খোলা চোখে-বছর শেষ, বছর শুরু by হাসান ফেরদৌস
ইংরেজিতে বলা হয়, ‘অন দি ওয়ান হ্যান্ড’ এবং ‘অন দি আদার হ্যান্ড’। একই কথার দুই পিঠ। আমেরিকায় টক শোগুলোয় এই ‘দুই হাত’ ব্যবহার না করে কথা বলার জো নেই। সেখানে সবকিছুই ‘একদিকে’ এই তো ‘অন্যদিকে’ ওই। সমসাময়িক বিষয়ের ভাষ্যকারেরা, যাঁরা কথা বেঁচে খান, তাঁরা কখনোই কোনো একটা বিষয়ে পরস্পরের সঙ্গে একমত হন না।
একজন যদি ‘অন দি ওয়ান হ্যান্ড’-এর কথা বলেন, তো অন্যজন বলেন ‘অন দি আদার হ্যান্ড’-এর কথা। অথচ অবাক ব্যাপার হলো, গত দশকের শেষে ও নতুন দশকের শুরুতে দেখা যাচ্ছে সব ভাষ্যকারই অন্তত একটা বিষয়ে একমত। তাঁরা সবাই বলছেন, নতুন সহস্রাব্দের প্রথম দশক আমেরিকার জন্য ছিল মহাদুর্যোগের। এই দশকের নানা নামও দিয়েছেন তাঁরা—নষ্ট দশক, সংকটের দশক, অর্থনৈতিক মন্দার দশক। এই নষ্ট দশকের প্রভাব কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ হবে না, এ কথাতেও কাগুজে পণ্ডিতেরা একমত।
একমত হওয়ার কারণও আছে। গত ১০ বছর আমেরিকার ওপর দিয়ে যে ঝড়ঝাপটা গেল, এমন ঝক্কি আমেরিকাকে বহুদিন পোহাতে হয়নি। জর্জ বুশের নির্বাচন দিয়ে দশকের শুরু। সেই থেকেই শনির দশা চলছে। নাইন-ইলেভেন, আফগানিস্তান, ইরাক ইত্যাদি পেরোতে না পেরোতেই এক মহামন্দার গাড্ডায় পড়ে গেল আমেরিকা। তারপর হঠাত্ আলোর ঝলকানির মতো বারাক ওবামার উত্থান। তো সে আলো জ্বলতে না জ্বলতেই সলতের ফিতে নিভতে শুরু করেছে। ওবামার সাফল্য-ব্যর্থতা হিসাবের সময় এখনো আসেনি, কিন্তু এরই মধ্যে একটা জিনিস স্পষ্ট, আর তা হলো বিশ্বজুড়ে আমেরিকার আধিপত্যের দিন শেষ। প্রকৃতপক্ষে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, ওবামার বিজয়ের ভেতর দিয়েই মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘোষিত হয়। জর্জ বুশের সময় আমেরিকার রক্ষণশীলেরা এক ‘আমেরিকান শতাব্দীর’ কথা বলা শুরু করেছিলেন। তাঁরা এমন কথাও বলছিলেন, আমেরিকার জন্য যা ভালো, পৃথিবীর জন্যই তা ভালো; আমেরিকার জন্য যা মন্দ, পৃথিবীর জন্য তা মন্দ হতে বাধ্য। গায়ের জোরে, অস্ত্রের গুঁতোয়, ডলারের উেকাচে যা খুশি তাই করতে চেয়েছিল ওয়াশিংটন। বারাক ওবামার বিজয়ের ভেতর দিয়ে সেই ‘ইম্পেরিয়াল’ আমেরিকার পতন হলো, আর তা সম্ভব হলো খোদ আমেরিকানদের হাতেই।
অথচ এখন (এখানে ‘অন দি আদার হ্যান্ড’ কথাটা যোগ করুন) ওবামার এক বছর যেতে না যেতেই বলা শুরু হয়েছে, ওবামার প্রেসিডেন্সি আসলে জর্জ বুশের তৃতীয় দফা, তাঁর ‘থার্ড টার্ম’। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে নিয়ে লবিস্টদের সঙ্গে ঘরসংসার, আগের অবস্থার কোনো কিছুই তাঁর সময়ে বদলায়নি। বদলানোর কোনো স্পষ্ট চেষ্টাও নেই, আর সে কারণেই হতাশা ও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। এক বছরেই দেশের মানুষ ওবামাকে নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে।
নতুন বছরে তিনটি সমস্যা ওবামাকে ভোগাবে সবচেয়ে বেশি—সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অব্যাহত মন্দাবস্থা ও ডেমোক্রেটিক পার্টির বেসামাল অবস্থা। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শক্ত কথা বলে নির্বাচনে জিতেছিলেন ওবামা। কিন্তু এখন তিনি নিজেই আমেরিকার নতুন ‘ওয়ার প্রেসিডেন্ট’ বনে গেছেন। ইরাক ও আফগানিস্তানের দুটি যুদ্ধই এখন তাঁর ঘাড়ে। তার ওপর রয়েছে পাকিস্তান ও সদ্য যুক্ত হওয়া ইয়েমেন। এই শেষের দুটি দেশে আমেরিকার সামরিক ভূমিকা নিয়ে কথা এখনো তেমন তেতে ওঠেনি। কারণ, দুই দেশেই যুদ্ধ চলছে দূরপাল্লায়। সরাসরি সেনা না পাঠিয়ে চালকবিহীন বিমান থেকে বোমা ফেলে চলছে এই দুই যুদ্ধ। আর উভয় যুদ্ধই পরিচালিত হচ্ছে সিআইএর নেতৃত্বে অতি গোপনে। কী হচ্ছে, কাক-পক্ষীকেও সে কথা জানানো যাবে না। দেশের নিরাপত্তা নিয়ে কথা, তার ওপর আবার এর সঙ্গে সিআইএ জড়িত! ফলে কোনো পক্ষ থেকেই এ নিয়ে রা নেই। এই তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওবামা জিতবেন, এ কথা কেউই বিশ্বাস করে না। খোদ ওবামাও নন। কিন্তু যুদ্ধ না করে আল-কায়েদার হুমকি মোকাবিলায় তিনি অন্য আর কী করতে পারেন, সে ছবিটাও পরিষ্কার নয়।
ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটা অব্যাহত সমস্যা হলো, ‘নিরাপত্তা’ প্রশ্নে তাঁরা ‘অধিক নমনীয়’—এমন একটা ধারণা। রিপাবলিকানরা কনুই এগিয়ে গুঁতোগুঁতির জন্য সদা প্রস্তুত। আমেরিকার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি থাকুক বা না থাকুক, বিপদের আশঙ্কা মনে হলেই আঘাত হানার পুরো অধিকার আমেরিকার আছে—জর্জ বুশের এই ‘প্রি-এম্পটিভ স্টাইক’-তত্ত্বে তারা এখনো আমুণ্ডু বিশ্বাস করে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ওবামা এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়েছেন, সামরিক হামলার বদলে কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ক্ষমতায় বসে দেখছেন, কনুই এগিয়ে না ধরলে ওই ‘অধিক নমনীয়’ তকমাটা তাঁর কপালে স্থায়ী হয়ে চেপে বসতে পারে। আর সত্যি সত্যি যদি নাইন-ইলেভেনের মতো কোনো মহাদুর্যোগ আবারও ঘটে, প্রতিপক্ষ থেকে বলা হবে—কী, বলেছিলাম না ওবামা নিরাপত্তার ব্যাপারে ‘নমনীয়’। শুধু ওবামার জন্য নয়, পুরো ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য সেটা হবে নিশ্চিত রাজনৈতিক মৃত্যুর পরোয়ানা।
সবাই এ কথা মানেন, আফগানিস্তানে সফল হতে হলে ওবামার দরকার পাকিস্তানের সাহায্য। আল-কায়েদা ও তালেবানের সেটাই সদর দপ্তর। কিন্তু সে দেশের উর্দিওয়ালারা আমেরিকার দেওয়া মাখনটা-ঘিটা চাটবে, কিন্তু তালেবানের ওপর চাপ বাড়ানোর কথা বললেই তাদের মুখ তালব্য-শ হয়ে ওঠে। কারণ, পাকিস্তানের কাছে আসল শত্রু তালেবান নয়, ভারত। ইসলামাবাদ হিসাব করে দেখেছে, আমেরিকা আজ হোক কাল হোক, আফগানিস্তান ছাড়বেই। তখন যাতে কাবুলে পাকিস্তানের প্রতি নরম এবং ভারতের প্রতি গরম—এমন এক সরকার ক্ষমতায় থাকে, সে জন্য তালেবানদের তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চায় পাকিস্তান। পাকিস্তানি কর্তাদের হিসাবের এই সমীকরণটা যত দিন না বদলানো যাচ্ছে, যুদ্ধের চেহারা তত দিন খুব একটা বদলাবে না।
আফগানিস্তানে আমেরিকা যদি ব্যর্থ হয়, আর তেমন ব্যর্থতার আশঙ্কা একদম উড়িয়েও দেওয়া যায় না, তার ফলে এক আমেরিকাই ভুগবে না, আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ায় থাকি, তারা সবাই ভুগব। এই সহজ কথাটা আমাদের মাথায় পুরোপুরি ঢুকেছে বলে মনে হয় না। আমরা জানি, আমেরিকানরা আফগানিস্তানের পাহাড়ি ফাঁদ থেকে পালানোর জন্য একটা পথ ইতিমধ্যেই খোঁজা শুরু করেছে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত ঢালাওভাবে সব তালেবানকে তারা সন্ত্রাসী বলে খরচার খাতায় নাম লিখে রেখেছিল। কিন্তু এখন বিপদ আঁচ করতে পেরে তারা ‘ভালো তালেবান’ আর ‘মন্দ তালেবান’—শত্রুদের এই দুই ভাগে ভাগ করা শুরু করেছে। ‘মন্দ তালেবান’ মানে সেসব জেহাদি, যারা আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত; যাদের লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে ইসলামি জিহাদ, যাদের কাছে আমেরিকা হচ্ছে ‘দি গ্রেট স্যাটান’। অন্যদিকে ‘ভালো তালেবান’ শুধু আফগানিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট, সেখানে ইসলামি হুকুমত হলেই তারা খুশি। পাকিস্তানের পরামর্শে ওবামা সাহেবরা এখন এই ‘ভালো’ তালেবানদের বাছাই করা শুরু করেছেন। আমরা যারা আমাদের নিজেদের তালেবানদের কথা জানি, তাদের ভেতর ভালো খুঁজতে গেলে যে কম্বল সাফ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। ভয়ের কথা হলো, আমেরিকা ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি নিয়ে এই তথাকথিত ‘ভালো তালেবানরা’ যদি সত্যি সত্যি কাবুলে কোনো সরকার গঠনে সক্ষম হয়, তার প্রভাব যে আরব সাগর ডিঙিয়ে ভারত ও বাংলাদেশেও পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তালেবানদের কারণে কেবল কাবুল পুড়বে না, আমরাও পুড়ব। এমন ভয়ানক শত্রুকে রুখতে হলে একজোট হয়ে এগোতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সলাপরামর্শ নেই। পাকিস্তান ও ভারত এ নিয়ে সহযোগিতার কথা বিবেচনায় পর্যন্ত আনেনি। আমরাও এ নিয়ে টুঁ শব্দটি তুলিনি। একটি তালেবানবিরোধী দক্ষিণ এশীয় সামরিক মোর্চা গঠন সম্ভব হলে একদিকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন কমবে, তালেবান রোখাও সহজতর হবে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বাইরেও নানা গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে ওবামা সরকার। ইরান নিয়ে কী করা যায়, সেটা এখনো স্পষ্ট হয়নি। প্রথম প্রথম কূটনীতির কথা বললেও ইরানি অনমনীয়তার মুখে তিনি এখন শক্ত কথা বলা শুরু করেছেন। নিজের সামরিক ‘ক্রেডেনশিয়াল’ পোক্ত করতে এই শক্ত ভাবটা খুব জরুরি। অন্যদিকে মস্ত ঢাকঢোল পিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতেও বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। ওবামা দাবি করেছিলেন, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ইসরায়েল বলে দিয়েছে, তারা বসতি নির্মাণ বন্ধ করবে না। ব্যস, বারাক ওবামার মুখে আর কথা নেই।
যুদ্ধ ছাড়া ওবামার জন্য অন্য বড় চ্যালেঞ্জ দেশের অর্থনীতি। সেখানেও পণ্ডিতেরা ‘এদিক’ ও ‘সেদিকের’ কথা বলছেন। ‘একদিকে’ দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির বেহাল অবস্থা কিছুটা হলেও সামাল দিতে পেরেছে ওবামা সরকার। ফেডারেল পর্যায়ে বিস্তর টাকা ঢালা হয়েছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মোটর কোম্পানিগুলোকে বাঁচাতে। আবাসিক ঋণ খাতকে সাহায্য করতেও বিস্তর অর্থ এসেছে। এসব সরকারি হস্তক্ষেপের ফলে আমেরিকায় মন্দাবস্থা শেষ হয়েছে—এ কথা বিশ্বাস করে এমন পণ্ডিতের অভাব নেই এ দেশে। এ কথা বলার পক্ষে তাঁদের যুক্তি হলো, শেয়ারবাজারের তেজি ভাব, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আপাত সচ্ছলতা এবং বেকার ভাতার জন্য আবেদনকারীর সংখ্যার ক্রমাবনতি। ক্রিসমাস মৌসুমে খুচরো ব্যবসায়ীরা খদ্দেরের মুখ দেখেছেন, সেটাও খুশির খবর। নতুন মাল স্টকে তুলতে হলে উত্পাদন খাত আবার সচল হয়ে উঠবে, লোকজন চাকরি পাওয়া শুরু করবে। কিন্তু ‘অন্যদিকের’ কথাও একদম ফেলনা নয়; তা হলো, ব্যাংকগুলো লাভের মুখ দেখলেও তারা এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থঋণ বাজারে ছাড়ছে না। আর ঋণবাজারে প্রাণ না এলে অর্থনীতিও গড়গড়িয়ে চলা শুরু করবে না। সবচেয়ে বড় কথা, এত করেও চাকরির বাজার চাঙা করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি আইএমএফ যে ভবিষ্যতের বু্ল-প্রিন্ট তুলে ধরেছে তাতে বলা হচ্ছে, ২০১০-এ আমেরিকার প্রবৃদ্ধি শূন্য শতাংশে রয়ে যাবে এবং বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। যে হারে টাকা ধার করে আমেরিকাকে টিকে থাকতে হচ্ছে, তাতে আইএমএফের হিসাবে, এই দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ বিশ্বের মোট জিডিপির ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এ ধারা না বদলালে মার্কিন ডলারের পতন প্রায় অনিবার্য।
ওবামার তিন নম্বর যে সমস্যার কথা বললাম ডেমোক্রেটিক পার্টিতে স্থবিরতা, সেটা আরও গোলমেলে ব্যাপার। ওবামার ও তাঁর ডেমোক্রেটিক পার্টির ২০০৮ সালের বিজয়ের পেছনে প্রধান সমর্থন জুটেছিল স্বতন্ত্র ভোটারদের কাছ থেকে। এরা এরই মধ্যে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। দলের উদারনৈতিক ও বামপন্থী অংশ ওবামার ব্যাপারে খুবই আশান্বিত ছিল। তারা ভেবেছিল, ওবামা আসা মাত্র সব একেবারে উল্টে যাবে। ইরাক থেকে সেনা ফেরত আসবে, গুয়ানতানামো বের কয়েদখানা বন্ধ হবে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে দৈহিক নির্যাতন থামবে, ‘নির্বাহী ক্ষমতা’র নাম দিয়ে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার বুশ ডকট্রিন বাতিল হবে, সমকামীদের সমানাধিকার আসবে ইত্যাদি। এর কোনোটাই হয়নি, হবে বলেও মনে হয় না।
খুব মুখ বড় করে ওবামা বলেছিলেন তাঁর দুই প্রধান অগ্রাধিকার হলো স্বাস্থ্য-বিমা ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে নতুন আইন প্রণয়ন। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে লোকদেখানো উদ্যোগের বাইরে ওবামা প্রশাসন কিছুই করবে না, কোপেনহেগেন সম্মেলনে সে কথা পরিষ্কার হয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য-বিমা প্রশ্নে একটা আইন হয়তো হবে, কিন্তু দলের বামপন্থীরা বলছেন, এমন আইন হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো। বিমা কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া রাজত্ব কমাতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিমা সরবরাহের কথা ওবামা বলেছিলেন। কিন্তু বিমা কোম্পানিগুলোর লবিংয়ের মুখে এবং রিপাবলিকানদের ‘না না’ চিত্কারের সামনে তিনি মুখে কুলুপটি এঁটে বসে থাকলেন। এমনকি স্বাস্থ্য-বিমা আইনে ‘পাবলিক অপশন’ না থাকলে ক্ষতি নেই—এমন কথাও তিনি বললেন। ওবামার এই আগে থেকে দুই হাত তুলে ধরার প্রবণতার কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল অংশ দারুণ হতাশ। নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে এরা চাঙা না হলে দলের ভরাডুবি ঠেকানো কঠিন হবে। এ কথা ঠিক যে, বিরোধী রিপাবলিকানদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে ওবামা পড়েছিলেন। কিন্তু সে প্রতিরোধ তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিমা কোম্পানি ও রিপাবলিকানদের প্রতিবাদের কারণেই তো গত ৬০ বছরে স্বাস্থ্য-বিমা এগোয়নি। ওবামা সে প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ করে চলতি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ম্যান্ডেটই পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন করার জন্য দরকার শক্ত নেতৃত্বের। ওবামা সে পথে না গিয়ে আপসের পথ বেছে নিলেন। কোনো রকম একটা আইন পাস হলেই তিনি খুশি, এ কথা ফাঁস হয়ে গেলে খোদ ডেমোক্র্যাটদের ভেতরেই স্বাস্থ্য-বিমা প্রশ্নে সমর্থন নেতিয়ে পড়ে।
প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা এখন সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে অপেক্ষা করছেন আগামী নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের। তাঁরা হিসাব কষে বসে আছেন, সে নির্বাচনে কংগ্রেসের উভয় পরিষদেই ডেমোক্র্যাটদের চলতি নিয়ন্ত্রণ শেষ হবে, রিপাবলিকানরা ফের ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরে আসবেন। ঠিক যেভাবে ১৯৯৪-তে বিল ক্লিনটনের সময় হয়েছিল। তবে (অর্থাত্ ‘অন্যদিকে’) ডেমোক্র্যাট এবং ওবামার জন্য একটা ভালো খবর হলো, বিপক্ষ রিপাবলিকানদের ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। এই দল এখন একদমই নেতৃত্বহীন। দলের সবচেয়ে কট্টর রক্ষণশীল অংশ—যাঁরা ওবামাকে একজন কমিউনিস্ট চর বলে মনে করেন এবং দরকার হলে শ্বেতপ্রধান রাজ্যগুলো আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও যাঁদের কোনো আপত্তি নেই, তাঁরা এখন এই দলের গাড়ির চালক হয়ে বসেছেন। নভেম্বরে যদি তাঁদের হাতে বৈঠা রেখে বৈতরণী পেরোতে চায় রিপাবলিকান পার্টি, তা হলে খুব বেশি দূর এগোনো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
ওবামা হয়তো সে আশায় এখন সকাল-বিকেল মোমবাতি জ্বালছেন।
৫ জানুয়ারি, ২০১০; নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
একমত হওয়ার কারণও আছে। গত ১০ বছর আমেরিকার ওপর দিয়ে যে ঝড়ঝাপটা গেল, এমন ঝক্কি আমেরিকাকে বহুদিন পোহাতে হয়নি। জর্জ বুশের নির্বাচন দিয়ে দশকের শুরু। সেই থেকেই শনির দশা চলছে। নাইন-ইলেভেন, আফগানিস্তান, ইরাক ইত্যাদি পেরোতে না পেরোতেই এক মহামন্দার গাড্ডায় পড়ে গেল আমেরিকা। তারপর হঠাত্ আলোর ঝলকানির মতো বারাক ওবামার উত্থান। তো সে আলো জ্বলতে না জ্বলতেই সলতের ফিতে নিভতে শুরু করেছে। ওবামার সাফল্য-ব্যর্থতা হিসাবের সময় এখনো আসেনি, কিন্তু এরই মধ্যে একটা জিনিস স্পষ্ট, আর তা হলো বিশ্বজুড়ে আমেরিকার আধিপত্যের দিন শেষ। প্রকৃতপক্ষে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, ওবামার বিজয়ের ভেতর দিয়েই মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘোষিত হয়। জর্জ বুশের সময় আমেরিকার রক্ষণশীলেরা এক ‘আমেরিকান শতাব্দীর’ কথা বলা শুরু করেছিলেন। তাঁরা এমন কথাও বলছিলেন, আমেরিকার জন্য যা ভালো, পৃথিবীর জন্যই তা ভালো; আমেরিকার জন্য যা মন্দ, পৃথিবীর জন্য তা মন্দ হতে বাধ্য। গায়ের জোরে, অস্ত্রের গুঁতোয়, ডলারের উেকাচে যা খুশি তাই করতে চেয়েছিল ওয়াশিংটন। বারাক ওবামার বিজয়ের ভেতর দিয়ে সেই ‘ইম্পেরিয়াল’ আমেরিকার পতন হলো, আর তা সম্ভব হলো খোদ আমেরিকানদের হাতেই।
অথচ এখন (এখানে ‘অন দি আদার হ্যান্ড’ কথাটা যোগ করুন) ওবামার এক বছর যেতে না যেতেই বলা শুরু হয়েছে, ওবামার প্রেসিডেন্সি আসলে জর্জ বুশের তৃতীয় দফা, তাঁর ‘থার্ড টার্ম’। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে নিয়ে লবিস্টদের সঙ্গে ঘরসংসার, আগের অবস্থার কোনো কিছুই তাঁর সময়ে বদলায়নি। বদলানোর কোনো স্পষ্ট চেষ্টাও নেই, আর সে কারণেই হতাশা ও ক্ষোভ দানা বাঁধছে। এক বছরেই দেশের মানুষ ওবামাকে নিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে।
নতুন বছরে তিনটি সমস্যা ওবামাকে ভোগাবে সবচেয়ে বেশি—সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, অব্যাহত মন্দাবস্থা ও ডেমোক্রেটিক পার্টির বেসামাল অবস্থা। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শক্ত কথা বলে নির্বাচনে জিতেছিলেন ওবামা। কিন্তু এখন তিনি নিজেই আমেরিকার নতুন ‘ওয়ার প্রেসিডেন্ট’ বনে গেছেন। ইরাক ও আফগানিস্তানের দুটি যুদ্ধই এখন তাঁর ঘাড়ে। তার ওপর রয়েছে পাকিস্তান ও সদ্য যুক্ত হওয়া ইয়েমেন। এই শেষের দুটি দেশে আমেরিকার সামরিক ভূমিকা নিয়ে কথা এখনো তেমন তেতে ওঠেনি। কারণ, দুই দেশেই যুদ্ধ চলছে দূরপাল্লায়। সরাসরি সেনা না পাঠিয়ে চালকবিহীন বিমান থেকে বোমা ফেলে চলছে এই দুই যুদ্ধ। আর উভয় যুদ্ধই পরিচালিত হচ্ছে সিআইএর নেতৃত্বে অতি গোপনে। কী হচ্ছে, কাক-পক্ষীকেও সে কথা জানানো যাবে না। দেশের নিরাপত্তা নিয়ে কথা, তার ওপর আবার এর সঙ্গে সিআইএ জড়িত! ফলে কোনো পক্ষ থেকেই এ নিয়ে রা নেই। এই তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওবামা জিতবেন, এ কথা কেউই বিশ্বাস করে না। খোদ ওবামাও নন। কিন্তু যুদ্ধ না করে আল-কায়েদার হুমকি মোকাবিলায় তিনি অন্য আর কী করতে পারেন, সে ছবিটাও পরিষ্কার নয়।
ওবামা ও ডেমোক্র্যাটদের জন্য একটা অব্যাহত সমস্যা হলো, ‘নিরাপত্তা’ প্রশ্নে তাঁরা ‘অধিক নমনীয়’—এমন একটা ধারণা। রিপাবলিকানরা কনুই এগিয়ে গুঁতোগুঁতির জন্য সদা প্রস্তুত। আমেরিকার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি থাকুক বা না থাকুক, বিপদের আশঙ্কা মনে হলেই আঘাত হানার পুরো অধিকার আমেরিকার আছে—জর্জ বুশের এই ‘প্রি-এম্পটিভ স্টাইক’-তত্ত্বে তারা এখনো আমুণ্ডু বিশ্বাস করে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ওবামা এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়েছেন, সামরিক হামলার বদলে কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন ক্ষমতায় বসে দেখছেন, কনুই এগিয়ে না ধরলে ওই ‘অধিক নমনীয়’ তকমাটা তাঁর কপালে স্থায়ী হয়ে চেপে বসতে পারে। আর সত্যি সত্যি যদি নাইন-ইলেভেনের মতো কোনো মহাদুর্যোগ আবারও ঘটে, প্রতিপক্ষ থেকে বলা হবে—কী, বলেছিলাম না ওবামা নিরাপত্তার ব্যাপারে ‘নমনীয়’। শুধু ওবামার জন্য নয়, পুরো ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য সেটা হবে নিশ্চিত রাজনৈতিক মৃত্যুর পরোয়ানা।
সবাই এ কথা মানেন, আফগানিস্তানে সফল হতে হলে ওবামার দরকার পাকিস্তানের সাহায্য। আল-কায়েদা ও তালেবানের সেটাই সদর দপ্তর। কিন্তু সে দেশের উর্দিওয়ালারা আমেরিকার দেওয়া মাখনটা-ঘিটা চাটবে, কিন্তু তালেবানের ওপর চাপ বাড়ানোর কথা বললেই তাদের মুখ তালব্য-শ হয়ে ওঠে। কারণ, পাকিস্তানের কাছে আসল শত্রু তালেবান নয়, ভারত। ইসলামাবাদ হিসাব করে দেখেছে, আমেরিকা আজ হোক কাল হোক, আফগানিস্তান ছাড়বেই। তখন যাতে কাবুলে পাকিস্তানের প্রতি নরম এবং ভারতের প্রতি গরম—এমন এক সরকার ক্ষমতায় থাকে, সে জন্য তালেবানদের তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে চায় পাকিস্তান। পাকিস্তানি কর্তাদের হিসাবের এই সমীকরণটা যত দিন না বদলানো যাচ্ছে, যুদ্ধের চেহারা তত দিন খুব একটা বদলাবে না।
আফগানিস্তানে আমেরিকা যদি ব্যর্থ হয়, আর তেমন ব্যর্থতার আশঙ্কা একদম উড়িয়েও দেওয়া যায় না, তার ফলে এক আমেরিকাই ভুগবে না, আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ায় থাকি, তারা সবাই ভুগব। এই সহজ কথাটা আমাদের মাথায় পুরোপুরি ঢুকেছে বলে মনে হয় না। আমরা জানি, আমেরিকানরা আফগানিস্তানের পাহাড়ি ফাঁদ থেকে পালানোর জন্য একটা পথ ইতিমধ্যেই খোঁজা শুরু করেছে। কিছুদিন আগ পর্যন্ত ঢালাওভাবে সব তালেবানকে তারা সন্ত্রাসী বলে খরচার খাতায় নাম লিখে রেখেছিল। কিন্তু এখন বিপদ আঁচ করতে পেরে তারা ‘ভালো তালেবান’ আর ‘মন্দ তালেবান’—শত্রুদের এই দুই ভাগে ভাগ করা শুরু করেছে। ‘মন্দ তালেবান’ মানে সেসব জেহাদি, যারা আল-কায়েদার সঙ্গে জড়িত; যাদের লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে ইসলামি জিহাদ, যাদের কাছে আমেরিকা হচ্ছে ‘দি গ্রেট স্যাটান’। অন্যদিকে ‘ভালো তালেবান’ শুধু আফগানিস্তান নিয়ে সন্তুষ্ট, সেখানে ইসলামি হুকুমত হলেই তারা খুশি। পাকিস্তানের পরামর্শে ওবামা সাহেবরা এখন এই ‘ভালো’ তালেবানদের বাছাই করা শুরু করেছেন। আমরা যারা আমাদের নিজেদের তালেবানদের কথা জানি, তাদের ভেতর ভালো খুঁজতে গেলে যে কম্বল সাফ হবে, তাতে সন্দেহ নেই। ভয়ের কথা হলো, আমেরিকা ও পাকিস্তানের স্বীকৃতি নিয়ে এই তথাকথিত ‘ভালো তালেবানরা’ যদি সত্যি সত্যি কাবুলে কোনো সরকার গঠনে সক্ষম হয়, তার প্রভাব যে আরব সাগর ডিঙিয়ে ভারত ও বাংলাদেশেও পড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
তালেবানদের কারণে কেবল কাবুল পুড়বে না, আমরাও পুড়ব। এমন ভয়ানক শত্রুকে রুখতে হলে একজোট হয়ে এগোতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো সলাপরামর্শ নেই। পাকিস্তান ও ভারত এ নিয়ে সহযোগিতার কথা বিবেচনায় পর্যন্ত আনেনি। আমরাও এ নিয়ে টুঁ শব্দটি তুলিনি। একটি তালেবানবিরোধী দক্ষিণ এশীয় সামরিক মোর্চা গঠন সম্ভব হলে একদিকে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন কমবে, তালেবান রোখাও সহজতর হবে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বাইরেও নানা গ্যাঁড়াকলে আটকে আছে ওবামা সরকার। ইরান নিয়ে কী করা যায়, সেটা এখনো স্পষ্ট হয়নি। প্রথম প্রথম কূটনীতির কথা বললেও ইরানি অনমনীয়তার মুখে তিনি এখন শক্ত কথা বলা শুরু করেছেন। নিজের সামরিক ‘ক্রেডেনশিয়াল’ পোক্ত করতে এই শক্ত ভাবটা খুব জরুরি। অন্যদিকে মস্ত ঢাকঢোল পিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তাতেও বিন্দুমাত্র অগ্রগতি হয়নি। ওবামা দাবি করেছিলেন, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। ইসরায়েল বলে দিয়েছে, তারা বসতি নির্মাণ বন্ধ করবে না। ব্যস, বারাক ওবামার মুখে আর কথা নেই।
যুদ্ধ ছাড়া ওবামার জন্য অন্য বড় চ্যালেঞ্জ দেশের অর্থনীতি। সেখানেও পণ্ডিতেরা ‘এদিক’ ও ‘সেদিকের’ কথা বলছেন। ‘একদিকে’ দেখা যাচ্ছে অর্থনীতির বেহাল অবস্থা কিছুটা হলেও সামাল দিতে পেরেছে ওবামা সরকার। ফেডারেল পর্যায়ে বিস্তর টাকা ঢালা হয়েছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মোটর কোম্পানিগুলোকে বাঁচাতে। আবাসিক ঋণ খাতকে সাহায্য করতেও বিস্তর অর্থ এসেছে। এসব সরকারি হস্তক্ষেপের ফলে আমেরিকায় মন্দাবস্থা শেষ হয়েছে—এ কথা বিশ্বাস করে এমন পণ্ডিতের অভাব নেই এ দেশে। এ কথা বলার পক্ষে তাঁদের যুক্তি হলো, শেয়ারবাজারের তেজি ভাব, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আপাত সচ্ছলতা এবং বেকার ভাতার জন্য আবেদনকারীর সংখ্যার ক্রমাবনতি। ক্রিসমাস মৌসুমে খুচরো ব্যবসায়ীরা খদ্দেরের মুখ দেখেছেন, সেটাও খুশির খবর। নতুন মাল স্টকে তুলতে হলে উত্পাদন খাত আবার সচল হয়ে উঠবে, লোকজন চাকরি পাওয়া শুরু করবে। কিন্তু ‘অন্যদিকের’ কথাও একদম ফেলনা নয়; তা হলো, ব্যাংকগুলো লাভের মুখ দেখলেও তারা এখনো পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থঋণ বাজারে ছাড়ছে না। আর ঋণবাজারে প্রাণ না এলে অর্থনীতিও গড়গড়িয়ে চলা শুরু করবে না। সবচেয়ে বড় কথা, এত করেও চাকরির বাজার চাঙা করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি আইএমএফ যে ভবিষ্যতের বু্ল-প্রিন্ট তুলে ধরেছে তাতে বলা হচ্ছে, ২০১০-এ আমেরিকার প্রবৃদ্ধি শূন্য শতাংশে রয়ে যাবে এবং বেকারত্বের হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। যে হারে টাকা ধার করে আমেরিকাকে টিকে থাকতে হচ্ছে, তাতে আইএমএফের হিসাবে, এই দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ বিশ্বের মোট জিডিপির ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এ ধারা না বদলালে মার্কিন ডলারের পতন প্রায় অনিবার্য।
ওবামার তিন নম্বর যে সমস্যার কথা বললাম ডেমোক্রেটিক পার্টিতে স্থবিরতা, সেটা আরও গোলমেলে ব্যাপার। ওবামার ও তাঁর ডেমোক্রেটিক পার্টির ২০০৮ সালের বিজয়ের পেছনে প্রধান সমর্থন জুটেছিল স্বতন্ত্র ভোটারদের কাছ থেকে। এরা এরই মধ্যে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। দলের উদারনৈতিক ও বামপন্থী অংশ ওবামার ব্যাপারে খুবই আশান্বিত ছিল। তারা ভেবেছিল, ওবামা আসা মাত্র সব একেবারে উল্টে যাবে। ইরাক থেকে সেনা ফেরত আসবে, গুয়ানতানামো বের কয়েদখানা বন্ধ হবে, জিজ্ঞাসাবাদের নামে দৈহিক নির্যাতন থামবে, ‘নির্বাহী ক্ষমতা’র নাম দিয়ে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার বুশ ডকট্রিন বাতিল হবে, সমকামীদের সমানাধিকার আসবে ইত্যাদি। এর কোনোটাই হয়নি, হবে বলেও মনে হয় না।
খুব মুখ বড় করে ওবামা বলেছিলেন তাঁর দুই প্রধান অগ্রাধিকার হলো স্বাস্থ্য-বিমা ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে নতুন আইন প্রণয়ন। জলবায়ু পরিবর্তন প্রশ্নে লোকদেখানো উদ্যোগের বাইরে ওবামা প্রশাসন কিছুই করবে না, কোপেনহেগেন সম্মেলনে সে কথা পরিষ্কার হয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য-বিমা প্রশ্নে একটা আইন হয়তো হবে, কিন্তু দলের বামপন্থীরা বলছেন, এমন আইন হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো। বিমা কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া রাজত্ব কমাতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বিমা সরবরাহের কথা ওবামা বলেছিলেন। কিন্তু বিমা কোম্পানিগুলোর লবিংয়ের মুখে এবং রিপাবলিকানদের ‘না না’ চিত্কারের সামনে তিনি মুখে কুলুপটি এঁটে বসে থাকলেন। এমনকি স্বাস্থ্য-বিমা আইনে ‘পাবলিক অপশন’ না থাকলে ক্ষতি নেই—এমন কথাও তিনি বললেন। ওবামার এই আগে থেকে দুই হাত তুলে ধরার প্রবণতার কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল অংশ দারুণ হতাশ। নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে এরা চাঙা না হলে দলের ভরাডুবি ঠেকানো কঠিন হবে। এ কথা ঠিক যে, বিরোধী রিপাবলিকানদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে ওবামা পড়েছিলেন। কিন্তু সে প্রতিরোধ তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিমা কোম্পানি ও রিপাবলিকানদের প্রতিবাদের কারণেই তো গত ৬০ বছরে স্বাস্থ্য-বিমা এগোয়নি। ওবামা সে প্রতিরোধকে চ্যালেঞ্জ করে চলতি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর ম্যান্ডেটই পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই ম্যান্ডেট বাস্তবায়ন করার জন্য দরকার শক্ত নেতৃত্বের। ওবামা সে পথে না গিয়ে আপসের পথ বেছে নিলেন। কোনো রকম একটা আইন পাস হলেই তিনি খুশি, এ কথা ফাঁস হয়ে গেলে খোদ ডেমোক্র্যাটদের ভেতরেই স্বাস্থ্য-বিমা প্রশ্নে সমর্থন নেতিয়ে পড়ে।
প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা এখন সুতোয় মাঞ্জা দিয়ে অপেক্ষা করছেন আগামী নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের। তাঁরা হিসাব কষে বসে আছেন, সে নির্বাচনে কংগ্রেসের উভয় পরিষদেই ডেমোক্র্যাটদের চলতি নিয়ন্ত্রণ শেষ হবে, রিপাবলিকানরা ফের ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরে আসবেন। ঠিক যেভাবে ১৯৯৪-তে বিল ক্লিনটনের সময় হয়েছিল। তবে (অর্থাত্ ‘অন্যদিকে’) ডেমোক্র্যাট এবং ওবামার জন্য একটা ভালো খবর হলো, বিপক্ষ রিপাবলিকানদের ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। এই দল এখন একদমই নেতৃত্বহীন। দলের সবচেয়ে কট্টর রক্ষণশীল অংশ—যাঁরা ওবামাকে একজন কমিউনিস্ট চর বলে মনে করেন এবং দরকার হলে শ্বেতপ্রধান রাজ্যগুলো আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও যাঁদের কোনো আপত্তি নেই, তাঁরা এখন এই দলের গাড়ির চালক হয়ে বসেছেন। নভেম্বরে যদি তাঁদের হাতে বৈঠা রেখে বৈতরণী পেরোতে চায় রিপাবলিকান পার্টি, তা হলে খুব বেশি দূর এগোনো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
ওবামা হয়তো সে আশায় এখন সকাল-বিকেল মোমবাতি জ্বালছেন।
৫ জানুয়ারি, ২০১০; নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments