যুক্তি তর্ক গল্প-এক বিপ্লবীকে শতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি by আবুল মোমেন
মাস্টারদা সূর্যসেন বাঙালির ইতিহাসে এক অবিনশ্বর উত্তরাধিকার, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামের এক উজ্জ্বল নাম, বাঙালির সাহস ও বীরত্বের এক অক্ষয় কীর্তিমান সিংহপুরুষ। মাস্টারদার বিপ্লবী জীবনের অনন্য অধ্যায় ১৯৩০-এর চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ, যখন তাঁর নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকান আর্মি চট্টগ্রামে পুলিশের অস্ত্রাগার দখল করে নেয়
এবং জালালাবাদ যুদ্ধের মাধ্যমে চট্টগ্রামকে কার্যত চার দিনের জন্য ব্রিটিশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন করে রেখেছিল। সেই বিদ্রোহ, যুদ্ধ ও স্বাধীনতার এক সৈনিক বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী।
বিপ্লবী বিনোদবিহারীর জন্ম চট্টগ্রামে ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি। অর্থাত্ আর দুই দিন পরেই তাঁর শততম জন্মদিবস।
আমাদের সৌভাগ্য, তিনি এখনো আমাদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে বেঁচে আছেন। আমরা তাঁকে শততম জন্মদিনের প্রাক্কালে উষ্ণ অভিনন্দন জানাই ও আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
শ্রী চৌধুরী কালের সাক্ষী, জীবন্ত কিংবদন্তি, চলমান ইতিহাস। এই বঙ্গের বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম, রাষ্ট্রসাধনা এবং গণতন্ত্র ও মানবমুক্তির আন্দোলন ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও স্বাধীনতার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়নি। এ সংগ্রাম আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। যখন পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার দিকে মোড় নিচ্ছে, তখন আন্দোলনের তরুণ কর্মীদের চেতনায় বারবার মাস্টারদা সূর্যসেন ও চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের কথা ধ্বনিত হয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামে বাঙালি সেদিন প্রেরণা পেয়েছে যুববিদ্রোহের মহানায়ক সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের কাছ থেকে। সেই কীর্তির আলোকরেখায় একটি পুরো জাতি অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি অসমসাহসী নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির ইতিহাসের এই অধ্যায়টি ফিরে ফিরে আলোচিত হয়েছে, স্মরণ করা হয়েছে।
ইতিহাসে অনেক ঘটনাই ঘটে। তার মধ্যে কোনো কোনোটি অগ্নিগর্ভ সম্ভাবনার বীজ হিসেবে সুপ্ত থাকে। যথাসময়ে তা চেতনা ও প্রেরণার আকারে মানুষের মনে বিকশিত হতে থাকে। এভাবে এককালের কয়েকজন দুঃসাহসী আদর্শবাদী ত্যাগী তরুণের এক বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র প্রয়াস ইতিহাসের উজান বেয়ে আজও প্রাসঙ্গিক। কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, উত্তরোত্তর এর তাত্পর্য ও গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। ১৯৩০ এই ২০১০-এও প্রাসঙ্গিক, চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ আমাদের ইতিহাসে আজও প্রাসঙ্গিক এক অধ্যায়, মাস্টারদা এক জাতীয় নায়ক, প্রীতিলতা এ জাতির বীরকন্যা এবং তাঁদের সব সহযোদ্ধা এ দেশের বীর সন্তান।
পাকিস্তান ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না, বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি ব্রিটিশের অনুসৃত নীতি ও ব্যবহারই বহাল রাখে। কারণ, মুসলিম লীগের নেতা জিন্নাহ এবং তাঁর অনুগামীরা ব্রিটিশের অনুগ্রহ ও সমর্থন নিয়ে তাদেরই গূঢ় স্বার্থ হাসিলের নীতির অংশ হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল। সেই আন্দোলন দিনে দিনে কংগ্রেসবিরোধী হয়ে উঠেছিল, আর ব্রিটিশের অনুগামী সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছিল।
ফলে পাকিস্তান জন্ম নিয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর হিসেবে। নয়তো এ দেশ স্বাধীনতার পরপরই কীভাবে ইঙ্গ-মার্কিন প্রভাবিত বিভিন্ন সামরিক চুক্তিতে জড়িয়ে যায়, আমেরিকার দৃষ্টিতে উন্নয়নশীল দেশের মডেলের মর্যাদা পায়! পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি, অন্ধ ভারতবিরোধিতা, ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদ, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই সময়ে তত্কালীন পাকিস্তানে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের অনেকেই আবার রাষ্ট্রীয় জেলজুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন। বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী পাকিস্তান আমলে একাধিকবার এভাবে কারাবাস করেছেন, নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। পাকিস্তান থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অব্যাহতভাবে দেশ ত্যাগ করেছেন। শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে সমাজে শূন্যতা ও অবক্ষয়ের সৃষ্টি হলেও এ বিষয়ে রাষ্ট্র ছিল উদাসীন, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ গড়তে পারেনি মূলত সচেতনতার অভাবেই।
আমাদের রাজনীতিতে এবং সমাজচর্চায় সূর্য সেন ও তাঁর সহযোদ্ধাদের আদর্শ বা তত্কালীন অন্যান্য আন্দোলন-সংগ্রামের প্রসঙ্গ বারবার আলোচিত, এমনকি অনুপ্রেরণার উত্স হিসেবে আলোচিত হলেও তা কিন্তু কার্যত অনুসৃত হয়নি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই একই মানসিকতা কমবেশি বাংলাদেশেও চলে এসেছে এবং সমাজের বড় একটি অংশ বহুকাল আগে বিলুপ্ত মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ, কৌশল ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছে। হত্যা ও চক্রান্তের মাধ্যমে এসব শক্তি দীর্ঘদিন এ দেশে ক্ষমতায়ও ছিল। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা তথা রাষ্ট্রসাধনার গতিপথ সহজ হয়নি, আজও সহজ নয়।
বিনোদবিহারী চৌধুরীর সহযোদ্ধাদের মধ্যে তাঁর নেতা মাস্টারদা সূর্যসেন, তাঁর প্রথম মন্ত্রদাতা রামকৃষ্ণ বিশ্বাসসহ অনেকেই সেই পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ আমলে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছেন। অনেকে আন্দামানে দ্বীপান্তরে দীর্ঘকাল কারাবাস ভোগ করেছেন, অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে নানা কারাগারে বন্দিজীবন অথবা স্বগৃহে অন্তরীণ জীবন কাটিয়েছেন।
জীবনের এসব কঠিন পরিণতিকে তাঁরা সহজভাবে নিয়েছেন। তাই দেখা যায়, কারও জীবনই ব্রিটিশ শাসকের কঠোর দমনমূলক হস্তক্ষেপেও বিনষ্ট হয়নি, থেমে যায়নি। তাঁরা মানুষ হিসেবে অব্যাহতভাবে বিকশিত হয়েছেন, সবাই উত্তরকালেও ব্যক্তিগত জীবনের গণ্ডি ছাপিয়ে বৃহত্তর জাতীয় জীবনের রাজনীতি ও সমাজসংগঠনে আজীবন ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি যাঁরা সেদিন ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছেন বা ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে সহস্তে প্রাণ বিসর্জন শ্রেয় মনে করে আত্মঘাতী হয়েছিলেন, তাঁরাও সবাই শহীদের মর্যাদায় বরাবর উত্তর প্রজন্মের জন্য আদর্শের বর্তিকাবাহক হয়ে রয়েছেন। আর যাঁরা দীর্ঘ জেলজীবন কাটিয়েছেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই জেলে বসে ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে শিক্ষায় সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁরা প্রায় সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন জেলে বসে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা রাজনৈতিক জ্ঞানার্জনের ও পথের সন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একদল ঝুঁকেছেন সমাজতন্ত্রের আদর্শের দিকে। তাঁরা বিপ্লবের ঝান্ডা উঁচিয়ে ধরলেন এবং সেভাবে পরবর্তী জীবনে যুক্ত থেকেছেন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের সঙ্গে। আর অপর দল মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার মানবিক বাণীতে আস্থা রেখে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ ধরলেন।
বিনোদবিহারী জেলে বসে ডিস্টিংকশনসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আর ঝুঁকে পড়েন গান্ধীবাদী আদর্শের দিকে, যোগ দেন জাতীয় কংগ্রেসে। দেশ ভাগ হওয়ার সময় অর্থাত্ পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় তিনি বিবেকের কণ্ঠস্বর শুনে জন্মভূমিতে থেকে যাওয়ার সংকল্প নেন।
সেদিন এ কাজটি সহজ ছিল না। তাঁর প্রায় সব সহযোদ্ধাই দেশ ত্যাগ করেছিলেন। শিক্ষিত বর্ধিষ্ণু হিন্দু পরিবার মুসলিম লীগের পাকিস্তানে বসবাস স্বস্তিদায়ক হবে মনে করতে পারেনি। স্বজাতির দেশত্যাগের এই হিড়িকের মধ্যে বিনোদবিহারী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। প্রথম পর্যায়ে জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, একবার পাকিস্তানে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর একাধিকবার করেছেন কারাভোগ।
ইতিমধ্যে তিনি নানাবিধ সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও কাজে জড়িত হয়ে গেছেন এবং একসময় প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে আসেন। কিন্তু সমাজের যেখানে সংকট, মানুষের যেখানে দুঃখ ও দুর্ভোগ, সেখানে তিনি সতত উপস্থিত, সরব, সোচ্চার ও সক্রিয়। না, এক দিনের জন্যও তিনি নিষ্ক্রিয় হননি, পেছনে হটে যাননি। শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেও তিনি অবসরভোগী মানুষ নন, জীবনবিমুখ স্থবির সেকালের মানুষ নন। তিনি অত্যন্ত প্রাণবন্ত, প্রাসঙ্গিক একজন মানুষ। তাই শুভচেতনার সব মানুষ তাঁকে ডাকে, সব উদ্যোগে তিনি উপস্থিত হন, সব কাজে তিনি যুক্ত হন। চট্টগ্রাম নগরের তিনি যথার্থই অভিভাবক।
বিনোদবাবু ত্রিশের দশকের বিএ, ডিস্টিংকশনসহ। তিনি কিংবদন্তির এক স্বাধীনতা-সংগ্রামী, তাঁর পরিচয় ক্ষমতার সর্বমহলেই ছিল, আছে। কিন্তু তাতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি, তার কোনো ছাপ পড়েনি। এসব অর্জনকে তিনি ব্যক্তিগত প্রাপ্তির কাজে লাগাননি। যেন সন্তর্পণে তিনি ব্যক্তিগত শুদ্ধতা, শুভ্রতা ও স্বকীয়তাকে রক্ষা করে চলেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর চাহিদা অল্প, আর বস্তুগত অর্জন সামান্য। চট্টগ্রাম শহরের মোমিন রোডের একটি গলিতে ছোট্ট একতলা দুই কক্ষের একটি কুটির তাঁর বাসভবন। স্ত্রী শহরের নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অপর্ণাচরণ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন, একসময় যে স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁর স্ত্রী বিভা চৌধুরী, সবার প্রিয় বেলাদিদি মাত্র কদিন আগে তাঁর শতবর্ষে পদার্পণের প্রাক্কালে পরিণত বয়সে মৃত্যু বরণ করেছেন। বিনোদবাবু নিজে চাকরিও করেননি, ওকালতিও করেননি, খ্যাতি-প্রতিষ্ঠাকে ভাঙিয়ে চলেননি। এই সেদিন পর্যন্ত বাসায় ছাত্র পড়িয়ে সামান্য উপার্জন করেছেন। সাধারণ কাপড়ের সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি তাঁর একমাত্র পোশাক।
কিন্তু এই সংযত জীবন কিংবা দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন তাঁর আদর্শের ঐশ্বর্য কিংবা চিত্তের বিভা ও উষ্ণতাকে একটুও কমাতে পারেনি। বরং ব্যক্তিগত আদর্শ ও চরিত্রগুণ একজন ছোটখাটো বিত্তহীন মানুষকেও কতটা দৃঢ় সংগ্রামী এবং আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন করে তুলতে পারে, বিনোদবিহারী তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বিনোদবিহারী চৌধুরী তাঁর বচনে-আচরণে, বসনে-ভাষণে, জীবনে-যাপনে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুষমামণ্ডিত এক মানুষ। যিনি সচরাচর সহজ, অনাড়ম্বর, কোমল হূদয়ের প্রাণবন্ত মানুষ, তিনিই প্রয়োজনে কঠিন, দৃঢ় এবং আপসহীন হয়ে পূর্ণতাপ্রত্যাশী মানুষের প্রতিকৃতি হয়ে ওঠেন। তাঁর সম্পর্কে ইতিহাসবিদ আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন যথার্থই বলেছেন, বিনোদবিহারী চৌধুরী এক ঋষি-বিপ্লবী।
শতবর্ষে তাঁকে আরেকবার শ্রদ্ধা জানাই।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
বিপ্লবী বিনোদবিহারীর জন্ম চট্টগ্রামে ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি। অর্থাত্ আর দুই দিন পরেই তাঁর শততম জন্মদিবস।
আমাদের সৌভাগ্য, তিনি এখনো আমাদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে বেঁচে আছেন। আমরা তাঁকে শততম জন্মদিনের প্রাক্কালে উষ্ণ অভিনন্দন জানাই ও আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।
শ্রী চৌধুরী কালের সাক্ষী, জীবন্ত কিংবদন্তি, চলমান ইতিহাস। এই বঙ্গের বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম, রাষ্ট্রসাধনা এবং গণতন্ত্র ও মানবমুক্তির আন্দোলন ১৯৪৭-এর দেশভাগ ও স্বাধীনতার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়নি। এ সংগ্রাম আরও দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। যখন পূর্ব বাংলায় গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার দিকে মোড় নিচ্ছে, তখন আন্দোলনের তরুণ কর্মীদের চেতনায় বারবার মাস্টারদা সূর্যসেন ও চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের কথা ধ্বনিত হয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামে বাঙালি সেদিন প্রেরণা পেয়েছে যুববিদ্রোহের মহানায়ক সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের কাছ থেকে। সেই কীর্তির আলোকরেখায় একটি পুরো জাতি অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর জাদুকরি অসমসাহসী নেতৃত্বের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির ইতিহাসের এই অধ্যায়টি ফিরে ফিরে আলোচিত হয়েছে, স্মরণ করা হয়েছে।
ইতিহাসে অনেক ঘটনাই ঘটে। তার মধ্যে কোনো কোনোটি অগ্নিগর্ভ সম্ভাবনার বীজ হিসেবে সুপ্ত থাকে। যথাসময়ে তা চেতনা ও প্রেরণার আকারে মানুষের মনে বিকশিত হতে থাকে। এভাবে এককালের কয়েকজন দুঃসাহসী আদর্শবাদী ত্যাগী তরুণের এক বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র প্রয়াস ইতিহাসের উজান বেয়ে আজও প্রাসঙ্গিক। কেবল প্রাসঙ্গিক নয়, উত্তরোত্তর এর তাত্পর্য ও গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। ১৯৩০ এই ২০১০-এও প্রাসঙ্গিক, চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ আমাদের ইতিহাসে আজও প্রাসঙ্গিক এক অধ্যায়, মাস্টারদা এক জাতীয় নায়ক, প্রীতিলতা এ জাতির বীরকন্যা এবং তাঁদের সব সহযোদ্ধা এ দেশের বীর সন্তান।
পাকিস্তান ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না, বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি ব্রিটিশের অনুসৃত নীতি ও ব্যবহারই বহাল রাখে। কারণ, মুসলিম লীগের নেতা জিন্নাহ এবং তাঁর অনুগামীরা ব্রিটিশের অনুগ্রহ ও সমর্থন নিয়ে তাদেরই গূঢ় স্বার্থ হাসিলের নীতির অংশ হিসেবে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল। সেই আন্দোলন দিনে দিনে কংগ্রেসবিরোধী হয়ে উঠেছিল, আর ব্রিটিশের অনুগামী সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছিল।
ফলে পাকিস্তান জন্ম নিয়েছিল ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর হিসেবে। নয়তো এ দেশ স্বাধীনতার পরপরই কীভাবে ইঙ্গ-মার্কিন প্রভাবিত বিভিন্ন সামরিক চুক্তিতে জড়িয়ে যায়, আমেরিকার দৃষ্টিতে উন্নয়নশীল দেশের মডেলের মর্যাদা পায়! পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে পাকিস্তান সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি, অন্ধ ভারতবিরোধিতা, ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদ, অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই সময়ে তত্কালীন পাকিস্তানে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের অনেকেই আবার রাষ্ট্রীয় জেলজুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন। বিপ্লবী বিনোদবিহারী চৌধুরী পাকিস্তান আমলে একাধিকবার এভাবে কারাবাস করেছেন, নানা হয়রানির শিকার হয়েছেন। পাকিস্তান থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অব্যাহতভাবে দেশ ত্যাগ করেছেন। শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে সমাজে শূন্যতা ও অবক্ষয়ের সৃষ্টি হলেও এ বিষয়ে রাষ্ট্র ছিল উদাসীন, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ গড়তে পারেনি মূলত সচেতনতার অভাবেই।
আমাদের রাজনীতিতে এবং সমাজচর্চায় সূর্য সেন ও তাঁর সহযোদ্ধাদের আদর্শ বা তত্কালীন অন্যান্য আন্দোলন-সংগ্রামের প্রসঙ্গ বারবার আলোচিত, এমনকি অনুপ্রেরণার উত্স হিসেবে আলোচিত হলেও তা কিন্তু কার্যত অনুসৃত হয়নি। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই একই মানসিকতা কমবেশি বাংলাদেশেও চলে এসেছে এবং সমাজের বড় একটি অংশ বহুকাল আগে বিলুপ্ত মুসলিম লীগের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ, কৌশল ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করে চলেছে। হত্যা ও চক্রান্তের মাধ্যমে এসব শক্তি দীর্ঘদিন এ দেশে ক্ষমতায়ও ছিল। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা তথা রাষ্ট্রসাধনার গতিপথ সহজ হয়নি, আজও সহজ নয়।
বিনোদবিহারী চৌধুরীর সহযোদ্ধাদের মধ্যে তাঁর নেতা মাস্টারদা সূর্যসেন, তাঁর প্রথম মন্ত্রদাতা রামকৃষ্ণ বিশ্বাসসহ অনেকেই সেই পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ আমলে ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছেন। অনেকে আন্দামানে দ্বীপান্তরে দীর্ঘকাল কারাবাস ভোগ করেছেন, অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে নানা কারাগারে বন্দিজীবন অথবা স্বগৃহে অন্তরীণ জীবন কাটিয়েছেন।
জীবনের এসব কঠিন পরিণতিকে তাঁরা সহজভাবে নিয়েছেন। তাই দেখা যায়, কারও জীবনই ব্রিটিশ শাসকের কঠোর দমনমূলক হস্তক্ষেপেও বিনষ্ট হয়নি, থেমে যায়নি। তাঁরা মানুষ হিসেবে অব্যাহতভাবে বিকশিত হয়েছেন, সবাই উত্তরকালেও ব্যক্তিগত জীবনের গণ্ডি ছাপিয়ে বৃহত্তর জাতীয় জীবনের রাজনীতি ও সমাজসংগঠনে আজীবন ভূমিকা পালন করেছেন। এমনকি যাঁরা সেদিন ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছেন বা ব্রিটিশের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে সহস্তে প্রাণ বিসর্জন শ্রেয় মনে করে আত্মঘাতী হয়েছিলেন, তাঁরাও সবাই শহীদের মর্যাদায় বরাবর উত্তর প্রজন্মের জন্য আদর্শের বর্তিকাবাহক হয়ে রয়েছেন। আর যাঁরা দীর্ঘ জেলজীবন কাটিয়েছেন তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই জেলে বসে ব্যক্তিগতভাবে নিজেকে শিক্ষায় সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁরা প্রায় সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন জেলে বসে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা রাজনৈতিক জ্ঞানার্জনের ও পথের সন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে একদল ঝুঁকেছেন সমাজতন্ত্রের আদর্শের দিকে। তাঁরা বিপ্লবের ঝান্ডা উঁচিয়ে ধরলেন এবং সেভাবে পরবর্তী জীবনে যুক্ত থেকেছেন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের সঙ্গে। আর অপর দল মহাত্মা গান্ধীর অহিংসার মানবিক বাণীতে আস্থা রেখে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ ধরলেন।
বিনোদবিহারী জেলে বসে ডিস্টিংকশনসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আর ঝুঁকে পড়েন গান্ধীবাদী আদর্শের দিকে, যোগ দেন জাতীয় কংগ্রেসে। দেশ ভাগ হওয়ার সময় অর্থাত্ পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় তিনি বিবেকের কণ্ঠস্বর শুনে জন্মভূমিতে থেকে যাওয়ার সংকল্প নেন।
সেদিন এ কাজটি সহজ ছিল না। তাঁর প্রায় সব সহযোদ্ধাই দেশ ত্যাগ করেছিলেন। শিক্ষিত বর্ধিষ্ণু হিন্দু পরিবার মুসলিম লীগের পাকিস্তানে বসবাস স্বস্তিদায়ক হবে মনে করতে পারেনি। স্বজাতির দেশত্যাগের এই হিড়িকের মধ্যে বিনোদবিহারী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। প্রথম পর্যায়ে জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন, একবার পাকিস্তানে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর একাধিকবার করেছেন কারাভোগ।
ইতিমধ্যে তিনি নানাবিধ সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও কাজে জড়িত হয়ে গেছেন এবং একসময় প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে সরে আসেন। কিন্তু সমাজের যেখানে সংকট, মানুষের যেখানে দুঃখ ও দুর্ভোগ, সেখানে তিনি সতত উপস্থিত, সরব, সোচ্চার ও সক্রিয়। না, এক দিনের জন্যও তিনি নিষ্ক্রিয় হননি, পেছনে হটে যাননি। শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসেও তিনি অবসরভোগী মানুষ নন, জীবনবিমুখ স্থবির সেকালের মানুষ নন। তিনি অত্যন্ত প্রাণবন্ত, প্রাসঙ্গিক একজন মানুষ। তাই শুভচেতনার সব মানুষ তাঁকে ডাকে, সব উদ্যোগে তিনি উপস্থিত হন, সব কাজে তিনি যুক্ত হন। চট্টগ্রাম নগরের তিনি যথার্থই অভিভাবক।
বিনোদবাবু ত্রিশের দশকের বিএ, ডিস্টিংকশনসহ। তিনি কিংবদন্তির এক স্বাধীনতা-সংগ্রামী, তাঁর পরিচয় ক্ষমতার সর্বমহলেই ছিল, আছে। কিন্তু তাতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে কোনো পরিবর্তন আসেনি, তার কোনো ছাপ পড়েনি। এসব অর্জনকে তিনি ব্যক্তিগত প্রাপ্তির কাজে লাগাননি। যেন সন্তর্পণে তিনি ব্যক্তিগত শুদ্ধতা, শুভ্রতা ও স্বকীয়তাকে রক্ষা করে চলেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর চাহিদা অল্প, আর বস্তুগত অর্জন সামান্য। চট্টগ্রাম শহরের মোমিন রোডের একটি গলিতে ছোট্ট একতলা দুই কক্ষের একটি কুটির তাঁর বাসভবন। স্ত্রী শহরের নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অপর্ণাচরণ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন, একসময় যে স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁর স্ত্রী বিভা চৌধুরী, সবার প্রিয় বেলাদিদি মাত্র কদিন আগে তাঁর শতবর্ষে পদার্পণের প্রাক্কালে পরিণত বয়সে মৃত্যু বরণ করেছেন। বিনোদবাবু নিজে চাকরিও করেননি, ওকালতিও করেননি, খ্যাতি-প্রতিষ্ঠাকে ভাঙিয়ে চলেননি। এই সেদিন পর্যন্ত বাসায় ছাত্র পড়িয়ে সামান্য উপার্জন করেছেন। সাধারণ কাপড়ের সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবি তাঁর একমাত্র পোশাক।
কিন্তু এই সংযত জীবন কিংবা দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন তাঁর আদর্শের ঐশ্বর্য কিংবা চিত্তের বিভা ও উষ্ণতাকে একটুও কমাতে পারেনি। বরং ব্যক্তিগত আদর্শ ও চরিত্রগুণ একজন ছোটখাটো বিত্তহীন মানুষকেও কতটা দৃঢ় সংগ্রামী এবং আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন করে তুলতে পারে, বিনোদবিহারী তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বিনোদবিহারী চৌধুরী তাঁর বচনে-আচরণে, বসনে-ভাষণে, জীবনে-যাপনে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুষমামণ্ডিত এক মানুষ। যিনি সচরাচর সহজ, অনাড়ম্বর, কোমল হূদয়ের প্রাণবন্ত মানুষ, তিনিই প্রয়োজনে কঠিন, দৃঢ় এবং আপসহীন হয়ে পূর্ণতাপ্রত্যাশী মানুষের প্রতিকৃতি হয়ে ওঠেন। তাঁর সম্পর্কে ইতিহাসবিদ আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন যথার্থই বলেছেন, বিনোদবিহারী চৌধুরী এক ঋষি-বিপ্লবী।
শতবর্ষে তাঁকে আরেকবার শ্রদ্ধা জানাই।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments