিন্তু এ সমস্যার সমাধান করতে পারেননি। তিনি যখন মুখ্যমন্ত্রী হবেন তখন কি তিনি সেই পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে পারবেন? তার পরও আমরা তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহারের দিকে নজর দিতে পারি। প্রথম দফায়ই পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম শাসনামলে কিভাবে রাজ্যটি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে তার বর্ণনা আছে; উৎপাদন খাতে কিভাবে রাজ্যটি বঞ্চিত হয়েছে তারও বর্ণনা আছে। তারপর দেখানো হয়েছে, কিভাবে শ্রম বিনিয়োগে পশ্চাৎপদ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেখানো হয়েছে বেকারত্ব কিভাবে বেড়েছে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামোগত দুরবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। তিনি এমনও দেখিয়েছেন, ১৭টি রাজ্যের মধ্যে এই রাজ্য নবম স্থানে থাকার যে যোগ্যতা অর্জন করেছে সেও ব্যক্তির কল্যাণেই হয়েছে। সেখানে রাজ্যের ভূমিকা তেমন কিছুই নেই।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে তাঁদের দল নির্বাচিত হলে কিভাবে তাঁরা অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করবেন। এটা পুরোপুরি ইতিবাচকভাবেই দেখানো হয়েছে। কিন্তু রাজ্যের উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তার মাধ্যমে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে তা খুব একটা স্পষ্ট বলা হয়েছে এমনটি মনে হয় না। অবকাঠামোগত বিনিয়োগ বৃহত্তর হওয়া উচিত বলে মনে করি। কলকাতাভিত্তিক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক অভিরূপ সরকারও আমাকে বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে আয়কর প্রদানের অবস্থা অন্য রাজ্যগুলোর চেয়ে অনেক কম। এখন রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য এদিকে নজর দিতে হবে। তিনি আরো জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে রাজস্ব আয় বাড়াতে গেলে সেখানে যে দুর্নীতি আছে তা কমিয়ে আনা খুবই প্রয়োজন। যদি এমনটি সম্ভব হয় রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। তবে শুধু রাজস্ব আদায় বাড়িয়েই এ সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে না, ব্যয় কমিয়ে আনারও প্রয়োজন হতে পারে। এখন দেখার বিষয়, মমতা ব্যানার্জি অর্থনৈতিক উন্নয়ন করার জন্য কী কৌশল অবলম্বন করেন।
লেখক : সাংবাদিক
ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন

No comments

Powered by Blogger.