জাবি গ্রন্থাগার :এখনও পেল না পূর্ণতা by ইমদাদ হক

ছাত্রজীবনই শিক্ষার্থীর সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় পড়ালেখার পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করা দরকার। তা হলে মেধার সুষ্ঠু বিকাশ ঘটবে। নেতৃত্ব দেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠবে। বর্তমান সময়ে প্রতিযোগিতাটা বিশ্বজনীন।


মেধার লড়াইয়ে বাংলাদেশের মফস্বলের একজন ছাত্রের প্রতিযোগী এখন আমেরিকার হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী। বসে থাকার সময় একেবারেই নেই। শিক্ষার্থীর ডেডিকেটেড মানসিকতার সঙ্গে প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ।
কলুষিত ছাত্ররাজনীতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ধর্ষণের সেঞ্চুরি, ধর্ষক প্রতিরোধ দিবস, শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানি প্রভৃতি ঘটনার জন্য আলোচিত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। তার পরও শান্তিকামী শিক্ষার্থীরা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়। হাজারো প্রতিকূলতার মধ্যেও তারা চায় শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। কিন্তু স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদাসীনতায় থমকে যায় পড়ূয়া শিক্ষার্থীদের প্রয়াস। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য সরবরাহকৃত সুযোগ-সুবিধা একেবারেই অপ্রতুল। গবেষণা খাতে বরাদ্দ নেই বললেই চলে। শিক্ষা খাতের বরাদ্দ তো হাসির খোরাক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির অবস্থা ভয়াবহ। শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত বই সংকট, আসন সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। বিগত দু'বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও অবহেলিত থেকেছে লাইব্রেরি বলে। একে পরিপূর্ণ করতে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বারবার দাবি উঠলেও প্রশাসনের উদাসীনতায় তা এখনও অপূর্ণই রয়ে গেছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম। লাইব্রেরির হালচাল নিয়ে দৈনিক সমকালসহ একাধিক জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হলেও প্রশাসনের মাথাব্যথা নেই।
১৯৭১ সালে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রজেক্ট আকারে পরিচালিত হওয়ার সময় সেখানেই এ লাইব্রেরিটির যাত্রা শুরু হয়। পরে ঢাকার অদূরে সাভারে সাতশ' একর জমির ওপর ক্যাম্পাসটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় আনুষ্ঠানিকভাবে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৪০ বছরেও এর ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন পূর্ণতা পায়নি। ১৯৮৫ সালে লাইব্রেরির মূল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর ৫৫ হাজার বর্গফুটের কাজ সম্পন্ন হলেও বাকি ৪৫ হাজার বর্গফুটের কাজ আজও শেষ হয়নি। মূল ভবনের পাশে আরেকটি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলেও তার নির্মাণ কাজ শুরুই হয়নি। দক্ষ জনবলের অভাবও প্রকট এ লাইব্রেরিটিতে। বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও প্রয়োজন থাকা সত্ত্ব্বেও লাইব্রেরিতে জনবল নিয়োগের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা রয়েছে প্রধান লাইব্রেরিয়ানের পদটি। গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে একটিও সিলেবাসভিত্তিক বই কেনা হয়নি। আর নামমাত্র অন্যান্য যে কয়টি বই কেনা হয়েছে তা শিক্ষার্থীদের কোনো কাজেই আসে না। বর্তমানে সিলেবাস ভিত্তিক বইয়ের সংকট চরমে পেঁৗছেছে। লাইব্রেরিতে আসন সংখ্যাও খুবই কম। এ কারণে শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
বর্তমানে এতে বই রয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার। যেগুলো ২০০৮ সালের আগে কেনা। এরপর নতুন বই কেনা হয়েছে মাত্র ৩১টি। সিলেবাসভিত্তিক বই না কেনায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। বইয়ের দাম খুব বেশি হওয়ায় কিনে পড়া তাদের জন্য দুঃসাধ্য। আবার সিলেবাসভিত্তিক অধিকাংশ বই শিক্ষকরা উঠিয়ে আর জমা দেন না। অনেক শিক্ষার্থী আবার শিক্ষকের নাম ভাঙিয়ে বই ইস্যু করে পরে তা আর ফেরত দেন না। অধিকাংশ বইয়ের পৃষ্ঠা বা ছবি থাকে কাটা-ছেঁড়া। বই কাটা ও জমা না দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর আইন না থাকায় এ প্রবণতা অনেক বেশি। সর্বশেষ বাজেটে বই এবং জার্নালের জন্য বরাদ্দ মাত্র সাড়ে ২৮ লাখ টাকা; যা মোট বাজেটের তুলনায় একেবারেই নগণ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ১০ হাজার। এমফিল গবেষক শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৩৪০ জন। পিএইচডি শিক্ষার্থী রয়েছেন ১১৩০ জন। সব মিলিয়ে ১২ হাজার ৪৭০ শিক্ষার্থীর বসার জন্য লাইব্রেরিতে আসন রয়েছে মাত্র ১৩৬টি। গড়ে একটি আসনের বিপরীতে বসার জন্য লড়ছে ৯২ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের উপচেপড়া ভিড়ের কারণে পড়াশোনার শান্ত পরিবেশ আর থাকে না। কিছু শিক্ষার্থী লাইব্রেরি ত্যাগের সময় খাতা-পত্র দিয়ে পরের দিনের জন্য সিট দখল করে রাখে। ফলে সকালবেলা এসেও খালি জায়গা পাওয়া যায় না। এ ছাড়া লাইব্রেরিটিতে নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ চলে গেলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যে একটি আইপিএস আছে তাও বিকল। আসন সংখ্যার তীব্র সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী লাইব্রেরিতে গিয়ে ফিরে আসে। অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে। এ ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষকে বারবার বলেও কোনো লাভ হয়নি। লাইব্রেরির অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর্কাইভস সংরক্ষণ। পর্যাপ্ত আসবাবপত্র না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য ধুলা-বালি দিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথিপত্র অযত্নে-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে। লাইব্রেরির ক্যাটালগ সিস্টেমও বেশ জটিল । তবে সম্প্রতি দুটি কম্পিউটারের মাধ্যমে ক্যাটালগ সিস্টেম চালু করা হলেও এর কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট প্রশ্ন। অনেক ক্যাটালগ হারিয়েছে কিংবা ছিঁড়ে গেছে। তাই বইও পাওয়া যায় না অনেক সময়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের কোনো ওয়েবসাইট না থাকায় অনলাইনে বই পড়ার সুযোগ নেই।
লাইব্রেরির এ সংকটের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এটি এখন শিক্ষার্থীদের অস্তিত্বের লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বারবার রাজনৈতিক বক্তব্য দিলেও ইতিবাচক পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। একটি মেধা ও মননে সমৃদ্ধ জাতি গঠনে লাইব্রেরির ভূমিকা অপরিসীম। তাই শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি, অবিলম্বে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিকে সমস্যামুক্ত করে ডিজিটালাইজড করতে হবে।
imdadju09@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.