প্রতিক্রিয়া-আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দ্বন্দ্ব বনাম জাতীয় প্রত্যাশা by ওয়াহিদ নবী
হেগেলের উক্তি উদ্ধৃত করে বার্নার্ড শ’ বলেছিলেন, ‘আমি হেগেলের সঙ্গে একমত, যখন তিনি বলেন, ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে এই যে মানুষ ইতিহাস থেকে কিছু শেখে না।’ কথাগুলো তাঁরা বিদ্রূপ করে বলেছিলেন। ইতিহাসের শিক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন আমাদের সমস্যা বুঝতে। এম এম আকাশ ইতিহাস থেকে যে তথ্যগুলো তুলে ধরেছিলেন, সে সম্বন্ধে আমার কোনো দ্বিমত নেই।
তবে সীমিত পরিসরে সব কথা বলা যায়নি। এই সুযোগটি নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই।
ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার, আমাদের দুই জোটের একজোটের কৌশল। আমাদের স্বাধীনতার চার স্তম্ভের দুটি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এরা মেনে নেবে না—এটাই স্বাভাবিক এবং মেনে নেবে না বলেই এরা জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। আমাদের প্রশ্ন, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এই মূলনীতিগুলো জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করেছে কি? অনিবার্য কারণেই স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু হঠাত্ করেই হয়েছিল। এ জন্য ভৌগোলিক স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ নীতিগুলো জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করা হয়নি। পাকিস্তান আমলের ধর্মীয় রাজনীতির মোহ থেকে মানুষ রাতারাতি মুক্ত হয়ে যাবে, এটা আশা করা যায় না। আসলে ‘সেক্যুলার’ কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা ব্যবহার না করে ‘পার্থিব’ বা জাগতিক কথাগুলো ব্যবহার করলে ভালো হতো। আসলে এ কথাটি সবাইকে বলা উচিত যে, সেক্যুলার কথাটি যিনি প্রথম ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন, তিনি স্পেনের মুসলমান দার্শনিক আবু রুশদ।
স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের ব্যর্থতার বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সফল হননি। বেন বেল্লা, নক্রুমা, ওবোতে শোয়েকারনো এর উদাহরণ। মেকিয়াভেলি তাঁর প্রিন্স গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘শাসককে হতে হবে সিংহের মতো হিংস্র (ফিয়ার্স) ও শিয়ালের মতো ধূর্ত।’ শেখ মুজিব ছিলেন সিংহের মতো কিন্তু হিংস্র ছিলেন না। শিয়ালের মতো ধূর্তও তিনি ছিলেন না।
পাকিস্তান আমলে রাজনীতিতে আমলা ও সেনাবাহিনীর প্রাধান্য থাকায় রাজনীতিবিদেরা দেশ শাসনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি। আমরা এই দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছি। স্বাধীনতার কাছে আমাদের অনেকের প্রত্যাশা অবাস্তব ছিল। পাকিস্তানিরা সবকিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। স্বাধীনতার পর ওই সম্পদগুলো আমরা পেয়ে যাব—এমন ধারণাও অনেকে করেছিল। স্বাধীনতার পর তীব্রবেগে ধনী হওয়ার চেষ্টায় লেগে গেলেন একদল, যাঁরা নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করলেন জাতির সামনে। ‘চাটার দল সব খেয়ে শেষ করে দেয়’ বঙ্গবন্ধুর কথাটা আর্তচিত্কারের মতো শুনিয়েছিল। সি এস লুইস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফোর লাভস-এ উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের ইতিহাসের সব অংশই গৌরবের নয়।’ দেশের জন্য গৌরবের নয়, এমন সব কথার আলোচনা সাহসের সঙ্গে আমাদের প্রয়োজনে করা উচিত।
একুশের সংগ্রামীরা আমাদের মধ্যে জাতীয় অহংকারবোধ এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকের মধ্যে বহুদিনের পরাধীনতাজনিত হীনম্মন্যতাবোধ থেকে গেছে। এর একটা লক্ষণ হচ্ছে, চাটুকারিতা। বঙ্গবন্ধু জুলিওকুরি পুরস্কার পেলে দিনের পর দিন অসংখ্য মিছিল আসতে থাকে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে, অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কত কাজ।
আমলারা তুলনামূলকভাবে অভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু তাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহ্য করতে পারলেন না। বাগড়া দেওয়া তাঁদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল। সেনাবাহিনীর কর্মচারীরা তীব্রবেগে পদোন্নতি পেলেন। মেজর থেকে মেজর জেনারেল হতে তাঁদের দু-তিন বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। একজনের যা পাওনা তার চেয়ে বেশি পেলে তার মাথা গরম হয়ে যায়। কয়েকজনের তা-ই হলো।
আওয়ামী লীগের এক অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আওয়াজ তুলে বাজার গরম করে ফেলল। হাজার হাজার তরুণ সে ডাকে সাড়া দিল। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব ছিল দিশেহারা। অন্যদিকে কলকারখানা জাতীয়করণের পর সেগুলো ভালোভাবে চলল না। দিশেহারা মুক্তিসেনাদের একদল নৈরাশ্যের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলল। একদলীয় সরকার গঠনের প্রয়োজন সম্পর্কে জনসাধারণকে তেমন কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। সরকারের শত্রুরা এই সুযোগ নিয়েছিল।
সেনাবাহিনীর একদল জুনিয়র অফিসার নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাল। এর পরের ইতিহাস দিশেহারা রক্তপাতের আর সেনা-কর্তাদের ক্ষমতালিপ্সার ইতিহাস। সাময়িকভাবে বিজয়ী জিয়া স্বাধীনতার আদর্শবিরোধী সব ধারা সংবিধানে ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধীরা একত্র হলো। সব সেনা-নেতাই ক্ষমতা দখলের পর ঘোষণা দেন। বিভিন্ন দেশে তাঁরা কেবল নামগুলো বদলে দেন। সব সেনা-নেতা যা করেন, জিয়াও তা-ই করেছেন। সরকারি অর্থ ব্যয় করে ও সরকারি সংগঠনকে ব্যবহার করে তিনি দল গঠন করেছেন। রাজনীতিবিদদের জেলে পুরে নিজের ঢাকঢোল পিটিয়েছেন। যেহেতু রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে ঢালাওভাবে, তাই তাঁর সাধুতার কথা প্রচার করা হলো। জিয়া সরকারি অর্থ খরচ করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিন্তু এটাকে অনেকে দুর্নীতি মনে করে না। তবুও তাঁকে ঘিরে সততার একটা প্রচার হয়েছে। জিয়া এখন গত, তাই তাঁর গুণাগুণের ওপর নির্ভর করলে চলবে না বিএনপির। ভাগ্যের কী পরিহাস! তাঁর সন্তানেরা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত।
এম এম আকাশ বাংলাদেশের রাজনীতির তিনটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। অতীতের বিশ্লেষণ করলে এই তিনটিকে অবশ্যই যুক্তিসংগত মনে হয়। তবে ঠিক কী ঘটবে, কে বলতে পারে?
সবাই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নিয়ে হতাশ। এর কারণ অবশ্য রয়েছে। বাংলাদেশে প্রকৃত বুর্জোয়া কয়জন আছেন। উত্পাদনের মাধ্যম কতটা তাদের নিয়ন্ত্রণে? ঋণখেলাপির মাধ্যমে কি প্রকৃত বুর্জোয়া হওয়া যায়? আমাদের নেতাদের সামাজিক আচরণ কি বুর্জোয়াদের মতো? আমার তো মনে হয় রাজনৈতিক কর্মীরা নেতাদের সামন্তদের মতো মনে করেন। আর নেতারা নব্য ধনীদের মতো আচরণ করেন। শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, আমাদের সামগ্রিক সামাজিক আচরণ এমনি।
এম এম আকাশ বামপন্থীদের সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। আদর্শের প্রতিষ্ঠা, মানুষের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা ও আত্মত্যাগের জন্য কমিউনিস্ট নেতারা ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁরাই অনেক আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা আন্দোলন করেন সেই ভিত্তির ওপর। আমাদের আজকের সমাজে বামপন্থীদের স্থান কোথায়? এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পর কেন বামপন্থীরা বুর্জোয়া দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল? কেউ কেউ বলেন, আমাদের জনগণ অত্যন্ত ধার্মিক বলে বাম আন্দোলন বিস্তৃত হচ্ছে না। কেউ বলেন, দারিদ্র্য আমাদের বহু বছর ধরে চলছে, তাই দারিদ্র্য দূর করতে কারও তাড়া নেই। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আরও আলোচনা হওয়া উচিত। একবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, পরের বার বিএনপি এবং তারপর অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা দখল—এই বিষাক্ত চক্রের বাইরে আসতে হলে বামের শক্তির ঐক্য জরুরিভাবে প্রয়োজন। যদি বাম শক্তি এটা করতে সক্ষম না হয়, তবে জনগণ হয়তো মনে করবে যে আত্ম-অহমিকাই এই অনৈক্যের প্রকৃত কারণ।
ওয়াহিদ নবী: প্রাবন্ধিক ও প্রবাসী চিকিত্সক।
ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার, আমাদের দুই জোটের একজোটের কৌশল। আমাদের স্বাধীনতার চার স্তম্ভের দুটি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা এরা মেনে নেবে না—এটাই স্বাভাবিক এবং মেনে নেবে না বলেই এরা জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। আমাদের প্রশ্ন, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এই মূলনীতিগুলো জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করেছে কি? অনিবার্য কারণেই স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু হঠাত্ করেই হয়েছিল। এ জন্য ভৌগোলিক স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কিছু আলোচনা করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এ নীতিগুলো জনগণের কাছে ব্যাখ্যা করা হয়নি। পাকিস্তান আমলের ধর্মীয় রাজনীতির মোহ থেকে মানুষ রাতারাতি মুক্ত হয়ে যাবে, এটা আশা করা যায় না। আসলে ‘সেক্যুলার’ কথাটার বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা ব্যবহার না করে ‘পার্থিব’ বা জাগতিক কথাগুলো ব্যবহার করলে ভালো হতো। আসলে এ কথাটি সবাইকে বলা উচিত যে, সেক্যুলার কথাটি যিনি প্রথম ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন, তিনি স্পেনের মুসলমান দার্শনিক আবু রুশদ।
স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের ব্যর্থতার বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নেতারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সফল হননি। বেন বেল্লা, নক্রুমা, ওবোতে শোয়েকারনো এর উদাহরণ। মেকিয়াভেলি তাঁর প্রিন্স গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘শাসককে হতে হবে সিংহের মতো হিংস্র (ফিয়ার্স) ও শিয়ালের মতো ধূর্ত।’ শেখ মুজিব ছিলেন সিংহের মতো কিন্তু হিংস্র ছিলেন না। শিয়ালের মতো ধূর্তও তিনি ছিলেন না।
পাকিস্তান আমলে রাজনীতিতে আমলা ও সেনাবাহিনীর প্রাধান্য থাকায় রাজনীতিবিদেরা দেশ শাসনের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি। আমরা এই দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছি। স্বাধীনতার কাছে আমাদের অনেকের প্রত্যাশা অবাস্তব ছিল। পাকিস্তানিরা সবকিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। স্বাধীনতার পর ওই সম্পদগুলো আমরা পেয়ে যাব—এমন ধারণাও অনেকে করেছিল। স্বাধীনতার পর তীব্রবেগে ধনী হওয়ার চেষ্টায় লেগে গেলেন একদল, যাঁরা নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করলেন জাতির সামনে। ‘চাটার দল সব খেয়ে শেষ করে দেয়’ বঙ্গবন্ধুর কথাটা আর্তচিত্কারের মতো শুনিয়েছিল। সি এস লুইস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফোর লাভস-এ উল্লেখ করেছেন, ‘আমাদের ইতিহাসের সব অংশই গৌরবের নয়।’ দেশের জন্য গৌরবের নয়, এমন সব কথার আলোচনা সাহসের সঙ্গে আমাদের প্রয়োজনে করা উচিত।
একুশের সংগ্রামীরা আমাদের মধ্যে জাতীয় অহংকারবোধ এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেকের মধ্যে বহুদিনের পরাধীনতাজনিত হীনম্মন্যতাবোধ থেকে গেছে। এর একটা লক্ষণ হচ্ছে, চাটুকারিতা। বঙ্গবন্ধু জুলিওকুরি পুরস্কার পেলে দিনের পর দিন অসংখ্য মিছিল আসতে থাকে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে, অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে প্রধানমন্ত্রীর হাতে কত কাজ।
আমলারা তুলনামূলকভাবে অভিজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু তাঁরা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহ্য করতে পারলেন না। বাগড়া দেওয়া তাঁদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়াল। সেনাবাহিনীর কর্মচারীরা তীব্রবেগে পদোন্নতি পেলেন। মেজর থেকে মেজর জেনারেল হতে তাঁদের দু-তিন বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। একজনের যা পাওনা তার চেয়ে বেশি পেলে তার মাথা গরম হয়ে যায়। কয়েকজনের তা-ই হলো।
আওয়ামী লীগের এক অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আওয়াজ তুলে বাজার গরম করে ফেলল। হাজার হাজার তরুণ সে ডাকে সাড়া দিল। কিন্তু তাদের নেতৃত্ব ছিল দিশেহারা। অন্যদিকে কলকারখানা জাতীয়করণের পর সেগুলো ভালোভাবে চলল না। দিশেহারা মুক্তিসেনাদের একদল নৈরাশ্যের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলল। একদলীয় সরকার গঠনের প্রয়োজন সম্পর্কে জনসাধারণকে তেমন কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। সরকারের শত্রুরা এই সুযোগ নিয়েছিল।
সেনাবাহিনীর একদল জুনিয়র অফিসার নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাল। এর পরের ইতিহাস দিশেহারা রক্তপাতের আর সেনা-কর্তাদের ক্ষমতালিপ্সার ইতিহাস। সাময়িকভাবে বিজয়ী জিয়া স্বাধীনতার আদর্শবিরোধী সব ধারা সংবিধানে ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরোধীরা একত্র হলো। সব সেনা-নেতাই ক্ষমতা দখলের পর ঘোষণা দেন। বিভিন্ন দেশে তাঁরা কেবল নামগুলো বদলে দেন। সব সেনা-নেতা যা করেন, জিয়াও তা-ই করেছেন। সরকারি অর্থ ব্যয় করে ও সরকারি সংগঠনকে ব্যবহার করে তিনি দল গঠন করেছেন। রাজনীতিবিদদের জেলে পুরে নিজের ঢাকঢোল পিটিয়েছেন। যেহেতু রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে ঢালাওভাবে, তাই তাঁর সাধুতার কথা প্রচার করা হলো। জিয়া সরকারি অর্থ খরচ করেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিন্তু এটাকে অনেকে দুর্নীতি মনে করে না। তবুও তাঁকে ঘিরে সততার একটা প্রচার হয়েছে। জিয়া এখন গত, তাই তাঁর গুণাগুণের ওপর নির্ভর করলে চলবে না বিএনপির। ভাগ্যের কী পরিহাস! তাঁর সন্তানেরা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত।
এম এম আকাশ বাংলাদেশের রাজনীতির তিনটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। অতীতের বিশ্লেষণ করলে এই তিনটিকে অবশ্যই যুক্তিসংগত মনে হয়। তবে ঠিক কী ঘটবে, কে বলতে পারে?
সবাই বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নিয়ে হতাশ। এর কারণ অবশ্য রয়েছে। বাংলাদেশে প্রকৃত বুর্জোয়া কয়জন আছেন। উত্পাদনের মাধ্যম কতটা তাদের নিয়ন্ত্রণে? ঋণখেলাপির মাধ্যমে কি প্রকৃত বুর্জোয়া হওয়া যায়? আমাদের নেতাদের সামাজিক আচরণ কি বুর্জোয়াদের মতো? আমার তো মনে হয় রাজনৈতিক কর্মীরা নেতাদের সামন্তদের মতো মনে করেন। আর নেতারা নব্য ধনীদের মতো আচরণ করেন। শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, আমাদের সামগ্রিক সামাজিক আচরণ এমনি।
এম এম আকাশ বামপন্থীদের সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। আদর্শের প্রতিষ্ঠা, মানুষের কল্যাণের প্রতি দৃষ্টি, অক্লান্ত পরিশ্রম, সততা ও আত্মত্যাগের জন্য কমিউনিস্ট নেতারা ছিলেন সবার শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁরাই অনেক আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলেন। আওয়ামী লীগের কর্মীরা আন্দোলন করেন সেই ভিত্তির ওপর। আমাদের আজকের সমাজে বামপন্থীদের স্থান কোথায়? এত ত্যাগ-তিতিক্ষার পর কেন বামপন্থীরা বুর্জোয়া দলগুলোর ওপর নির্ভরশীল? কেউ কেউ বলেন, আমাদের জনগণ অত্যন্ত ধার্মিক বলে বাম আন্দোলন বিস্তৃত হচ্ছে না। কেউ বলেন, দারিদ্র্য আমাদের বহু বছর ধরে চলছে, তাই দারিদ্র্য দূর করতে কারও তাড়া নেই। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আরও আলোচনা হওয়া উচিত। একবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, পরের বার বিএনপি এবং তারপর অরাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতা দখল—এই বিষাক্ত চক্রের বাইরে আসতে হলে বামের শক্তির ঐক্য জরুরিভাবে প্রয়োজন। যদি বাম শক্তি এটা করতে সক্ষম না হয়, তবে জনগণ হয়তো মনে করবে যে আত্ম-অহমিকাই এই অনৈক্যের প্রকৃত কারণ।
ওয়াহিদ নবী: প্রাবন্ধিক ও প্রবাসী চিকিত্সক।
No comments